উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // ষষ্ঠ পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল//জাকির তালুকদার//প্রথম পর্ব//
- ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // দ্বিতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস / আমাদের আগুনবিহীন কাল / জাকির তালুকদার / তৃতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস /আমাদের আগুনবিহীন কাল /জাকির তালুকদার /চতুর্থ পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পঞ্চম পর্ব
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // ষষ্ঠ পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// সপ্তম পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// পর্ব আট
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব নয়
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব দশ
- উপন্যাস।। আমাদের আগুনবিহীন কাল।। জাকির তালুকদার।। পর্ব এগারো
মা এখন আর মোবাইলে কথা শুরু করলে সহজে থামতে চায় না। অথচ এই যন্ত্রটার প্রতি তার অরুচির অন্ত ছিল না। ইমরুল নিজেও মোবাইলে বক বক করতে পছন্দ করে না। কিন্তু এখন মা আর ছেলের সেতুবন্ধ হয়েছে মোবাইল।
দুই-দুইটা উইকএন্ড কেটে গেল। তুই বাড়ি এলি না!
ইমরুল আমতা আমতা করে- নতুন জায়গা একটু গুছিয়ে নিতে সময় লাগছে মা।
তুই যেখানে থাকিস, সেই ডরমিটরিটা কি মোটামুটি বাসযোগ্য?
তা নাহলে বাস করছি কেমন করে?
এসি লাগানো আছে?
এসি লাগে না মা। এ তো ঢাকার মতো বাড়ি আর মানুষে ঠাসা জায়গা নয়। আমাদের বিল্ডিংটা একেবারে ফাঁকা মাঠের মধ্যে। জানালা খুলে রাখলে চারদিক থেকে হু হু করে বাতাস আসে। রাতে ফ্যান বন্ধ করে শুতে হয়।
এই কথাটা সত্যি। প্রায় রাতেই ইলেকট্রিসিটি থাকে না। ফ্যান বন্ধই থাকে।
তোর রান্না করে দেয় কে? আমি এত করে বললাম মান্নানকে সঙ্গে দিয়ে দেই।
মান্নান হচ্ছে আব্বার খাস বাবুর্চি।
আমার রান্না করার বুয়া আছে মা।
কেমন রাঁধে? খেতে পারিস?
প্রথম দুই দিন প্রায় খাবার মুখেই তুলতে পারেনি ইমরুল। খুব ঝাল ছিল। আর তেল-মশলা এতই বেশি ছিল যে মুখটা পুড়ে সেদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তারপরে সালেহা খালাও কিছুটা ঝাল-তেল কমিয়েছে, ইমরুলের জিভ-মুখও অ্যাডজাস্ট করতে শুরু করেছে। চলে যাচ্ছে এখন। বেশ জোর দিয়েই ইমরুল বলে সালেহা খালা খুবই ভালো রান্না করে মা।
হ্যাঁ তুই বললি আর হলো? না খেতে পাওয়া ঘরের মহিলারা রান্নার কাজ করে। ওরা ভালো খাবার কী আর চেনে যে ভালো রান্না করবে!
মর্মান্তিক সত্যি কথা। কিন্তু এরা আছে বলেই না ঢাকা আর ঢাকার বাইরের লক্ষ লক্ষ চাকরিজীবীরা তৈরি খাবার পেয়ে চাকরি-বাকরি করতে পারছে।
না মা, সালেহা খালা সত্যিই ভালো রান্না করে। ভালো ঘরের মেয়ে। ঠিক প্রফেশনাল বুয়া না আরকি। স্বামী মদ-জুয়াতে সম্পত্তি উড়িয়েছে বলে এখন এই কাজ করতে হচ্ছে।
আহারে!
সালেহা খালার জন্য অকৃত্রিম দরদ মায়ের কণ্ঠে। বলে- তাহলে এক কাজ করিস। তুই ওখান থেকে যখন ঢাকায় চলে আসবি, সঙ্গে নিয়ে আসিস মহিলাকে। আমাদের এখানেই থাকবে। মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে দেবে।
সে তখন দেখা যাবে!
আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আগামী থার্সডেতে অবশ্যই বাড়ি চলে আসবি। নাহলে কিন্তু আমি ওখানে যাব!
না না তোমাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমিই যাব।
কষ্ট কিসের অ্যাঁ? ছেলে যেখানে থাকে সেখানে যেতে মায়ের কষ্ট হবে কেন? তাছাড়া গেলে আমারও একটা নতুন জায়গা দেখা হবে।
কী আর দেখবে এখানে! দরকার নাই মা। আমি চলে আসব।
বুঝতে পারছি। তুই যে খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই, সেটা আমাদের দেখতে দিতে চাস না।
আমি ভালো আছি মা। সত্যিই ভালো আছি। আমার কাজ আছে এখানে।
তুই কেন আমাকে ছেড়ে গেলি ইমু!
মায়ের কণ্ঠে অনুযোগ। গলা ধরে এসেছে- আমার মেয়েটা থাকে সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়। তোর বড় ভাইটা তো ব্যবসা আর কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। বাপের ধাত পেয়েছে। তোর ভাবি তো বাড়িতে কখন থাকে আর কখন থাকে না আমি টেরই পাই না। তুইও কেন আমাকে ছেড়ে দূরে গেলি বাপ? ওই চাকরি যে আসলে তোর একটা ছুতা তা বুঝতে তো আমাদের কারওই বাকি নেই। তুই কেন গেলি বাপ?
গলা বুজে আসে ইমরুলেরও। নিজেকে সামলাতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। তারপর বলে তুমি ঠিকই বলেছ মা, আমি একটা নির্দিষ্ট কাজ করার জন্যেই এখানে এসেছি। কাজটা শেষ হলেই ফিরে যাব তোমার কাছে।
সত্যিই! খুশিতে ঝলমল করে ওঠে মায়ের কণ্ঠ- তাহলে আমাকে বল কী কাজ? আমি যদি কোনো সাহায্য করতে পারি করব।
বলব মা। তোমার সাহায্য আমার লাগবে। তখন বলব।
আচ্ছা বাবা। একটু শান্তি পেলাম।
রাখি মা এখন?
রাখবি! আচ্ছা! ও হ্যাঁ। নিশি এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করল। তুই নাকি ওর সাথে ফোনে ঠিকমতো কথাই বলিস না?
বিরক্তিতে ছেয়ে যায় ইমরুলের মন। চেপে রেখে বলে আচ্ছা পরে কথা বলে নেবো একসময়। এখন ছাড়ি মা।
ফোন ছাড়তে না ছাড়তেই আবার বেজে ওঠে। অচেনা নম্বর। ধরবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত ইয়েস বাটনে চাপ দেয়। ওপার থেকে নয়নের কণ্ঠ ভেসে আসে- ডাক্তার সাহেব, আপনার জন্য কিছু কাগজ এনেছি। খুঁজে বের করেছি আরকি। কোথায় পৌঁছে দেব? খাজনা বন্ধ আন্দোলনের শহিদদের নাম-ঠিকানা সব পেয়েছি।
নয়নকে দেবতার মতো মনে হয় তখন তার। যেমন মনে হতো ফারুক ভাইকে। সাংবাদিক বলতে কেবলমাত্র এতদিন ফারুক ভাইকেই বুঝত ইমরুল। তার কাছে যাওয়া মানেই এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কিন্তু ব্যবহার একেবারেই অদ্ভুত ফারুক ভাইয়ের। কখন যে কোন মুডে থাকে বলা মুশকিল। একদিনের কথা মনে পড়ে ইমরুলের। আড্ডায় ঢুকতেই ফারুক ভাই খেঁকিয়ে উঠল- তুমি শালা এখানে কোন ধান্দায় আসো?
কয়েক পেগ বাংলামদ পেটে পড়লেই ফারুক ভাই প্রশ্নটা করে ইমরুলকে। করবেই। ইমরুল উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকায় আবার ফারুক ভাই প্রশ্নটা করে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। হ্যাঁ তোমাকেই। আমাদের এই লোয়ার মিডলক্লাস পেটিবুর্জোয়া সার্কেলে তুমি কেন এসে ভিড়েছ চান্দু? স্টাডি করতে এসেছ? দেখতে এসেছ কীভাবে আমরা মানুষ না হয়েও মানুষ নামে জীবন যাপন করি? দেখতে এসেছ আমরা কতজনের কাছে কতরকমভাবে আমাদের পোঁদ বন্ধক দিই? দেখতে এসেছ কত ছোট ছোট অফার দিয়ে আমাদের কিনে নেওয়া যায়? এসব নিয়ে থিসিস লিখবে? ইংরেজিতে? করপোরেট হাউস তোমার থিসিসের ফান্ড করবে। তোমার থিসিসের প্রকাশনা উৎসব হবে পাঁচতারা হোটেলে। মিনিস্টার থাকবে প্রধান অতিথি। তাই না? এই জন্যই তুমি ঘুরঘুর করো আমাদের চারপাশে তাই না?
পল্টনের গলিতে আজিমের ভাতের হোটেলের পেছনের ঘরে রাত এগারোটার পরে বসেছে ওরা। আজিম অনেক পুরনো ভক্ত ফারুক ভাইয়ের। তার বিশ্বাস এই দেড় কোটি মানুষের ঢাকা শহরে যে দুই-চারজন মানুষের বাচ্চা আছে, তাদের মধ্যে ফারুক ভাই একজন। ঢাকা শহরে এখন আর আড্ডা তেমন হয় না। হবে কীভাবে! বসার জায়গাই তো নেই। গিজগিজ করা মানুষ যে যেখানে পেরেছে নিজের দখল কায়েম করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া মানুষের আড্ডার কোনো জায়গা এখন নেই। সেখানেও এত ভিড় যে পৌষ মাসেও মানুষের গায়ের গরমে ঘাম ঝরে। সেই সময়ে আজিম যে ফারুক ভাইকে এখানে বসার সুযোগ করে দেয় মাঝে মাঝে, তাতেই বোঝা যায় ফারুক ভাইয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধার পরিমাণ কত বেশি। এই ঘরটা আসলে তার কর্মচারীদের রাতের শোবার জায়গা। একটামাত্র চৌকি। টেনেটুনে দুইজন শোয়া যায়। অন্যরা মেঝেকে শোয়। অনেকগুলো ফোল্ডিং কাঁথা-বালিশ দেখা যাচ্ছে। চৌকিতে ফোল্ডিং করা কাঁথা-বালিশের গায়ে ঠেস দিয়ে আধাশোয়া হয়ে গ্লাস থেকে বাংলা খাচ্ছে ফারুক ভাই। অন্যদেরও ঢালাও পারমিশন আছে খাওয়ার। যে খাচ্ছে সে খাচ্ছে। যে বাংলা না খাচ্ছে, সে চাট খাচ্ছে মাঝে মাঝে। ফারুক ভাই ছাড়া অন্য তিনজনের জন্যে তিনটে চেয়ার দিয়ে গেছে আজিমের কর্মচারী।
তান্না বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে- তা কেন হবে ফারুক ভাই! ও তো আমাদের বন্ধু। ও নিজের সোসাইটিতে তিষ্টাতে পারে না। নিজেদের সোসাইটি ওর কাছে ভণ্ডামি আর ক্রাইমে ভরা বলে মনে হয়। তাই ও আমাদের কাছে আসে। মানে আপনার কাছে আসে।
কেন? আমার কাছে কেন আসে? আমি কি পির না সাঁইবাবা? আমার কাছে এলে ওর লাভটা কী?
লাভের জন্যে তো আসে না। আসে আপনাকে পছন্দ করে বলে। আপনার লেখা পছন্দ করে বলে।
আর লেখা! ফারুক ভাই ‘ফুঁ’ শব্দ তোলে ঠোঁটে- লেখার আবার পছন্দ করার কী আছে! তোরা তো জানিস না। আমি তোদের আজ একটা গোপন কথা ফাঁস করে দিচ্ছি শোন। লেখা মানে হচ্ছে বিজ্ঞাপন। সেলফ অ্যাডভার্টাইজমেন্ট। কে নেবে আমাকে নাও! বুঝতে পেরেছিস তো, বিজ্ঞাপন, স্রেফ বিজ্ঞাপন।
ইমরুল বুঝতে পারে না। তবু একটু হাসির চেষ্টা করে। তার হাসি দেখে খেপে ওঠে ফারুক ভাই। একটু চড়া কণ্ঠে বলে- বিশ্বাস হচ্ছে না! আচ্ছা বিজ্ঞাপন যদি সরাসরি না বলিস, না বল। তবে এটুকু তো মানবি যে লেখা হচ্ছে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা?
হ্যাঁ। এই কথাটা খানিকটা মানা যায়। ক্রিয়েটিভ লেখার কথা বাদ দিলে জার্নাল ধরনের বা কলামগুলো তো দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাই তো করা হয়।
গালি দিয়ে উঠল ফারুক ভাই- আমার ইয়ে বুঝেছিস তুই! ক্রিয়েটিভ লেখা আর কলাম লেখা বলে কোনো কথা নেই। এখন আমরা যা কিছু লিখি, সবগুলোরই অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এক। তা হচ্ছে নিজেকে বিক্রির জন্য সর্বোচ্চ দাম পাওয়ার চেষ্টা।
হতাশা-আক্রান্ত মানুষটার জন্য খুব মায়া লাগল ইমরুলের। সুস্থ অবস্থায় এই লোকের সামনে লেখকদের নিয়ে একটা কটু মন্তব্য করলে তাকে বাক্যবাণে ফালা ফালা করে দেয় ফারুক ভাই। আর এখন সে বলে চলেছে- শোন, আমরা লেখা দিয়ে শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া কিংবা তাদের হাতানাতাদের ইঙ্গিত দিয়ে রাখি যে, আমরা তোমার লোক। তারা ক্ষমতায় এলেই দেখবি তখন পোয়াবারো। ওই যে ইশারাই কাফি! দেখা যাচ্ছে ইশারা অনুযায়ী সেই লেখক হয়ে যাচ্ছে বাংলা একাডেমির ডিজি, জাদুঘরের মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমির অমুক, অমুক একাডেমির অমুক। তা ছাড়া পদক-পুরস্কার-বিদেশ ভ্রমণ তো আছেই।
এসব কথা বলার দরকার নেই ফারুক ভাই।
বলব না কেন? এবার খেঁকিয়ে উঠল ফারুক ভাই- বলব না কেন? আমি কি কোনো শালাকে ডরাই? আমি কি ওইসব পদের জন্য জিভ থেকে টপটপিয়ে পড়া লালা নিয়ে দৌড়াই?
না দৌড়ান না। সেই জন্যই তো আমরা আপনার কাছে আসি।
এবার ম্লান হাসে ফারুক ভাই। বলে- এসে লাভ নেই। মান্দেলশ্তামরা বেশিদিন জনসমক্ষে বিচরণের সুযোগ পায় না। আমিও পাব না।
মনে মনে রোমাঞ্চ বোধ করল ইমরুল। এখনই বোধহয় ফারুক ভাইয়ের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে কবি মান্দেলশতামের কোনো কবিতা কিংবা তার সম্পর্কে না-জানা কোনো অসাধারণ তথ্য। এই লোভেই না তাদের ফারুক ভাইয়ের পাশে পাশে ঘুর ঘুর করা। কখন যে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে স্তোত্রের মতো কবিতার পঙ্ক্তি কিংবা সুসমাচারের মতো মণিমুক্তো মেশানো কথামালা!
কিন্তু ফারুক ভাই অনেকক্ষণ কেটে গেলেও মুখ খোলে না। শ্যামল একটু তাগাদা দেয় মান্দেলশতামের কথা কী যেন বলছিলেন!
ফারুক ভাইয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকছত্র কবিতা
বিদায়, হে সখা, বিদায়ের ক্ষণ মানো,
হে প্রিয় আমার বুকেরই মধ্যে রবে
এ-বিদায় সে তো ললাটলিখনই জানো
নিশ্চিত ফের কোনোখানে দেখা হবে।
বিদায় হে সখা, বাড়াবো না হাত, কবো না কো বরাভয়
খেদ কোরো না কো মোছা ললাটের শোক
মৃত্যু জানো তো নতুন কিছুই নয়,
তবে বাঁচাটাও নতুন বলে না লোক।
তান্না বলে এ তো সের্গেই ইসিয়েনিনের কবিতা।
মুদোচোখেই তার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল ফারুক ভাই শাবাশ ছোকরা, তোর হবে!
তারপরেই দ্রুত সংশোধন করল নিজের কথা না খুব বেশি তোর হবে না। হলে হবে ওর। ইমরুলের দিকে আঙুল তুলে দেখাল ফারুক ভাই।
কেন? ওর হবে না কেন?
হবে না। কারণ তান্নাও আমারই মতো হাঘরে পরিবারের ছেলে। হাঘরে বোঝো? ও বোঝো! আচ্ছা বেশ। তাহলে শোনো, আমাদের মতো পরিবারের সন্তানরা বেশিদূর যেতে পারে না। যেমন ধরো, আজ এই দুই পাত্তর বাংলা মদ খাওয়ার কারণে কাল সকালে আমার বাপের ওষুধ কেনার টাকায় টান পড়বে। আমার বাপের যে কত অসুখ! হার্টের অসুখ, হাই ব্লাডপ্রেশার, ডায়াবেটিস, প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের অসুখ। গত পনেরো বছর ধরে আমার বাপের জন্য প্রতিদিন প্রায় দেড়শ’ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। আজ বেহিসাবি খরচটা করে ফেললাম মাল খেয়ে। মাঝে মাঝে এই রকম হয়ে যায়।
খান কেন তাহলে?
এবার একেবারে স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলল ফারুক ভাই। বোঝা গেল মাতলামি তার কেটে গেছে পুরোপুরি। কিন্তু কথার মধ্যে মহাশূন্যের সমান হাহাকারÑ কেন খাই? হঠাৎ অনেকদিন পর পর আমার মনে হয়, আমার অসাধারণ কিছু একটা হবার কথা ছিল। সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমি কোনোদিন সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে অনুবাদ করার সুযোগ পাব না। তখন মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে। সেই ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখার জন্যই মদ খেতে আসি।
কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে এলো। ঘরের বাতাস অনেকটাই ভারী হয়ে গেল বিষাদে। এই রকম কথার পিঠে কোনো কথা বলে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যায় তা ভেবে বের করতে সময় নিচ্ছে সবাই। তান্নাই আবার কথা শুরু করতে পারে যাই হোক, মান্দেলশতামের কবিতা নিয়ে কী যেন বলতে চেয়েছিলেন?
এবার খ্যাপাটে কণ্ঠে কথা বলে ফারুক ভাই- কবিতার আবার আলোচনা কীসের? কবিতা তো কবিতাই। তার কোনো আলোচনা হয় না। বরিস পাস্তেরনাকের কথা মনে নেই তোদের? প্যারিসে বিশ্ব কবিতা কংগ্রেসে কবিতা নিয়ে বলতে উঠে পাস্তেরনাক কী বলেছিলেন? কয়েকটামাত্র কথা। বলেছিলেন- ‘কবিতার আসন সবসময় সর্বোচ্চ গিরিচূড়ায়- আল্পস থেকেও অনেক উঁচুতে। অথচ কবিতার উৎস আমাদের পায়ের তলায় ঘাসের মধ্যে, শুধু কাউকে মাথা নিচু করে দেখতে হবে আর মাটি থেকে তুলে নিতে হবে। এই বিষয়টি এতই সরল যে, সভায় আলোচনা করার মতো নয়।’
আবার অনেকক্ষণের নীরবতা।
ফারুক ভাই আবার কথা বলে- অথচ এই পাস্তেরনাকের ওপর কী নির্যাতনটাই না চালিয়েছে স্ট্যালিন!
রুশ বিপ্লবের সময় সিংহভাগ লেখক-বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে পাস্তেরনাকও ছিলেন বিপ্লবের পক্ষের একজন আপোসহীন কর্মী এবং সমর্থক। কিন্তু লেনিনের মৃত্যুর পরেই পথ হারাতে শুরু করল বিপ্লব। অন্য সব ক্ষেত্রের মতো তখন লেখকরাই যেহেতু স্ট্যালিনের কাজের গলদগুলো সবচেয়ে আগে বুঝতে পারছিলেন, তাই স্ট্যালিনেরও প্রধান টার্গেট ছিলেন লেখকরাই। তখন সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হলো র্যাপ নামে লেখকদের সংগঠন। বলা হলো র্যাপের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রলেতারিয় বিপ্লবী সংস্কৃতি গড়ে তোলা। কথাগুলো শুনতে ভালোই। কিন্তু আসলে পেছনে ছিল জবরদস্তি এবং হুমকি। এই সংগঠনে যোগ দিলে সে লেখক হিসেবে বাঁচতে পারবে, তা নাহলে তার জায়গা হবে শ্রমশিবিরে অথবা কবরে। স্ট্যালিনের ঘোষণা ছিল যে, লেখকদের এই সংগঠনে যোগ দিয়ে হয় প্রলেতারিয়েতদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে হবে, নইলে সোভিয়েত লেখক হিসেবে নিজের অধিকার প্রত্যাহার করতে হবে। পরে র্যাপ থেকে জন্ম নিল সোভিয়েত রাশিয়া লেখক ইউনিয়ন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, র্যাপের মাধ্যমে যিনি লেখকদের বাধ্য করছিলেন স্ট্যালিনের পক্ষে কাজ করতে, সেই এভারবাককেও স্ট্যালিনের নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তো পাস্তেরনাককেও বাধ্য করা হলো সংগঠনে যোগ দিতে। তাকে পাঠানো হলো একটি যৌথ খামার দেখতে। উদ্দেশ্য যৌথ খামার দেখে এসে তিনি এই যৌথ খামার ব্যবস্থার পক্ষে একটি বই লিখবেন। কিন্তু পাস্তেরনাক সেখানে গিয়ে যা দেখলেন, তাতে যৌথ খামার ব্যবস্থার ওপর তার ঘৃণা জন্মে গেল। সেখানে চাষিদের দুরবস্থা দেখে তিনি মানসিকভাবে এতই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, প্রায় এক বছর তিনি রাতে ঘুমাতেই পারেননি। পরে মিনস্কতে এক লেখক সমাবেশে তিনি পরিষ্কার বললেন যে, হুকুমমাফিক পাম্প দিয়ে নলকূপে পানি তোলা যায়, কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না। পাস্তেরনাক তখন আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত লেখক। তাকে প্রাণে মারলে বহির্বিশ্বে প্রচণ্ড প্রভাব পড়বে। কিন্তু স্ট্যালিন তো ছাড়ার পাত্র নয়। পাস্তেরনাককে না মেরে তখন মারা হলো তার প্রিয় বন্ধু কবি মান্দেলশতামকে। মান্দেলশতামকে গ্রেফতার করার কয়েকদিন পরে হঠাৎ একরাত্রে বেজে উঠল পাস্তেরনাকের টেলিফোন। রিসিভার তুলতেই শোনা গেল একটি কণ্ঠ কমরেড স্ট্যালিন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
শুনে তো পাস্তেরনাক হতভম্ব।
স্ট্যালিনের প্রথম প্রশ্ন ভেসে এলো- মান্দেলশতামকে গ্রেফতার করার পরে তোমাদের কবি-সাহিত্যিক মহল কী বলাবলি করছে বলো তো!
তোতলাতে তোতলাতে পাস্তেরনাক বললেন নাহ্ কেউ কিছু বলছে না। কী বলবে! সকলেই তো ভীষণ ভয়ে ভয়ে আছে।
আচ্ছা! কিন্তু মান্দেলশতাম সম্পর্কে তোমার নিজের কী ধারণা? কবি হিসেবে সে কেমন?
পাস্তেরনাক বললেন- বড় কবি। ভালো কবি। তবে আমাদের গোত্রের নন। তিনি প্রাচীনপন্থি ক্ল্যাসিকাল ধারার কবি; আর আমরা পুরনো সব কাব্যকৌশলগুলো ভাঙতে চাইছি।
তবে মান্দেলশতাম সত্যি সত্যি একজন জিনিয়াস কবি। ঠিক কি না? স্ট্যালিনের প্রশ্ন।
এর উত্তরে কী বলবেন পাস্তেরনাক? কী বলা সম্ভব? আমতা আমতা করে বললেন- এটা তো কোনো বিবেচ্য বিষয় হলো না। কিন্তু আমরা মান্দেলশতামকে নিয়ে এত কথা বলছি কেন, তা বুঝতে পারছি না। আমার অন্য কথা বলার ছিল আপনাকে। অনেকদিন ধরেই বলার সুযোগ চাইছি।
কী কথা? কী নিয়ে কথা?
জীবন ও মৃত্যু নিয়ে।
ঘটাং করে কেটে গেল টেলিফোনের লাইন।
মান্দেলশতামকে আর কেউ দেখতে পায়নি কোনোদিন। আর বরিস পাস্তেরনাক। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেও তাকে বাধ্য করা হলো সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে।
চুপচাপ শুনল ওরা তিনজন। ফারুক ভাই থামতে ইমরুল প্রশ্ন করল নিচুগলায়- তাহলে আমরা সমাজতন্ত্র চাইছি কেন?
ফারুক ভাই খেপে উঠল চাইব না মানে! সমাজতন্ত্র মানে কি শুধু স্ট্যালিনের আমল? আর সমাজতন্ত্র ছাড়া এই দেশের চৌদ্দ কোটি দুপেয়ে জানোয়ারগুলোকে মানুষের স্বীকৃতি কে দেবে? আছে আর কিছু?
একটু ভেবে মাথা ঝাঁকাল ইমরুল- না নেই। সত্যিই নেই।
শ্যামল জিজ্ঞেস করে- আপনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে একবিন্দুও সম্মান করেন না তাই না?
তার দিকে ধারালো চোখে তাকাল ফারুক ভাই যে সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয়, তাকে সম্মান দেখাতে যাব কোন দুঃখে?
গরিব বলে তারা সম্মান পাবে না?
গরিব বলে নয়। গরিব বলে কাউকে অসম্মান করার লোক আমি নই। আমি অসম্মান করি দারিদ্র্যের কারণে তাদের কোনো ইমান না থাকার জন্য।
এ আবার কেমন কথা? ইমান নাই গরিবদের?
হাসল ফারুক ভাই- গরিবদের ইমান থাকা খুব কঠিন রে ভাই! তোর তো অভিজ্ঞতা নাই, তাই জানিস না। তোরা মনে করিস গাঁয়ের গরিব মানুষরা খুব সহজ-সরল। না কথাটা ঠিক নয়। ওরা বোকা। কিন্তু সরল নয়। এই দেশের যে এত দুরবস্থা, তার জন্য কি তোর মানে করিস শুধু দেশের শাসকরাই দায়ী? গরিব ভোটারদের কোনো দায় নেই?
তাদের আবার কীভাবে দায়ী করব!
ক্যান বেছে বেছে সবচেয়ে পোকায় খাওয়া শয়তানগুলোকে ভোট দেয় না ওরা?
প্রতিবাদ করতে গিয়েও থমকে গেল ইমরুল। তাই তো!
ফারুক ভাইকে তখন আবার কথায় পেয়েছে যাও তো চান্দু, যে কোনো আসনে সবচেয়ে সৎ শিক্ষিত যোগ্য লোককে দাঁড় করিয়ে দাও গিয়ে। দেখবে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে নিশ্চিতভাবে।
সবসময় তো হয় না।
সবসময়ই হয়। শোন তোদের বিলাসগাড়ির ঘটনা বলি। উত্তরবঙ্গের একটা ইউনিয়ন। সেই জায়গাকেই আমরা একটা পাইলট এলাকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। বাম দলগুলোর বাছা বাছা কর্মীকে পাঠানো হয়েছিল। একনাগাড়ে ছয় বছর কাজ করা হলো। গড়ে উঠল বিশাল ক্ষেতমজুর আর কৃষক সংগঠন। বিলাসগাড়ি ইউনিয়নে কাজ করা হয়েছিল খুব সায়েন্টিফিক পদ্ধতিতে। পুরো ইউনিয়ন জরিপ করা হয়েছিল। ভোটার সংখ্যা কুড়ি হাজারের মতো। গ্রামবাসীর আর্থ-সামাজিক শ্রেণিবিভাগ, বিগত আন্দোলন-সংগ্রাম অংশগ্রহণের ইতিহাস, শিক্ষার হার, শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের প্রবণতাসহ বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় স্টাডি করে রেজিস্টার তৈরি করা হয়েছিল। সংগঠন হয়েছিল সত্যিই বিরাট। সংগঠনের মাধ্যমে খাসজমি খুঁজে বের করে দখল করা হলো। বিলি করা হলো ভূমিহীনদের মধ্যে। কাবিখা প্রজেক্টের গম চুরি বন্ধ করা হলো। এনজিওগুলোর মহাজনি ঋণ নিয়ে যারা সর্বস্বান্ত হয়েছিল, তাদের পুনর্বাসন করা হলো। ছয় বছরে সংগঠন থেকে সরাসরি বেনিফিটেড হয়েছিল প্রায় সাত থেকে আট হাজার ভোটার। ইউপি ভোটের সময় আমরা বললাম, এবার আপনারা নিজেদের মধ্য থেকে নিজেদের লোককে চেয়ারম্যান-মেম্বার বানাবেন। সবাই রাজি। লোকমান নামের একজনকে চেয়ারম্যান ক্যান্ডিডেট করা হলো। তার নমিনেশন জমা দিতে ইউএনও অফিসে যাওয়ার সময় যত বড় মিছিল হলো, অত বড় মিছিল নাকি ওই এলাকার মানুষ আগে কোনোদিন দ্যাখেনি। তারপর ভোটের রেজাল্ট শুনবি?
বলেন।
লোকমান পেল সর্বসাকুল্যে তিনশো উনিশ ভোট।
শ্যামল থাকতে না পেরে উত্তেজনার চোটে বলে ফেলল- এ কীভাবে সম্ভব?
ফারুক ভাইয়ের মুখে তিক্ত হাসি ভোটের আগের রাতে টাকা খেয়ে সব চলে গেছে বিএনপি-আওয়ামী লীগের ভোটের বাক্সে।
এই রকম অসংখ্য ঘটনা আছে। সেসব থেকে আমার শিক্ষা হচ্ছে, বাংলাদেশের তথাকথিত জনগণের ওপর নির্ভর করে এই দেশে কোনো মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব নয়।
তাহলে কার ওপর নির্ভর করব?
অম্লান বদনে বলল ফারুক ভাই- জানি না।
আবেগে ইমরুলের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে- তাই নাকি! আপনি কোথায় আছেন নয়ন ভাই? প্রেস ক্লাবে?
না। আমি আছি মুন্সির চায়ের দোকানে। বাজারের উত্তর কোণে। মসজিদটার পাশে। চেনেন আপনি?
সে আমি চিনে নেব। আপনি থাকুন। আমি আসছি এখনই।