উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব ছয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এক
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব দুই
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফকিুর রশীদ ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব ছয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। শেষ পর্ব
ছয়
খুবই অবাক করা বিষয় হচ্ছে, শওকত আলীর পদত্যাগপত্র নিয়ে পরে আর একটি কথাও তোলেন নি মনিরুজ্জমান সাহেব।
কীভাবে যে তিনি ওই আর্মির বাচ্চা আর্মিও এতদসংক্রান্ত সাধ পূরণ করেছিলেন, সে ব্যাখ্যাও নিজে থেকে কখনো দেননি। এ
নিয়ে শৗকত আলী সামান্য কৌতূহল দেখালেও অসামান্য উদাসীনতার অদৃশ্য দেয়াল তুলে তিনি ঠিকই এড়িয়ে গেছেন। বরং
কৌশলে পুরানো প্রসঙ্গ তুলে শওকত আলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, ওই যে সেদিন তুমি জানতে চাইলে না আর্মির
বাচ্চা আর্মি জিনিসটা কী রকম? আসলে ব্যাপার হয়েছে কী জানো তো… এভাবেই নতুন এক গল্প ফেঁদে বসেন মনিরুজ্জামান
সাহেব। সেই গল্পের ডালপালা থেকে আবার ডালপালা গজায়, গল্প এগিয়ে চলে ঠিকই, কিন্তু মূল প্রসঙ্গে আর ফেরা হয় না তাঁর।
সাধারণত ঘৃণ্য কিছু প্রানীর বংশ পরম্পরা উল্লেখ করে মানুষকে গালি দিতে শোনা যায়, শুনতে শুনতে প্রায় সবার কানও অভ্যস্ত
হয়ে গেছে; তাই বলে আর্মিও বাচ্চা আর্মি?
এটা কেমন কথা?
এ নিয়ে একাধিকবার তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। প্রতিবারই তিনি এ গল্পে সে গল্পে পাশ কাটিয়ে যান। এবার নিজে থেকেই
ওই প্রসঙ্গ তুললেন, বলতেও চাইলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূল ব্যাখ্যা আর বলাই হলো না; অসংখ্য শাখা প্রশাখার বিস্তারী গল্পের
ঝাঁপি সহসা বন্ধ করেন এবং চোখ গোল কওে আঁৎকে ওঠেন,
কটা বাজে সে হুঁশ আছে? এ্যাঁ?
বসুন তো মনির ভাই! এত ছটফট করছেন কেন?
শওকত আলী শান্ত স্বরে বলে। কিন্তু মনিরুজ্জামান সাহেব ভীশন ব্যস্ততা দেখান,
হ্যাঁ, দিলে তো আজকের দিনটার বারোটা বাজিয়ে!
এমন সব গল্প তুলে দাও না এখন আমি অফিসে যাই কী করে!
ও হ্যাঁ, আপনার তো অফিস আছে! মাথার উপরে আর্মির বাচ্চা আর্মি!
ইয়ার্কি হচ্ছে! শোনো, তোমার মত হাত পা গুটিয়ে আমি তো এখনো ডাঙায় উঠতে পারিনি!
আমাকে তো অফিসে যেতেই হবে!
আপনার ডাঙায় ওঠা! সে আর হবে না মনির ভাই।
দাঁড়াও দাড়াও! তোমাকেও ডাঙা থেকে আবার নামাচ্ছি জলে।
আহা সে তো আর চাকরি নয়! আপনি বললেন যে বিজনেস!
হ্যাঁ। বিজনেসই তো!
আচ্ছা মনির ভাই! আমার নেই পুঁজিপাট্টা, আমাকে দিয়ে ব্যবসা হবে?
হবে। খুব হবে। মনিরুজ্জামান সাহেব হা হা করে হেসে ওঠেন। যেনবা শওকত আলীও মজা পায়,
বাহ! বেশ মজা তো!
তোমার পুঁজি তুমিই। এবার শওকত আলী হাসে সশব্দে।
অন্যপক্ষ ধমকানি দেন,
হাসছ কেন, বলো তো! শোনো শওকত, ঘটে বুদ্ধি থাকলে টাকা পয়সার পুঁজি তত লাগে না, বুঝেছ?
আমার তাহলে বানিজ্যবুদ্ধি আছে বলছেন?
অবশ্যই আছে। পয়সার পুঁজি অনেকেরই আছে। বুদ্ধির পুঁজিটা কিন্তু সবার নেই।
শওকত আলী উঠে দাঁড়িয়ে গলা খ্যাঁকারি দিয়ে কেশে কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলে,
আপনার বিবেচনায় শওকত আলীর সেটা আছে।
জ্বি জনাব।
বেশ। সম্ভাব্য ভ্রাতৃকলহ পরিহারের স্বার্থে মেনে নেয়া হলো। তা এখন আমাকে কী করতে
হবে ভাইজান।
চাকরিতে রিজাইন করে এ রকম বসে খেলে চলে? কাল সকালে একদম রেডি থাকবে,
আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
কিন্তু কোথায়?
দামড়া বলদকে আর কোথায় নিয়ে যাব! সোজা জোয়ালের তলে!
দু’জনেই একযোগে হেসে ওঠে হো হো করে। সেই হাসির তোড়ে শাহানা বেগমের হাতে
চায়ের ট্রে কেঁপে ওঠে টলমল করে। বাসায় যেদিন মনিরুজ্জামান সাহেব আসেন, সেদিন
সে নিজে হাতেই ঘন্টায় ঘন্টায় চা পরিবেশন করে। এই মানুষটা যে সাংঘাতিক চায়ের
পোকা, সেটা অনেক আগেই বুঝেছে শাহানা বেগম।
সামনে ট্রে নামিয়ে সে বিনর কুণ্ঠায় চায়ের পেয়ালা বাড়িয়ে ধরে,
ভাইজান, আরেক কাপ চা!
আবারও চা! আজ আমি অফিসে যাব কখন, বলো দেখি!
চা খান তো মনির ভাই! অফিস আপনাকে ছাড়বে না।
ছাড়বে না? দাঁড়াও। আমিই অফিস ছেড়ে দিচ্ছি।
এই আস্ফালনে মোটেই আস্থা পায় না বলে শওকত আলী উচ্চস্বরে হা হা করে হেসে ওঠে।
মনিরুজ্জামান সাহেব পিরিচে ঢেলে চা জুড়িয়ে চুমুক দেন এবং এদিকে চোখ কটমট করে তাকান
সাত
মাত্র দিন দশেকের মাথায় মনিরুজ্জামান সাহেব সত্যি একদিন সকালে শওকত আলীকে
ধরে নিয়ে যান তাঁর বিজনেস ফার্মে। অফিস বলতে বড় কিছু নয়। জিরাফের মত মাথা উঁচু
এক বিশাল বিল্ডিঙের থার্ড ফ্লোরে এসে মাঝারি সাইজের দু’টো কী আড়াইটে রুম নিয়ে
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-মৌসুমী এন্টারপ্রাইজ। কিসের ব্যবসা? কী বৃত্তান্ত? সাদা চোখে কিছুই
বুঝা যাবে না। এ জগত সম্পর্কে সামান্যতম পূর্বধারণাও যার নেই, সে এসে দেখবে ঝকঝকে
তকতকে ওয়েল ডেকোরেটেড অফিসরুম। ভারী পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে মনে হবে
অন্যজগতে এসে পড়েছি।
দুই রুমের একটিতে বসেন এ প্রতিষ্ঠানের মালিক কাম ম্যানেজিং ডিরেক্টর মনিরুজ্জামান।
অন্যটিতে তৌফিক উদ্দিন এবং টাইপিস্ট মর্জিনা সুলতানা। তৌফিকউদ্দীনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
মনিরুজ্জামানের সঙ্গে দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা আছে বলে সে দাবি করে।
অফিসিয়াল কার্টিসি অনুযায়ী স্যার সম্বোধন করলেও আড়ালে আবডালে মনিরুজ্জামান সাহেবকে
সে মামা বলে। ছেলেটি ভালো। মূলত এ বিজনেসের ভেতর বাহির সবটাই দেখভাল করে ওই তৌফিক।
সন্ধ্যার পর ঘন্টা দুয়েকের জন্যে এমডি সাহেব এসেব সব কিছু বুঝে নেন, চিঠিপত্র দেখেন,
নতুন চিঠিতে সই স্বাক্ষর করে ডেসপাচে দেন; সবশেষে এ্যাকাউন্টস মিলিয়ে রাত ন’টার মধ্যে
বাসায় ফিরে যান। এই তাঁর রুটিন। সেই রুটিনের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সকালবেলায় শওকত আলিকে
সঙ্গে নিয়ে এসে মনিরুজ্জামান সাহেব সোজা এমডি’র চেয়ারে বসিয়ে দেন, তৌফিক উদ্দীনের
সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, নতুন এমডি শওকত আলী আমার ছোটভাই। এখন থেকে ও-ই
সার্বক্ষণিকভাবে দেখাশোনা করবে। তৌফিক সালাম কর।
তৌফিকউদ্দীন আদেশ মান্য করে ঠিকই। হাত উঁচিয়ে সালাম জানায়। কিন্তু দু’চোখের ভুরু
কুঁচকানোতেই বুঝা যায় পুরো ব্যাপারটাকে সে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করতে পারছে না। চোরাচোখে
শওকত আলীকে দ্রুত দেখে নেয় সে।
তারপর বলে, মর্জিনা সুলতানাকে ডেকে দেব স্যার?
মনিরুজ্জামান সাহেব চোখ গোল করে তাকান,
কেন? মর্জিনাকে কী দরকার?
নতুন এমডির সঙ্গে পরিচিত হবে।
নতুন এমডির সঙ্গে নয়, বলো নতুন স্যারের সঙ্গে পরিচিত হবে।
জ্বি স্যার। সাত্তার মিয়াকেও ডাকব স্যার?
সাত্তার মিয়া বয়স্ক মানুষ। লেখাপড়া বিশেষ জানে না। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া কান্ডজ্ঞান তার কম নয়। এ অফিসে
সবারই ফাইফরমাশ খাটে একান্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। কারো বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ নেই। সবার সঙ্গে পরিচয় পর্ব
সারা হলে মনিরুজ্জামান সাহেব সত্যি সত্যি গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে পুরো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তুলে দেন শওকত আলীর
কাঁধে। এ ব্যবসার গোড়ার কথাও খানিক খুলে বলেন। তিনি জানান, বিমানবন্দর কেন্দ্রিক ক্লিয়ারিং ফরোয়ার্ডিংয়ের ধান্দাপাতির
হাতেখড়ি হয় তাঁরই এক মামাশ্বশুর আলহাজ্ব আবু বকর সিদ্দিকের কাছে। আহ! লোকটা আজ বেঁচে নেই! বিমানবন্দরে চাকরি
করতেন বলে অনেককে এ ধরনের ব্যবসায়িক সুযোগ করে দিয়েছেন, কিন্তু নিজে কারো কাছ থেকে বাড়তি সুযোগ কিংবা দু’পাঁচ
পয়সার পার্সেন্টেজও গ্রহণ করেন নি। সেই মামা শ্বশুরের কাছে মনিরুজ্জামান সাহেব গিয়েছিলেন চাকরি বাকরির ধান্দায়।
তিনি চাকরি না দিয়ে এই পথের সন্ধ্যান দিয়েছিলেন। সেই থেকে লেগে থাকা। যৌবনের শুরুতে চাকরির প্রতি মোহ ছিল এবং
স্ত্রীরও পীড়াপীড়ি ছিল বলেই কয়েক মাসের মধ্যে কর্পোরেশনের এই চাকরিটা হয়ে গেলে তিনি এ সুযোগটা হাতছাড়া করেননি।
চাকরি পাশাপাশি ব্যবসাও ধরে রেখেছেন জোড়াতালি দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে জোড়াতালি মোটেই নয়। চাকরিটাকে গ্রহণ করেছেন
নিশ্চিত আয়ের উৎস এবং সামাজিক মর্যাদার ভিত্তি হিসেবে। কিন্তু ব্যবসার দিকেও যথেষ্ট সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। নিজে বেশি
সময় দিতে পারেননি, উদ্যমী পরিশ্রমী লোক রেখেছেন। তৌফিক উদ্দীনের আগেও দু’জন লোক ওই পোস্টে চাকরি করে গেছে।
বরাবরই সন্ধ্যেবেলার তদারকিটুকু নিজেই করে এসেছেন নিয়মিত। তাতেই সোনা ফলেছে। ক্লিয়ারিং ফরোয়ার্ডিংয়ের সঙ্গে
এক্সপোর্ট-ইমপোর্টও যুক্ত হয়েছে অনেক আগেই। ব্যবসা কেবল মিানবন্দরেই এখন আটকে নেই; বেনাপোল, দর্শনা, আখাউড়া
সহ নানান স্থলবন্দরেও ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে। ফলে শওকত আলীর মত নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল ও কর্মঠ মানুষের খুবই দরকার
হয়ে পড়েছে।
কিন্তু তাই বলে এমডি?
ওই হলো! এ দেশে মুসলমান মাত্রই এমডি। তুমিও তর বাইরে নও। হা হা করে হেসে পরিবেশ হালকা করে দেন মনিরুজ্জামান সাহেব।
কিন্তু এতবড় জোঝা কাঁধে চাপানো হচ্ছে সে মোটেই হাসতে পারে না। বরং গজ গজ করে ওঠে, ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার!
মনিরুজ্জামান সাহেব পূর্বাপর হাসতে হাসতেই
সিরিয়াস কথা বলেন,
এমডি বলি অথবা আর যে নামেই পদটা চিহ্নত করি না কেন, দায়িত্ব তোমার। তুমি হাল ধর, আমিও শিগ্গিরই চলে আসছি।
আপনি সত্যি চাকরি ছেড়ে আসবেন মনির ভাই?
এতক্ষণ হাসির পরও তিনি বলেন, হাসালে দেখছি শওকত। ওই আর্মির বাচ্চা আর্মির অধীনে চাকরি করা যায়! তোমার মত ভদ্রলোক
পারেনি, আমিই বা কদিন পারব বলো!
না না মনির ভাই, আপনার বিজনেস আলটিমেটলি আপনাকেই দেখতে হবে। আমি ততদিন আগলে রাখার দায়িত্বটুকু নিচ্ছিমাত্র।
ব্যাস। তুমি সেটুকুই নাও।
এরপরও তিনি গম্ভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে আশ্বস্ত করেন, আমি তো আছিই। সন্ধ্যের পর আমি ঠিকই আসব।
প্রকৃতপক্ষে মনিরুজ্জামান সাহেবের সেই সান্ধ্য আগমনও মাস দুয়েকের মধ্যেই অনিয়মিত হয়ে ওঠে। যখনই আসুন সার্বিক
খোঁজখবরটুকু রাখেন এই পর্যন্তই। চাকরি ছাড়ার কথা তাঁর মুখে শোনাই যায় না। এদিকে তৌফিক উদ্দীনকে হাত করেই এই
নতুন ধারার কাজকর্ম শিখতে হয় শওকত আলীকে। তৌফিক তো প্রথমে তাকে পাত্তাই দিতে চায়নি। এমডি মনিরুজ্জামান
সাহেবের ভাগ্নে, তার দাপট তো কম নয়! এ অফিস তো এতদিন সে-ই চালিয়ে আসছে! হঠাৎ নতুন মানুষের কী যে এমন
প্রয়োজন হলো কে জানে! মর্জিনাকে সঙ্গে নিয়ে জোট বাঁধে, ঘোট পাকায় শওকত আলীর বিরুদ্ধে। আবার কখনো বা এই
ভাবনারও উদয় হয় অন্তরে এতদিন পর মামা কি তাকে কোনো কারণে অবিশ্বাস করছেন?
শওকত আলী দুর্বল এই পয়েন্ট ধরেই তৌফিককে কাছে টানে। খুব কাছে থেকে দেখতে গিয়েই টের পায়,
ছেলেটি অত্যন্ত সহজ সরল। তার মামা সবার সামনে ভাগ্নে হিসেবে স্বীকৃতি দেন না বলে দীর্ঘদিনের এক কষ্ট তো আছেই,
নতুন কষ্ট যোগ হয়েছে এই অবিশ্বাস থেকে। শওকত আলী অবিশ্বাসের প্রসঙ্গটা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয়। তার মনে এই আস্থা
ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে যে মনিরুজ্জমান সাহেব এখনো তাকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। এমন কী সে নিজেউ
তৌফিকউদ্দীনের কাছ থেকেই কাজ শিখতে চায়। আগের চাকরির অভিজ্ঞতা যতই থাকুক, ইনডেন্ট-ইনভয়েস কিংবা
ক্লিয়ারিং ফরোয়ার্ডিংয়ের কী জানে সে! এভাবে একটুখানি নত হলে তৌফিকউদ্দীনও খানিক এগিয়ে আসে। সে প্রস্তাব রাখে,
আমার মামা যখন আপনাকে ছোটভাইয়ের মত জানে, আমি তো তাহলে আপনাকেও মামা ডাকতে পারি!
ডাকবেন? শওকত আলী অবাক চোখে তাকায়, এই অফিসেই ডাকবেন?
তৌফিকউদ্দীন আহত হয়। চোখ নামিয়ে নেয়। শওকত আলী বুঝতে পারে এবং মেনেই নেয় বেশ, মামাই ডাকবেন।
সত্যি বলছেন মামা? তৌফিকউদ্দীনের চোখেমুখে উপচে পড়ে খুশি, তাহলে আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন
তো? আমি তো এখন ভাগ্নে!
আচ্ছা, সে হবে এক সময়।
এক সময় না। এখন থেকেই।
আচ্ছা।
জগৎ সংসারে কত রকম যে মানুষ আছে আর মানুষের যে কত রকম অপূর্ণতা থাকতে পারে, কে কবে তার হিসেব মিলিয়েছে!
দিনে দিনে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবার পর উন্মোচিত হলো যে তৌফিকউদ্দীনের মায়ের কোনো ভাইই নেই, সে মামা পাবে কোথায়!
অথচ মামা সম্বোধনটি নাকি তার খুব প্রিয় সম্বোধন। মামা ডাকলে তাকে সবচেয়ে আপনারজন মনে হয়, চোখ বন্ধ করে তার
উপরে নির্ভর করা যায়, তার কথায় জীবন উৎসর্গ করা যায় এই রকম তার ব্যাখ্যা। মামাকে নিয়ে তার এই রকম আদিখ্যেতা।
মনিরুজ্জামান সাহেবের কাছ থেকে না হোক, শওকত আলীর কাছ থেকে প্রকাশ্যে মামা সম্বোধনের অনুমতি লাভের পর সত্যিই
তৌফিকের আচরণ ও শিষ্ঠতাবোধ পাল্টে যায়। শিশুর সারল্য নিয়ে অকপটে নিজেকে মেলে ধরে মামার সামনে।
প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় মনিরুজ্জামান সাহেবের প্রাণখোলা সহযোগিতা এবং নবলব্ধ ভাগ্নে তৌফিকউদ্দীনের আন্তরিক আগ্রহ ও
প্রচেষ্টায় মাস তিনেকের মধ্যে শওকত আলী যখন নতুন কর্মবাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মোটামুটি খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং
সত্যি বলতে কী নিজেকে পুরোপুরি গুছিয়েও উঠেছে, এমনি সময় নারী কণ্ঠের একটি টেলিফোন এসে হঠাৎ তার ভেতর বাহির
কেমন এলোমেলো করে দেয়। এ অফিসে টেলিফোন মূলত একটাই। সেটা এমডি সাহেবের টেবিলে থাকে। কিন্তু তারই একটা
প্যারালাল লাইন টানা আছে পাশের ঘরে তৌফিকউদ্দীনের টেবিলে। দিনের বেলা যত ফোন আসে তা ওই তৌফিকউদ্দীনই রিসিভ
করে, সন্ধ্যের পর মনিরুজ্জামান সাহেব নিজেই ধরেন দীর্ঘদিন এখানে এরকমই চল হয়ে আছে। ব্যবস্থাটা শুরু থেকেই ভালো লাগে
না শওকত আলীর। কিন্তু এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করে না। মনে মনে ঠিক করে রাখে, কিছুদিনের মধ্যে আরো একটা টেলিফোনের
জন্য টি এ্যান্ড টি তে আবেদন করতে হবে। তো এরই মাঝে এক পড়ন্ত বিকেলে টেলিফোন বেজে ওঠে। নিত্যদিনের মত বাজতেই
থাকে। শওকত আলী ফাইল থেকে একবার চোখ তুলেও আবার ফাইলেই মনোযোগ দেয়। প্যারালাল লাইনে পাশের ঘর থেকে ফোন
রিসিভ করে তৌফিকউদ্দীন। কিন্তু এক নিমেষেই এ ঘরের পর্দা ঠেলে সে উঁকি দেয়,
মামা, আপনার ফোন।
শওকত আলী বিস্মিত হয় আমার ফোন?
এমন ঘটনা খানিকটা অভিনবই বটে। অফিসিয়াল ফোন তো তৌফিকউদ্দীনই রিসিভ করে, তবে কি ব্যক্তিগতভাবে তাকে খুঁজছে কেউ?
এই অফিসের ফোন নম্বর সে কাউকে দিয়েছে বলেও সহসা মনে পড়ে না। তবু দ্বিধান্বিত হাতে রিসিভার তুলে কানে লাগায়,
হ্যালো!
রিনরিনে এক নারীকণ্ঠ সুরের নিক্কন তুলে বলে, হ্যালো! কে বলছেন?
আপনি শওকত ভাই বলছেন তো?
জ্বি বলছি। আপনি?
আপনি ভালো আছেন ভাই?
আছি। কিন্তু আপনি কে বলছেন!
আমার কথা বাদ দিন। নতুন কর্মস্থল আপনার কেমন লাগছে?
আপনাকে না চিনলে আমি সে কথাই বা জানাব কেন!
ঘনঘোর কুয়াশার অবগুণ্ঠন যেনবা মিষ্টি হাসির ঝিলিকে চমকে ওঠে। শওকত আলী বিস্মিত হয়,
হাসছেন তো বেশ। আপনার পরিচয় বলুন।
আমার পরিচয় কোনো গুরুত্বপূণৃ বিষয় নয়, তাই বলছি না। কিন্তু আপনার খবরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমার খবর আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেন?
তা তো বলতে পারব না ভাই!
নাহ্! এই হেঁয়ালি ভালো লাগছে না।
বেশ তো, ফোন ছেড়ে দিন তাহলে!
এ্যাঁ! চমকে ওঠে শওকত আলী। বুঝতে পারে না এটা কোন ধরনের কথা হলো!
বলছি ভালো না লাগলে আপনি ফোন রেখে দিন!
শওকত আলী ভারি বিব্রত বোধ করে, টেলিফোন নামিয়ে রাখতে হবে তাকেই! ভালো না লাগলে রেখে দিন এ কথার মানে কী!
চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে নাকি?
আচ্ছা, আপনার পরিচয় লুকাচ্ছেন কেন বলুন তো!
আবারও ওপারে এক চিলতে হাসির আবীর ছড়ায়,
লুকাইনি তো! বলেছি ওটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। ছিলেন চাকরিতে, এলেন ব্যবসা বাণিজ্যে মানিয়ে নিতে পারছেন তো?
আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই তো জানেন দেখছি!
ওইটুকুও জেনে নেবেন।
বেশ। তাই হবে। জেনে নেব।
তবু বলবেন না আপনি কে?
আপনি অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছেন শওকত ভাই। এখন রাখি। পরে কথা হবে আবার।
হ্যালো! হ্যালো!
ওপারে রিসিভার নামিয়ে রাখা হয়েছে ক্রাডেলে। শওকত আলী বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে নিজের হাতের রিসিভারের দিকে।
অস্ফূট কণ্ঠে বলে ওঠে এ সবের কোনো মানে হয়! সেও ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখে ফোন। মনে মনে হাতড়ায় কে এই মহিলা!
হাসিটুকু যেন ভারি চেনা চেনা মনে হলো! চেনা হাসি? নিজেকেই ধমকায় সে আবার কবে কার হাসির সূত্র প্রভেদ খুঁজতে গেল!
পাশের রুম থেকে তৌফিকউদ্দীন উৎকণ্ঠিত গলায় জানতে চায়,
কোনো খারাপ খবর না তো মামা?
খারাপ খবর? কই, না তো!
নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই অচেনা লাগে। কেঁপে ওঠে। ভেঙেচুরে যায়। তৌফিক অবশ্য আর কোনো প্রশ্ন করে না। নিজের
কাজে চলে যায়। কিন্তু শওকত আলীর ভাবনা হয়, এই মহিলা প্রথমে কী বলেছিল তৌফিককে! কিন্তু সে কথা এখন ডেকে শুধাতে
যাওয়াও কি ঠিক হবে! মাথা খারাপ! কৌতূহলের গন্ধ পেলে কী ভাবতে কী ভাববে তার ঠিক আছে!
শওকত আলী নিজেই খুক খুক করে একটুখানি হেসে ওঠে। নিজের সঙ্গেই রসিকতা করতে ইচ্ছে হয় জীবনের মধ্যবেলায় নারী
কণ্ঠের সামান্য একটুখানি টেলিফোন সংলাপে সে এমন উতলা হয়ে উঠছে কেন? সে কি কারো কাছে কিছু লুকাতে চাইছে?