উপন্যাস।। ভালোরাসার লাল পিঁপড়ে।। আনোয়ারা সৈয়দ হক।। পর্ব দুই


মেয়েটা বাড়িতে ঢুকেছিল একেবারে হতচ্ছরি অবস্থায়। বেলিখালাই প্রথম দেখেছিল তাকে। রােদে জ্বলে যাওয়া চুল, রুক্ষ চামড়া, দাঁত উচু, কালাে কুচকুচে রঙ, নাকের ওপর একটা আঁচিল। প্রথমে দেখে একেবারে ভক্তি হয় নি সালমান। বয়স তেরো চৌদ্দ হবে বা তার চেয়ে আরাে একটু বেশি। শুকনাে শরীরে বয়স অনেক সময় লুকোচুরি খেলতে ভালবাসে। তবে মাসিক শরীর খারাপ যে তার হয় তাতে নিঃসন্দেহ। তার বুকের গঠন বাড়ন্ত এবং অনেকটা দৃষ্টিকটুভাবে বাড়ন্ত। তার চোখ দুটো বর্তুলাকার এবং সেই চোখে এক ধরনের শীতল কাঠিন্য। তাকে কোনাে কিছুর নির্দেশ দিলে সে স্থির হয়ে নির্দেশকারীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপাত দৃষ্টিতে যদিও মনে হয় সে মন দিয়ে কথা শুনছে, আসলে সেটা সত্যি নয়। সে প্রায়শ অন্যমনস্ক থাকে। মানুষের চোখের দিকে তাকালেও যেন একেক সময় মনে হয় সে তার দৃষ্টির ভেতর দিয়ে আরাে দুরে পৌছুতে চায়, আরও গভীরে। সবচেয়ে বড় অস্বস্তি হল খুশির কথা বললে মেয়েটা হাসে না। ধমক দিলে কাঁদে না। রাগ হলে তার কপালের শিরা দুটো দপদপ করে লাফাতে থাকে। চোখের দৃষ্টি তখন সুদূর হয়ে যায়। নিজের পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে এক ধরনের উদাসীনতা তাকে পেয়ে বসে। সে নাক খুটতে থাকে। গলা টানে। হাতের তর্জনী আর বুড়াে আঙুল দিয়ে গােল তৈরি করে ছিটকে সে গােল খুলে ফেলে। কখনাে ওড়নার প্রান্ত দিয়ে হাতের মুঠি চেপে ধরে রাখে। প্রথম দিন মেয়েটাকে চোখে দেখেই সালমার মনে হয়েছিল মেয়েটা দুর্বিনীত হবে। কিন্তু সংসার করতে গেলে ঐ যা হয়। একটা একটা করে দিন কাটে। দিনগত পাপক্ষয়ের। ভেতরে মানুষের অবস্থান থিতু হয়ে আসে। এমনকী সালমা তার তরুণীসুলভ মন নিয়ে ফিরােজাকে খুশি করতেও চেষ্টার ত্রুটি করেনি। সে পথ থেকে কিনে এনে দিত তাকে চুলের ফিতে, লাল কাচের চুড়ি, গলার হার, নাকের নাকফুল। একেক সময় একেকটা। রাস্তায় চলাফেরা করতে গিয়ে যেখানেই তার বেবিট্যাক্সি থামত বা রিকশা সে চোখ চালিয়ে দেখে নিত ফিরুকে খুশি করার জন্যে কিছু কেনা যায় না। খাদ্য খাবারের দিক থেকেও সালমা অনেক উদার ছিল। কদবেল, পেয়ারা, আমলকি, জাম্বুরা, পেপে যা সে নিজে খেতে পছন্দ করত তা ফিরুর জন্যেও আলাদা করে কিনত সে। এত কিছু করেও সালমার ভেতরে একটা ক্ষোভ ছিল। তা হলাে, উপহারের জিনিস হাতে পেয়ে ফিরােজাকে কখনাে খুশি দেখা যেত না। এমনভাবে সে উপহার গ্রহণ করত যেন এগুলো তার পাওনা, যেন এগুলো দিতে সালমা বাধ্য এই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেই সে এ বাড়িতে পদার্পণ করেছে। সালমার আরও অস্বস্তি হতাে যখন সে দেখতো ফিরােজা, কেউ তাকে লক্ষ করছে না ভেবে, দিব্যি টেলিভিশনের সামনে বসে প্রােগ্রামগুলাে মন দিয়ে উপভােগ করছে। তখন তার মুখের কঠিন রেখাগুলাে কোথায় যেন মিলিয়ে যেত, চোখের দৃষ্টি থেকে সুদূরের ভাব সরে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠত হাসির ঝিলিক, হানিফ সংকেত – এর প্রােগ্রাম দেখেতাে খিলখিল করে হেসেই উঠত সে। বক্তার প্রশ্ন – উত্তরের সাথে সাথে মাথা দোলাত। ছায়াছবির গান ও দৃশ্য দেখে তার মুখের ভাব ঘনঘন পাল্টে যেত, সেখানে এই সুখ, এই দুঃখ, এই রাগ, এই আনন্দ, এই কৌতুক। অথচ যখন সালমা আর হাসান বসে থাকত সামনে বা কোনাে আত্মীয়স্বজন, তখন তার চেহারা একেবারে গম্ভীর, কখনাে বা ভাবলেশহীন। টেলিভিশনে হাজার হাসির নাটক হলেও সে হাসত না। আবার সেখান থেকে উঠেও যেত না। গ্যাট হয়ে টিভির দিকে মুখ করে বসে থাকত। তখন তার কাছে এক গ্লাস পানি চাইলে সে না শােনার ভান করত। জোর করলে তার কপালের রগ দুটো লাফাতে শুরু করত। আচার – আচরণে বুঝিয়ে দিত যে টিভি দেখার সময় কোনাে প্রকারের ঝামেলা সে পছন্দ করে না। ওদিকে আজকাল টেলিভিশনে এত রকমের প্রােগ্রাম থাকে যে, এমনকী বিটিভিতেও এত ধরনের নাটক, প্যাকেজ প্রোগ্রাম, গান, ছায়াছবি, সচিত্র অনুষ্ঠান ইত্যাদি যে প্রায় প্রতিদিনই সালমা কাজ থেকে বাসায় ফিরে দেখত ফিরােজা টিভি খুলে তার সামনে মাটিতে লেপ্টে বসে আছে। দরজায় বেল শুনেই কোনাে রকমে দরজাটা খুলে দিয়ে, এমনকী কে ঢুকল তার মুখের দিকে তাকিয়েই অনেক সময় সরে গিয়ে টিভির সামনে বসে পড়ত সে। একবার সালমার এক দূরসম্পর্কের খালু চিটাগাং থেকে ঢাকায় সালমার সাথে দেখা করতে এলে এভাবে দরজা খুলে দিয়েছিল সে। অনেকক্ষণ পর খেয়াল হতে চমকে গিয়ে দেখল তার ঘরের ভেতরে ঢুকে বসে আছে এক নতুন আগন্তুক। তার গায়ে আলখাল্লা, মাথায় টুপি, গালে ঘন কালাে চাপদাড়ি আর হাতে বিশাল বড় এক রুপার হাতল বাঁধানাে লাঠি। ফিরােজা ভেবেছিল বুঝি হাসান বাসায় ফিরে এসেছে। বেলিখালাই যােগাড় করে দিয়েছিলেন ফিরােজাকে। ফিরােজার ডাক নাম ফিরু। এই নামে তাকে সবাই ডাকে। বেলিখালার বান্ধবীর পাশের বাসার প্রতিবেশীর মা তার নিজের বাড়ি থেকে ফিরুকে পাঠিয়েছিলেন। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে কয়েকটা গ্রাম ও ছােট দুটো নদী পার হয়ে অন্য এক গ্রামে ফিরুর এক ফুপু থাকে। সেই ফুপু সাথে করে ফিরুকে এনে দিয়েছিল বান্ধবীর পাশের বাড়িতে। প্রতিবেশী ফুপুসহ পাঠিয়েছিল বেলিখালার বান্ধবী ফারজানার কাছে। ফারজানা বেলিখালাকে ডেকে ফুপুর সামনে ফিরুকে তুলে দিয়েছিলেন বেলিখালার হাতে। তারপর বেলিখালা নিজের গাড়ি করে ফিরুকে নিয়ে এসেছিলেন সালমার বাসায়। সালমারা দুই-ভাই, দুই-বােন। তাদের সবার সাথে বেলিখালার সম্পর্ক খুব ভাল। আপন মায়ের পেটের বােন না হলেও বেলিখালাকে তার নিজের মতই দেখে। সালমার মা তার বাড়ির একমাত্র মেয়ে হওয়ায় নিজের আর কোনাে বােন নেই। বেলিখালা হলেন সালমার মায়ের আপন খালাতাে বােন। সােস্যাল ওয়ার্ক করে বেড়ানাে বেলিখালার এক রকমের হবি। বাড়িতে বসে থাকতে মন চায় না বলে এইসব করে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। নানাবিধ মহিলা সংগঠনের সঙ্গেও বেলিখালা নিজেকে জড়িত রেখেছেন। মা নয়, বেলিখালাই সালমার সংসারের সুবিধা অসুবিধার খবর রাখেন। চাকরির ক্ষেত্রে সালমা এমনিতে খুব প্রমিজিং। এর জন্যে তার কোনাে এক্সট্রা খাটুনি করতে হয় না। দৈনন্দিন রুটিন কাজকর্মের ভেতরেই নিজেকে বেশ গুছিয়ে তুলতে পারে। তার ব্যবহার, আচার আচরণ সকলের পছন্দ। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে বলে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ককে সে অবহেলা করে না। সাধ্যমত শ্বশুর – শাশুড়ি, ননদ – ভাসুর ও জাদের খোঁজ খবর করে। ঈদে বকরিদে রাজশাহী যায় বা তারা আসে। সালমা এমনিতে খুব খােলা মনের মেয়ে। অবশ্য তার রাগ জেদ একটু বেশি। কিন্তু বােঝালে বােঝে। সালমার স্বামী হাসানও তার চলাফেরায় যথেষ্ট স্মার্ট এবং আত্মবিশ্বাসী। তাছাড়া হাসান। হৃদয়বানও। বাড়ির ভেতরে ও বাইরে সকলের সাথে তার ব্যবহার অত্যন্ত মার্জিত। এই রকম ব্যবহার তাকে কেউ শেখায় নি, নিজে থেকে সে অর্জন করেছে। মফস্বলের ছেলে। হলেও হাসানের ভেতরে নাগরিক সভ্যতার সুস্পষ্ট ছাপ আছে। এ যার হয় তার হয়, সকলের হয় না। বাড়ির কাজের মেয়েদের প্রতি হাসান যথেষ্ট যত্নশীল কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করে। বস্তুত কাজের মেয়েদের সাথে সে খুব কম কথাই বলে। সালমা যেভাবে সংসার চালায় সেভাবে চলে। সালমার ইচ্ছাতেই হাসান লেখাপড়া শেষ করে রাজশাহী ফিরে না গিয়ে ঢাকায় থেকে গেছে। সালমা এ ব্যাপারে সচেতন। প্রেম ভালবাসার ক্ষেত্রে সালমাই আগে এগিয়েছে, হাসান পরে। পরে অবশ্য হাসান বলেছে সালমাকে অনেক আগে থেকেই মনে মনে সে কামনা করলেও নানা কথা ভেবে বেশিদূর এগােয় নি। হাসান জানত সালমার বাবা মৃত্যুর আগে পূর্তমন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। সচিবের মেয়েকে চট করে ভালবাসলেই হাত বাড়িয়ে পাওয়া যায় নাা। কাজের মেয়ে ফিরুর চেহারা দেখে সালমার নিজের যাই মনে হােক, হাসান কিন্তু বেশি পছন্দ করে নি। সে – ই প্রথম আপত্তি তুলেছিল। এর আগে কোননাদিন সে সালমার ঘর সংসার বা কাজের মেয়েদের চেহারা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। কিন্তু ফিরুকে দেখে বলেছিল, এত ছােট্ট একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে এরকম একটি মেয়ে রাখছ শামু! এর চেহারা দেখলে তাে মানুষের মাথা। গরম হয়ে যাবে। যে বাসা বড় এবং অনেক লােক, সেখানে এ মেয়ে মানিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের এই ছােট্ট সংসারে নয়। সালমা হাসানের আপত্তি শুনে অবাক। ফিরু কুৎসিত বটে, কিন্তু কাজের মেয়ে সুন্দর হলেই যে কাজ সুন্দর হবে তার তাে কোনাে গ্যারান্টি নেই। হাসানকে সে কথা বলতে হাসান বলেছিল, তা তাে বুঝি শামু। যুক্তি দিয়ে বুঝি। কিন্তু এই আড়াই কামরা ঘরে সর্বক্ষণ একটা মুখগােমড়া কালো মেয়ে বিশাল ক্ষুব্ধ দুটো চোখ বের করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা চোখে দেখতেও তাে শোভন হবে না হাসানের কথা শুনে হেসে ফেলেছি। আড়াই নাগরা বাসায় মুখ গোমড়া কালাে মেয়ে। বেশ। সে অপাঙ্গে তাকিয়ে বলেছি, আড়াই কামরা বাসায় ক্লিওপেট্রা। কোনােদিন আসবে না কি ভেবেছিলে? অথবা নেফ্রেতিতি? শুধু ভেবেছিলামই না। নিয়েও এসেছি। এই বলে সালমার গালে একটা ঠোনা মেরে হাসান তার মুখ চুম্বন করেছিল। যাই হােক থেকে গেল ফিরােজা অর্থাৎ ফিরু। অস্থায়ীভাবে কাজ ঠেকানাে কাজের মেয়ে হিসেবে বাসায় এলেও থাকতে থাকতে আট মাস হয়ে গেল তার। তবে এই আটমাস সালমার সুখে কাটে নি। ফিরুর মুখ গোমড়া ভাব সালমার অতি ভাল ও মিষ্টি কথাতেও পরিবর্তন হয় নি। খাওয়ার ব্যাপারে তারা মাত্র তিনটি গ্রাণী। যদি কোনােদিন হঠাৎ করে মেহমান এসে পড়ত, মুখ ভার করে রাখত ফিরু। যেন মেহমান চলে গেলেই সে খুশি। একদিন সালমার ছােট চাচা এল নবীনগর থেকে। সকালে এসে রাতের বাসে ফিরে যাবে। কিন্তু ফিরুর সেদিন মেজাও খারাপ সকাল থেকে। চা, নাস্তা, দুপুরের খাবার সবকিছু সে পরিবেশন করল দাপিয়ে ঝাপিয়ে। বাথরুমে ভেজা কাপড় ফেলে রাখল হাসানের। সালমার ভেজা তােয়ালে পড়ে থাকল। পরনের পেটিকোট ও ব্লাউজ সাবান পানিতে জড়াজড়ি হয়ে মুখ আটকে লাগল বাথরুমের নর্দমার। ঘরদোর উল্টাপাল্টা করে। ঝাড়মেছি করতে লাগল। ডাকলে ডাকের সাড়া দেয় না। টেবিলে থালা সাজিয়ে রেখে পানি দেয় না। লবণ, আচার, পাতিলেবুর প্লেট সাজিয়ে রাখে না। কোনোরকমে দাঁত চেপে সবকিছু সহ্য করে ছােট চাচাকে রাতের বাসে তুলে দিয়ে ফিরােজাকে নিয়ে পড়ল সে। সালমা রেগে চোখ ঘুরিয়ে বলল, বাড়িতে কোনাে মেহমান দেখলে তাের গা জ্বালা করে তাই ফিরাে? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া প্রয়ােজন মনে করল না। রান্নাঘরে ঢুকে হাড়িপাতিল এপাশ ওপাশ করতে লাগল। ওর ব্যবহার দেখে রাগে গা জ্বলে গেল সালমার। সেও তার পেছন পেছন রান্নাঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে বলল, কথার জবাব দিস না যে? বাড়িতে একজন মেহমান দেখলেও তাের হিংসা হয় তাই না রে? ক্যান আমার আবার হিংসা কীসের? আপনাগাে মেহমানে আমার হিংসা কী? মুখ ঘুরিয়ে হঠাৎ বসে উঠল ফিরােজা। শুনে একেবারে ক্ষেপে গেল যেন সালমা। আরো জোরে চিৎকার করে বলল, তুই ভেবেছিস কী আঁ? তােরে ছাড়া আমাদের চলবে না, এই ভেবেছিস বেয়াদব কাহিকা? উত্তরে ফিরােজা বলল, আমি গরিব মাইনষের মাইয়া। আমারে ছাড়া আপনাদের চলব না একথা ভাবুম ক্যা? এসব ভাবনা তাে আপনাদের। মেয়েটার স্পর্ধা দেখে সেদিন অবাক হয়েছিল সালমা। আর সেইদিনই সালমার উচিত ছিল। তাকে বিদায় করে দেয়া। কেন যে ভীমরতি ধরল তার! কেন যে সেদিন বিদায় করে দিল না মেয়েটাকে! কেন যে কাজের মেয়ে – শূন্য সংসারে কল্পনা তার মানসিক পরিমণ্ডলে আতঙ্কের সৃষ্টি করল। বিছানায় শুয়ে অন্ধকারে নিজের বােকামির কথা চিন্তা করে নিজের মাথার চুল এখন ছিঁড়তে লাগল সালমা। গোছা গোছা চুল এখন মুঠি পাকিয়ে ছিড়ে তুলতে লাগল সে মাথার তালু থেকে দরজার ওপারে তখন স্টার প্লাস সজোরে গান গেয়ে উঠেছে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। ভালোবাসার লাল পিঁপড়ে।। আনোয়ারা সৈয়দ হক।। পর্ব একউপন্যাস।। ভালোরাসার লাল পিঁপড়ে।। আনোয়ারা সৈয়দ হক।। পর্ব তিন >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *