উপন্যাস// কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // ষষ্ঠ পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস / কবি আসছে/ ফারুক আহমেদ/ প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস// কবি আসছে //ফারুক আহমেদ// দ্বিতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস // কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // তৃতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস // কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // চতুর্থ পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস// কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // পঞ্চম পর্ব
- উপন্যাস// কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // ষষ্ঠ পর্ব
- উপন্যাস //কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // পর্ব সাত
- ধারাবাহিক উপন্যাস// কবি আসছে // ফারুক আহমেদ// পর্ব আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস // কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // পর্ব নয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস//কবি আসছে// ফারুক আহমেদ//পর্ব দশ
যখন জটলাটা মোহাম্মদ আলীকে ঘিরে বড় হতে থাকে, তখন পিয়াল প্রথম দেখল খাবারের টেবিল, তারপর দেখল সেই বৃত্তটা, মানে কলিম স্যারের বৃত্ত। বৃত্তটা ভেঙে গেছে, এখন একা হয়ে আছেন ইয়াকুব আলী। টিপু সুলতান বেয়ারাদের নানারকম নির্দেশ দিচ্ছেন খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। ড. হামযা আর রুবাবা এখন এক পালক, ড. হামযার আর্ট নিয়ে প্রভাব আছে বাজারে। রুবাবা খুব হাসছে হামযা বেটার সঙ্গে। কলিম স্যারকে কোথাও দেখা গেল না, বোধহয় রেস্টে গেছেন, বয়স তাঁকে রেস্টের দিকে নিয়ে গেছে। যাহোক পিয়াল চেষ্টা করছে আজ রাতে কলিম স্যারের মুখোমুখি না হতে; হয়ে গেলে অন্য হিসাব। পিয়াল ইয়াকুব আলীর দিকে হাঁটতে শুরু করে। জনা তিরিশেকের এই আয়োজনে অনেকগুলো জটলা শিল্প জটলা, কবিতা জটলা, প্রবন্ধ জটলা ইত্যাদি। আবার কখনো কখনো কাটাকাটি হয়ে যায় ককটেলের মতো। শিল্পকলা আর কথাসাহিত্য কাম প্রবন্ধ যেমন একসঙ্গে এখন। এর মধ্যে পিয়াল পুরো লনটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়; আসলে কুমকুমকে খুঁজে নেয় আর-কি। না সে কোথাও নাই। তার থাকা না থাকা নিয়ে এ মুহূর্তে পিয়াল ভাবছেও না।
ইয়াকুব আলীর মুখোমুখি হয়ে পিয়াল সালাম দেয়। ইয়াকুব আলী সালাম নিলেও পিয়ালকে ঠিক নজরে এনেছে বলে মনে হয় না।
-ভাই, আমি পিয়াল, পিয়াল পাললিক। আপনার ‘মৃদু নন্দনতত্ত্ব’ বইটার ওপর একটা আলোচনা
লিখেছিলাম।
-ও আচ্ছা, তুমি পিয়াল। তোমার সঙ্গে তো অনেকবার আমার কথা হয়েছে টেলিফোনে।
পিয়াল ঘাড় কাৎ করে মাথা চুলকায়। মনে হয় খুব লজ্জা পেয়েছে।
-ভাই, আপনার ‘নন্দনতত্ত্বের অআকখ’ নামে যে ওয়ার্কশপটা ছিল, সেটা কি আর চালু করবেন না?
-কেন করব না। কিন্তু ঠিক লোকটি ঠিক স্থানে পাচ্ছি না যে। শোন, মোটা শিল্প আর চিকন শিল্পের মধ্যে পার্থক্য কী, জানো?
পিয়াস চুপ করে থাকে, সে কিছু বলে না।
-শোন, চিকন শিল্প হলো সেই শিল্প, যা দেখে তোমার চোখ দিয়ে জল পড়বে। আর মোটা শিল্প সেটা যা দেখে তোমার দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে জল পড়বে। খুব গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বলে যায় ইয়াকুব আলী।
পিয়াস এই কথা শুনে হেসে ফেটে পড়বে মনে হয় হয়। কিন্তু সে একদম হাসে না, ঘাড়টা কাৎ করে রাখতে সক্ষম হয়। তারপর একটু সময় নিয়ে বলে
-আপনার ‘অতিভৌতিক বালখিল্য’ ছোটগল্পের বইটাকে আমার মনে হয়েছে স্বাধীনতাউত্তর বাংলা ছোটগল্পের অন্যতম সংযোজন। আপনি নন্দনতত্ত্ব নিয়ে কাজ করে, এমন দারুণ ছোটগল্প সংকলন বের করেছেন, অথচ আর ছোটগল্প লিখলেন না…
ইয়াকুব আলী বড় বড় চোখ করে পিয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁকে দেখে মনে হয় হাত থেকে এখনই রেড ওয়াইনের গ্লাস নিচে পড়ে যাবে। পিয়াল বুঝতে পারে না ব্যাপারটা কী ঘটছে। ইয়াকুব আলী তখনই তার ডান হাত দিয়ে পিয়ালের হাত চেপে ধরেন, বাম হাতে ধরা আছে রেড ওয়াইন।
-শোন, তুমি আমার অফিসে আসো এরই মধ্যে একদিন। এত মানুষের ভিড়ে প্রয়োজনীয় কথাটা বলা কঠিন, বুঝলে।
এত দ্রুত কুপোকাত হয়ে যাবে ইয়াকুব আলী পিয়াল ভাবেনি তা। ব্যাগে এতগুলো অস্ত্র ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে ছোট চাকুটাতেই বেটার গলাটা কাটতে পেরে পিয়াল যারপরনাই খুশি।
মিলনমেলা ১২ নাগাদ ভাঙতে শুরু করল ততক্ষণে বেশির ভাগই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে থাকা চেয়ারে বসে পড়েছে। পানিটা যাদের পেটে একটু বেশি পড়ছে, তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে থেকে এই চাঁদোয়া আকাশ দেখা সম্ভব নয়। এর মধ্যে আর কলিম স্যারকে দেখা গেল না। আশ্চর্য, কুমকুম কি চলে গেছে? কুমকুমের সঙ্গে তো একটু কথা বলা যেত এমন এক লেটনাইট জৌলুসে।
রুবাবা উঠে গেল ডা. হামযার গাড়িতে। কবি মোহাম্মদ আলীও বিদায় নিল। পিয়ালও ভাবছে বিদায় নিবে এবার।
তখন স্যারকে দেখতে পেল। টিপু সুলতান খুব হন্তদন্ত হয়ে স্যারকে বিদায় দিতে এগিয়ে এল। আর স্যারের পেছন পেছন কুমকুম। কুমকুম এখনো যায়নি আশ্চর্য! স্যার বললেন, এই মেয়ে তুমি আমার সঙ্গে চলো, এত রাতে একা কীভাবে যাবে?
স্যার বিদায় নেয়ার পর পিয়ালও বেরিয়ে পড়ে। যাওয়ার সময় টিপু সুলতানকে বলে যায়, ভাই, আপনার আত্মাটা কবির মতোই। কোনো হিসেবের মধ্যে নাই।
অর্পা তাবাসসুম জহিরকে জানিয়েছে টিএসসিতে নয়, আসতে ধানমন্ডি লেকে। ধানমন্ডি লেকের কথা শুনে জহিরের কেমন জানি আনন্দ হয়। শাহবাগের দিকে একটা জরুরি কাজ ছিল, তার আর সে কাজের কথা মনে থাকে না। তাবাসসুম বলেছে ছয়টায় আসতে, তার অফিস ছুটি হয় ছয়টায়। কিন্তু জহির রবীন্দ্র সরোবরে সাড়ে পাঁচটাতেই এসে হাজির।
তাবাসসুম পৌঁছে বলল, ওমা, তুমি এত সিনসিয়ার জহির, আমার আগেই চলে এসেছ?
-জি আপু, আপাতত তো আমার কোনো কাজ নাই। আর আপনি ডেকেছেন!
-হুম, চলো কোথাও বসি।
-জি আপু।
এক বেঞ্চে দুজন বসে বাদামের খোসা ভাঙতে ভাঙতে সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় নামে
-আপু, এ মুহূর্তে কী লিখছেন?
-তেমন কিছুই না, কিছু অনুবাদ করছি?
-কী, উপন্যাস?
-আরে না, এত সময় কোথায়? অফিসের চাপে প্রায় দিশেহারা হওয়ার অবস্থা, পাস্তারনাকের কিছু কবিতা অনুবাদ করছি।
-ও গ্রেট, পাস্তারনাক আমার ভালো লাগে, তার ড. জিগাভো পড়েছি। কিন্তু পাস্তারনাকের কবিতা কেউ একজন বাংলায় অনুবাদ করেছে বোধহয়।
-হুম তা করেছে বটে, তার মানে এই নয় যে আর করা যাবে না। যা হয়েছে, তা বিছিন্নভাবে, বাছাই করে করে। আমি তার একটি বইয়ের পুরোটা অনুবাদ করছি।
-আচ্ছা, এটা খুব ভালো কাজ হবে, আর ইচ্ছা করলেই তো সবাই অনুবাদ করতে পারে না। তো অনুবাদই করছেন শুধু, কবিতা লিখছেন না?
-না একদম হচ্ছে না, এত ব্যস্ততা, কবিতাকে কোথায় পাব?
-তাতে কী, এর মধ্যে একটু-আধটু হলেও তো লেখা উচিত। কোথাও ইদানিং লেখা দেখছি না আপনার।
-একে তো লিখতে পারছি না। তার ওপর আমার কবিতা কে ছাপবে? আমার তো সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে খাতির নাই।
- কী যে বলেন আপু, আপনিই তো লিখেছেন যে জন যোজন যোজন দূরে/ সে আসলে আমারই হৃদয়ে কড়া নাড়ে।
-হা হা হা। কলকল করে একটা মিষ্টি হাসি মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ল তাবাসসুমের। এর সঙ্গে শরীর থেকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণও ছড়িয়ে পড়ে।
-লিখেন আপু, আর যদি লেখা না-ই আসে, তাহলে একটা প্রেমে পড়েন, দেখবেন কবিতা কীভাবে আসতে শুরু করেছে। টেনে টেনে কথাগুলো বলে জহির।
-তা-ই নাকি, তুমি কি তা-ই করো?
-তা বলতে পারেন। হা হা হা করে হেসে ওঠে জহির। এরপর সে একটু এগিয়ে বসে। আবারও বলে, জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন না, ‘মানবকে নয় নারী, শুধু তোমাকে ভালবেসে/ বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।’
আলাপ জমে উঠছিল। তখনই তাবাসসুমের ফোন আসে। ফোন রিসিভ করে বলে, বলো?
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, আমি ধানমন্ডি লেকে, এক ছোটভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, তুমি ফিরবে কখন?
ফোনে কথা শুনে জহির লজ্জা পায়, মাথা নিচু করে থাকে।
আবারও একটু চুপ। তারপর, ঠিক আছে তুমি এসে তাহলে বিফটা রান্না করে ফেলো, আমি আসছি। এসে ভাত রান্না করব। বাই।
-তোমার দুলাভাই, বুঝলে একটু শান্তিতে আড্ডা দিব তা না, অফিস থেকে বেরিয়েই ফোন।
-এখন বলো তোমার খবর?
জহির চুপ হয়ে থাকে। সে আর ঠিক আগ্রহ পায় না। একটু একটু করে জমে ওঠা সন্ধ্যাটা হঠাৎই একটা ঘা খেয়ে কাৎ হয়ে পড়েছে বলেই মনে হয়।
-আপু, আমার আর খবর কী, কবিতা লেখার চেষ্টা করছি, চাকুরি খুঁজছি। এই আর কি?
-তোমার কবিতা খুব একটা পড়া হয়নি আমার। তবে একটা না দুটা পড়েছিলাম, পড়ে মনে হয়েছে তুমি ভালোই করবে। যাক আজ তাহলে ওঠি। তুমি কোথায় যাবে?
-আমাকে একটু কাশেম ভাই ডেকেছেন, সেখানেই যাব।
-কাশেম মানে কাব্য কাশেম?
জহির মাথা নাড়ায়।
-তা-ই? আগে আগে বলবে না, তাহলে তোমার সঙ্গে আমিও যেতাম। আজ তো দেরি হয়ে গেল। আরেকদিন গেলে আমাকে নিয়ে যেও কিন্তু। আর এভাবে আড্ডা দেয়া যায় পার্কে পথে। একদিন আমার বাসায় চলে এসো, খাব আড্ডা দিব, মজা করব। গড়গড় করে কথাগুলো বলে গেল তাবাসসুম।
এ মুহূর্তে জহির একটু ভড়কে যায়। হঠাৎ মনে হয় কবি অর্পা তাবাসসুম দিলখোলা হয়ে পড়েছে। কিন্তু এখন যে চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। সে কী উত্তর দিবে ভেবে না পেয়ে বলল, আচ্ছা।
যায় যায় প্রতিদিনের অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ৮টা হয়ে গেল। অফিসে পৌঁছে দেখে কাব্য কাশেম অফিসের বাইরে চায়ের দোকানে বসে আছে। জহির কাছে গিয়ে সালাম দেয়।
জহিরকে দেখে কাব্য কাশেম বলে, তুমি এখন এখানে কী করছ? আমি তো আরও আগে চলে যেতাম, আসার আগে ফোন দিতে হয় না?
-সরি ভাই, একটা কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। আপনার বইয়ের একটা রিভিউ পাঠিয়েছি, তা কি পেয়েছিলেন?
-না তো, কবে পাঠালে?
-এই তো দিন-চার আগে।
-পাই নাই। চা খাবে? অবশ্য উত্তরের অপেক্ষা না করে কাব্য কাশেম বলে, মির্জা আমাকেও এক কাপ দাও।
-কেন এসেছ, কোনো কাজে?
-না তেমন কিছু না, তবে ভাই আপনার একটা ইন্টারভিউ লাগবে, কবে সময় দিবেন?
-সময় দিব মানে, সময় তো পরে আগে রাজি হই। কীসের জন্য?
-ভাই, ছোট কাগজের লোকগুলো আপনারে গুনতে চায় না। চায় না কারণ আপনার নামে একটা প্রচারণা আছে, আপনি ছোটকাগজের কবিদের ছোট কবি বলে তামাশা করেন। আমি তো জানি এ অভিযোগ ঠিক না। আমি ছোটকাগজ মাটির টান-এর সম্পাদককে বলছি আপনার একটা দীর্ঘ ইন্টারভিউ করে দিব। শুনে সে আমাকে বার বার ফোন দিচ্ছে। এই যে আপনারে গুনতে চায় না, আসলে কিন্তু চায়। সুযোগ পাচ্ছে না বলে গালি দেয়। ইন্টারভিউটা দেন, একটা হুলুস্থূল পড়ে যাবে।
-আচ্ছা দেখা যাবে। আগে চা খাও তারপর এই নিয়ে কথা। আর তুমি আমার এখানে কবিতা দাও না কেন?
-ভাই আপনি না চাইলে কেমনে দিই।
-চাইতে হবে কেন? তুমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই, তুমি লিখবা যখন যা। তবে…, একটু থামে কাব্য কাশেম।
-তবে, কী ভাই?
-পিয়ালও আমার ইউনিভার্সিটির। কিন্তু ওকে কোনোমতেই নয়, তোমার জন্য সবসময় দরজা খোলা।
এই ব্যাপারের পুরোটাই কাজে লাগাল জহির। বলল, ও তো কলিম স্যারের পা চেটে বেড়ায়, টিপু সুলতানের গু সাফ করতে বাসায় চলে যায়।
-টিপু সুলতানকেও ও ধরে ফেলছে!
-ভাই, শুধু টিপু সুলতান, নন্দন আলীকেও।
-নন্দন আলী মানে ইয়াকুব আলী? হা হা হা তাহলে ওর তো চাকুরিটাও হয়ে গেল।
-খালি পিয়াল, আর ওই হিজড়া কথাসাহিত্যিকটার কথা কেন বাদ যাচ্ছে?
-মানে কার কথা বলছ?
-আরে ফেসবুক খুললেই যার আঙুল নাড়াচাড়া করতে দেখা যায়। যে আঙুল অমুকের পাছার দিকে ছুটে তো তমুকের পাছা খামছে ধরতে চায়।
-হা হা হা, কৌশিক কাম ওর হিসাব আলাদা, ওকে আগে চেনো, তারপর বলো, নামটাই দেখ না কৌশিক কাম, ওর ভেতর তীব্র কামবোধ আছে, তবে এই কাম মানে যৌনতা নয়।