উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এক
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব দুই
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফকিুর রশীদ ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব ছয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। শেষ পর্ব
বার.
কোথায় আবার! এই ঢাকাতেই হবে হয়তো। ঢাকা তো বটেই। ঢাকার কোথায় যেন দেখেছি। আবার খিলখিল করে হেসে রাজদর্শনের পর মাত্র সাতদিনের মাথায় শওকত আলী শিল্পপতি হয়ে যায়। শুনতে যতই অবিশ্বাস্য লাগুক, ঘটনাটা সত্যি। অচল-সচল যা-ই হোক, পাটকলের মালিককে লোকে শিল্পপতি বলবে না? মরা হাতিও লাখ টাকা, সবাই জানে। সদাশয় সেই মন্ত্রীর কল্যাণে নারায়ণগঞ্জের এক লে-অফ ঘোষিত পাটকল পানির দামে কেনার বন্দোবস্ত হয়ে যায় অতি সহজেই। ফর্মালিটিজ মেনটেনের জন্যে যা যা করণীয়? কাগজপত্র এদিক সেদিক করে ফাইলওয়ার্ক একেবারে ঝকঝকে তকতকে ফিটফাট সারা হয়ে যায় মন্ত্রীর ইঙ্গিতেই। তবে অলিখিত শর্ত থাকে যে ওই পাটকলের ফিফ্টি পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ড করবেন মন্ত্রী মহোদয়ের স্ত্রী। মন্ত্রীর সঙ্গে মাখামাখি যতই থাক, এ নাগাদ মন্ত্রীর পরিবার পর্যন্ত কখনোই পৌঁছানোর সুযোগ হয়নি শওকত আলীর। তেমন প্রয়োজনও কখনো পড়েনি। এদিনও যে খুব জরুরী প্রয়োজন ছিল এমনও নয়। দলিল পত্রে সইস্বাক্ষর অন্য যে কোনোভাবেই করিয়ে নেয়া সম্ভব, এটা সবারই জানা। তবু এই অজুহাতে মন্ত্রী মহোদয় ডেকে পাঠায় শওকত আলীকে। সত্যি বলতে কী, মন্ত্রীপাড়ায় যাওয়ার অভিজ্ঞতাও তার এই প্রথম। সেপাই সান্ত্রী, পোষা কুকুর? এসব কিছুর বাইরে যে তার জন্য আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল, সে কথা কে জানতো! হ্যাঁ, মন্ত্রীপত্নীকে দেখে সে যথার্থই একটা ধাক্কা খায়। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। চোখ নামিয়ে নেয় নিচে। তবু আবার চোখ চলে যায় চোরাপথে। জরিপ করে চোখ-মুখ-নাক, গালের টোল? কোথায় দেখেছে…কোথায়….কোথায়…মনে করতে ভয়ানক কষ্ট হয়। এক সময় সে ফস্ করে শুধিয়েও বসে, আচ্ছা ম্যঅডাম! আপনাকে কোথায় দেখেছি? বলুন তো! সেই টোল্ ফেলা হাসিতে লুটিয়ে পড়ে ম্যাডাম। লুটানো হাসির মধ্যেই জানায়ওঠে ম্যাডাম। হাসির গমকে তার কথার খানিক বুঝা যায়, আর খানিক অস্পষ্টই থেকে যায়। তবু সে সামনে ঝুঁকে প্রশ্ন করে, কোথায় দেখেছেন? সে কথা মনে না পড়লে কি আমাকে বিজনেস পার্টনার করবেন না?
এ কী বলছেন আপনি!
এবার মন্ত্রী মহোদয়ের হাসির পালা। কিন্তু হাসতে হাসতে কেউ এমন রূঢ় ইয়ার্কি মারতে পারে? এই মন্ত্রী প্রবরটি পারে। কত অবলীলায় বলতে পারে, কিসের বিজনেস পার্টনার! প্রয়োজন হলে তোমাকে লাইফপার্টনারও করা যাবে, বুঝেছ?
এবার স্বামী স্ত্রী দু’জনে একযোগে হেসে ওঠে। কিন্তু শওকত আলীর চোখমুখ থেকে আলো নিভে যায়। এসব কোন্ধ ধরনের রসিকতা বুঝতে পারে না। স্ত্রীরত্ন ও হয়েছে তেমনই, দিব্যি মুখের উপরেই বলতে পারে, আমার এখন তাই করা উচিত। সারা দেশে যা শুরু হয়েছে? তোমাদের দিন শেষ। বিজনেসম্যানের দিন আছে, থাকবে। তাই না শওকত ভাই?
অতি দ্রুত ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে শওকত আলী আপত্তি জানায়, না ম্যাডাম, না; ব্যাপারটা মোটেই ওরকম নয়। বিজনেসেরর উত্থান-পতন আছে।
ও বাবা! ভয় পেয়ে গেলেন নাকি, এ্যাঁ?
নাহ্! কী যে বলেন!
আবার দু’জনে একযোগে হাসির ছররা ছড়ায়। মন্ত্রীর গায়ে এলিয়ে পড়ে ম্যাডাম! রীতিমত খুনসুটি জুড়ে দেয়, না গো, আমার এই কেলোপট্কাই ভালো। অবেলায় আমি তাকে ফেলে যাব কোথায়! বিজনেস গোল্লায় যাক। কেলোপট্কা! মন্ত্রীর গায়ের রঙ কালো বটে, তাই বলে স্বামীকে কেউ কেলোপট্কা বলে! আদর করার কী যে ছিরি! এতক্ষণ পর হঠাৎ এক পলক তাকাতেই শওকত আলীর মনে পড়ে যায়? এই মহিলাকে সে মেজর ইমরান চৌধুরীর কাছে যাওয়া আসা করতে দেখেছে বহুদিন। হ্যাঁ বহুদিন। সেই আর্মির বাচ্চা আর্মি নিজের পাশে বসিয়ে গাড়িতে করে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে বহুদিন। প্রথম দিকে অফিসের অনেকেই বসের বউ ভেবে সালামও দিয়েছে। তফাৎ বলতে তখন তার চোখে থাকত কালো বোদ চশ্মা, এখন নেই। হয়তো এখনো চোখে পরে বাইরে টাইরে গেলে, রাতের বেলা বাড়ির মধ্যে গগজ পরবে কোন দুঃখে! শওকত আলী চূড়ান্তভাবে চোখ বুলিয়ে নিজেকে নিশ্চিত করে? এ ম্যাডাম সেই রোদ চশমার মহিলা্ বটে। মনে মনে দু’হাত তুলে সালাম জানায়, বাহবা দেয়? চালিয়ে যান ম্যঅডাম। থামবেন না। সামরিক অসামরিক আমলা,পাতিমন্ত্রী-মন্ত্রী…এভাবে চালিয়ে গেলে মগডালে উঠতে আর মগডাল তো নারী দেখলে নিজেই নুয়ে থাকে দিনরাত। কাজেই আর অসুবিধা কোথায়! এতক্ষণ পর গা গুলিয়ে বমি আসে শওকত আলীর। কিসের এক অবরুদ্ধ বিবমিষা তলপেট থেকে ঠেলে উপরে আসতে চায়। কিন্তু এসব ছেলেমানুষী করলে চলবে কেন! সেই রাত শওকত আলীর জন্যে গোত্রান্তরের রাত। ব্যবসায়ী তো বটেই, এবার সে হচ্ছে শিল্পপতি। পিছু হটবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সে রাতে শ্যাম্পেনের গেলাস ঠোকাঠুকির মাধ্যমে এই শুভ ঘটনার সেলিব্রেট করতে গিয়ে কথায় কথায় তারা একটি বেসরকারী ব্যাংক খোলার পরিকল্পনাও করে ফ্যালে। এ প্রস্তাব শুনে শওকত আলীর প্রথমে কপালে ঘাম ফোটে, তারপর পেসাবের বেগ হয়। টলতে টলতে উঠে টয়লেট থেকে ফিরে এলে কী ভেবে মন্ত্রী আশ্বস্ত করে, টাকা নিয়ে ভাববেন না যেন! টাকা দেবে গৌরী সেন!
মানে?
অবাক বিস্ময়ে শওকত আলীর চোখ কপালে? রীতিমত একটা ব্যাংক খুলবে, আর টাকার ভাবনা ভাববে না? হা হা করে উচ্চস্বরে হেসে একেবারে গোপন কথাটিও ফাঁস করে দেয় মন্ত্রী, টাকা বানানো ব্যাংক তো আছেই সরকারের। আমরা খুলছি বেসরকারী ব্যাংক? টাকা বাড়ানো ব্যাংক। গলার স্বর একটু নামিয়ে সে জানায়, এ নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপও হয়ে গেছে তার!
তাই নাকি!
আবেগে উঠে দাঁড়ায় শওকত আলী। হে হে করে হাসতে হাসতে মন্ত্রী মন্তব্য করে, কবি মানুষ তো! মনটা বড়ই নরম। কোনো প্রস্তাবেই না বলতে পারেন না? তাই না মেহেরজান? মেহেরজান! মন্ত্রীপত্নী এই মহিলার নাম তাহলে মেহেরজান? ভারি মজার নাম তো! এরই মধ্যে প্রেসিডেন্টেরও মন পরীক্ষা হয়ে গেছে! প্রবল অগ্রগতিই বটে। সাবাশ মেহেরজান! মেহেরজানের সম্মতি জ্ঞাপনের সুযোগ কোথায়! মন্ত্রীর তখন কথা বলার নেশায় পেয়ে বসেছে। অনর্গল কথা বলে যেতে ইচ্ছে করে তার। তার মাথায় তখনো প্রেসিডেন্টের কবিত্বের ঘোর। সে বিশ্লেষণ দেয়, কবিদের যা হয় আর কী, ফুল পাখি নদী নারী ছাড়া তো কিচ্ছু বোঝে না! আমাকে জিগ্যেস করলেন স্যার? তোমাদের ব্যাংকের নাম কী? আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বললাম? নাম তো আমরা ঠিক করিনি স্যার! আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে। আপনিই একটা নাম দেন স্যার। স্যার কী বললেন জানেন? শওকত আলী ঘাড় উঁচু করে তাকায়। স্যার বললেন? এ দেশের প্রকতির দিকে চোখ মেলে তাকাও, নাম খুঁজে পাবে। আকাশ দ্যাখো। পাহাড় দ্যাখো। ফুল পাখি নদীর দিকে তাকাও? কত নেবে নাম! যাও, যে কোনো নদীর নাম রাখোগে ব্যাংকের। রাতের প্রহর গড়ায়। মন্ত্রীর কথা ফুরায় না। পদ্মা মেঘনা যমুনা সুরমা? নদীর নামও ফুরায় না। ব্যাংকের নামও স্থির হয় না।
তের.
এদিকে সেদিনের সেই রাতেই বিরাট এক বিপর্যয় ঘটে যায়। খবর আসে ভোরবেলায় টেলিফোনের ঝন্ধঝনাৎ শব্দে। ওপার থেকে যে ফোন করেছে, তার কণ্ঠে খুব তাড়া, একটুও তর সইছে না তার। সে জানতে চায়,
আঙ্কেল আছে বাড়িতে?
এ আবার একটা প্রশ্ন হলো! আঙ্কেল মানে তো শওকত আলী, নাকি! তার বাড়িতে সে থাকবেই! এই ভোরবেলা কোথায় যাবে! এপারে ফোন ধরেছে ডিনা, সে একটু খোলাসা হতে চায়,
হ্যালো! আপনি কে বলছেন?
নিজের পরিচয় না দিয়ে বরং সে প্রশ্ন করে, এটা কি টু জিরো থ্রি ফোর টু থ্রি?
জ্বি, আপনার নাম্বার ঠিক আছে। কিন্তু কে বলছেন আপনি?
আমার দরকার আঙ্কেলের সঙ্গে। আঙ্কেল নেই?
আছে। বাবা ঘুমিয়ে আছে। আপনার পরিচয় না দিলে ডাকা যাবে না।
অ। তুমি দীনা! ওপারর কণ্ঠ তরল হয়ে আসে, ছলকে ওঠে উচ্ছ্বাস! এমন বড় মানুষের মত কথা বলছ না, আমি চিনতেই পারিনি!
আমি ডিনা। বড় মানুষের মত নয়, আমি ঢের বড় হয়েছি। কলেজে পড়ি…
অনেকদিন দেখিনি তো! শোনো দীনা, আমি মিন্টু বলছি, আঙ্কেলের সঙ্গে দরকার।
কোন মিন্টু?
স্বপনের ফ্রেন্ড। তোমার মিন্টু ভাই। মনে পড়ছে না?
অ, বুঝেছি। গান মিন্টু। কিন্তু ভাইয়া তো বাড়িতে নেই!
স্বপনের বন্ধুদের মধ্যে দুই মিন্টু। দু’জনকে পৃথকভাবে শনাক্ত করার জন্যে অস্ত্রপ্রিয় মিন্টুকে নিজেদের সার্কেলে সবাই বলে গান মিন্টু। তাই বলে বন্ধুর ছোট বোনের কাছেও ওই নাম শুনতে হবে? মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়।
কণ্ঠে সেই উষ্মা ফুটে বেরোয়,
তোমার ভাইয়া বাড়ি নেই, সেটা খুব ভালোই জানি।
তুমি একটু আঙ্কেলকে ডেকে দাও না! খুব জরুরি দরকার।
সেটা আমাকে বলা যাবে না?
উহ্! ছেলেমানুষি করো না তো দীনা! আমাদের এখন বিপদ চলছে। মাথায় ঠিক নেই। আঙ্কেলকেক ডাকো তাড়াতাড়ি!
আচ্ছা।
এতক্ষণে টেলিফোনের গুরুত্ব কিছুটা অনুভব করে ডিনা। তবু বাবাকে জাগাতে পারে না। কতো রাতে ঘুমিয়েছে তার ঠিক আছে! মেয়ের আনাগোনা দেখে বরং শাহানা বেগম ধস্মস্ করে উঠে পড়ে, এলোমেলো কাপড়চোপড় ঠিক করতে করতে এবং হাই তুলতে তুলতে জিগ্যেস করে,
সাত সকালে কার টেলিফোনরে দীনা!
দীনা সবার কাছেই ডিনা হয়েছে, শাহানা বেগমও আদর করে ডাকে কখনো কখনো। কিন্তু ভুল হয় প্রায়ই। এতদিনেও মন থেকে পুরানো নামটা মুছতে পারে না। ওই দীনাই এস যায় জিভের ডগায়। ডিনাও হয়েছে তেমনই, সবাইকে শুধরে দেবে! উঁহু! দী নায়, ডিনা। কেবল মাকে কিছুই বলবে না, বরং এক চিলতে হাসি উপহার দেবে। সেই হাসি থেকেই শাহানা বেগম বুঝে নেবে! ভুলটা কোথায় হয়েছে। কিন্তু ডিনা সেই তাৎপর্যপূর্ণ হাসিটি না হেসেই মাকে জানায়,
বাবার ফোন।
কে করেছে এত ভোরবেলা?
গানমিন্টু। নাম শুনেছ? ভাইয়ার ফ্রেন্ড। যাও, এখন বাবাকে ডেক দাও।
শওকত আলীকে জাগিয়ে তোলার পরিবর্তে নিজেই ছুটে যায় টেলিফোনের কাছে। ছেলের জন্যে প্রাণ উথালপাথাল করে ওঠে। রিসিভার কানে তুলে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে,
হ্যালো মিন্টু! এই ভোরবলোয় কী খবর?
খবর ভালো না আন্টি। আমি একটু আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলব। জরুরি দরকার।
আমাকে মোটেই বলা যাবে না? যাবে। কিন্তু, আঙ্কেলের সঙ্গেই কথা বলা দরকার আমার।
কী হয়েছে বলো তো!
স্বপনকে আবার এ্যারেস্ট করেছে পুলিশ। অবশ্য তাকে আটকে রাখতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক ছেড়ে দিতেই হবে। আমরা সবাই…
মিন্টু আরো কী সব আশাবাদে উচ্চকিত কথাবার্তা বলতেই থাকে। এদিকে রিসিভারটাই খসে পড়ে হাত থেকে।
শাহানা বেগম অবরুদ্ধ কান্নার ভার দু’চোখে নিয়ে ছুটে এসে স্বামীর বুকে আছড়ে পড়ে! ওগো, একটা
কিছু কর! আমার স্বপনকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে! শুনছ?
স্বপনের মায়ের আহাজারি আর্তনাদে অবশেষে ঘুম ভাঙে শওকত আলীর। ভয়ানক বিরক্তি নিয়ে দু’চোখ মেলে তাকায়, তারপর খবরের সারমর্ম শুনে চোখের পাতা থেকে নিদ্রা টুটে যায়। কিন্তু বিরক্তি যায় না। গজ্গজ্ করে? এ্যারেস্ট তো সে হবেই। এ আর নতুন কী! পুলিশের হাতে এ্যারেস্ট না হলে নেতা হওয়া যায়!
সম্প্রতি এ বাড়ির সঙ্গে স্বপনের সম্পর্ক একেবারেই কমে গেছে। সে থাকে তার পুরনো বৃত্তে। তাঁতিবাজার না লন্ডীবাজারে! কোথায় যেন কোনো এক হিন্দুর পরিত্যক্ত বাড়ি সে দখল করেছে দলবল নিয়ে। সেখানেই তার আসর জমেছে। সেখান থেকেই ওই এলাকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করছে। এই এলাকায় কখনো সে এলেও আসে আন্দোলন সংগ্রাম তথা রাজনৈতিক কাজে। বাড়ি আসতে ইচ্ছে হয় না। রুচিও হয় না। স্বৈরাচারী সরকারের এক মন্ত্রীর সঙ্গে তার বাবার মাখামাখিটা অনেকেরই নজরে পড়ে এবং এ নিয়ে তাকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় বলেই নাকি তার বাড়ি আসা সম্ভব হয় না। কবে কোন ফাঁকে এইসব ছেলে ভুলানো গীত শুনিয়ে গেছে তার মাকে। অকৃতজ্ঞতা আর বলে কাকে! ওই মন্ত্রী যে তাকে মার্ডার কেস থেকে বের করে এনেছে, সে হুঁস আছে! মায়ে পুতে দু’জনেই সে কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে। অথচ দ্যাখো, আবার সেই ঠ্যালায় পড়েছে, অম্নি ওর বন্ধুবান্ধব লেজ নাচিয়ে কাঁইকুঁই শুরু করেছে? আঙ্কেল, ওই মিনিস্টারকে দিয়ে একটু তদবির করে দ্যাখেন না!
স্বপনের বন্ধু গান মিন্টু অবশ্য টেলিফোনে এক রকম বক্তৃতাই করে ফেলে? স্বৈরাচারী সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দল মত নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ এখন এক দফা এক দাবিতে পৌঁছে গেছে। ফলে ওই বিশ্ববেহায়াকে বিদায় নিতেই হবে। যাবার আগে এখন মরণ ছোবল হানছে। স্বপন পড়ে গেছে সেই ছোবলের টার্গেটে।
আপনি একটু দ্যাখেন আঙ্কেল।
’আচ্ছা, দেখছি।’ বলে টেলিফোন ছেড়ে দেয়ার পর শওকত আলী সত্যি সত্যি ভাবতে বসে? এখন সে কী করবে! পানির দামে পাটকল কিনে সদ্য সে শিল্পপতি হয়েছে। অনেকে বলছে, ভাঙাচোরা লোহালক্কড়ের দরে ঝেড়ে দিওে ওটা নাকি কয়েক কোটি টাকার খনি। এ কি সোজা কথা! আবার চলছে ব্যাংক খোলার কথা। পদ্মা মেঘনা যাই হোক, ব্যাংকের টাকায় ব্যাংক খোলা, এ যে রীতিমত মাছের তেলে মাছ ভাজার মৌসুম! প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পর্যন্ত কথা হয়ে গেছে। এখন কি পিছিয়ে আসার উপায় আছে! আর এই সব শুভ উদ্যোগের মধ্যে বারবার মন্ত্রী মহোদয়কে বিরক্ত করাও কি উচিত! তবুও তো পুত্রদায়! তাদের প্রথম সন্তান। কত না আবেগ উচ্ছ্বাসের ফসল? এই স্বপন! সত্যি তার আগমন অনেকটা স্বপ্নের মতোই। যৌবনের প্রথম দিনগুলোতে কোনো কিছু ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই সে এসে পতাকা উড়িয়েছে মাতৃমৃত্তিকায়। সেই বিজয় পতাকা পত্পত্ করে উড়েছে আর এদিকে পিতৃত্বের অহংকারে ফুলে উঠেছে শওকত আলীর বুক, মাতৃত্বের মমতায় আপ্লুত হয়েছে শাহানা বেগমের অন্তর। সেই স্বপনের এমন বিপন্ন দিনে সে নির্বিকার থাকতে পারে! মনের দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে মন্ত্রী মহোদয়কে টেলিফোনে অনুরোধ জানায় শওকত আলী। মজার বিষয় হচ্ছে, একটুও সময় না নিয়ে মন্ত্রী জানিয়ে দেয়, দেখি কী করা যায়! কী নাম যেন ওর..
আলী আহসান স্বপন। সবাই স্বপন নামেই…
আরে নাহ্! পুলিশের খাতায় ওর নাম ঘোড়া স্বপন, আমার মনে পড়েছে? ভেরি মাচ নটোরিয়াস। ডেঞ্জারাস।
মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে যায়। মাঝে মধ্যেই কানে আসে ওই নাম, কাগজেও দেখেছি দু’চার দিন। কোথা থেকে কীভাবে যে মানব সন্তানের নামের আগে ওইসব জন্তু জানোয়ার এসে যুক্ত হচ্ছে, সে রহস্য আজো খুঁজে পায় নি। নদীর পাড় ভাঙা এক দীর্ঘশ্বাস পড়ে আছড়ে, তবু তো আমার সন্তান! একটু দেখবেন। সম্ভবত সূত্রাপুর থানা…
আচ্ছা দেখছি।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে স্ত্রীর কাঁধে দু’হাত মেলে দেয় শওকত আলী। বহুদিন পর সে স্ত্রীর সামনে ডুকরে ওঠে! কী ছেলেই যে পেটে ধরেছিলে!
মন্ত্রী মহোদয় ‘দেখছি’ বলার পরও এক দুই করতে করতে তিনদিন কেটে যায়, তবু সেই দেখা আর চূড়ান্ত অর্থে হয়েই ওঠে না। টেলিফোনে হোক কিংবা সাক্ষাতেই হোক, একই কথা কতবার বলা যায়! এদিকে থানা হাজত থেকে স্বপনকে চালান দেয়া হয় কোর্টে। সঙ্গে যায় দুটি খুনের মামলা এবং ধর্ষণসহ জঘন্য অভিযোগে আরো তিন চারটি মামলার নথিপত্র। স্বপনের বন্ধুরা এখন বাসায় এসে তড়পায়, গর্জায়। তাদের এই গর্জনের সঙ্গে মিশে থাকে অভিযোগের তীব্র ঝাঁঝ? যেনবা শওকত আলী চেষ্টা করলেই স্বপনকে ছাড়িয়ে আনতে পারে, কিন্তু ঠিকভাবে চেষ্টা তদবিরটা হচ্ছে না। কেন, এর আগেরবার পারে নি! ছোট হোক বড় হোক, মন্ত্রী বলে কথা! গতবার মন্ত্রীর এক হুঙ্কারেই হাজতের গরাদ ফাঁক হয়ে গেল, স্বপন হাসিমুখে বেরিয়ে এলো। এবার সেই মন্ত্রী টেলিফোনের হ্যালোটুকুও করছে না।
কেন করছে না?
সেখানেও ঘোরতর অবিশ্বাস? আপনি সেইভাবে বললে ওই মন্ত্রী না করে পারে? ‘সেইভাবে’ মানে কী, তার আবার ব্যাখ্যা নেই। বরং চোখ উল্টে তারা পরোক্ষ হুমকি ঝাড়ে! এভাবে দিন যাবে না আঙ্কেল! দিন ঠিকই বদলাবে। তখন আপনার ওই মন্ত্রীকেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। হয়তো ওদের এই অনুমানই ঠিক। সারা দেশে ততটা তীব্র উত্তাপ ছড়িয়ে না পড়লেও ঢাকা শহর সারাক্ষণ জ্বলছে। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে নগরবাসী। অফিসপাড়া প্রায় অচল। এ দুঃসময়ে মন্ত্রী নিজের কথা ভাববে না তো কি শওকত আলীর ক্রিমিনাল ছেলের কথা ভাববে? খুব ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলে দেছেছে সে? মন্ত্রীদের মনোবল ভেঙে পড়েছে, সর্বদা আশংকা? কখন কী যে হয়ে যায় বলা যায় না।
শওকত আলী একবার মন্ত্রীপত্নী মেহেরজানের স্মরণাপন্ন হবার কথাও ভাবে, তার হাত তো প্রেসিডেন্টের মসনদ পর্যন্ত লম্বা! যদি কোনো কাজে লেগে যায়! কিন্তু অচেনা আড়ষ্ঠতা এসে সে পথও আগ্ধ;লে দাঁড়ায়।
চৌদ্দ.
ব্যাপারটা সুনাম দুর্নামের যা-ই হোক, এ দেশের শ্যামল প্রকৃতি, মাটির ঘ্রাণ, নদীর প্রবহমানতা মানুষকে কবি স্বভাবের করে তুলেছে। খুব সজ্ঞানে না হলেও এই ভূখন্ডের অধিকাংশ মানুষই কবিত্বের মধ্যেই জীবন যাপন করে। এখানে মাঠের চাষীও ছেলের নাম রাখে জলিলের ভাই খলিল, হাশেমের ভাই কাশেম, নবির দবির, যদুমধু?এমনি আরো কত কী। মেয়েদের বেলায় তো কথাই নেইএমনি আরো কত কী। মেয়েদের বেলায় তো কথাই নেই? শেফালি, চামেলি, জুঁই, টগর? রাশি রাশি ফুলের নামে নাম। এ দেশের মা আদর করলে তো বটেই, সন্তানকে গাল দিলেও তাতে কাব্য হয়। কিন্তু তাই বলে সারা দেশের যিনি মাথা, তাঁর নাকি কবিতা লিখলে চলে! আধুনিক রাষ্ট্র থেকে রীতিমত কবিদের নির্বাসিত করার পরামর্শ যেখানে দিয়েছেন মহামতি প্লেটো, তার বদলে এই বাঙালমুলুকে খোদ রাষ্ট্রপ্রধানই যদি হন কবিপ্রবর, তা হলে সেই রাষ্ট্র চলে! কবিতা তো মানুষের মনকে কাদামাটির মত নরম করে দেয়, আবেগপ্রবণ প্রেমিক করে তোলে; তখন শক্ত সিদ্ধান্ত নেয় কী করে? ফুলের কাজ গন্ধ বিলিয়ে যাওয়া। তার সামান্য কাঁটা কত রক্ত ঝরাতে পারে? সে তো ফণিমনসা নয় যে কেবলই কণ্টকাকীর্ণ? উদোম গায়ে ইয়ার্কি মারতে মারতে নূর হোসেন মরেছে? কী করবে কবি! অল্পবয়সের ছেলেপিলে এঁড়ে বাছুরের মত একটু বেশি লাফায়, একটু বেশি হইচই করে ঠিকই, তাই বলে নিজের শরীরটাকে ওইভাবে সাইনবোর্ড বানানোর কোনো মানে হয়! দ্যাখো জীবন্ত সেই সাইনবোর্ডেও কী চমৎকার কাব্য সুষমা? স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক। মূর্খ পুলিশ নাকি কাব্য বোঝে! দিল গুলি চালিয়ে। ডাক্তারি ফেলে ডাক্তারদের সমিতি করে বেড়ায় যে ডাক্তার, চলমান স্বৈরাচার- বিরোধী আন্দোলনে কী যে অপরিসীম অবদান তার, সে কীনা রফে গোয়ার্তুমি করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে গুলি খেয়ে মরেছে। কে জানে, কাজী নজরুলের কবরের পাশে ঘুমাবার সাধ জেগেছিল কী না তার! এই দারিদ্র্যপীড়িত দেশে একটা ডাক্তার হওয়া কি চাট্টিখানি কথা! অথচ দ্যাখো? কী দারুণ হেলাফেলায় গুলির মুখে ডা. মিলন উড়িয়ে দিল সেই মহামূল্য জীবন! এইসব নিষ্ফল জীবনপাতের কোনো মানে হয়! এখানে যাহা বায়ান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন। আজ যে দাবীতে এত লম্ফঝম্ফ, এত জ্বালাও পোড়াও, কদিন পরে মানুষ সব ভুলে যাবে, সব সয়ে যাবে। মাঝেথেকে অনেকগুলো জীবন অসময়ে ঝরে গেল। এদেশে গণতন্ত্র কবে এমন মুক্তি পেয়েছে? মৃত্যু যেভাবেই হোক, এত রক্তপাতে কবি কি বিচলিত না হয়ে পারেন? কবি চিরদিনই রক্তপাতকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন। এমন কী যুদ্ধক্ষেত্রেও তার এই একই দর্শন? যত কম রক্তপাতে যুদ্ধজয় করা যায় তত সেনাপতির সাফল্য বাড়ে। তাই তে তিনি প্রায় রক্তপাতহীন এক অভিনব অভ্যুত্থান প্রক্রিয়ায় একদিন ক্ষমতাশীর্ষে আরোহন করেছিলেন। এখন এই অবতরণকালে এইসব অন্ধ বধির রক্তপাত তার কবিচিত্তকে যারপরনাই ব্যথিত করে তোলে। ফলে তিনি আর কতক্ষণ অনড় অটল হয়ে বসে থাকবেন! এমনিতেই এক শিল্পী কী একখান খচ্চর মার্কা ছবি আঁকতে আঁকতে নাটকীয় ভঙ্গিতে পটল তুললেন; যাবার আগে বিশ্ববেহায়াটায় কী যা তা না রটিয়ে গেলেন! শিল্পী হবেন অহিংস! এই কি অহিংস নীতি! আপনাকে তো কেউ গুলিটুলি করেনি! তা হলে এ রকম নাটকীয় মৃত্যুর কী প্রয়োজন ছিল! আপনিও কি মরণের ভালে আঁকতে চেয়েছেন জীবনের জয়টিকা? এ সব হেঁয়ালি ভালো লাগে না কবির। ‘প্রবল গণ আন্দোলনে দেশ কাঁপছে’ বলে দুর্মুখ কাগজঅলারা যতোই গলা ফাটাক, ঐ কাঁপুনিকে ডিসেম্বরের ভরা শীতের স্বাভাবিক কাঁপুনি বলেই গন্য করেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট; তবু কবিত্বজনিত কোমল স্বভাবের কারণে একদিন তিনি কাহারও দ্বারা প্ররোচিত না হইয়া স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে পদতাগ করেন। এ তো কেবল মলমূত্র ত্যাগের মত সাধারণ কোনো ঘটনা নয়, কিংবা নয় বীর্য ত্যাগের মতো কোনো ব্যাপারও। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আসনে আসীন মহামহিম ব্যক্তি দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসাবশত মমত্বখচিত আসনটিই ত্যাগ করলেন।