উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব পঞ্চম
- ধারাবাহিক উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/ প্রথম পর্ব
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// দ্বিতীয় পর্ব
- উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/পর্ব তিন
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব চার
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব পঞ্চম
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব ছয়
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব সাত
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// পর্ব আট
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব নয়
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব দশ
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব এগারো
- উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব বারো
- উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী// শেষ অধ্যায়
অনেক দিন পর।
পার্থ যায় জুডির বাসায়। অলস দুপুর। কেবল রোদ একটু নরম হয়ে এসেছে। গাছগুলোর মধ্যে সবুজাভ ভাব। সেই কোমল দুপুরে জুডির সান্নিধ্যে কাটানোর জন্য পার্থের ইচ্ছে জাগে।
নক করতেই আয়ারল্যান্ডের মেয়ে মনিকা রীভ হাসি মুখে বলে, ‘জুডি খুব শিগগির ফিরবে। বন্ধের দিন হলেও ওর আজ ডিউটি আছে। তুমি রুমে অপেক্ষা করতে পারো।’
পার্থ প্রথমে আপত্তি করলেও পরে মনিকার রুমে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। দেয়ালে স্বাধীনতাকামী একজন তরুণের পোস্টার সাইজের ছবি।
মনিকা-জুডি, যুগোশ্লোভিয়ার নাদিমাভ এক রুমে থাকে।
পার্থ জুডির সঙ্গে সম্পর্কের পর অপর দু’জনকে চেনে। আগলা আগলা পরিচয়।
এভাবে কখনো মনিকার মুখোমুখি হয়নি পার্থ। এই প্রথম। পার্থ জানে আয়ারল্যান্ডের মানুষ জাতীয়তাবাদী। দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করছে। মনিকার প্রতি পার্থের অন্যরকম একটি শ্রদ্ধাবোধ আছে।
অনেকক্ষণ ওরা কথা বলতে পারলো না। পরস্পরের প্রতি ঈষৎ নম্র আমন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও।
এক সময় মনিকা বলে, ‘যুদ্ধের চিহ্ন বয়ে বেড়ানোর মধ্যে সুখ আছে। তোমার প্রতি অভিনন্দন।’
‘তোমার দেশ সম্পর্কে আমার ধারণা কম। তোমরা যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করছো তা আমি জানি। তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইলো।’
মনিকা মিষ্টি হেসে চোখের পাতা নাচিয়ে বলে, ‘তুমি কি এক কাপ কফি খাবে?’
পার্থ সম্মতি জানায়।
মনিকা কফি তৈরি করতে করতে বলে, ‘তোমাদের এখানে যখন প্রথম আসি, আজ থেকে এক বছর আগে বাহাত্তরের সেই সময় আমার এক ভাই মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।’
পার্থ মনিকার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে পোস্টারের দিকে তাকায়।
‘ও খুব স্বাধীনতাপ্রিয় ছিলো। ও খুব স্বপ্ন দেখতো। ওর কাছ থেকে আমি দেশপ্রেমের ভাষা শিখি। যতবার আমি জুডির সঙ্গে তোমাকে দেখেছি ততবার নস্টালজিয়ায় ভুগেছি।’
কথাগুলো এত সহজভাবে মনিকা বলে যেন পার্থের সঙ্গে ওর সম্পর্ক অনেক দিনের। অথবা এ কথাগুলো বলার জন্য মনিকা যেন প্রতিক্ষাই করছে।
মনিকার চোখে জল। পার্থের কষ্ট হতে থাকে।
‘আমাদের ইতিহাস তো তুমি জানো। আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি।’
‘তোমরা যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করছো, তখন আমার দেশে এক হাসপাতালে কাজ করি। তোমাদের সর্বশেষ সংবাদ শোনার আগ্রহ পোষণ করেছি। বাহাত্তরে যখন তোমাদের পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার করার জন্য এদেশে আসি, তখনকার সুখ তোমাকে বোঝানো যাবে না।’
‘জুডি আমাকে তোমার কথা বলেছে। আমরা আসলেই খুব দরিদ্র। নিজস্ব কোনো আয় নেই। শিক্ষাহীন, শিল্পহীন কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো। তাও আবার মানুষ অনুপাতে জায়গা কম। দু’শত বছর ঔপনিবেশিকতা, তেইশ বছর পাকিস্তানি শোষণের ভেতর দিয়ে সদ্য স্বাধীন একটি জাতি হিসেবে মেরুদণ্ড শক্ত করা কষ্টকর। বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করে ভিত নির্মাণ করা দুঃসাধ্য। শেখ মুজিব চেষ্টা করছে।’
মনিকা বলে, ‘শেখ মুজিবের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। মানুষের প্রতি প্রেম আছে। মস্তকের চেয়ে আবেগ দ্বারা পরিচালিত। সে শুধু ভালোবাসতে জানে।’
পার্থ কিছুই বলে না মনিকাকে। বুকের ভেতর শূন্যতা হা হা করে। বিকেলের ছায়া দীর্ঘ হতে হতে মিলিয়ে যেতে থাকে। পার্থ জুডির জন্য অপেক্ষা করতে চায় না। অনেকটা অসৌজন্য ভাবে ক্রাচে ভর দিয়ে রাস্তা নামে। আর রাস্তার মানুষগুলোকে কেমন অসহ্য ধাবমান, পলায়নপর মনে হতে থাকে।
‘আমি দুঃখিত পার্থ। পার্থ, মনিকা তোমার প্রেমে পড়ে গেছে। বড়ো ভালো মেয়ে। তোমাকে সম্মান করে।’ জুডি টেলিফোনে ঝড় তোলে।
‘সত্যি আমার মন খারাপ হয়েছিলো। আমি মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। কেন? তার কোনো কারণ নেই। বিশ্বাস করো জুডি, সত্যিকার অর্থেই কৃতজ্ঞ। জীবনকে এভাবে দেখা হয়নি।’
‘তুমি খুশি হয়েছো পার্থ? আমার সত্যিই ভালো লাগছে। তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘জুডি, কেন তোমার ওখানে গিয়েছিলাম জানো! আমার একটি চাকরি দরকার। চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করতে পারবো, এমন চাকরি। ভালো হয়, কোনো বিদেশী সংস্থায় হলো।’ বেশ গম্ভীর গলায় পার্থ বলে।
‘তুমি চাকরি করবে? আমি ভাবতে পারছি না। নেশন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ভাতা দেবে, এটা তোমাদের প্রাপ্য। জাতির জন্য তোমাদের এই ত্যাগ তো বিশাল!’
‘আমাদের নিয়ে ভাববার আগে জাতিকে আজ তার সমগ্রতা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আমরা সময়ের সাহসী সন্তান হিসেবে বেঁচে থাকবো।’
‘তুমি খুব ড্রীমি এবং মিস্টিরিয়াস মানুষ।’
‘এই কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছি।’
‘বীর?’ জুডির চোখে অলৌকিক তৃপ্তি ফুটে ওঠে।
‘তুমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে জুডি। কবিতার মতো করে কথা বলো।’
‘তুমি নাজিম হিকমতের কবিতা পড়েছো? তুরস্কের কবি। মানুষের জন্য লিখেছে। স্বাপ্নিক। আমার প্রিয় কবি। তোমাকে দেখলেই আমার নাজিম হিকমতের কথা মনে পড়ে, তার স্বপ্নের মানুষ হলে তোমরা। আমার খুব গর্ব হয়। এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম একটি সময়কে অতিক্রম করে চলেছি।’
পার্থকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জুডি আবার বলে, ‘তোমার চাকরি হয়ে যাবে। ডা. ডিডমেনশন বললে আরো নিশ্চিত।’
পার্থ বলে, ‘জুডি সত্যিকার অর্থেই আমি কোনো নারী দেখিনি। বিশেষ বয়স থেকে বেড়ে ওঠা একটি নির্দিষ্ট সন্ধিক্ষণে এসে জানতে পারি ঈভ-আদমের চিরন্তন তৃষ্ণা। ততোদিন সামাজিক মানুষ হয়ে গেছি। নরনারীর স্বাভাবিক মেলামেশার মধ্যে পাপ আবিষ্কার, ভালোবাসায় দূরত্ব সৃষ্টি করে বেড়ে ওঠা এই আমি। হ্যাঁ তুমি প্রথম নারী, যে আমাকে পুরুষ করে জাগিয়ে তুললে। আমার লোভ হয়।’
টেলিফোনের ওপাশে জুডি দ্রুত নিঃশ্বাস পতনের শব্দ তোলে। মন খারাপ হয় পার্থের। কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
‘আজ রেখে দেই জুডি?’
‘তোমাকে তো আসল কথা বলা হয়নি। মনিকা তোমার সঙ্গে কথা বলে তৃপ্তি পেয়েছে। ধন্যবাদ। আজ এ্যাটকিনশনকে লিখবো ‘মনিকা পার্থের প্রেমে পড়িল।’ হাসতে হাসতে জুডি টেলিফোন ছেড়ে দেয়।
পার্থের হঠাৎ করে কোনকিছুই ভালো লাগে না। ঘোর লাগা সন্ধ্যার মধ্য দিয়ে যেন হাঁটছে। একটু কষ্ট কষ্ট ভাব। নবীন নক্ষত্রের আলোর মতোন ঝিলিক মেরে হারিয়ে যায়। গাঢ় তমসায় পার্থ কারো মুখায়ব আবিষ্কার করতে না পেরে জুডি-মনিকা-মনিকা জুডির ছায়াবাজি খেলায় মেতে ওঠে।