উপন্যাস

উপন্যাস।। ভালবাসার লাল পিঁপড়ে।। আনোয়ারা সৈয়দ হক।। পর্ব ছয়

সালমা আজ লাঞ্চ-এর সময় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছে। মন ভাল লাগছিল না। শুধু যে
ভাল না লাগা তা নয়, কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মত লাগছিল। পাগল, পাগল মনে হচ্ছিল
নিজেকে। বুকের ভেতর থেকে তীব্র, তীক্ষ একটা গরম শিস উঠছিল ওপরের দিকে। একবার
মনে হচ্ছিল বুকটা দুফালা হয়ে যাবে। পেটের ভেতর থেকে মাঝে মাঝেই দমক মেরে
উঠছিল বমির। কিন্তু রুমালে মুখ চেপে রাখার জন্যে বমি ঠিক হচ্ছিল না, ওয়াক উঠছিল
শুধু।
সালমা হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিল। ধানমণ্ডি অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হয়ে সে
মিরপুর রােডে এসে দাঁড়াল। তার সামনে দিয়ে প্যাঁ পোঁ করে হর্ন বাজাতে বাজাতে বাসগুলো
ছুটে যেতে লাগল। বেবিট্যাক্সি, টেম্পাে, রিকশা তার চারপাশে। সালমা তাকিয়ে দেখল কত
লােক, কত হাজার হাজার লােক এখন এই মিরপুরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। কেউ
কাউকে চেনে না। অন্তত সালমা এদের কাউকেই চেনে না। চেনা কোনো লােকের সাথে
এখন দেখা হােক সালমা তা চায়ও না। অচেনার জনারণ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলাটাই
সালমার এখন উদ্দেশ্য। রােদ চড়া হয়ে উঠেছে এই দুপুরে। চামড়ার ভেতর দিয়ে ছুরির
ফলার মত কষে দাগ কেটে দিচ্ছে রােদ্দুর। কিন্তু সালমার তাতে একফোঁটা কষ্ট লাগছিল না।
আরাে বেশি রােদ্দুর হলেও যেন কিছু আর এসে যায় না। সূর্যটা যদি হঠাৎ মন পাল্টে এক
হাত নিচে নেমে আসে আর প্রকৃতি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, আসমান ঝলসানাে কয়লা হয়ে
ফুটপাতে পড়ে থাকে তাহলেও কোনাে দুঃখ নেই। বস্তুত পৃথিবী নামক গ্রহটি এই মুহূর্তে
শেষ হয়ে গেলেই সালমার জন্যে ভাল। সামাজিক লজ্জার হাত থেকে অন্তত সালমা
চিরদিনের জন্যে বেঁচে যেতে পারে।

হাঁটতে হাঁটতে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল পার হয়ে গেল সালমা। নিউমার্কেটের দিকে এগুচ্ছে সে।
তার মনের ভেতরে এলােমেলাে চিন্তার ঝড়। এ ক’দিন হাসানের মুখের দিকে সরাসরি
সে তাকাতে পারে নি। যে মুখ এতদিন ছিল তার চেনা, তাই যেন রাতারাতি অচেনা হয়ে
গেছে। গােপনে বা আড়ে আড়ে যতবার সে আজকাল হাসানকে দেখে, তাকে হাঁটতে-
চলতে, কথা বলতে বা খেতে দেখে ততবার কেন জানি হাসানকে তার চোর চোর মনে হয়।
মনে হয়, এই কি সেই হাসান? এই তার প্রিয়তম? এর জন্যেই কি সে মায়ের অবাধ্য মেয়ে।
হয়েছে? যতবার এসব কথা মনে উঠেছে, ততবার তার বুকের ভেতরে জ্বলে উঠেছে ক্ষোভের
আগুন। শুধু ঘুমিয়ে থাকলে হাসানকে কেন জানি নিস্পাপ মনে হয়। একবার লাল
হাসান একবার সবুজ হাসান হয়ে সারারাত তার চোখের সামনে ঘুমিয়ে থাকে হাসান আর
সারারাত জেগে থেকে সালমা তাকে দেখে। লাল হাসানকে মনে হয় রক্তজবা আর সবুজ
হাসানকে মনে হয় কলাপাতার মত সবুজ। রাতের বেলা হাসান যতক্ষণ জেগে থাকে কতবার
করে যে বােঝায় সালমাকে। এইতাে গতকাল রাতেও কতবার করে সে বুঝিয়েছে।
ফিরােজাকে কান মলে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছে। চিৎকার করে গতকালও
বলেছে, তুই আমার নামে মিথ্যে করে কেন লাগিয়েছিস ফিরু? এতে তাের কী স্বার্থ? আমি
তাের কী ক্ষতি করেছি? বেরিয়ে যা তুই আমার বাড়ি থেকে।

ফিরােজার তাে বাড়ি ছেড়ে যেতে আপত্তি নেই। বিন্দুমাত্র নয়। শুধু তার পাওনা টাকাগুলাে
মিটিয়ে দিলেই সে ফুপুর হাত ধরে চলে যাবে। কিন্তু ওখানেই যত গণ্ডগােল। সালমা চায়
না ফিরােজা চলে যাক। ব্যাপারটার ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ফিরােজা চলে গেলে সালমা
জীবনেও হাসানের সাথে ঘর করতে পারবে না। কিন্তু তার বিস্ময় লাগে একথা ভেবে যে
হাসান কখন মেয়েটার গায়ে হাত দিল! তার ঘর হল দু’টো। একটা শােবার, একটা বসার।
বসার ঘরে হাসান তার কম্পিউটার এনে রেখেছে। অনেক রাত পর্যন্ত অফিসের কাজকর্ম
করে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সে কাগজপত্র নিয়ে বসে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ
হয়ে যায়। ফিরােজা রান্নাঘরের সামনে যে করিডােরটুকু আছে সেখানে মশারি খাটিয়ে
ঘুমােয়। প্রথম প্রথম দরজা খুলেই ঘুমােতাে ওরা। কিন্তু বাসাবাড়ির কাজের মেয়েরা ইদানীং
খুনখারাপি করতে থাকায় ছিটকিনি লাগিয়ে ঘুমােয়। হাসান পাশের ঘরে কাজ করতে বসলে
সালমা বিছানায় শুয়ে মাথার কাছে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়তে বসে। পড়া মানে গল্পের
বই পড়া। সালমার নিজস্ব কোনাে প্রিয় লেখক নেই। হাতের কাছে যা পায় তাই পড়ে।
ম্যাগাজিন থেকে খবরের কাগজ বা কোনো ভাল লেখকের বই হাতে পেলেই সে পড়ে।
দু’দশ পাতা পড়তে পড়তে তার চোখে ঘুম এসে যায়। তখন সে প্রায়ই উচ্চকণ্ঠে ডাক দেয়
হাসানকে। বলে তার ঘুম এসে যাচ্ছে, সে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। আর হাসান প্রায়ই বলে, আর
একটুখানি বাকি আছে জান, তুমি ঘুমােও, আমি আসছি। হাসান তাকে বিয়ের আগে থেকেই
জান বলে ডাকে। সালমাও হাসানকে ডাকে জান। মাঝে মাঝে সােনা মানিক বলে বটে তবে
সে অতি ঘনিষ্ঠতার সময়। বাঙালির কালচারে প্রেয়সী বা প্রিয়তমকে জান বলা অবশ্য নেই,
কিন্তু বর্তমানের বাঙালি কালচার অনেক দোঁআশলা হয়ে গেছে। ক্রমাগত হিন্দি সিনেমা
ভিসিআর – এ বা ডিশ – এ দেখা এর অন্যতম কারণ। কিন্তু সালমা বা হাসানের কাছে এগুলাে
কোনাে ফ্যাক্টর ছিল না। মনের স্বতঃস্ফূর্ত ডাকই ছিল তাদের, জান।

ঘুমােতে গিয়ে হাসান প্রায় রাতেই জাগিয়ে তুলত সালমাকে। আর ভীষণ বিরক্ত লাগত তখন
সালমার। হাসানকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হতাে। এই পুরুষ শুধু তার প্রয়ােজন হলে স্ত্রীর
কাছে আসে। স্ত্রীর ডাকে আসে না, এমনি মনে হতাে তার। ক্লান্তিতে ভেঙে আসত তার
শরীর। ভােরে উঠে কত কাজ তার। দুর্বিনীত একটি কাজের মেয়ে নিয়ে তার সংসার।
ভােরে না উঠলে সাড়ে আটটার ভেতরে অফিস রওনা হতে পারবে না। সে অফিসে যাবার
আগেই হাসান বেরিয়ে যায়। হাসান যায় আটটায়। মােহাম্মদপুরের নূরজাহান রােডে বাসা
ভাড়া নিয়েছে তারা। হাসানের অফিস মতিঝিল। ঠিক সাড়ে আটটার ভেতরে হাসান পৌঁছে
যায় সেখানে। আটটার পরে হলে রাস্তায় ভিড় জমে যায়। অফিসে পৌঁছােতে দেরি হয়।
নিজেদের অফিস হলেও খুব কড়া ডিসিপ্লিনের ভেতরে রেখেছে হাসান সবকিছু। এখন
জীবনে উঠে দাঁড়াবার সময়। এসময় কোনােকিছুর শিথিলতা কাম্য নয়। কিন্তু সালমারও
কিছু ডিসিপ্লিন আছে। তাকেও ঠিক সময়ে অফিসে হাজিরা দিতে হয়। হাজিরা খাতায় নাম
সাইন করতে হয়, পাশে সময় লিখতে হয়। দেরি মাসের ভেতর এক বা দু’দিন হতে পারে,
সবদিন তাে নয়। এই অবস্থায় রাতে যখন সে ঘুমের সাগরে, তখন হাসান তার ঘুম ভাঙিয়ে
দিত। ইদানীং এসব কারণে মনের ভেতরে বিরক্তি হয়ত জমেছিল কিছু। প্রায় হাত দিয়ে
ঠেলে সরিয়ে দিত তাকে। দু’একসময় কটু কথাও বলেছে। ’তােমার তাে নিজের অফিস,
আমারটাও কি নিজস্ব? ’একথাও বলেছে মাঝে মাঝে। সত্যি বলতে কী, দাম্পত্য জীবনটা
কেমন একটা রুটিনের মত হয়ে এসেছিল ইদানীং। একঘেয়েমির ছোঁয়া এসেছিল। কীভাবে
এসেছিল জানে না সালমা। হয়ত মা এবং ভাইদের অমতে বিয়ে করার জন্যে সে অত্যন্ত
সতর্ক অবস্থায় ছিল বেশ কিছুদিন। সবকিছু আস্তে আস্তে কিছুটা নরম হয়ে এলে আবার
তাদের সম্পর্ক পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে এই আশা ছিল মনে মনে। আসছিলও তাই। কিন্তু
রাজধানীতে দু’জন মানুষের কারাে সাহায্য ছাড়াই মাথা উঁচু করে দাঁড়ানাে চাট্টিখানি কথা
ছিল না। সালমা ভাইদের কাছ থেকে কোনাে সাহায্য নেয় নি। নেবার প্রশ্নই ওঠে না। বাবা
যে বাড়ি এবং অন্যান্য সম্পত্তি রেখে গেছেন তার ভাগ এখনাে সে পায় নি।
কবে পাবে জানে না।

আদৌ পাবে কী না তাও জানে না। নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করার জন্যে হয়ত সম্পত্তি থেকেও
ভাইয়েরা তাকে বঞ্চিত করতে পারে। তবে এসব নিয়ে সালমার কোনাে মাথাব্যথা নেই।
রাস্তা দিয়ে আপন মনে হাঁটতে লাগল সালমা। এখন সময় কত সে জানে না। হাতের ঘড়ি
দেখতে চায় না সে। ঠিক একটায় সে অফিস ছেড়ে বেরিয়েছে। দু’টোর ভেতরে আবার
ফিরতে হবে। অধিকাংশ লােক এই সময় অফিসে বসে গল্প গুজব করে, খাবার খায়, পান
সিগারেট খায়। অনেকে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। অনেকে ব্যক্তিগত কাজ সেরে নেয় চট করে।
সালমার মনে পড়ল সে হাসানের দিকে আজকাল কেন যেন কোনাে খেয়াল করত না।
কেন যেন তার মনে হত হাসানেরই দায়িত্ব তার দিকে খেয়াল করা। তার সুযােগ সুবিধের
দিকে নজর রাখা। স্রোতের বিপরীতে সালমা হাসানের জীবনে প্রবেশ করেছে। হাসানের তাই
কর্তব্য সালমাকে আদর যত্নে ভালবাসায় ভরিয়ে দেয়া। এতবড় আত্মবিসর্জনের পর এটুকু
সালমার প্রাপ্য— এই মনে হতাে তার। এটা কি তার জীবন সম্পর্কে ভুল ধারণা ছিল? সালমা
জানে না। দাম্পত্য জীবনকে সফল করে তুলতে স্বামী ও স্ত্রীকে কি সমানভাবে পরিশ্রম
করতে হয়? সালমা জানে না। সালমার মনে পড়ল একদিন রাতের বেলা হাসান তাকে আদর
করতে করতে বলল, আমি আরেকটু সলভেন্ট হলে তােমাকে আর কাজে যেতে দেব না জান।
তখন তােমাকে আমি যখনই কাছে চাইব, তখনই পাবাে। হাসানের কথা শুনে টপ্ করে
সালমা বলে উঠল, তা কী করে হয়? এটা তাে সলভেন্সির প্রশ্ন নয়, স্বাবলম্বী হবার প্রশ্ন। তুমি
হাজার রােজগার করলেও আমাকে কাজ করতে হবে। আমি বাড়িতে বসে থাকতে পারব না।
মনে করাে সমাজের একজন পুরুষ শিক্ষার্থীকে সরিয়ে আমি ভার্সিটিতে স্থান করে নিয়েছি।
বা অন্য আরেকটি মেয়েকে সরিয়ে আমি ভর্তি হয়েছিলাম। হয়ত আমার জায়গায় সেই পুরুষ
বা মেয়েটি ভর্তি হলে সমাজের অনেক কাজ হতাে। হয়ত তারা এমন কিছু কাজ করত যাতে
তাদের পরিবারের উন্নতি হয় বা সমাজের দশজন লােকের উপকার হয়। আর আমি সে
জায়গায় কাজই করব না, তা হয় না হাসান।

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই রাতের ঘটনাটার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল সালমার। আর
তক্ষুণি মনে হল, ভুল, মস্তবড় ভুল কাজ করে ফেলেছে সালমা। ব্যবহারটা সে ভাল করে নি
স্বামী আদর করে তার স্ত্রীকে বলছে, আমি সলভেন্ট হয়ে উঠলে তােমাকে আর বাইরে
কাজ করতে দেব না, তখনি স্ত্রীর নিজের কাজ করার পেছনে ফিলােসফিটা ওভাবে বর্ণনা না
করলেও চলত। স্বামীর আদরটাকে আদরের মত নেয়া উচিত ছিল। বুদ্ধিমতী স্ত্রীরা এমন
ব্যবহার করে যে কোনাে বুদ্ধিমতী স্ত্রী তখন নিজের অতীত ভুলে, শিক্ষা ভুলে, এমনকী
নিজের কর্মদক্ষতা ভুলে আদুরে গলায় বলত, কত মজা হবে তখন। আমি সারাদিন পায়ের ভুল
দিয়ে বসে থাকরো আর গল্পের বই পড়ব। আর স্বামী তখন বলবে, না, তা হবে না। আমি বাসায়
ফিরে এসে যেন দেখি আমার বউ আমার জন্যে সেজেগুজে বসে আছে। তার কপালে টিপ
থাকবে, চোখে কাজল, খোপায় জড়ানাে থাকবে রজনীগন্ধার মালা, গায়ে থাকবে কস্তুরী
আতরের গন্ধ। এরপর হেসে উঠবে দুজনে। অথচ দু’জনেই মনে মনে জানবে, এর
কোনােটাই পুরােপুরি সত্যি হয়ে উঠবে না। মিথুন ক্রিয়ার আগে বা ও নারী- পুরুষের,
স্বামী-স্ত্রর কত রকমের রঙঢঙ, কত রকমের সত্যিমিথ্যে কথা, কত খুনসুঁটি।

Series Navigation<< উপন্যাস।। ভালোবাসার লাল পিঁপড়ে।। আনোয়ারা সৈয়দ হক।। পর্ব পাঁচউপন্যান।। ভালবাসার লাল পিঁপড়ে।। আনোয়ারা সৈয়দ হক।। পর্ব সাত >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *