উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/ প্রথম পর্ব
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// দ্বিতীয় পর্ব
- উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/পর্ব তিন
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব চার
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব পঞ্চম
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব ছয়
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব সাত
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// পর্ব আট
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব নয়
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব দশ
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব এগারো
- উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব বারো
- উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী// শেষ অধ্যায়
একদিন জুডির এক প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠে পার্থ।
‘তাই তো!’
এমন করে ব্যাপারটা ভাবেনি পার্থ।
জুডি বলে, ‘তোমরা স্বাধীনতা বুঝো না। জাতির আবেগ আছে যুদ্ধ করেছো! শেখ মুজিবের মতোন মানুষ কী করবে বুঝতে পাচ্ছে না। জনগণের সঙ্গে শাসকের সম্পর্ক কী? যার সঙ্গে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী সম্পর্কযুক্ত, তার প্রতি জনগণের প্রত্যাশা অনেক। জনগণ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পরিণতি সুবিধের হবে না।’
পার্থ অবাক হয়।
জুডি এদেশের রাষ্ট্রীয় বিষয়-আশয় জানতে চায়। এ ভূ-খণ্ডের মানুষ এবং অধিকার সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখে।
পার্থ জুডিকে বলে, ‘তুমি হয়তো স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের চেয়ে ভালো খোঁজ রাখো।’
‘ধন্যবাদ।’
‘তবে এতো তাড়াতাড়ি শেখ মুজিব ব্যর্থ হবে মনে হয় না।’ জুডি ওর নিঃসঙ্গতাকে ঢাকতে গিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে থাকে। যা ঊনিশ বছরের তরুণীর কাছে কৌতূহলী এবং আনন্দময়।
একদিন জুডি বলে, ‘পার্থ তোমার মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করালে না!’
সাবলীল ভঙ্গিমায় জুডি কথাগুলো বলতে পারে।
পার্থ চমকে উঠে, ‘তাই তো!’
জুডিকে বলতে কষ্ট হয়।
বাংলাদেশে একজন ঊনিশের যুবা’র সাধারণত কোনো মেয়ে বন্ধু থাকে না।
পার্থ জুডির মুখের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসে।
জুডিকে বলা হয় না।
না, পার্থ কিছুই বলে না। অন্তহীন দীনতা ওকে কুরে কুরে খায়।
নিরুত্তর পার্থের জবাব আশা করে জুডি।
‘তোমার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হবার প্রয়োজন আছে?’
পার্থের চোখে মুখে রক্তে ঝলকানি খেয়ে যায়।
আরক্ত হেসে পার্থ বলে, ‘না জুডি, আমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই। তোমাদের মতো হৃদয়ঘটিত ব্যাপার খুব সহজ আবেগের উপর নির্ভর করে না। আমাদের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত থাকে। তাই এ ব্যাপারে দেশবাসী পবিত্র এবং সরল। তোমাদের মতো বহুগামী জীবনধারার ছলনাটুকু শেখেনি। অবশ্য সমাজ ব্যবস্থা তোমাদের সহায়ক। বিশ্বাস করতে পারো আমার কোনো বন্ধু নেই। মা’র পর মেয়ে মানুষের প্রতি অন্য আকর্ষণ আছে তোমাকে দেখার আগে জানা ছিলো না।’
জুডি আকাশের দিকে তাকায়। চোখে মুখে অদ্ভুত সরলতা। অনন্ত নীলাব্র মেঘমালার সঙ্গে মনোলোক উড়তে থাকে সুদূর থেকে সুদূরতম দূরত্বে।
পার্থ এখন ক্রাচে ভর দিয়ে ভালো ভাবে হাঁটতে পারে।
জুডির কথাই সত্য।
ডা. গাস্টের কাছে পার্থের অপারেশন অত্যন্ত মাইনর। অপারেশনের পর জ্ঞান ফিরে এলে ডাক্তার পার্থকে বলেছিলো, ‘খুব শিগগির ভালো হয়ে উঠবে তুমি। কিছুদিন সতর্ক চলাচল করার পর আগের মতোন হাঁটতে পারবে। জাতি, তোমাকে মনে রাখবে। তোমার প্রতি আমার অভিনন্দন রইলো।’
পার্থের চোখ ভরে জল আসে, প্রচণ্ড আনন্দ-কষ্টে ব্যাকুল করে তোলে। কিছুই বলা হয় না ডাক্তারকে।
জুডি যেন পার্থের ঘনিষ্ঠ অবলম্বন।
একজন গৃহপালিত মানুষের মতো পার্থের জীবন এবং জাগতিক আত্মিকতায় বিলীন হতে থাকে জুডি।
হাসপাতালের বাইরে জুডির যে জীবন তা পার্থকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে চায়।
কখনো কখনো পার্থকে নিয়ে কক্সবাজারসহ দেশের টুরিস্ট জোনগুলোতে ঘুরে বেড়ায় জুডি।
একবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যায় ওরা। জ্যোৎস্নারাতে সাগরের দিকে তাকিয়ে পার্থ জুডিকে জিজ্ঞেস করে, ‘জুডি, আমার জন্য তুমি অনেক টাকা খরচ করছো, আমার প্রতি তোমার আগ্রহ সীমাহীন। তোমার তুলনায় আমরা দরিদ্র। তোমার দেশে একজন নার্স যে বেতন পায় তা আমরা স্বপ্নেই ভাবি না। আমাদের দু’বেলা খাবার যোগাড় করা দুরূহ কষ্টকর। তাই আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।’
জুডি ব্যথিত কণ্ঠে বলে, ‘পার্থ, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আছে। বিশ্বাস করো, এই বয়সটুকুতে অনেক আঘাত পেয়েছি। তোমার সঙ্গে পরিচয় হবার পর তা অনেকটা ভুলতে পারছি। তুমি অতো কিছু ভাবতে যেও না!’
‘তোমার আমার দেশের দূরত্ব অনেক। আচার, অনুষ্ঠান ভিন্ন, সামাজিক কালচার পৃথক। কিন্তু আমি তো তোমার কষ্টের সঙ্গে এক হতে
পারি। বেদনায় নীল হয়ে যাই। আমরা শুধু পরস্পরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে চাই।’
উত্তাল জলরাশির সঙ্গে হৃদয় মিশিয়ে দিয়ে আকাশে তাকিয়ে থাকে পার্থ। দু’এক ফোঁটা অশ্রু সৈকতের তৃষ্ণার্ত বালু শুষে নেয়। পার্থ অজান্তে জুডির হাতে হাত রাখে।
এই প্রথম একজন নারীর শরীরে ওর হাত স্পর্শ করে। পার্থের সারা অস্তিত্বে একজন নারী বিরাজমান। যাকে সে একজন অলৌকিক মানবী এবং অদৃশ্যমান স্বপ্নময় মুগ্ধ মুখ ভাবছে।
ওরা দু’জনেই কেউ কথা বলতে পারে না। নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্রের জলরাশির স্নিগ্ধ বাতাস দু’জনকে আবিষ্কার করার পথ করে দেয়।
পার্থ ভাবে ওর মতো একজন পঙ্গু মানুষের প্রতি বিদেশী মেয়েটির সীমাহীন মমতার ঋণ কেবলি ভারী হচ্ছে।
করুণা মিশ্রিত তীব্র, রোরুদ্ধমান কান্না বুকে ভরে ওঠে।
জুডি ভাবে ভালোই তো, একটি জীবনকে আঁকড়িয়ে ধরে অতীতকে হারানো…।
পার্থ যোগ্য মানুষ। গর্বিত অতীত আছে। হৃদয়বান এই তরুণটির সান্নিধ্য আকর্ষণীয়। জুডি অকল্যান্ডে তার বন্ধু এ্যাটকিনশনকে লেখে
প্রিয় এ্যাটকিনশন,
পার্থ নামক একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হতে চেষ্টা করছি। ওর মা একজন স্বামীহীন প্রৌঢ়া মহিলা। কেমন যেন মা-মা চেহারা। দেখলেই বুকের ভেতর হু-হু করে ওঠে। পার্থ তার একমাত্র সন্তান। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। পঙ্গু যোদ্ধাদের মধ্যে ও আমার সেবায় আছে। আমার মতো বয়স ওর, সরলতা আছে।
পার্থের মা, আমার তোমার বাবা-মা’র মতো না। ভদ্রমহিলা স্বামীকে ভাবেন ঈশ্বর। প্রেমময়ী সন্তানের জননী। তার জীবনের সমস্ত চাহিদা সন্তান-স্বামীকে ঘিরে। আমার খুব ভালোলাগে। আমার সঙ্গে ভদ্রমহিলার সম্পর্ক মা মেয়ের মতোন। ভাষার দূরত্ব অতিক্রম করে আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারি। সহসা এখান থেকে চলে যাবার আগ্রহ পাচ্ছি না। তবে কোনো বসন্তে তোমার ডাক শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।
পার্থ বন্ধু হিসেবে আন্তরিক। জীবনের শুরুতেই অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছে। মানুষকে বুঝতে পারে। তোমার কথা বলা হয়নি ওকে। খুব শিগগির বলবো।
বাবার সঙ্গে দেখা হলে বলবে আমি তাকে মনে করছি। আমার অনেক কষ্ট। তুমি ভালো থেকো।
জুডিএল, বাংলাদেশ
১৭ এপ্রিল, ১৯৭৩