ধারাবাহিক উপন্যাস//কবি আসছে// ফারুক আহমেদ//পর্ব দশ

পায় পম্পা। হাতে হেলমেট। সুঠাম, লম্বা চুল। সিঁড়ির পাশের একটা দোকানে দাঁড়িয়ে শার্ট বা কিছু একটা দেখছে। পম্পা ছেলেটার পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়। পাশে হ্যাঙ্গারে রাখা একটা জামা ধরে সরে আসে। আঙুলে ইশারা করে দোকানদারকে বলে, ভাই ওটার দাম কত?
নীল জামাটা তো?
পম্পা মাথা নাড়ে। ফাঁকে ছেলেটার দিকে একবার তাকায়। মুখে হাসির আভাস। অবশ্য মুহূর্তেই দোকানদারের দিকে দৃষ্টি ফেরায়।

  • এগারশ’ পঞ্চাশ, আপা। সস্তাই…
  • কি বলেন? কথাটা পম্পা এমনভাবে বলে, মনে হয় সে বলছে কি, বলেন।
    পম্পা একটু থেমে চারদিক দেখে নিয়ে বলে, দাম বেশি।
    ছেলেটা এবার সরাসরি পম্পার দিকে চোখ রাখে। দুটা ঠোঁট এমনভাবে ভাঁজ করে, মনে হয় সুইস গেটের দুটা দরজা খুলে দেওয়া হলো, এখনি গরগর শব্দে পানি বয়ে যাবে।
    পম্পা আর দেরি করে না। সে দোকান থেকে বেরিয়ে এক্সেলেটরের দিকে পা বাড়ায়। এক্সেলেটরে চড়ে টের পায় তার ঠিক পেছনের সিঁড়িতেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে। পম্পা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সেই ছেলেটা। পম্পা ঘাড় ঘোরানো মাত্রই ছেলেটা হেসে ওঠে, সঙ্গে তার ঠোঁট দুটায় একটা ভাঁজ পরে। পম্পা অবশ্য মুহূর্তেই দৃষ্টি সামনে ফিরিয়ে আনে। ছেলেটার কর্মতৎপরতা ব্যাপক, বলতেই হয়। সে এমনভাবে ইঙ্গিতগুলো করছিল তাতে মনে হয় আর কয়েক সেকেন্ড সময় পেলে আরো বেশ কিছু কসরত দেখিয়ে দিত।
    পম্পা চারতলায় একটা ফাস্টফুডের দোকানে দইফুচকার অর্ডার দিয়ে পাশের খালি টেবিলে বসে পড়ে। এবার ওর মনে হয় ছেলেটা আশেপাশে কোথাও নেই। এতে সে স্বস্তি অনুভব করছে কি-না তা অবশ্য ঠিক বুঝতে পারে না। বরং সেই যে বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে হয়েছিল, তাবরেজকে একটা ফোন দিতে যা কিনা মনের কোথাও সামান্য উঁকি দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল। এখন মনে হচেছ, তা-ই করা উচিত ছিল। অবশ্য সে নিশ্চিত নয় তা করা উচিত ছিল কিনা।
    দইফুচকার প্লেট আনতে গিয়ে নজরে পড়ে ছেলেটাকে। একটা টেবিল তফাতেই সে বসে আছে। বসে কেমন যেন অন্থিরতায় হাঁসফাঁস করছে। পম্পাকে দেখে ছেলেটা ইশারায় কিছু একটা বলতে চাইল। পম্পা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে টেবিলে ফিরে এসে দইফুচকা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যস্ত মানে সে নিবিড়ভাবে ফুচকায় দই ঢেলে একটা একটা করে মুখে পুরতে থাকে। অবশ্য কয়েকটা ফুচকা মুখে দেওয়ার পর এই নিবিড় মনোযোগের ভেতরও সে টের পায় ছেলেটা তার কাছাকাছি এসে পড়েছে। কিছু কি বলতে চায় সে। পম্পা মনে মনে একপ্রকার প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। একটা নাম, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি তো অনেক আগে থেকেই মনের ভেতর টাইপ করা আছে একটা কেন অনেক টাইপ করা আছে। অনেকগুলো থেকে কোনো একটা ছেলেটার জন্য বরাদ্দ করে দিবে। নাম ইতু, পড়ি নর্থসাউথে, বাসা বনানী ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তেমন কিছু ঘটলো না। ছেলেটা টেবিলের কাছে এসে, টেবিলে মৃদুভাবে হাত রাখল। তারপর আঙুল দিয়ে টেবিল মৃদু স্পর্শ করে সামনের দিকে চলে যায়। এতে পম্পা অনেকটা আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে। সে কোনো মতেই মাথা তুলতে পারে না।
    খাওয়ার বিল মিটিয়ে পম্পা লিফ্টে নিচে নেমে আসে। মার্কেটে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না। বেরিয়ে এসে রিকশা ঠিক করে। তখন তার ছেলেটার কথা মনে পড়ে। ছেলেটা টেবিলে আঙুল ফেলার পর ওকে সে ডেকে নিতে পারতো। দু-চারটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারতো। রিকশায় উঠে বসে। বসে সামনের মৃদু অন্ধকারে ছেলেটাকে দেখতে পায়। একটা বাইকের উপর বসে আছে। দৃষ্টি পম্পার দিকে। দৃষ্টি মানে স্থির দৃষ্টি। পম্পা সঙ্গে সঙ্গে রিকশা থেকে নেমে পড়ে। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে ডাকতে শুরু করে, কি আপা, যাইবেন না? পম্পা কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা মার্কেটের ভেতর চলে আসে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে এনামুলকে ফোন দেয়, হু, কোথায় তুমি? সেই যে সরু পথ বেয়ে ওর স্বর সন্ধ্যায় রওয়ানা করেছিল এখনো তা বহাল আছে মনে হলো।
  • বাসায়। কেন?
  • একটু আসতে পারবা, মেট্রোতে?
  • ঠিক আছে, আসছি।
    পনের মিনিটের মধ্যে এনামুল চলে আসে। এনামুল জিজ্ঞেস করে কী ব্যাপার, তুমি না আজ বের হবে না?
    এনামুলের কথায় পম্পা হাসে। বলে, একটা জরুরি জিনিস কিনতে বের হতে হলো।
  • সেটা তো আমাকেও বলতে পারতা।
    পম্পা হাসে। তারপর ফিসফিস করে বলে মেয়েলি জিনিস, বুঝলা।
    এনামুল কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বলে, তাহলে আমাকে ডাকলে কেন?
  • দই ফুচকা খেতে ইচ্ছা হলো। তোমাকে ছাড়া খেতে ইচ্ছা হলো না? বলে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দেয়।
    এনামুলের ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ঘুরে মিলিয়ে যায়। সেটা সে দারুণভাবে সংবরণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
    মার্কেট থেকে বেরিয়ে দুজন রিকশায় চড়ে বসে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা হাওয়া এখনো পম্পার চুল দুলিয়ে দিচ্ছে। চুল একবার ডান দিক, আরেকবার বামদিকে দুলছে। কেননা পম্পা একবার ডান দিক আরেকবার বামদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। রাস্তার সামনে, যেখানে সোডিয়ামের আলো নেই অর্থাৎ অন্ধকার, সেসবেও সে চোখ বুলিয়ে নেয়। এদিকে এনামুলের ঠোঁটে একটা হাসি এসে বসে পড়েছে। হাসি বসে পড়েছে তো পড়েছেই।
  • আমি জানি তুমি আমাকে অনেক পছন্দ করো। এনামুল এটুকু বলে থামে। একটা রাখাল অনেক গরুকে তাড়িয়ে যেমন নিয়ে যায়, মনে হলো এনামুলের কথাগুলোকে কোনো একটা বিষয় সেরকম তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে আবার বলতে শুরু করে, তুমি আমাকে অনেক পছন্দ করো। কিন্তু সবসময় কেমন নির্জীব। মনে হয় আমাকে তুমি কখনোই পছন্দ করোনি।
    এনামুল এমনি একপাল কথা মাঠে ছেড়ে দেয়, আর পেছন থেকে কথাগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো একটা রাখাল আছেই।
    কথা শেষ করে এনামুল পম্পার দিকে তাকিয়ে থাকে।
    পম্পা কোনো উত্তর দেয় না। রিকশা ৩২ নাম্বার ব্রিজ পেরিয়ে দীর্ঘ জ্যামে আটকা পড়ে।
  • যাক রিকশা আটকা পড়ছে। তোমার সঙ্গে কিছুটা সময় বেশি থাকা যাবে।’ বসে থাকা হাসি এবার এনামুলের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
  • জানো প্রায়শই ভাবি তোমাকে নিয়ে একটা উপত্যকায় চলে যাব, যার সবটা সবুজে ঢাকা। যেদিকে তাকাবে, সেদিকে সবুজ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। হ্যাঁ পাবে, তা আকাশ, নীল আকাশ। আর না হয় আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা-কালো মেঘ। আর যা দেখতে পাবে তার নাম এনামুল, বুঝলে। এমন একটা উপত্যকায় তোমাকে কিন্তু আমি নিয়ে যাব।
    এনামুল তার দীর্ঘ বয়ান শেষ করে পম্পার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
  • বলো, তুমি কিছু বলো! এনামুলের অসহিষ্ণু আবদার।
    পম্পা চুপ। মুখের বলিরেখায় কোনো প্রতিবিম্ব নেই।
  • কি? কণ্ঠ থেকে এনামুলের অসহিষ্ণুতা আবার বেরিয়ে আসে।
  • দেখ এসব ফালতু কথা আমার ভালো লাগে না। জ্যামে এমনিতেই অসহ্য লাগছে?
    এ কথা শুনে এনামুল চুপসে যায়। প্রথমে মনে হলো কিছু একটা বলবে, তারপর তা-ও নয়। পম্পা নিঃশব্দে সামনের জ্যামের দিকে তাকিয়ে থাকে। জ্যাম অবশ্য আর দীর্ঘ হয় না। রিকশা জ্যাম থেকে বেরিয়ে, বাতাস কেটে কেটে এগুতে থাকে। পম্পার বাসার সামনে রিকশা এলে দুজন নিঃশব্দে বিদায় নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

দুজন, মানে জহির ও পম্পা যখন ফেসবুকে একজন আরেকজনকে সাড়া দিল, সে রাতটা ছিল দুজনের জন্যই বিষণ্নতার। ফলে পম্পার মনে হলো এই কবির সঙ্গে দেখা হলে ভালোই হয়। অন্যদিকে জহির যেকোনো একটি কাহিনির মধ্যে ঢুকে যেতে অস্থির হয়ে ছিল। এমতাবস্থায় তাদের কথা এবং পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ প্রকৃতি নির্ধারণ করে দয়। এর ফলে তাদের এর পরদিন বিকালে দেখা হয়।

  • পম্পা, আমি কতদিন ভেবেছি আপনাকে নক করব, কিন্তু যদি কিছু মনে করেন।
    জহিরের এই কথায় পম্পা হেসে ওঠে, বলে, আমারও তো একই অবস্থা। আপনাকে নক করি করি বলেও থেমে যাচ্ছিলাম।
    এভাবে কথা হতে হতে দু’ঘণ্টার মাথায় সিদ্ধান্তে আসে, এ মহানগর থেকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নেয়া দরকার।
    এরপর সিদ্ধান্ত হলো, আজ রাতেই তারা কোথাও চলে যাবে।
    জহিরের কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগে। সে প্রথমে ভয় পায়, আস্তে আস্তে ভয়ের ঘাড়ে একটা রোমাঞ্চ এসে ভর করে। তখন জহির পকেটে হাত দিয়ে দু’ঘণ্টা সময় চায়। পম্পা বুঝে ব্যাপারটা, বলে, টাকার জন্য চিন্তা করতে হবে না। আমি একটা ভালো বেতনের চাকুরি করি।
    এ কথায় জহির লজ্জা পায়। বলে, না না, আমি বাসায় গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে আসতে দু’ঘণ্টা সময় চেয়েছিলাম।
    এ কথায় পম্পা হেসে ওঠে। বলে, আমার অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা আছে, যা যা লাগবে আমরা কিনে নিব, ব্যাগও। দেশের বাইরে তো আমরা যাচ্ছি না।
    জহির মনে মনে বলে, কী আধুনিক মেয়েরে, বাবা।

দুজন একটা সিএনজিতে উঠে পড়ে। পেছনে পড়ে থাকা পিয়াল, মোমেন, শিলা কুমকুম বা অর্পা তাবাসসুম, কোনোকিছুই মাথার ভেতর আলোড়ন তুলতে পারে না আর। সন্ধ্যাটার মৃদু অন্ধকার কেটে কেটে জহির আর পম্পা একটা অশহুরে গন্তব্যের কথা ভাবতে থাকে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // পর্ব নয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *