উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। প্রথম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। প্রথম পর্ব। কৃতজ্ঞতা, মেহেদী হাসান সোহান (সোহান হাসান)

আজ খুব সকালে ঘুম ভেঙেছে তার। সে প্রায় শেষ রাতে; তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। ইদানীং মাঝে মাঝে এরকম হয়। অকারণে ঘুম ভেঙে যায় হয়তো মাঝরাতেই। তারপর বাকি রাতটুকু কাটে নিদ্রাহীন। সিডেটিভে কোনো কাজ হয় না, অন্য কোনো ভাবেও না। ডাক্তার দেখিয়েছে সে বার কয়েক। গত মাসে পশ্চিম জার্মানি গিয়েছিল ব্যবসার কাজে। ওখানে থরো চেক- আপ করালো। মোটা টাকা খরচ করলো ডাক্তারের পেছনে। সে এক এলাহী ব্যাপার, কত রকম সে পরীক্ষা! অথচ অত কিছুর পর ফলাফল ছোট্ট, এক লাইনের। ডাক্তার জানালো, হি ইজ পারফেক্টলি অল রাইট। না, শরীরের কোথাও কোনো খুঁত নেই তার। তবে ঘুম হয় না কেন কোনো কোনো রাতে? কেন উদভ্রান্তের মতো বসে থাকতে হয় বিছানায় কিংবা চেয়ার টেনে বারান্দায়? তবে ঘুম না হলেও পরদিন কোনো ক্লান্ত বোধ করে না সে। ডাক্তার বলেছে তবে আর চিন্তা কি? কারো কারো এমন হয়। দু’ঘণ্টার ঘুমেও সে যদি সুস্থ থাকে, তবে এ নিয়ে ভাবতে হবে না– স্থানীয় ডাক্তারদেরও এই একই কথা।

তবু অস্বস্তিটুকু তার থেকে গেছে। এখন কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই, এক সময়ের মতো টানা পালিয়ে বেড়ানো নেই, শঙ্কা আর উদ্বেগে থাকা নেই, এখন তো প্রায় সবকিছুই তার হাতের মুঠোয় কিংবা আয়ত্তের মধ্যে। তাহলে ঘুম হয় না কেন! ঘুম ভাঙার পর কতক্ষণ সে ক্লান্ত-বিষণ্ন মুখে বসে থাকলো বিছানায়। তবে সে অল্প সময়ের মধ্যে মৃদু বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে পারলো। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে মেঝেতে নামলো। শীত শীত লাগছে। এয়ার কুলারটা অফ করে দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল বারান্দায়। পুরো বাড়ি ঘুমে নিথর হয়ে আছে। সে এবার ভাবলো রুম্পাকে ডাকবে। বাড়ির এই মেয়েটির সঙ্গেই তার যেটুকু সখ্য। প্রথম সন্তান; তাই তার সঙ্গে একটা আলাদা সম্পর্ক। পরের ছেলে-মেয়ে দু’জন, ইস্তিয়ার আর শম্পা। ওদের সঙ্গে একটা দুরত্ব থেকে গেছে তার। ওরা যখন বড় হচ্ছে, তখন সে নিজেকে আর নিজের ব্যবসা গুছোতে ব্যস্ত। সে দুরত্ব আজও কাটেনি। তেমন সুযোগও পাওয়া যায়। ইস্তিয়াক অবশ্য এমনিতে তাকে এড়িয়ে চলে। কখনো এমনও হয়, টানা এক সপ্তাহ নিছক ‘হুঁ’ হ্যাঁ’ ছাড়া কোনো কথাই হয় না তাদের। শম্পাও প্রয়োজন না পড়লে কাছে ঘেঁষে না। এ নিয়ে তার অবশ্য মাথাব্যথা বা আক্ষেপ নেই। সময় কোথায় তার? বাড়িতে কতটা সময়ই বা থাকছে সে। সকালের ব্রেকফাস্টেও টেবিলে দেখা, প্রায় প্রতিদিন। এটা কোনো নিয়ম নয়, যেভাবেই হোক সকালের নাস্তার টেবিলে তারা এক হয়ে যায়, মাত্র এটুকুই। অবশ্য রাতেও দেখা মেলে, যদি সে আর্লি ফেরে বাড়িতে; তবে দেখা হওয়া পর্যন্তই, ব্যস। ছেলে-মেয়েদের কথা ভাবতে ভাবতে এক মুহূর্তের জন্য স্ত্রীর কথাও মনে হয় তার। শম্পা তার মা’কে বলে, ‘দ্যাট ফ্যাট ওল্ড লেডি’। তারও এ কথাটিই মনে হল এ মুহূর্তে। অবশ্য স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞও সে। কত রকম আপদে-বিপদে পাশে থেকেছে তার। তার জন্য ঝামেলা সয়েছে অনেক। তা সেও কিছু কম করেনি। স্ত্রীকে দিয়েছে পুরো স্বাধীনতা, পর্যাপ্ত অর্থ। যা ইচ্ছে করুক সে, আপত্তি নেই তার। শুধু তার বিষয়ে নাক না গলালেই হল। তবে ফ্যাট লেডি এই গুড। নাক তার ব্যাপারেও গলায় না। সে নেমে এলো নিচে; বাইরের বারান্দায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। বারান্দায় এক কোণে এক সেট সোফা। সে এসে বসলো সেখানে। সোফার ওপর গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছিল ফক্স টেরিয়ারটা। জেগে উঠে তাকে দেখে লেজ নেড়ে সরে এল। পাশে বসে মুখ রাখলো তার উরুর ওপর। কুকুটার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে তাকালো সে, এদিকে-ওদিকে। ঘুম ভাঙার পর এই প্রথম তার মুখে হাসি ফুটলো। মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে, চারদিকে তাকাতে তার বড় ভালো লাগে। না তাকালে ঠিক ঠিক বোঝা যায় না অবস্থান, বোঝা যায় না গত ষোল-সতেরো বছরে কতটা ওপরে সে উঠলে। এ সময় তাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ ডেকে উঠে ফক্স টেরিয়ারটা। হঠাৎ, কি ব্যাপার! সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় এদিকে-ওদিকে। না, খামোখা ডেকে উঠা! কেউ নেই, কিছুই নেই কোথাও। সে আশ্বস্ত হতে হতে ভাবে তবে একটা ওয়াচডক কেনা দরকার। ইদানীং এরকম মনেহচ্ছে। ফক্স টেরিয়ারটা আছে, থাকুক; পেট-ডক। তবে পশাপাশি দরকার পাহারা দিতে পারা কোনো কুকুর। কী কিনবে? জার্মান শেফার্ড? সে ঠিক করলো, ডোবারিম্যান পিনশ্যর কিনবে।

আজ তার টাইট স্কেজ্যুল। সারে বারোটায় পাকিস্তান থেকে আসবে আবদুল্লাহ সাঈদ। এই একটি যথেষ্ট। আবদুল্লাহ সাঈদকে সশরীরে রিসিভ করতে হবে, হোটেলে নিয়ে তুলতে হবে, এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে। খুব সেনসিটিভ ব্যাপার। পান থেকে চুন খসলে পার্টি বিগড়ে যেতে পারে। তখন? এসব অবশ্য গুছিয়েই রাখা আছে। তাছাড়া বিডি তো আছেই তার পাশে। বিডি পাশে থাকলে যেকোনো বড় কাজে নিশ্চিন্ত সে। বিডি নিজেই বলে, ‘হোয়েন দেয়ার ইজ আ উইল দেয়ার ইজ আ ওয়ে’ এ কথাটি মুছে যাবে এক সময়। ওখানে লেখা হবে, ‘হোয়েন ইজ বিডি দেয়ার ইজ আ ওয়ে’। হো হো করে হেসে উঠলে সে। ফক্স টেরিয়ারটা ডেকে ওঠে, তার মুখের দিকে তাকায়। সেটার পিঠ চাপড়ে দেয় সে। ‘ইজি ইজি, নাথিং টু ওয়্যারি অ্যাবাউট।’ ব্রেকফাস্টের টেবিলে সে এসে বসার পরপরই শম্পি আসে। বসে পা দোলায় আর আড়চোখে তাকে লক্ষ্য করে। রুপা আর ইস্তিয়াকের দেখা নেই। এই সুযোগে শম্পা তাকে খোঁচায়, ‘আচ্ছা বাবা, ধর আমি একমাসের জন্যে স্টেটসে যেতে চাইলাম, এই ধর একটা, আরে ঐ কি যেন বলে…হ্যাঁ, শিক্ষামূলক সফরে। তা, কেমন লাগবে তোমার?’

‘গুড’- সে মাথা ঝাঁকালে। ‘খুব ভালো লাগবে। যাচ্ছিস নাকি?

‘ইয়েস, থিংকিং সো। তুমি টাকাটা দিয়ে দাও, আমি চলে যাই।’

হাসলো সে। ‘অত টাকা যে নেই আমার।’

‘আহ’ শম্পা হাত নাড়ালো-‘য়ু আর নট আ মাইজার, আর য়ু?

‘না, তা নই কক্ষনো। তবে অত টাকা আমার নেই সত্যি।’

শম্পা গম্ভীর মুখে টোস্ট বাটার লাগাতে লাগাতে বললো –‘ওয়েল, আমি তোমাকে টাকা খরচ করার একটা ভালো বুদ্ধি দিয়েছিলাম।…কখনো যদি অ্যান্টি-করপশন ধরে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার এত ব্লাক মানি কেন?- তখন বুঝবে।’

সে ভেতরে ভেতরে চমকালো খুব। শম্পা সেটা লক্ষ্য করেনি দেখে আশ্বস্ত হল। হাতের টোস্টটা সে নামিয়ে রাখলো পিরিচে। জোর করে একটুকরা হাসি ফুটালো মুখে। শম্পার দিকে তাকালো সরাসরি-
‘ইয়াং লেডি, তোমার পাপা সম্পর্কে এই বাজে তথ্য তোমাকে দিল কে?’

টোস্ট আর বাটরি-নাইফ নামিয়ে রাখলো শম্পা। দু’হাতের কনুই টেবিলের ওপর রেখে মুখ রাখলো হাতের চেটোয়। তাকে খুব উৎফুল্ল দেখালো-‘কোন তথ্য পাপা? ‘

‘এই যে ব্লাক-মানি, অ্যান্টি-করাপশন এসব?’

শম্পা কাঁধ ঝাঁকালো, খুব অবাক হয়ে বললো হোয়াই পাপা? ইস্তি দিল। ইস্তি তো আমাকে কমর্ফাম করেছে তোমাকে একদিন না একদিন পুলিশ ধরবেই।’

এতটা কখনো ভাবেনি সে। ইস্তিয়াক তাকে এড়িয়ে চলে বটে, কিন্তু এটা সে কখনো সিরিয়াসলি নেয়নি। তার বরং ধারণা ছিল এ বয়সে ছেলেরা ফ্যামেলি থেকে একটু অ্যালুফ থাকতেই ভালোবাসে। কিন্তু ইস্তিয়াককে এ মুহূর্তে তার মোটেও অ্যালুফ মনে হচ্ছে না, বরং মাচ কনসার্নড। কীভাবে ঘটছে এসব! মাঝে মাঝে মাহবুব ঢাকায় আসে, সে জানে। ইস্তিয়াকের সঙ্গে কি তার যোগাযােগ আছে? সম্ভব, খুব সম্ভব। আর যদি তাই হয়, তবে সেটা হবে রিয়েল হেডেক। খবর নিতে হবে, খুব জলদি- ভাবলো সে।

Series Navigationধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব- ০২ >>

One thought on “ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। প্রথম পর্ব

  • NusratSultana

    ভীষণ সুন্দর। অপেক্ষায়থাকলাম পরের পর্বের।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *