সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা// প্রথম পর্ব
- সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা// প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস //এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা//পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব তিন
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট // নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট // নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক// উপন্যাস // এক্সপেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব সাত
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব নয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব দশ
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব একাদশ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব বারো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব তেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব চৌদ্দ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব পনেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব ষোল
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব সতেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। আঠারো পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। শেষ পর্ব
আজ কেন নয়?
আরিফ আর সোহা চুপ করে বসেছিল ডাক্তার আশফাক রায়হানের সামনে। এরকম চুপ করে বসে থাকাটা ওদের জন্য নতুন নয়। গত দুই বছর ধরে উর্বরতার চিকিৎসা নিচ্ছে ওরা। কারণ, গত নয় বছরের সংসার জীবনে স্বাভাবিক নিয়মে সন্তানের মুখ দেখা হয়ে ওঠেনি ওদের।
হোমোপ্যাথি-কবরেজি-পানি পড়া এরকম নানান কাহিনী যে যা বলেছে করে-টরে গাদা গাদা ডাক্তারের না না না শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে অবশেষে এসেছে আকাঙ্খা ফার্টেলিটি সেন্টারে। ডাক্তার আশফাক রায়হান কখনো আশা ছাড়েনি, হাসি মুখে প্রতিবারই বলেছে, নেক্সট এক্সপেরিমেন্ট নিশ্চয়ই গুড রেজাল্ট এনে দেবে। আজ ডাক্তার আশফাকের মুখে হাসি নেই। সোহার বুকটা ঠান্ডা হয়ে আছে। বুকের ভেতরে এরকম এক অনুভূতি, ও যে বেঁচে আছে, এটা বিশ্বাস করতেই ওর কষ্ট হচ্ছে। আরিফ সোহার হাত ধরে ছিল। মনে আছে, বিবিটি বা বাজাল বডি টেম্পারেচার টেস্ট বোঝাতে গিয়ে ডাক্তার বলেছিল, ওভুলেটিং কখন হচ্ছে তা বোঝার উপায় হচ্ছে, ওভুলেটিং-এর ঠিক পরে নারীর শরীরের তাপমাত্রা নাকি পয়েন্ট ফাইভ থেকে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। হাতের আঙ্গুল গুনে গুনে ওভুলেটিং-এর সময় হিসেব করে সোহার এক হাত ধরে রাখত আরেক হাতকে।
হায় রে! সোহার হাত এখন পাথরের মত ঠান্ডা!
ডাক্তার এক গাদা রিপোর্ট পাশে সরিয়ে রেখে আশ্চর্য ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আই এম স্যরি।’ এরও মিনিট দুই পর বলল, আই এম এক্সট্রেমলি স্যরি।
এরও তিন মিনিট পর সমস্ত নীরবতা থেকে সোহাকে টেনে তুলে বলল, সোহা, আমি দুঃখিত।
আশফাক সোহার দিকে তাকায় না। তাকাতে পারে না। আরিফের দিকে তাকিয়ে বলে, সোহা, আমি দুঃখিত। আরিফের চোখ লাল হয়ে যায় চট্ করে। আক্রোশ জমা হয়ে যায় ওর মুখে। এর মানে কি? আরিফ কি ওসব মানে-টানে বোঝে না? সোহা মা হতে পারবে না বলেই তো ডাক্তারের মনে দু:খের বান ডেকেছে। কী কায়দা করে বলছে, আই এ্যাম সরি! এরকম ঢং দেখতে হবে, সোহার হাত ধরে বসে থেকেই কি দেখতে হবে! আরিফ সোহার হাতটা ধাম্ করে ছেড়ে দিয়ে আশফাকের দিকে ছুঁড়ে দেয় প্রশ্নটা। বলে, সোহা মা হতে পারবে না, এ-ই তো? আরিফ আক্রোশ নিয়ে তাকায় সোহার দিকে। তখন আশফাকের হাসি পায়। সন্তান না হওয়ার কষ্ট কেবল থাকবে, তা না কার জন্য কষ্ট, কে ব্যর্থ সক্ষমতা দেখাতে, তা নিয়ে চলে ব্যক্তিত্বের নোংরামি, আর বেশির ভাগ সময় এর শিকার বেচারি স্ত্রী। আশফাক বুঝতে পারে, ডাক্তার হিসেবে ওর উচিত ছিল, যা বলার আরিফকেই বলা। কিন্তু সোহার বিষণ্ন মুখটা এমনি, আশফাকের ইচ্ছে করে সোহার সাথে কথা বলতে। আরিফকে চেম্বার থেকে বের করে দিতে পারলে ভাল হ’ত। ডাক্তার—! আরিফ মাথার চুল খাঁমচে ধরে গজরাতে থাকে। এর মানে কি? আশফাক শান্ত স্বরে বলতে থাকে, আরিফ সাহেব, আমি তো আগেও বলেছি। সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব কি সম্ভব না, তা নির্ভর করে কয়েকটি ফ্যাক্টরের উপর। যেমন-পুষ্টি, যৌন অভ্যেস, হরমোনের অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, ব্যক্তির প্রকৃতি বা স্বভাব, সঠিক টাইমিং, অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবন যাপনের পদ্ধতি ইত্যাদি এবং এসবের সাথে অবশ্যই আছে আরেকটি ফ্যাক্টর। সেটি হচ্ছে, আবেগ। আবার নীরবতা। সোহার চোখের পানি গাল বেয়ে নীরবে ঝরছে। আর কিছু বলতে পারল না ডাক্তার। সোহার সামনে আর কোন ব্যাখ্যা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। আরিফ জানতে চায়, ফাইনালি প্রব্লেমটা কার, তা তো বুঝতে পেরেছেন। ইস! আরিফের এই ‘ইস্’ কেন বের হ’ল, বুঝতে পারল না সোহা বা আশফাকের কেউই। এমন হতে পারে, বিয়ের আগে যদি আরিফ বুঝতে পারত, সোহার প্রব্লেম আছে, তাহলে নিজেকে এভাবে ভোগাতে হ’ত না বলে যে দু:খবোধ জেগেছে আরিফের ভেতর, তারই প্রকাশ ঐ ইস্! সোহার সামনে আর কিছু বলতে চায় না আশফাক। কিন্তু আরিফের জেদি প্রশ্ন বাধ্য করে উত্তরটা দিতে। প্রব্লেম? বিষয়টা আসলে এরকম। ফর্টি সেভেন, এক্সওয়াইওয়াই ক্যারিওটাইপ হওয়ার কারণে ঝামেলায় পড়ে গেছেন আপনি।
আমি?
আরিফ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। আশফাক বুঝিয়ে বলে, ওর ক্রোমোজোমে নাকি বিকৃতি আছে। একটি এক্স আর একটি ওয়াই ক্রোমোজোমের বদলে ওর আছে একটি এক্স আর দু’টি ওয়াই ক্রোমোজোম। এই বিকৃতির কারণে স্পার্ম তৈরি হচ্ছে না। আরিফ পারছে না সোহার ডিম্বানুকে নিষিক্ত করার জন্য একটি স্পার্মও পাঠাতে। সোহা সমস্ত দক্ষতা, সমস্ত যোগ্যতা শরীরে ধারণ করেও মা হতে না পারার অক্ষমতায় ছটফট করছে। ডাক্তার আশফাক সোহার দিকে তাকিয়ে আর্দ্র হ’ল অকারণে। মেয়েটার মুখের আদলে তার ছোট বোনটার কেমন যেন একটা ছায়া আছে। বোনটা বিয়ের আগেই কোন এক বদমাশের প্রেমের বিষ গর্ভে বুনেছিল। মাত্র একুশ বছরের ছটফটে বোনটা গর্ভপাতের সময় সবাইকে বাঁচিয়ে নিজে মরে গেল, আর এই মেয়েটা আইনানুগভাবে সšতান চাচ্ছে, অথচ সন্তান জন্ম না দিতে পেরে মরে যাচ্ছে।
আরিফ মরীয়া কণ্ঠে জানতে চাইল, শুনেছি ডাক্তাররা চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। শরীরের বাইরে বাবা-মায়ের স্পার্ম আর ওভাম নিষিক্ত করে মায়ের গর্ভে বুনে দিতে পারেন। আমাদের বেলায় কি তা হতে পারে না?
আশফাক যতটা সম্ভব স্বাভাবিক স্বরে বলে, আপনার স্পার্মকে ক্ষমতাবান করার অনেক চেষ্টা আমি করেছি। ওগুলো আসলে স্পার্ম-ই না। মানে, স্পার্ম-এর ন্যুনতম যে যোগ্যতা থাকতে হয়, তা নেই। কী আর করা! আপনি চাইলে অন্য ডাক্তারকেও দেখাতে পারেন। মিরাকল তো ঘটে। ঘটে না?
সোহাকে সান্তনা দিতে গিয়ে অডাক্তারি কথা-বার্তা শুরু করল ডাক্তার আশফাক। শুকনো মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলল, এমনও তো হতে পারে….হতে পারে, মেডিকেল সায়েন্স ধাম করে খুব এগিয়ে গেল। স্পার্ম তৈরি করার ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে গেল। এমন প্রযুক্তি হয়তো বা এসে যেতে পারে। হয়তো…কোন এক অলৌকিক কারণে আরিফ সাহেব স্পার্ম তৈরি করার যোগ্যতাটা অর্জন করে ফেলতেও পারেন। কোন এক দিন, হতে পারে না? হতেও তো পারে।
আরিফ এতক্ষণ মাথা নীচু করে বসে ছিল। এবার মাথাটা তুলে ডাক্তারের দিকে তাকাল। ওর চোখে কোন অনুভূতি নেই। যেন তাকিয়ে থাকতে হয় বলে তাকিয়ে থাকা। ডাক্তার আশফাক বোকা বোকা হাসি হেসে বলল, আশা করতে তো দোষ নেই।
সোহা বিশাল একটা নিঃশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। সেই নিঃশ্বাসের ভারে গোটা হিমালয় পাহাড়টা ধ্বসে যায় কি না, এই ভয়ে আশফাক কেঁপে ওঠে। সোহা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যšত ওর মুখ থেকে চোখ সরানো সম্ভব হয়নি আশফাকের পক্ষে।
পরদিন। ডাক্তার আশফাকের টেবিলের ওপাশে একা বসে আছে আরিফ। মাথা নীচু করে ছিল কিছুক্ষণ। ডাক্তার বুঝল, বেচারা মনের ভার হাল্কা করার জন্য এসেছে। বাইরে যদিও রোগীর ভিড়, তবুও একে এভয়েড করতে পারল না। ছোট বোনটার মত মুখের আদল সোহার, আরিফ সোহার স্বামী, শুধু এই কারণে আরিফের মনটা হালকা করতে চাইল।
সোহা কেমন আছে ?
আরিফ কিছু বলল না।
আপনাদের দেখে আমার মায়াই লাগছে। মেডিকেল সায়ে›স এখনো সব মানুষের বন্ধাত্ব দূর করার মত উন্নত হয়নি। আমার পেশেন্টরা সবাই বাচ্চা চায়, বাবা-মা হতে চায়। কেউ কেউ হতে পারে, অনেকেই পারে না।
আরিফ তখনো কিছু বলে না।
কী করবেন, বলেন ? ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই। আরিফ এবার এক আকাশ সমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাতরায়। বলে, ভাগ্য !
আপনার ভাগ্য খারাপ আরিফ। আপনি বাবা হতে পারছেন না। সোহারও মন্দ ভাগ্য। মা হতে পারছে না, কেননা আপনি—
আশফাকের কথা শেষ হয় না। আরিফ কি রকম বিভ্রান্তি নিয়ে এক দমে অনেক কথা বলে ফেলে, এ কেমন ভাগ্য ? সোহার গর্ভে আমি সন্তান দিতে পারলাম না, সোহার সন্তানের বাবা হতে পারলাম না।
কিন্তু…তখন তো পেরেছিলাম।
মানে ?
দারু। সবগুলো পড়তে চাই। অসাধারণ একটা উপন্যাস শুরু হল।