উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এক
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব দুই
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফকিুর রশীদ ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব ছয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। শেষ পর্ব
এগার.
সময়ের আহব্বানে সাড়া দিয়ে শওকত আলী মুক্তিযুদ্ধ করেছে। রাজনৈতিক সম্পৃক্তি ছিল না কখনোই। ছিল তার নানাবিধ পিছুটান।
বৃদ্ধ পিতামাতার অবুঝ আকুতি, পুত্রপরিজনের আবেগঘন আবেদন, সরকারি চাকরি হারানোর ঝুঁকি পিছুটান আরও কত কিছুর।
পঁচিশে মার্চের পর ঢাকা থেকে কোনো রকমে গ্রামে ফিরলে যুব সম্প্রদায় আঁকড়ে ধরে ঢাকার খবর কী শওকত ভাই? আমরা এখন
কী করব? উৎকণ্ঠিত এই প্রশ্নের মুখে নিজেকে আর আড়াল করতে পারেনি সে। সকল পিছুটান উপেক্ষা করে সে ঘোষণা করেছে?
যুদ্ধই অনিবার্য। তার এই সিদ্ধান্ত শুনে গ্রামের যুবকেরা যুদ্ধে যাবে, আর সে বাড়িতে বসে থাকবে, তাই কিছুতেই হয়? সকল পিছুটান,
সকল মোহবন্ধন নিমেষেই তুচ্ছ হয়ে যায়। যুদ্ধই হয়ে ওঠে মুখ্য।
মুক্তিযুদ্ধ যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেরই ফসল? প্রবলভাবেই এই বিশ্বাস করে শওকত আলী। অথচ সেই যুদ্ধজয়ের পর থেকে অদ্যাবধি
তার ভেতরে কোনো রাজনৈতিক অভিলাষই জাগেনি কখনো। সে ধরেই নিয়েছে, এ কাজ তার নয়।
তাহলে কাজ কী তার?
খুব সহজ সরল সমীকরণ করে নিয়েছে সে? তার কাজ নিজেকে রক্ষা করা, নিজের দিকটা দেখা। কেউ
আত্মকেন্দ্রিক ভাবলেও ভাবতে পারে; নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেয়ে বড় কাজ সে আর সামনে দেখতে পায়নি। এই যুদ্ধ তাকে পিতৃহীন
করেছে। আছে বিধবা মা। স্বামীর কবর আগলাবার জন্যে সে গ্রাম্য ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবে না। স্ত্রী পুত্র নিয়ে শওকত আলী ফিরে আসে
ঢাকায়, ফিরে আসে পূর্বের কর্মস্থলে। বাব্বা! একযোগে দু’দুটো ইনক্রিমেন্ট প্রাপ্তিএ কি সোজা কথা! যুদ্ধ করার পুরস্কার? কম কোথায়!
সে চোখের সামনে বহু বাহাউদ্দিনের উল্লম্ফন দেখেছে, নিজেকে তাদের দলে নামাতে পারেনি। ট্রেন ইউনিয়ন করার নামে সরকারী খরচে
মস্কো ঘুরে এসে ছড়ি ঘোরাতেও দেখেছে তারই সহকর্মীকে।
সরকারি দলকে ন্যাংটা করার জন্যে কেউ গেছে জাসদে, কেউবা আন্ডার গ্রাউন্ডে। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক পট
পরিবর্তনের পর শুরু হলো পাকিস্তানি আমলের সামরিক-অসামরিক লুকোচুরি খেলা, ১৮ দফা/১৯ দফা বাস্তবায়নের জাদু, হ্যাঁ অথবা না এর
গণতন্ত্র এবং এক বীর মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে ক্রমশ পশ্চাদপসরণ? এ সবই চোখ মেলে দেখেছে শওকত আলী। দেখতে দেখতে রাজনীতির
উপরে একেবারেই বীতস্পৃহ হয়ে পড়েছে। কিন্তু দেখার তখন আরো কত বাকি তা কে জানতো! তারই কর্মস্থলে মাথার উপরে এসে বসলেন
পাকিস্তান প্রত্যাগত রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। কী মুশকিল! শুধু তার কর্মস্থলে হবে কেন, গোটা দেশের মাথার উপরেই তো পাকিস্তান
প্রত্যাগত দেশপ্রেমিক বিরাজমান। সম্পূর্ণ অমুক্তিযোদ্ধা হয়েও তিনিই হলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান উপদেষ্টা। অনেক হয়েছে। সহ্যেরও
একটা সীমা থাকে মানুষের। শওকত আলীর যথার্থই ধৈর্য্যচুতি ঘটে। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটি ভীষণ অপ্রয়োজনীয় মনে হয় তার। একদিন
সেই বিবর্ণ কাগজটি সে দু’হাতে টেনে ছিঁড়ে ফ্যালে। কাগজ ছেঁড়ে, কিন্তু স্মৃতি তো উপ্ড়ে ফেলা যায় না! সেইখানেই যত সংকট। নইলে
মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে মেজর ইমরান চৌধুরীর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যে সে কেন চাকরি ছেড়ে দেবে!
তারপর থেকে শওকত আলীর জীবনের বাঁক বদ্লেছে, আয় উপার্জন বেড়েছে, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে; কিন্তু রাজনীতি নিয়ে তো মোটেই
ভাবেনি! তার যত মনোযোগ ব্যবসা বাণিজ্যে। কী করে ব্যবসার নিত্য নতুন সম্প্রসারণ ঘটানো যায় তাই নিয়েই যত পরিকল্পনা তার। গুণধর
পুত্র স্বপনই তার ভাবনার জগতে বিরাট এক জিজ্ঞাসাচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে রাজনৈতক প্রতিপত্তি যুক্ত না হলে যে
হাতের মুঠো একদম ফাঁকা, সে তো ওই পাঁচতলার উপরে কনস্ট্রাকশনের সময়েই সে বুঝেছে। ক্ষমতা না থাকলে শুধু টাকায় হাতের মুঠো ভরে?
একবার তো এরশাদ সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী তাকে ম্যান পাওয়ার বিজনেসের আঠায় জড়িয়ে রাজনীতির পাঁকে নামিয়ে ফেলেছিল প্রায়। সেই
মন্ত্রী তাকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষা দেয়? সব বিজনেসের সেরা বিজনেস হচ্ছে পলিটিকস, এখানে জো বুঝে ইনভেস্ট করতে পারলেই কপাল ফর্সা।
শওকত আলীকে চমকে দিয়ে মন্ত্রী আরোজানায়? ফ্রিডম ফাইটার হিসেবে তো আপনার আছে গ্লোরিয়াস ব্যাকগ্রাউন্ড। না না, মোটেই অবহেলা
করবেন না। আমাদের রাজনীতিতে এটা বিরাট প্লাস পয়েন্ট। আমি নিশ্চয় স্যারকে বলবো আপনার কথা। ফ্রিডম ফাইটার!
সত্যি শওকত আলীর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নাহ্! এ পরিচয় তো সে নিজে থেকে কোথাও আর দেয় না!
অনেকদিন এ কথা কোথাও বলেও না। বরং কোথাও কখনো মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আলাপ আলোচনা উঠলে খুব
সচেতনভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তাহলে এই লোকটা কোত্থেকে জানল এই তথ্য? তার নিজেরই আবার হাসি পায়? মন্ত্রী বলে কথা! এদেশে
মন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতা কার? এই সামান্য তথ্য আবিষ্কার আবার একজন মন্ত্রীর কাছে কোনো ঘটনা!
‘স্যার’ মানে কী এবং কাকে বোঝানো হচ্ছে শওকত আলী সেটা খুব বুঝতে পারে এবং বুঝতে পারে বলেই ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠে। দীর্ঘ চার
বছরেও মনিরুজ্জামান সাহেব চাকরি ছেড়ে আসতে পারলেন না দেখে সে বিরক্ত হয়ে বিজনেস পৃথক করে নিয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে
তৌফিকউদ্দীনও তার মামার পক্ষ ত্যাগ করে শওকত আলীর সঙ্গেই চলে এসেছে এবং মর্জিনাকে বিয়ে করে ইতিমধ্যে সুখের সংসারও পেতেছে।
সে যা-ই হোক, শওকত আলী নিরন্র চেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছে। গত ছ’সাত বছরের সাধনায় ঢাকা শহরে বাড়ি গাড়ি হয়েছে ঠিকই,
তবু তার মনে হয় সে যেখানে পৌঁছুতে চায়, সে পথ এখনো অনেক দূরের, এখনো সামনে বহু চড়াই উৎরাই। এত পথ পাড়ি দেবে কী, গত বছর
স্বপনই তাকে বেশ খানিক পিছিয়ে দিল! এক বিমল বাবুর মেয়ের সর্বনাশ করে তো আশ মেটেনি তার! নিত্য নতুন তৃষ্ণা বাড়ে। লজ্জা শরম তার
কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। শাহানা বেগম একদিন বিয়ের কথা তুললে কত না বিশ্রী ভাষায় মায়ের সামনে আস্ফালন করেছে। মায়েরই তখন
কানে আঙুল গুঁজে পালাবার দশা।
সেই ছেলে কিনা মেয়েঘটিত কেলেঙ্কারী পাকিয়ে শেষে খুন খারাবির একশেষ। মূলত স্বপনের নামের সেই মামলা সামলাতে গিয়েই এই পাতি মন্ত্রীর
সঙ্গে মাখামাখি। সে এক টানটান দুঃসময় গিয়েছে বটে। এ তো আর ভিখিরির সঙ্গে সখ্যতা নয়! হাফ হোক সিকি হোক,মন্ত্রী বলে কথা! কাঁড়ি কাঁড়ি
টাকা বানের জলের মত হু হু করে নেমে গেছে সেই সময়ে। অবশ্য সোনার বিস্কুট গিলতে শিখিয়েছে সেই মন্ত্রীই। ফলে টাকার শোক ভুলতে খুব
বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু কার জন্যে এত হাপিত্যেশ-গলা শুকিয়ে কাঠ! কার জন্যে বেশুমার টাকা খরচ! তাকে কি পেরেছে হাতের মুঠোয় পুরতে?
পেরেছে তাকে বাগে আনতে? এ ঘটনার পরপরই শওকত আলী ছেলেদের আমেরিকা পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। ছোট চেলে আপন ঠিকই পাড়ি
জমায়। বুয়েট থেকে বেরিয়ে একটা বেসরকারী ফার্মে উচ্চ বেতনে জয়েন করেছিল বটে, তবু এই সুযোগটাও সে হাতছাড়া করে না। কিন্তু আপন যেটা
করবে, স্বপন তো সেটা করবে না কিছুতেই। আপন ভালো হলে স্বপনকে মন্দ হতে হবে, আপন লেখাপড়া করলে স্বপনকে গুন্ডামি করতে হবে? বহু
আগেই যেন এভাবে তাদের গতিপথ ভিন্ন হয়ে গেছে। কাজেই আপন যেহেতু আমেরিকা যাচ্ছে, তার আর যাওয়া যাবে না কিছুতেই। দেশের মাটির
উপরে তার প্রগাঢ় টান। খুন খারাবি ভালোমন্দ যা-ই করুক সেটা দেশের মাটিতেই করতে চায় সে। ‘দেশপ্রেম’শব্দটি আর মুখ লুকানোর জায়গা পায় না।
দেশেই যখন থাকবি, আর কত উড়নচন্ডী হয়ে ঘুরবি! তাহলে, বাপের ব্যবসার হাল ধর। না, সেখানেও তার ভয়ানক অনীহা। ছাত্রজীবন যে কোথায়
কখন বেঘোরে লুটিয়ে পড়েছে, তার নেই ঠিক ঠিকানা, আর উনি করেন ছাত্র আন্দোলন, স্বৈরাচার- বিরোধী আন্দোলন! আবার দেশের একজন মন্ত্রীর
সঙ্গে বাপের সখ্যতাও উনার সহ্য হয় না, সুযোগ পেলেই কুটুশ কুটুশ মন্তব্য ঝাড়েন। আর সে কি যা তা মন্তব্য! সে সব কানে তুললে সারা দেহে
বিচুতিবুলানোর জ্বলুনি ধরে যায়। জন্মদাতা বাপকে বলে কি না স্বৈরাচারের দোসর!
সামনাসামনি বলেনি বটে, কথা তো হাওয়ায় ভাসে, কানে ঠিকই আসে। তখন মাথার চাঁদি পর্যন্ত জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। ওকত আলী আপন মনেই
তড়পায়? আমি কি তোদের মত জ্বালাও পোড়াও করে বেড়াই! আমার এই চোখে ছেষট্টির ছয়-দফার আন্দোলন দেখেছি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
দেখেছি, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ- মুক্তিযুদ্ধ সব দেখেছি। তোরা ওই জ্বালাও পোড়াও ছাড়া কী দেখেছিস! রাজনীতি কাকে বলে জানিস! না,
রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে শওকত আলীও মোটেই জড়াতে চায় না। ছাত্রজীবনে সচেতন বন্ধুদের কথাবার্তায় টানটান উত্তজনা দেখেছে, সেটি ছিল
আইয়ুবের শাসনামলের উত্থানকাল, বজ্র আঁটুনির মধ্যেও ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে ছাত্রদের কৌশলগত রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেখেছে;
শওকত আলী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি।
লজিঙ বাড়ির ভাত খেয়ে গরীবের ছেলের পক্ষে রাজনীতিসম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি। লেখাপড়া শেষ হবার আগেই গ্রাম্য এক জুনিয়র স্কুলের মাস্টারি
দিয়ে তাকে শুরু করতে হয় কর্মজীবন, সেও তো পেটের দায়েই বলা চলে! স্বপনদের তো পেটের দায় নেই, ওদিকে নেতাও জানিয়ে রেখেছেন?
মানি ইজ নো প্রবলেম, কাজেই আর ভাবনা কী! ওরাই তো করবে এখনকার রাজনীতি, যাকে বলে ডিফিকাল্ট পলিটিক্স। রাজনীতির প্রতি শওকত
আলীর মোহ থাক আর নাই থাক, সেই যে খুনের মামলা থেকে পুত্র উদ্ধারের সূত্রে মন্ত্রী সঙ্গে পরিচয় এবং পরে সামান্য ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে? এই
একটি ঘটনা কখন অলক্ষে তাকে মাকড়শার জালে আটকে ফ্যালে। তাদের প্রিয় স্যারের কাছে সত্যি সত্যি কী কথা যে বলে এসেছে সে-ই জানে,
একদিন সেই মন্ত্রী মহোদয় এসে এমনভাবে জাপটে ধরে যে শওকত আলী কিছুতেই না বলতে পারে না। নিজেকে একটু গুছিয়ে তোলারও সময়
দিতে চায় না মন্ত্রী মহোদয়। তাদের স্যার আবার আটরশির পীরের কাছে যাবার জন্যে ছটফট করছেন, হাতে সময় কম। এ অবস্থায় মন্ত্রীর
পীড়াপীড়িতে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্তে¡ও শওকত আলীকে সত্যি সত্যি রাজদরবারে যেতে হয়। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা বটে। আলোকোজ্জ্বল
সেই দরবারে নিজেকে অতিশয় নগন্য মনে হয় তার। একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, তুচ্ছাতিতুচ্ছ। রবি ঠাকুর সেই কবে হরিপদ কেরানিকে এঁকেছেন
কবিতায়, শওকত আলী তো প্রকৃতপক্ষে তার সমানও নয়। চিত্তানুভূতির সমতা বুঝাতে গিয়ে রবি ঠাকুর তো একবারের জন্যে হলেও আকবর
বাদশার সঙ্গে উপমিত করেছেন হরিপদ কেরানিকে।
শওকত আলীর কোথায় সেই যোগ্যতা! তবু সেই মন্ত্রীর কী যে বাড়াবাড়ি, কথা বলতে গিয়ে মুখে ফেনা উঠে যায়, মাত্রাজ্ঞানও বুঝিবা গোলমাল হয়ে যায়।
দেশের প্রেসিডেন্টের সামনে তাকে শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নয়, বিপুল সম্ভাবনাময় একজন বিজনেস ম্যাগনেট হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। উষ্ণ
করমর্দনের পর শওকত আলী অবাক বিস্ময়ে, পরিপাটি করে সাজানো দাঁতে প্রেসিডেন্টের হাসির সৌন্দর্য আবিষ্কার করে। গালের চামড়ায়,
কপালের ভাঁজে বয়সের ছাপ পড়েছে বটে, তবু কত প্রাণবন্ত, আনন্দ উচ্ছসে টইটুম্বুর! এতটা কাছে থেকে দেখার পর শওকত আলী যেন কিঞ্চিৎ
অনুধাবন করতে পারে? কেন দেশের রমনীকূল পতঙ্গের মত ছুটে এসে এ অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দেয়। বয়সকে ভ্রƒকুটি করার শক্তি এবং সাহস, সেই সঙ্গে
প্রাণপ্রাচুর্য আছে বটে লোকটার!
অথচ এই মানুষটির বিরুদ্ধেই বাইরে চলছে আন্দোলন-সংগ্রাম, হরতাল-মিছিল; জ্বলছে সারা বাংলাদেশ! প্রস্তরপ্রতিম নিরুদ্বিগ্ন চেহারায় এ সবের
কোনো ছাপ পড়েছে বলে মনেই হয় না তার! কেনই বা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ছাপ পড়বে ওই চেহারায়। আন্দোলনকারীদের কী দাবি? ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
সে তো হবেই একদিন, চিরকাল কেউ থাকে ক্ষমতায়! কেউ তো এ দাবি তোলেনি? তুমি যে পথে ক্ষমতায় এসেছ সেই পথটা নোংরা, এ পথে ক্ষমতায়
আসাটাই অন্যায়? সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যে বিশ্বাসী জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে তুমি যে সংবিধান কেটে ছিঁড়ে রাষ্ট্রধর্ম বানিয়েছ, এটাও অন্যায়?
কেউ বলে না তো! কেউ তো এই উচিৎ কথাটি তোলেনি? ওহে প্রেসিডেন্ট, এ দেশের সহজসরল ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা একাত্তরে কীভাবে ধর্মভিত্তিক
রাজনীতিকে কতটা ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিল সে দৃশ্য তুমি দ্যাখোনি বলেই এ অন্যায় করতে পেরেছ; কিন্তু এ অন্যায়ের বিচার হবে! প্রকৃত
অপরাধ যেখানে চিহ্নিত হয় না এবং সেই অপরাধের বিচারও চায় না? সেখানে আবার দুর্ভাবনা কিসের? যতক্ষণ সে ক্ষমতায় আছে, ততক্ষণ তো
সম্পূর্ণ ক্ষমতাবান! অতএব কিসের উদ্বেগ!
অথচ সেদিন বাড়ি ফিরে পরনের কাপড়চোপড় বদলানোর সময় সহসা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়তেই চম্কে ওঠে? কে ওই লোকটা?
অবাক চোখে তাকায়, ওই আয়নায় কার চেহারা উদ্ভাসিত? কী আশ্চর্য! এটা তার নিজের বাড়ি, নিজের ড্রেসিং টেবিল, ঢাউস আয়নার সামনে
সে নিজে দাঁড়িয়ে। অথচ এ কার চেহারা? এ তো সেই আর্মির বাচ্চা আর্মি? মেজর ইমরান চৌধুরী!
তারই চাকরি জীবনের বস্। কিন্তু তার ছবি এখানে কেন?
সারারাত ভেবে ভেবে এই অদ্ভুত রকমের দর্পণ বিভ্রান্তির কোনো কিনারা করতে পারে না শওকত আলী।