উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এক

মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টাই যে কখনো এই স্বাধীন দেশে
নিজের অস্তিত্বকে এমন বিপন্ন করে তুলবে, এ কথা কে ভেবেছিল একাত্তরে? হ্যাঁ, যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে প্রতিটি দিনই ছিল মুক্তিযোদ্ধার জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ; তাই বলে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও ওই পরিচয়টা গোটা জীবনকেই এভাবে এক ভয়ঙ্কর ভূমিধ্বসের মুখোমুখি দাঁড় করাবে? অন্তত শওকত আলী এ রকম সংকটের কথা কখনো ভাবেনি। কেন ভাববে?
অতি সাধারন ভাবনার মানুষ সে। একেবারে সাদামাটা জীবনযাপন তার। এ জীবনে তার যে মহৎ অর্জন ওই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়, তা নিয়ে বিশেষ আস্ফালন তো দূরের কথা, ন্যায্য গৌরবটুকুও সে ঢাক পিটিয়ে কোথাও প্রকাশ করতে যায়নি। সে কেন ভাববে? অথচ কেবলমাত্র মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের কারণে সামরিক শাসনামলে চাকরি হারায় শওকত আলী। সরকারি চাকরি নয়। এক কর্পোরেশনে অতি সামান্য চাকরি তার। কতই বা মাইনে! ওতে কারও সংসার চলে! শওকত আলীর দিব্যি চলে যায়। পিছুটান বলতে তেমন কিছুই নেই। দুই ছেলে এক মেয়ের সংসার। ওদের মাও হয়েছে তেমনি ঠান্ডা মানুষ। হিসেবী মানুষ। কী যে জাদুকরী কৌশলে স্বামীর ওই সামান্য রোজগারে দিব্যি মাস চালিয়ে দেয়। টানাটানি যে থাকে না, তা নয়; টেনেটুনে সংসার চালানোর পরও এখানে সেখানে দু’দশটাকা জমা করে, দু’তিন মাস পর হুট করে একদিন আবদার জানায় চলো যাই, সবাই মিলে সিনেমা দেখে আসি।ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়ার পর সে আবদার অনেক কমে গেছে, কিন্তু একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। স্বামীর চাকরি হারানোর সংবাদে তো তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার কথা, চোখে সর্ষেফুল দেখার কথা, এমন কি বাজ পড়া ঠা ঠা তালগাছের মত বোধলুপ্ত বৃক্ষবিশেষ হয়ে যাবারই কথা।
কিন্তু এই চাকরি হারানোর পর শওকত আলীর যেনবা এক প্রকার মোহমুক্তি ঘটে যায়। বন্ধনমুক্তিও বটে। তার চাহিদা খুবই সামান্য। সে তো সঞ্চয় বোঝে না। কেবল দিন কাটানো বোঝে। একটা দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেলেই আরেকটা দিনের জন্যে প্রতীক্ষা। চাকরি চলে যাবার এই হা-মুখ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে।
বিগত দুই দশকে শওকত আলী আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। দৃষ্টি তার শুধুই সামনে। পেছনে একাত্তরের রণাঙ্গন, রক্তাক্ত জনপদ, দুর্ভিক্ষ, হাহাকার; আর সম্মুখে অজুত সম্ভাবনার হাতছানি। কেন পেছনে তাকাবে সে! কী আছে পেছনে?

দরিদ্র কৃষক পিতার কাঁধে দগদগে ঘা, মায়ের মলিন মুখ এবং ছনছলানো চোখের দৃষ্টি আর কত বেঁধে রাখবে? সেই কবে তারা মরে পচে মাটি হয়েছে; ধূসর স্মৃতির সুতোয় পেঁচিয়ে অনেক দগ্ধেছে, আর কেন!
যুদ্ধশেষে চাকরিতে ফিরে দু’দুটো বাড়তি ইনক্রিমেন্ট পাওয়া, অচিরেই এলডি ক্লার্ক থেকে ইউডি ক্লার্ক হয়ে যাওয়া এক সময় এইসব প্রাপ্তিকেই অনেক বড় মনে হয়েছে শওকত আলীর। চারিদিকে অবাঙালির পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল, ব্যবসায়ী না হয়েও লাইসেন্স-পারমিটের কাড়াকাড়ির মতো নৈরাজ্য দেখে সাংঘাতিক বিরক্ত হয়েছে সে। এই মচ্ছবে যোগ দেয়ার জন্যে দু’চারজন চেনাজানা
বন্ধুবান্ধব যে তাকে আহব্বান জানায়নি, তা নয়। একজন রণাঙ্গনের সহযোদ্ধাকে তো মনে হয়েছিল বাহাত্তরের বখতিয়ার।
বখতিয়ার! মানে ইতিহাসের বখ্তিয়ার খিলজি?
দাঁত কেলিয়ে খ্যা খ্যা করে হেসে এই ঐতিহাসিক
উপমাটি উপভোগ করে বাহাউদ্দিন, বেশ বলেছ যা
হোক দিগ্বিজয়ী বীর!
বলব না! সামনে যা দেখছ, তাই তো গিলে ফেলছ।হজম হবে তো?
বাহাউদ্দিন আবার হাসে সশব্দে। তারপর বন্ধুর বাক্য সংশোধন করে দেয়, গিলছি কোথায়! কেবল আগলে রাখছি। দেশের যা অবস্থা!
কেন, দেশের অবস্থা কি খারাপ নাকি?
না, মানে সব কিছু ওলোটপালোট; লন্ডভন্ন।
তোমার জন্যে তো সেটাই ভালো। দেখো, যেন বদহজম না হয়।
একটুখানি রেগে ওঠে বাহাউদ্দিন,
কী বালের হজম বদহজমের কথা বলছ বলো তো! যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি আমরা, সরকার গড়েছি আমরা; আর এই ঘটনা হজম হবে না?
বন্ধুর চোখ থেকে শওকত আলী চোখ সরিয়ে নেয়। বুঝতে পারে, বাহাউদ্দিনকে পেয়ে বসেছে বিকৃত এক উন্মাদনায়। সেই ঘোর থেকে তাকে এখন উদ্ধার করা অসম্ভব প্রায়। এক পা এগোইতেই পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখে বাহাউদ্দিন, গভীর সখ্যতায় বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। তারপর এক লহমায় তুই তোকারিতে নেমে আসে, পরামর্শ দেয়, পিছিয়ে যাবি দোস্ত। একদম পিছিয়ে যাবি। এইবার চোখ তুলে তাকায় শওকত আলী। তার চোখে তখন আগুনের ফুলকি। তবু অবলীলায় হাসতে পারে বাহাউদ্দিন। হাসতে হাসতেই বলে, শোন দোস্ত, সাধু সন্ন্যাসগিরি পরে দ্যাখাস। মক্কা গিয়ে না হয় একবার হজ্বও করে আসিস। এখন কাজে লেগে পড় দেখি আখের গুছিয়ে নে।
সুহৃদ বন্ধুর এই হিতোপদেশ কানে ঢোকে কি ঢোকে না কে জানে!

শওকত আলী রাস্তার উপরে দু’বার থুতু ফেলে হনহন করে এগিয়ে যায়। মনে মনে গজ্গজ্ করে উনি হবেন বখতিয়ার খিলজি! আহ্লাদ! তোমার মত লুটেরা ছিল বখতিয়ার! শালা রাজাকার কোথাকার!
রাজাকার? নিজেই চমকে ওঠে শওকত, এ কী বলছি আমি!
এ কী ভাবছি! রণাঙ্গনে কী যে দুর্দান্ত সাহসী
মুক্তিযোদ্ধা ছিল এই বাহাউদ্দিন, সে কথা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি! গ্রেনেড নিক্ষেপে কী যে অব্যর্থ রক্ষ্য তার! রাজনগর কালভার্টের কাছে শুধু গ্রেনেড ছুঁড়েই তো এক ট্রাক পাকসেনা সাবড়েছিল একা বাহাউদ্দিন। হ্যাঁ, সেদিন আমিও ছিলাম সঙ্গে। আমাকে নিরাপদ দূরত্বে আখক্ষেতে বসিয়ে রেখে গ্রেনেডের পিন খুলে গোঁয়ারের মতো ছুটে গিয়েছিল কে? এই বাহাউদ্দিনই তো!অপারেশন শেষে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর কার পিছ চাপড়ে বলেছিলেন-বাঘের বাচ্চা? এই বাহাউদ্দিনকে নয়?
আপন মনেও শওকত আলী সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে- নাহ্ সেই বাহাউদ্দিন এ নয়। একে দেখে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরও আর চিনতে পারবেন? এই বাহাউদ্দিন রাজাকার। অবশ্য বাহাউদ্দিন একা নয়, চারপাশে অনেকেই নেমেছে দখলের উন্মত্ত নেশায়; শওকত আলী এদের সবাইকে রাজাকার বলে সনাক্ত করে। সুযোগসন্ধানী এই দখলবাজদের কী বলবে তবে! দেশের শত্রু রাজাকার! এদের সবাইকে মনে মনে রাজাকার বলে গালি দিয়ে এবং ক্ষমাহীন অভিযোগে অভিযুক্ত ও চিহ্নিত করে রাখে শওকত আলী। অপেক্ষায় থাকে, আবার যদি কোনো
নেতা যুদ্ধের ডাক দেয়, তাহলে সে সবার আগে এই
রাজাকারদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরবে।
আর একজন আছেন তার অফিসেই, মনিরুজ্জামান সাহেব, গল্পে আকাশ ফাটানো ওস্তাদ। কথায় আছে না গাঁজার নেওকা কেবল পানিতেই ভাসে না, আকাশেও ওড়ে। এই মনিরুজ্জামান সাহেবের বেলায় সে কথা খাটে। কথা বলত শুরু করলে দু’গালের কথায় ফেনা তুলে ছাড়বেন। গল্পের ঘুড়ি কত দূরে উড়লো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, লাটাই থেকে সুতো ছেড়েই চলেছেন; ছেড়েই চলেছেন। কুমিল্লার মানুষ। আখাউড়া নাকি কসবা সীমান্ত দিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন, ত্রিপুরার স্থানীয় লোকদের কীভাবে মোটিভেট করেছেন, সেখানকার কোন ইনফ্লূয়েন্সিয়াল মিনিস্টার নাকি তার বাবার সহপাঠী বন্ধু ছিল এই সব আগডুম বাগডুম গল্পের তার শেষ হয় না। শওকত আলীর মাথার উপরে তার অবস্থান। মানে অফিসিয়ালি তাকে বস মানতেই হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বভাবে এমনই প্রাণখোলা দিলদরিয়া মানুষ যে তিনি নিজেই ক্ষণে ক্ষণে অফিসিয়াল ডেকোরাম ভেঙে ফ্যালেন, নিজেই সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে ধরেন নাও ভায়া, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দাও দেখি! বুদ্ধিটা একটু খোলতাই হোক।

অধূমপায়ী শওকত আলী বিব্রত হয়, আর কতদিন যে এই অনভ্যস্ততার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে ভেবে পায় না। তার চোখে আবার অধূমপায়ী মানেই মেয়েলি স্বভাব।
অনেকদিন পর হঠাৎ বাহাউদ্দিনেরর সঙ্গে দেখা। রাস্তায়। তবে হাঁটতে হাঁটতে নয়। গাড়ি হাকিয়ে সে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে। সাঁ করে পাশ কেটে বেরিয়ে যাবার পরও বেশ খানিক গিয়ে আবার ফিরে আসে। একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, আরে দোস্ত! খবর শুনেছ?
শওকত আলীর চোখে মুখে ভয়ানক বিরক্তির ছায়া। কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার। বাহাউদ্দিন একা একাই তড়পায়, গাছের পাশে এখন আগাছা ও বেড়ে উঠবে অবাধে। মহান নেতার উদারতার কথা শোনো নি? কী আশ্চর্য! শওকত আলী পূর্বাপর নির্বিকার। মুখে কথা নেই। চোখে নৈরাশ্য। শোনো দোস্ত, বাপ মরেছে আমার, মা-বোনের বেইজ্জতি হয়েছে আমার; তুমি ক্ষমা করার কেবলো দেখি! ইয়ার্কি নাকি! সহসা সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। জন্মদাতা বাপের মুখ
মনে পড়ে। মায়ের কান্নাভেজা মুখ মনে পড়ে। মনে পড়ে পিতৃহন্তারক নাজম উদ্দীনের চেহারাও। কিন্তু বাহাউদ্দিন এভাবে কথা বলছে কেন? কই, ওর বাপ মা কিংবা ভাইবোন হারানোর কথা তো কখনো শোনেনি! তবু সে আঙুল নাড়িয়ে ঘোষণা করে, আমি কিন্তু ক্ষমা করিনি দোস্ত। আর দাঁড়ায় না বাহাউদ্দিন। সাঁ করে এক টানে বেরিয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে কী যে ওলোট পালেঅট হয়, শওকত আলীর পেটের ভেতরে হঠ্রাৎ দুমড়ে মুচড়ে ওঠে, মাথা শূন্য হয়ে ভোঁ ভোঁ করে; অতঃপর সে রাস্তার উপরেই হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলে। যেন বা সে আর নিজের দেহের ভারসাম্যই রক্ষা করতে পারে না। পথ চলতি এক রিকসাঅলঅ কাঁধ বাধিয়ে তাকে উদ্ধার করে। রিকসায় উঠিয়ে নেয়।
সে বছরই প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করে শওকত আলী এবং অল্পদিনের মধ্যেই পারচেজ অফিসার পদে প্রমোশন পায়। গা থেকে কেরানির ছাপটা খসে পড়ায় তার খুব স্বস্তি হয়। বহুদিন থেকে সে তাকিয়েছিল এই প্রমোশনের দিকে। সেই লক্ষ্যে সে যখন বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে,

তখনই একদিন তার কানে আসেডিপার্টমেন্টাল প্রমেশোন আর দেয়া হবে না, ম্যঅনেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাইরেক্ট রিক্রুট করবে। তাতেই লাভ বেশি। এ খবরে প্রথমে খুবই মন ভেঙে যায়।
এমন কথাও ভেবে বসে না, এ চাকরিই আর করবে না। কিন্তু এ চাকরি ছাড়ার আগে নতুন চাকরি তো একটা যোগাড় করতে হবে। কিন্তু তার জন্যেও চাই গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রিটা। অবশেষে পরীক্ষায় পাসের পর এই প্রমোশনটা হয়ে গেলে সে প্রায় দুনিা জয়ের সমান আনন্দ পায়। নিজের এই প্রাপ্তিটুকুতেই শওকত আী স্বস্তি এবং তৃপ্তি খোঁজে। সেই সঙ্গে নিজেকে মহান নেতার পর্যায়ে উন্নীত করে সব রাজাকারকেই ক্ষমা করে দেয়। না না, একটুখানি ভুল হলো। ক্ষমা সে করতে পারে না নীলগঞ্জের পিস কমিটির নেতা নাজিম উদ্দিনকে। তারই প্রত্যক্ষ নির্দেশে একদল রাজাকার শওকত আলীর নির্বিবাদী বাবাকে হত্যা করে, ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। ছেলের যুদ্ধে যাবার অপরাধে এভাবেই সাজা পায় গোটা পরিবার। অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে পরিবারের সকলে। ব্যক্তিগত এই ক্ষতি ও ক্ষত মুছে ফেলার মতো মহানুভব হতে পারেনি শওকত আলী। আরও বছর দুয়েক পর মাতৃবিয়োগ ঘটলে গ্রামের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কশূন্য হয়ে পড়ে প্রায়, তবু ওই ব্যক্তিগত ক্ষত কিছুতেই শুকায় না তার। ওই ক্ষত সহস্র রক্তজবা হয়ে ফুটে থাকে।

Series Navigationউপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব দুই >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *