উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব চার

চার

ছোটবেলায়, মানে সকুল পেরিয়ে সবে কলেজে পা দিয়েছে এ রকম সময়ে শওকত আলি কে একবার বিশেষ একটা কাজে সিরাজগঞ্জ যেতে হয়েছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন এমন ভালো কিছু নয় ট্রেনে চেপে ঈশ্বরদী জংশন পর্যন্ত এসে অবাক চোখে একটি সাইনবোর্ড আবিষ্কার করে সে। টিনের বা লেহার পাতে লেখা সাইনবোর্ড নয়, রীতিমত ইটবালু সিমেন্টের কংক্রিটে তৈরি স্থায়ী সাইনবোর্ড। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে:

‘সিরাজগঞ্জ যাইতে গাড়ি বদল করুন।’
শওকত আলীকে সেবার গাড়ি বদল করতে হয়েছিল। এক গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর অচেনা জংশনে সিরাজগঞ্জের গাড়ি খুঁজে বের করতে একটু সময় লেগেছিল। একটু উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও হয়েছিল বইকি! চাকরি ছেড়ে এসে, এই এতদিন পর আবার সেই গাড়ি বদলের কথা মনে পড়ে শওকত আলরি। কিন্তু বদ্ধলি গাড়ি ধরার কোনো উৎকণ্ঠাই যেন আর বোধ করে না সে। সকুল কলেজগামী তিন ছেলেমেয়ে, তারা স্বামী-স্ত্রী সব মিলিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের বোঝা যার কাঁধে সে যে এত নিরুদ্বিগ্ন থাকে কী করে, কে বলবে সেই কথা! পরদিন সাপ্তাহিক ছুটির অবকাশে মনিরুজ্জামান সাহেব হই হই করতে করতে শওকত আলীর বাসায় এসে হাজির। এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। যখন আসেন ওইরকম সশব্দে আসেন কেথায় স্বপন-তপন! কইরে দীনা! ছেলেমেয়েরও খুব প্রিয় আঙ্কেল। কেবল ছোট ছেলে সলাজ আপত্তি জানায়, তার নাম তপন নয়, আপন। মনিরুজ্জামান সাহেব হো হো করে হেসে উড়িয়ে দেন ওই হলোরে বাবা, স্বপনের ভাই তপনই হয়। তোমার বাপ কায়দা করে নাম রেখেছে আপন। কেন, অন্যগুলো পর নাকি? দীনা তাঁকে সমর্থন জানায় ঠিক বলেছেন আঙ্কেল। ঠিক কথা। এদিন মনিরুজ্জামান সাহেব এসে সোজা শওকত আলীর কাঁধে থাবা দিয়ে বলেন, রিজাইন করে তুমি ঠিক কাজই করেছ শওকত। মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসতে বসতে জানান, আমি হলেও তাই করতাম। এ দিকে শওকত আলী কিন্তু নির্বকার। তার চোখে মুখে কোনোই প্রতিক্রিয়ার ছায়া নেই। ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মনিরুজ্জামান সাহেব নিজের কথারই সংশোধনী দেন, না না, ঠিক হলো না। আমি বোধ হয় পারতামই না শওকত।

সেই কবে থেকেই তো আমি চাকরি ছাড়ছি, পারছি কই? চাকরি ছাড়া কি একটা সোজা কাজ! সেই কঠিন কাজটি যে করেছে, তার মুখে কথা নেই। একতরফা কথা বলে যান মনিরুজ্জামান, এভাবে রিজাইন করার জন্যে যে মেন্টাল স্ট্রেংথ দরকার সেটা তোমার আছে, আমার নেই। চেয়ারম্যান ঠিকই ধরেছেন, তুমিই আসলে মুক্তিযোদ্ধা। আচ্ছা, কত নম্বর সেক্টরে ছিলে যেন! শওকত আলীর চোখের পলক পড়ে না। অবাক বিস্ময়ে মনিরুজ্জামান সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে ভেবেই পায় না  এতদিন পর এ কি একটা প্রশ্ন হলো! বয়সে এবং পদমর্যাদায় এই মানুষটি তার চেয়ে বড়। অফিসিয়াল সম্পর্কের বাইরেও তাকে বিশেষ স্নেহ করেন।

শওকত আলীর অনেক অপ্রিয় মন্তব্য নির্বিবাদে হজম করেন। এই সব কারণেই অপছন্দের অনেক দিক থাকা সত্তে¡ও এই লোকটিকে সে বেশ ভালোবাসে। সে একা নয়, তার স্ত্রী পুত্র পর্যন্তও। অফিসে তো নয়ই, অফিসের বাইরেও মনিরুজ্জামান সাহেবকে কখনো এমন অসংলগ্ন প্রগলভ অবস্থায় দেখা যায় না। শওকত আলী বিন্মর কণ্ঠে বলে, স্থির হয়ে বসুন তো মনির ভাই! কী মনে করে এসেছেন,
তাই বলুন! শুনি!
কী বলছ শওকত!
অবাক হল মনিরুজ্জামান সাহেব তুমি এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে আর আমি আসব না? সেটা তো আমি গতকালই আশা করেছিলাম। ওই যে শালা আর্মির বাচ্চা আর্মি ঘাড় মট্কে ধরেছিল! চেয়ারম্যানের প্রতি এমন অদ্ভুত সম্বোধন এর আগেও বেশ কদিন মনিরুজ্জামান সাহেবের মুখে সে শুনেছে। কিন্তু এখন আর ওই প্রসঙ্গে যেতে ইচ্ছে করে না মোটেই।
সে স্ত্রীকে ডেকে ওঠে,
এই যে শুন্ধছ স্বপনের মা! মনির ভাই; এসেছেন তো! চা দাও!
আমি এসেছি সেটা খুব জানে স্বপনের মা। কিন্তু চা নয়, আজ মিষ্টি খাব।
আপনার ডায়াবেটিস যে!
হোক। তুমি আর বাগ্ধড়া দিয়ো না তো!
এ্যাই শাহানা! মনির ভাই মিষ্টি খাবেন কিন্তু।
হ্যাঁ, মিষ্টিমুখ করেই তোমার সাহসিকতাকে আমি সেলিব্রেট করতে চাই।
কী যা তা বলছেন! এ কে সাহসিকতা বলে!
বলে না?
আমি কি দশতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়েছি? নাকি ভরা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছি?
তার চেয়েও বেশি কিছু করেছ তুমি।
চায়ের ট্রের উপরেই দু’পদের মিষ্টির পিরিচ সাজিয়ে ঘরে ঢোকে শওকত আলীর স্ত্রী। সেই ট্রে নামাতে নামাতে জানায,
মিষ্টি তো মনির ভাইই নিয়ে এসেছেন!
শওকত আলী চম্কে ওঠে,
আপনার মতলবটা কী, মনির ভাই?
ডায়াবেটিস রোগী হওয়া সত্ত্বে ও সত্যি সত্যি গালের মধ্যে আস্ত একটা মিষ্টি পুরে এক নিমেষেই সেটা খেয়ে
ফেলেন মনিরুজ্জামান সাহেব। তারপর চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে তিনি জানতে চান,
কর্পোরেশনে ঢোকার আগে কী একটা চাকরি করতে যেন তুমি!
গ্রাম্য এক জুনিয়র স্কুলে ছিলাম।
কত দিন ছিলে?
তা প্রায় সাত আট বছর মাস্টারি করেছি।
আট বছর সোজা কথা! সেই জন্যে তোমার এই অবস্থা।
এই অবস্থা মানে কী, কিছুই বুঝতে পারে না শওকত আলী। সে পূর্বাপর সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। মনিরুজ্জামান সাহেব ব্যাখ্যা দেন,
আট বছরের মাস্টারির প্রভাবটা যাবে কোথায়? এই জন্যে তোমার মেরুদন্ডটা বড্ড শক্ত। তার উপরে আবার কড়া মুক্তিযোদ্ধা। ডাবল স্ট্রেংথ।
শওকত আলী এক চিলতে হেসে ওঠে, ‘কড়া মুক্তিযোদ্ধা’ ব্যাপারটা কী রকম!
শেষ চুমুক দেয়ার পর হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মনিরুজ্জামান সাহেব বলেন, ও সব বাদ দাও তো! এখন কী করবে, ভেবেছ কিছু?
নাহ্!
ভাবাভাবির দরকার নেই। কাজে লেগে পড় দেখি! তোমার আমার খুব দরকার।
দুর্বোধ্যতার ঘোর কাটে না শওকত আলীর,
কী বলছেন মনির ভাই?
হ্যাঁ। আমার বিজনেস ফার্মের দায়িত্বটা তুমি নাও শওকত। আমি স্বস্তি পাবো।
শওকত আলী হা করে তাকিয়ে থাকে। বুঝতেই পারে না এই কথা বলার জন্যেই কি এত আয়োজন?
তাকিয়ে আছ কেন! একটা কিছুতো করে খাবে, নাকি?
ভাবছি আপনি আমাকে চাকরি দেবেন!
ব্যাপারটাকে চাকরি হিসেবে না নেওয়াই ভালো। বেতন টেতনের কথা আমি তুলতে পারব না। তুমি বরং প্রফিট পার্সেন্টেজে এসো। বিজনেসকে বিজনেস হিসেবে নাও। হাত লাগাও। আমিও অল্পদিনেই চলে আসছি। ঝোঁকের মাথায় চাকরিতে রিজাইন করলেও ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা মোটেই ভাবেনি শওকত আলী। এখন মেঘ না চাইতেই নাগালের মধ্যে জল দেখে সে নিষ্পলক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টির কী যে অর্থ বোঝেন,
মনিরুজ্জামান সাহেব হঠাৎ বলেন, অবশ্য তোমার চাকরিতে ফিরে আসতে চাইলে সেটাও তুমি পারো। সে পথও আমি একরকম তৈরি করেই এসেছি। সেক্ষেত্রে তোমাকে ওই আর্মির বাচ্চা আর্মির কথামত খান এ্যান্ড খানের সাপ্লাই রিসিভ করতেই হবে। হুঁ।
শওকত আলী একেবারে আঁৎকে ওঠে,
না না মনির ভাই, আমি আর কিছুতেই ওই বন্দি খাঁচায় ঢুকতে চাই না। অসম্ভব।
ভেরি গুড। দেখো, আমিও একদিন খাঁচা ভেঙে ঠিকই বেরিয়ে আসব। কিন্তু তার আগে যে তোমাকে একটা কাজ করতে হয় শওকত!
কী কাজ?
তোমার ওই রিজাইন লেটারটা উইথড্র করতে হবে যে!
শওকত আলী আকাশ থেকে পড়ে, কেন?
তুমি রিজাইন করেছ, এটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না চেয়ারম্যানের। তোমাকে এন্টি করাপশনে ফাঁসাবার ফন্দি আঁটছে।
আমি তার জবাবও দিয়েছি তো!
শোনো শওকত, ওই শালা আর্মির বাচ্চা আর্মির বড্ড সাধ হয়েছে তোমাকে ডিসচার্জ করার। মাথা মোটা
মানুষের কত রকম সাধ যে হয়!
তো আমাকে কী করতে হবে?
ওই যে বললাম!
অসম্ভব! আমার রিজাইন লেটার নিয়ে আপনাদের যা খুশি করতে পারেন মনির ভাই। ছিঁড়ে ফেলতে পারেন। উড়িয়ে দিতে পারেন। পুড়িয়ে দিতে পারেন। ওই বিষয় নিয়ে আমি আর একটুও ভাবতে রাজি নই।
এই দ্যাখো, আমাকে আবার জড়াচ্ছ কেন?
না। আমি জড়াতে যাব কেন? আপনি নিজেই তো জড়াচ্ছেন। আপনি কার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, বলুনস তো সত্যি করে?
শওকত আলী উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়। মনিরুজ্জামান সাহেবও চেয়ার ছেড়ে এসে পরম সখ্যতায় তার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
শোনো শওকত! এখন পাতাবাহারের জমানা। হোক

রিটায়ার্ড আর্মি, জানো তো মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই পাতাবাহারের পাতা শুকায় না। যে কারণেই হোক, তার
যখন মাথা গরম হয়েছে, ছোবল একটা মারবেই।
সে ভয় আমি করি না মনির ভাই।
তোমার কিছুই করতে পারবে না হয়তো। হয়রানিতে ফেলতে ঠিকই পারবে। যাক গে, পিআরও এরিনা খানের সঙ্গে তোমার পার্সোনাল রিলেশনটা কেমন?
ওই অফিসের সবার সঙ্গে সব সম্পর্কই আমি ঘুঁচিয়ে এসেছি। কারো কথাই আলাদা করে ভাবতে পারছি না এখন।
তুমি কি আমাকেও অপমান করছ শওকত?
না মনির ভাই, এত সাহস আমার এখনো হয়নি। কিন্তু, আপনি কার হয়ে সাফাই গাইতে এসেছেন?
নাহ্। আমি যাই এখন। তোমার মাথা থেকে প্রি- কন্সেপসনের ভূতটা আগে নামুক। ঠান্ডা মাথায় একটু
ভেবে দেখো, আমি না হয় পরে জেনে নেব তোমার সিদ্ধান্ত।
মনিরুজ্জামান সাহেব সত্যিই দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েন। শওকত আলী তবুও চিৎকার করে
জানায় আমার সিদ্ধান্ত ওই একটাই মনির ভাই।

Series Navigation<< উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব তিনউপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফকিুর রশীদ ।। পর্ব পাঁচ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *