উপন্যাস

উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এগারো

পনের.

দেশে আন্দোলন সংগ্রাম তো চলছে সেই কবে থেকেই। এ আর এমন নতুন কী!
এর মধ্যেই তো দীর্ঘ নয়টটি বছর কেটে গেল এপাশ ওপাশ করতে করতে! এর
মধ্যে ঝড় ঝাপটা তো কম যায় নি! দু’হাতে সামলেছেন তো সব কিছুই! হঠাৎ
এভাবে তাড়াহুড়ো করে পদত্যাগ করার মত কী যে এমন ঘটে গল! কার এমন
সাধ্য ছিল যে গলায় গামছা বেঁধে নামায়!
এদিকে এই অভাবিত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় শওকত আলীর কত বড় ক্ষতি হয়ে
গেল সেটা কি কেউ টের পাবে! ব্যাংকের টাকা নিয়ে ব্যাংক খোলার যে ব্যাংক
ব্যাংক খোলা সংক্রান্ত পরিকল্পনাটা সেই মন্ত্রী শিখিয়েছিল, অনেকদূর
অগ্রসরের পর সেই পরিকল্পনাই গেল মাঠে মারা। বড় ছেলেটা আছে
জেলহাজতে। সেখানেই পচে মরছে। অথচ মন্ত্রীর ভরসায় দিন গুজরান করে
চেষ্টা তদবিরের অন্যান্য লাইনঘাটও ধরা হয়নি। এখন তো সারা দেশের
রাজনৈতিক হাওয়া গেল পাল্টে, এখন কাকে পীর ধরবে সে? কার দোয়া
তাবিজে কাজ হবে এখন? স্বপনের বন্ধুরা এমন কুচুটে লজরে তার দিকে
তাকায়, যেন সমস্ত দোষ এই অধম বাপের। ছেলের জন্যে বুঝি তার কোনো
রকম দায় দুশ্চিন্তা নেই, কোনো চেষ্টা তদবির নেই; নিরুদ্বেগ নিরুৎকণ্ঠায়
কাটছে তার দিনরাত্রি।
অথচ এই প্রতিকূল পরিবেশে কি উৎকণ্ঠার শেষ আছে! রাজনৈতিক পট
পরিবর্তনের মাত্র দুদিন কী তিনদিনের মাথায় তৌফিক উদ্দীন বাড়িতে এসে
বলল, এ চাকরি আর করব না মামা।
শওকত আলীর তো মাথায় হাত। তবু সে তাৎক্ষণিকভাবে কৌশলী হয়ে ওঠে,
চাকরি করবে না মানে! তুমি কি আদৌ চাকরি কর?
না মামা, করব না।
কী মুশকিল! চাকরি কোথায়! পুরো ব্যবসাটাই তো চালাচ্ছ তুমি। বলতে গেলে
তোমারই ব্যবসা।
হঠাৎ দরজার আড়াল থেকে ঘোমটা পরা এক মহিলা বেরিয়ে এসে পায়ে হাত
ছুঁয়ে পটাপট সালাম করে মুখ নামিয়ে জানায়,
না মামা, চাকরিটা সে আর করবে না। তাকে ছেড়ে দেন।
এতক্ষণে মর্জিনাকে বেশ চিনতে পারে শওকত আলী। গত বছর ছেলেপুলে
হবার আগে সে ছুটি নিয়েছিল, আর জয়েন করেনি। তৌফিক জানিয়েছিল!
বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চাকরি বাকরি করা অসুবিধা, ওর পোস্টে অন্য লোক নিলেই
হবে। সেই মর্জিনা আবার আজ এসেছে! স্বামীর চাকরি ছাড়াতে! ব্যাপারটা কী!
সে তো আগে কখনো মামা ডাকে তাকে! সেও কি স্বামীর গলায় সুর মিলিয়েছে?
সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে শওকত আলী, ব্যাপারটা কী! বলো দেখি তোমরা? কী
হয়েছে তোমাদের?
দেশে এখন চলছে এক বিরাট ওলোট পালোট। এর মধ্যে তোমরা বলছ এই কথা।
ঘটনাটা কী? তৌফিক উদ্দীনের আগেই মুখ খোলে মর্জিনা, আমরা গরীব মানুষ।
এখন পোলাপান হয়েছে। দেশে গিয়ে ছোটোখাটো ব্যবসা বাণিজ্য করে খাব।
এখানে থাকব না।পোলাপান হবার পর নারীদেহে যে আলাদ সৌন্দর্যসুষমা
ফুটে ওঠে, মর্জিনা তার জ্বলন্ত সাক্ষী। তবু তার দিকে না তাকিয়ে শওকত আলী
তৌফিকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, শোনো তৌফিক, আমি তোমাকে বলি! আমি
কিন্তু অকৃতজ্ঞ নই। আজ কটা বছর তোমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছি।
ব্যবসা করেছ তুমি। এখনও তুমিই করবে। ওসব ধান্দা বাদ দাও। মাইনে পত্তর
নয়, এখন থেকে প্রফিট পার্সেন্টেজে এসো। নিজের পায়ে দাঁড়াও।
শওকত আলী নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই চমকে ওঠে। বহুদিন পর
মনিরুজ্জামান সাহেব যেন তার কণ্ঠে ভর করে সেই পুরানো কথাগুলোই
বলিয়ে নেয়। কিন্তু তৌফিক উদ্দীন তার সিদ্ধান্তে বদ্ধপরিকর,
না মামা, আমাকে মাফ করবেন।

এটাই তোমার শেষকথা তৌফিক?
জ্বি মামা।
তুমি আমাকে মামা ডেকেছ, আমিও তোমাকে ভাগ্নে বলে মেনে নিয়েছি।
তুমি আমাকে সত্যিকারের কথাটা বলো দেখি! কেন তুমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
তৌফিক উদ্দীন ঘাড় মাথা চুলকিয়ে নিতিবিতি করে যে তথ্য প্রকাশ করে তা
সত্যিই ভয়াবহ। একদল মারমুখো যুবক প্রতিদিনই অফিসে আসে শওকত
আলীর খোঁজে। বিশ্রী ভাষায় গালাগালি দিয়ে ফিরে যায়। টেবিল চেয়ার ভাঙচুর
করে। গতকাল চব্বিশ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে গেছে তৌফিককে চাকরি
ছাড়ার জন্যে। তারা এই স্বৈরাচারের আস্তানায় আগুন জ্বালিয়ে দেবে।
এইসব শুনতে শুনতে স্তম্ভিত হয়ে যায় শওকত আলী দীর্ঘক্ষণ বাক্য সরে না
মুখে। কিছুতেই মেলাতে পারে না! কবে কবে সে এত দূরে চলে গেছে, কখন?
সামান্য ওই তো মন্ত্রী-সংশ্লিষ্টতা, এটুকুই তাকে এতটা নিচে নামিয়ে দেবে?
একটি দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে চেপে সে অতিকষ্টে জানতে চায়,
এ যুবকদের কাউকে তুমি চিনতে পেরেছ তৌফিক?
দু’একজনকে চিনলেও আপনাকে সে নাম বলা যাবে না মামা।
অ, আচ্ছা।
মামা, আমরা এখন যাই তাহলে!
যাবে? যাও।
তৌফিক বউ সঙ্গে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই শওকত আলী মাথা পেঁচিয়ে সামনে আসে,
এখন তুমি কোথায় যাবে?
প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাব। দেশের বাড়ি। তারপর যা হয় একটা কিছু করব।
আচ্ছা তৌফিক, তোমার মনির মামার খবর জানো?
খুব ভালো জানি না। ওই যে শিপমেন্টের বিজনেস তার।
চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করে এখন নাকি রাজনীতিতে মেতেছে।
তাই নাকি!
শওকত আলী নিজেই অবাক হয়, হিসেব মেলাতেই পারে না!
এত প্রিয় মনির ভাই কবে কখন এতোটা দূরে চলে গেল! কার ভুলে এই দূরত্ব!
ওই মানুষটাও তো একবার ফোন করতে পারে! কতদিন সেই পরিহাসতরল
প্রীতিমধুর কণ্ঠ শোনা হয়নি!
মনে হয় বিজনেস পৃথক করার ঘটনায় মনির ভাই খুব কষ্ট পেয়েছেন। তখন
থেকেই মুখ ফিরিয়েছেন।
মর্জিনা আবারও ঢিপ্ ঢিপ্ করে কদমবুসি সেরে উঠে দাঁড়ায়, আমরা এখন যাই
মামা।
শওকত আলী উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় দেয়, আচ্ছা এসো। তৌফিক, ইচ্ছে হলে
আবার ফিরে এসে।
দিন এরকম যাবে না।
তৌফিকউদ্দীন সস্ত্রীক বিদায় নেয়ার পর শওকত আলী টেলিফোন সেটের
সামনে এসে বসে। মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে কী যেন একটু ভেবে নেয়।
তারপর টেলিফোন- ডাইরেক্টরী ঘেঁটে মনিরুজ্জামান সাহেবের ফোন নম্বর
খোঁজে। পুরানো ডায়েরী নিয়ে এসে পাতা ওল্টায়। নাহ্!
কোথাও নেই। ডিনা এসে জিগ্যেস করে,
কী খুঁজছ বাবা!
তোর মনির আঙ্কেলকে মনে পড়ে? ছোটবেলায় খুব দেখেছিস মনির ভাইকে।
হ্যাঁ, আমার মনে আছে।
সেই মনির ভাইয়ের ফোন নম্বরটা খুঁজছি।
নম্বর দিয়ে কী করবে, তোমার ফোনই তো ডেড হয়ে পড়ে আছে।
হোয়াট! কখন থেকে?
গত রাত থেকে।
কী ভেবে যেন গলার স্বর নামিয়ে এনে মেয়েকে হুকুম করে,
এক গ্লাস পানি আন তো মা!

ষোল.

শাহানা বেগমের গুনগুনানি কান্নাধ্বনিতে শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায় শওকত আলীর।
খুব যে উচ্চস্বরে কাঁদে এই মহিলা, তা মোটেই নয়। বরং কারো কিছুতেই যেন বিঘ্ন না
ঘটে, সেদিকেই তার প্রখর দৃষ্টি; তীব্র সচেতনতা। দিনের বেলায় প্রকাশ্যে কখনো সে
কাঁদতে বসে না। বেছে নেয় রাতের নিশুতি। ঘরে নয়, বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে
বসে একসময় কাঁদতে শুরু করে।
সন্ধ্যার শান্ত, নদীর কুলুকুলু ধ্বনির মতো মৃদুমন্দ সেই কান্না।
চৈত্রমধ্যাহ্নের বিরহী ঘুঘুর কণ্ঠের আর্তির মতো নিঃসঙ্গ সেই কান্না।
শীতপ্রভাতে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর মত নির্মল সেই কান্না।
কিন্তু কেন এই কান্না, সে কথা কেউ জানে না। মুখ ফুটে কাউকে কিছুই বলবে
না। প্রতিদিনই যে কাঁদে এমনও নয়, দু’চারদিন কিংবা সাতদিন পর সহসা
মধ্যরাতে দেখা গেল বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে বসেছে একাকী।
শওকত আলী বেড়াল পায়ে উঠৈ এসে তার পক্বজকব কোনোদিন দাঁড়ালে
প্রথম যৌবনের মত তাকে আঁকড়ে ধরবে, কিন্তু মুখে বলবে না কিছুই।
অশ্রুপ্রবাহ ঠিকই অব্যাহত থাকবে, কেবল মুছে যাবে মমতামন্দ্রিত
গুনগুনানি ধ্বনিটুকু। গায়ে ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন করে দেখেছে শওকত আলী,
স্বপনের জন্যে তোমার মন খারাপ করে?
মায়ের মন, খারাপ হতেই পারে! কিন্তু সে কথাও স্বীকার করে না মা। আসলে
এখন না হয় জেল হাজতে আছে, যখন মুক্ত ছিল তখনও কি কখনো মায়ের
খোঁজ নেয়ার সময় হয়েছে তার! তার জন্যে কেন মন খারাপ করবে?
কার্যত এ বাড়ির সবাই একরকম বন্দী। ডিনার কলেজে যাওয়া বন্ধ। শওকত
আলী দু’তিন দিন রাস্তায় নেমে দেখেছে গা ছম্ছম করে। রাতে নয়, দিনের
বেলায়। বিশেষ করে এ মহল্লার মোড়ে যুব সংগঠনের অফিসটি এখন
নির্বাচনী প্রচারণায় সবসময় সরগরম। ওই অফিসের সামনে দিয়ে বেরুলে,
বিকল্প রাস্তাও তেমন নেই।
আর ওই অফিসের সামনে এলেই শরীর ভারি হয়ে যায়। ছোটবেলায় গ্রামের
রথতলা মোড় পেরিয়েই ঘন ছায়ার বিশাল এক তেঁতুলতলা দিয়ে স্কুলে যেতে
হতো। ওই ভুতুড়ে তেঁতুলতলায় আসতেই গায়ে কাঁটা দিত। তখন চোখ মুখ
বন্ধ করে হৃৎপিন্ড মুঠোয় পুরে ভোঁ দৌড় ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু এখন
এই বয়সে ঢাকা শহরের রাস্তায় সেই ভোঁ দৌড় কি দেয়া চলে!
দমবন্ধ করা দুঃসহ এই সময়ে হঠাৎ এক সকালে এ বাড়িতে অসাধারণ এক
অতিথি এসে হাজির। আগে কখনো আসেননি এ অতিথি। শওকত আলীর
সঙ্গে যেদিন আনুষ্ঠানিক পরিচয়, সেদিন থেকেই তার অন্তরে বাসনা
জেগেছে! অন্তত একদিন একবেলার জন্যে হলেও এই মানুষটিকে নিমন্ত্রণ
করে নিয়ে আসবে; সময়ের ওলোট-পালোটে সবই আজ লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।
অথচ বলা নেই কওয়া নেই, অতিথি নিজেই আজ হাজির।
শওকত আলীর তোঃ চোখের পলক পড়ে না বিস্ময়ে,
আরে ম্যাডাম! আপনি অসময়ে এখানে!
গাল, কপালে লুটিয়ে পড়া উড়–উড়– চুল। সেই মাধুরীমেশানো হাসিতে বলে,
অসময়ে ডিসটার্ব করলাম নাকি!
অসময় নয়, দুঃসময় বলুন। আপনাকে এভাবে দেখব, ভাবিনি।
বোরকা পরেছি, তাই! বাঘা বাঘা মন্ত্রী পর্যন্ত বোরকা পরে গা ঢাকতে পারছে না,
আমি তো মেয়ে মানুষ!
তা ঠিক। বাসা চিনলেন কী করে? অসুবিধা হয়নি তো?
বাসা চেনা আবার ঘটনা হলো!
প্লিজ স্থির হয়ে বসুন তো! এ্যাই ডিনা! তোর মাকে নিয়ে…
রাখুন তো ভাই! আমি এসেছি জরুরি কাজে।…
এই পর্যন্ত বলতে বলতে বোরকার আড়ালে হাত চালিয়ে একেবারে অন্তর্বাসের
ভেতর থেকে ছোট্ট এক চিঠি বের করে সামনে বাড়িয়ে ধরে! এই নিন আপনার
চিঠি।
চিঠি মানে মন্ত্রীর চিঠি। মন্ত্রীপত্নীর বুকের উষ্ণতামাখা। তবু সে চিঠি হাতে নিয়েও
চটজলদি খুলতে সাহস হয় না। যেনবা সাপের ঝাঁপি খোলার মতই ঝুঁকিপূর্ণ!
গোখ্রো নাকি কালকেউটে বেরোয় কে জানে!
অথচ মেহেরজান বিদায় নেয়ার পর স্থির হয়ে বসে সেই চিঠি খুলে বাস্তবে দেখা
গেল উল্টোখবর, মোটামুটি সুখবরই বলা যায়। কাল কেউটে কী করে বশ করতে
হবে সেই সব শেকড় বাকড়ের বিস্তারিত সন্ধান দেয়া আছে ওই চিঠিতে। চিঠি নয়,
এ যেন এক মৃতসঞ্জিবনী সুধা।
দেহমন আবার চাঙা হয়ে ওঠে।
অন্যান্য দিনের মতোই আবার পাখিডাকা ভোর হয়, আবারও সোনালী আবীরমাখা
সূর্য এসে নতুন দিনের ঘোষণা দেয়; অন্ধকার ঠেলে জেগে ওঠে নতুন পৃথিবী।
শওকত আলী দু’হাত বাড়িয়ে এই নতুন দিনকে স্বাগত জানায়।
বিগত একমাসে জমে ওঠা ক্লান্তির ধুলো সরিয়ে সে ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চায়।
শাহানা বেগমকে আদেশ দেয়! নাস্তা রেডি কর, আমি অফিসে যাব।
অফিস?
শাহানা বেগম চম্ধকে ওঠে, তৌফিক নেই, এ সময়ে ওই অফিসে কী করতে যাবে?
তৌফিক ছাড়া আমার আরও স্টাফ আছে না? একটা মাসের মধ্যে তাদের
খোঁজখবর নিয়েছি আমি? এটা কোনো কাজের কথা হলো!
শাহানা বেগমের যুক্তিটা একটু ভিন্ন রকম। ঠিক যুক্তি নয়, এ তার প্রাণের
আকুতিমাখা আর্তি।
সে বলতে চায়! অফিস টপিসে আর কাজ নেই। বাড়িতে বসে আছো, তাই থাকো।
যা করার স্বপন এসে করবে। পুত্রের উপরে এই ভরসার কথা শুনতে ভালোই লাগে।
কিন্তু স্বপন কবে আসবে? পাঁচ সাতটা জঘন্য মামলার দাগী আসামী, বাইরে আসা
অতোই সেজা! মায়ের কী অমল ধবল প্রত্যাশা! পুত্র এসেই ঘর-সংসার, ব্যবসা
বাণিজ্য! সব কিছুর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। বাপের তখন ছুটি।
আহা! ড্যাং ড্যাং করে ঠ্যাং নাচিয়ে ঘুরে বেড়াবে শওকত আলী।
মনে মনে স্ত্রীর উপরে গজগজ করলেও শওকত আলীর অফিসমুখো প্রস্তুতি
চলতেই থাকে। বহুদিন পর তার এই অফিসযাত্রা, গোছগাছের কিছু বিষয় তো
থাকেই। সেই প্রস্তুতি যখন একেবারে শেষ পথে, তখনই বেজে ওঠে ডোরবেল।
কে ডাকে এ সময়ে? শওকত আলী নিজেই এগিয়ে এসে দরজা খোলে। বাইরে
দুই যুবক। একজনকে সে চেনে! বাদল, স্বপনেরই সঙ্গী সাঙাৎ। লোকে বলে
কানা বাদল। কেন যে বলে সে কথা শওকত আলীর জানা নেই। চোখে সব সময়
কালো গগজ এঁটে থাকে বলে ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু অনুমান
করারও উপায় থাকে না। তা সেই কানা বাদল সামনে আসে না, অন্যদিকে মুখ
ঘুরিয়ে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। মুখোমুখি এগিয়ে আসে তার সঙ্গীটি।
অবলীলায় বলে, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল শওকত ভাই! আপনি কি
বাইরে কোথাও
যাচ্ছেন?
শওকত ভাই? কানের দরজায় খট্ করে দাঁড়িয়ে পড়ে শব্দযুগল।
এই বয়সের ছেলেদের মুখে আঙ্কেল শুনেই অভ্যস্ত; বড়জোর কেউবা চাচা
মামা কাকা সম্বোধনও করে, কিন্তু সাধারণত কেউ ভাই বলে না। ছেলেটির মুখের
দিকে ভালো করে তাকায় শওকত আলী। সারামুখে বসন্তের দাগ। কপালের
বামদিকে ধারালো অস্ত্রের কাটা দাগও সুস্পষ্ট। সে এত গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে
ঢুকতে চায় না। সোজাসুজি জানতে চায়─এখন কথা বলবেন, নাকি পরে আসব
আমরা? না, মানে আমি অফিসে বেরুচ্ছিলাম আর কী!
অফিস মানে আপনার ওই আদম ব্যবসার অফিস তো?
তুমি বোধ হয় ভুল শুনেছ─ম্যান পাওয়ার বিজনেস ছাড়াও আমার কিছু ব্যবসা
বাণিজ্য আছে। এই একমাসে সব তো শিকেয় উঠেছে। যাই একটু দেখে আসি।
তোমাদের সঙ্গেও কথা বলব নিশ্চয়ই।
আমরাও তো আপনার ওই ব্যবসা বাণিজ্য নিয়েই কথা বলতে চাই।
তাই নাকি!
আগাম কথাবার্তা বলে না গেলে তো বেঘোরে মারা পড়বেন!
তুমি কি আমাকে থ্রেট করছ?
মোটেই নয়। আপনি অযথা ভুল বুঝছেন শওকত ভাই।
এতক্ষণে ছেলেটি পকেট হাতড়ে ব্যাংকের টোকেনের মত একটা পেতলের
চাক্তি বের করে হাতের মুঠোয় সামান্য এক নজর দেখিয়ে আবার পকেটে
চালান করে দেয়।
শওকত আলী এবার তটস্থ হয়ে ওঠে,
আগে বলবে না─তোমরা কেন এসেছ! এসো এসো,
ভেতরে এসে বসো।
ছেলেটি এক চিলতে হেসে সুড়–ৎ করে ঘরে ঢুকে পড়ে।
শওকত আলী এদিকে বাদলের জন্যে অস্বস্তি বোধ করে। সেটা বুঝতে পেরেই
ছেলেটি বলে, ও আছে, থাক বারান্দায়। অসুবিধা নেই। আসুন, প্রয়োজনীয়
কথা বলি।
নবাগত এই ছেলেটির নাম মুকুট। প্রথম দৃষ্টিতে যতটা ছেলেমানুষ মনে হয়েছিল,
মুখোমুখি বসে কথা বলার সময় বেশ বুঝা গেল ঠিক ততটা ছেলেমানুষ মোটেই
নয়। স্বপনের চেয়ে পাঁচ সাত বছরের বড় হবে, বছর দশেকের ব্যবধানও বিচিত্র
কিছু নয়।
কথা বলে অত্যন্ত গুছিয়ে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সবদিক হিসেব করে।
সেই মুকুটের কাছেই জানা গেল─আপাতত আত্মগোপনে থাকলেও শওকত
আলীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী মহোদয় নিজেই তাকে পাঠিয়েছে। সোনার বিস্কুটের
পরবর্তী চালানের জন্যে প্রস্তুত থাকতে বলেছে। এ বিষয়ে যেখানে যে রকম
যোগাযোগ করা প্রয়োজন, আন্ডারগ্রাউন্ডে বসে সে তার সবই ব্যবস্থা করে
ফেলেছে দুশ্চিন্তার বিশেষ কারণ নেই। মন্ত্রীত্ব গেছে যাক, সময়ে ফিরেও পাওয়া
যাবে। এ দেশের সরলমতি জনগণ নিজেদের উপরে আস্থা রাখতে পারে না বলেই
নেতা খোঁজে। জো বুঝে তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে গেলেই গলায় মালা দিয়ে বরণ করে
নেয়। ওই মালার নেপথ্যে কিছু টাকা পয়সা লাগে, খরচ খর্চা করতে হয়, অতএব
সময়ের অপচয় না করে টাকা রোজগারের ধান্দাটা অব্যাহত রাখাই জরুরি। সেই
জরুরি কাজেই পাঠানো হয়েছে মুকুটকে। সোজা সাপটা পরামর্শ মুকুটের─স্থানীয়
ছেলেপিলেকে হাতে রেখেই ব্যবসা বাণিজ্য চালাতে হবে।
আমিও তো সেটাই চাই।
সামনে ঝুঁকে এসে বলে শওকত আলী─কিন্তু কাকে হাত করি, কীভাবে হাত করি, বলো
দেখি মুকুট।
ব্যাপার কিছুই না। লাখ দুয়েক টাকা খরচ করলেই সব ঝামেলা শেষ। ওরাই তখন খুঁটি
হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে আপনার পাশে। আপনার অফিসও পাহারা দেবে আড়াল থেকে।
দু’লাখ! চোখ বড় বড় করে তাকায় মুকুটের মুখের দিকে।
মুকুট হেসে ওঠে তাচ্ছিল্যে,খুব বেশি হয়ে গেল শওকত ভাই!
দুই লাখ টাকা বেশি নয়?
হ্যাঁ বেশি তো বটেই। তবে আপনার ইনকামের তুলনায় কিছুই নয়। আমি ওদের সঙ্গে
কথা বলেছি, ওরা দুইয়ের নিচে নামবে না কিছুতেই।
মুকুট! আপাতত আমি লাখ লানেক দিচ্ছি। তুমি আরেকবার কথা বলে দ্যাখো।
হাসালেন শওকত ভাই। এসব নিয়ে দর কষাকষি চলে!
না না মুকুট, তুমি অন্তত একবার কথা বলো তো!
বেশ তো! আপনি আজ অফিসে যাবেন বলছিলেন না?
হ্যাঁ যাব। এই তো বেরিয়ে পড়েছি।
হঠাৎ খুব চঞ্চল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায় শওকত আলী, যেনবা বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে তার।
ক্ষিপ্রগতিতে এ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় টাকা আনার জন্যে। কিন্তু বাইরে বেরিয়েই
মেজাজ খিঁচ্ড়ে একাকার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কানা বাদলের সঙ্গে গল্প ঠুকছে ডিনা।
হাসতে হাসতে কাঁধ থেকে ওড়না গড়িয়ে পড়ছে, সেদিকে হুঁশ নেই অসভ্য মেয়ের।
আপাদমস্তক বেয়াদব ওই ছেলের সঙ্গে তোর কিসের এত কথা! মনে মনে দগ্ধায়,
তড়পায়; কিন্তু কাউকে কিছু না বলে দপ্দপ্ করে দাপাতে দাপাতে বেডরুমে চলে
আসে মওকত আলী; খটখট করে আইরন সেল্ফ খুলে রাবারব্যান্ডে আটকানো টাকার
বান্ডিল বের করে আগের মতই অসহিষ্ণু ভঙ্গিমায় ফিরে আসে। মুকুটের সামনে সেই
টাকার বান্ডিল রেখে বলে, নাও, এক লাখ আছে। যেভাবে পারো, ম্যানেজ করো।
টাকার বান্ডিল হাতে উঠে দাঁড়ায় মুকুট, পরামর্শ দেয়, তা হলে বরং আজ আর
আপনার অফিসে গিয়ে কাজ নেই।
কেন?
আমি আগে ওদের সঙ্গে আলাপ করে নিই। ম্যানেজ করতে পারলে আপনাকে বলব,
তারপর যাবেন।
এ তুমি কী বলছ মুকুট! আমার অফিসে আমি যাব না?
না। যাবেন না। না যাওয়াই ভালো। গত এক মাস তো যান নি!
আমি বুঝতে পারছি না মুকুট, তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
কী মুশকিল! আমি তো আপনাকে অভয় দিতেই এসেছি।

তবু যদি ভয়ের কারণ হই, তাহলে আমি উঠি শওকত ভাই। এই থাকল আপনার টাকা।
মুকুট সত্যিই উঠে দাঁড়ায়। শওকত আলীও বিলম্ব না করে এগিয়ে আসে। ঝপ করে
চেপে ধরে মুকুটের দু’হাত।
তুমি বসো তো ভাই! আমি আরো পঞ্চাশ হাজার বাড়িয়ে দিচ্ছি। তুমি সবাইকে বুঝিয়ে
সুজিয়ে ম্যানেজ করো।
মুকুট বসেই না। হাতের মধ্যে থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়, নাহ্! আপনি আমাকে ভুল
বুঝছেন শওকত ভাই। আমি যাই।
এই দ্যাখো, তুমিই তো আমাকে ভুল বুঝছ! আমার হয়ে ওদের সঙ্গে তুমি একটু বার্গেডিং
করবে না?
প্রশ্নই ওঠে না। এ সব নিয়ে বার্গেডিং চলে না। মাত্র দু’লাখ টাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের সব
পথঘাট আবার খোলা পাচ্ছেন! আমার হিসেবে এটাই তো বিরাট পাওয়া!
তা ঠিক। তা ঠিক। তুমি বসো, আমি দু’লাখই দিচ্ছি।
এসব কথা তুমি যেন মিনিস্টারকে বলতে যেও না, কেমন!
আচ্ছা, তাই হবে। আজ থেকেই আপনার টেলিফোন আবার চালু হয়ে যাবে, যা বলার
আপনিই তাকে বলবেন।

তার ফোন নম্বর কোথায় পাব? তোমার কাছে আছে?
ফোন নম্বর আছে। কোড নম্বর আছে। কোড ধরে না চাইলে তো পাবেন না তাকে।
তাই নাকি! উহ্! কতদিন দেখা নেই! কথা নেই!
বড্ড প্রফুল্ল হয়ে ওঠে শওকত আলীর অন্তর। হঠাৎ এক আঁজ্লা হাওয়া লেগে যেনবা
দুরে ওঠে সবুজ ধানের মাঠ। খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠে! তুমি বসো, আমি টাকা
নিয়ে আসছি।

Series Navigation<< উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব দশউপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব বারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *