উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// পর্ব আট

মিথ্যা কথা! ছইরউদ্দিন ডাকাত আছিল না!

তীব্রস্বরে প্রতিবাদ জানায় হরমুজ আলি। এ কথা বলার সময় এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে সম্ভব হলে তার ছানিঢাকা চোখ থেকে আগুন ছিটকে পড়ত। তবে তার উত্তেজনার পরিমাণ বোঝা যায় বসে থাকা থেকে সোজা খাড়া হয়ে যাওয়া আর বাতাসে নিজের কম্পমান হাত ঘোরানো দেখে।

নয়ন তাকে বলে সে কথা আমরাও জানি। কিন্তু পুলিশের খাতায় সে ছিল দস্যু। তার নাম থেকে এই কলঙ্ক মুছে ফেলার জন্য চেষ্টা করছি আমরা। আমরা জানি ছইরউদ্দিন ছিলেন কৃষক সমিতির নেতা।

হ্যাঁ। আমারে সমিতি আছিল। বিরাট সমিতি। ২৬৩ গিরামের সমিতি। সেই হাটবারে যখন গুলি কইরা পুলিশ মারল ২৬ জনারে, সেদিন তো হাজার হাজার মানুষের মিছিল। গুলি কর‌্যা পুলিশ হারামীগুলান পলাইছিল ইস্টিমারে। নাহলে মানুষ অগোরে টুকরা টুকরা কর‌্যা বিলের মাছগুলারে খাওন দিত।

হাটের মধ্যে ওই ফলকটা আপনারা লাগিয়েছিলেন?
কীসের কথা কচ্চো?
ওই যে একখান সিমেন্টের বেদি। যেটাতে শহিদদের নাম আর তারিখ লেখা আছে। এখন অবশ্য আর দেখতেই পাওয়া যায় না।

হ্যাঁ। কিষান সমিতিই লাগাইছিল। মওলানা সাব আইছিলেন। তানি ঐডা বসাইলেন। তারপরে দোয়া করলেন।

কোন মওলানা?
ওই যে তর্কবাগীশ।
আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ?
হবার পারে।

হরমুজ আলির খোঁজ পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে নয়নকে। উপজেলা থেকে কমপক্ষে কুড়ি কিলোমিটার দূরে থাকে বৃদ্ধ। রাস্তাও দুর্গম। খানিকটা মোটরসাইকেল, খানিকটা নৌকা, তারপর পুরো চার কিলোমিটার কাদা ঠেলে পায়ে হাঁটা।

জনে জনে কথা বলে নয়ন জেনেছে ওই সময়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী একজনই কেবল বেঁচে আছে। সে হরমুজ আলি। তখন তেরো-চোদ্দ বছর বয়সের ছেলে। কিন্তু সাথে সাথে থাকত কৃষক সমিতির। ছইরউদ্দিন তাকে দেখে হেসে বলত- বালক বীর।

তার মতো বালক অবশ্য আরও অনেকেই ছিল। তাদের কাজ ছিল গাঁয়ে গাঁয়ে সংবাদ পৌঁছে দেওয়া। ধলগাঁতি ছিল ছইরউদ্দিনের আসল আস্তানা। পাঁচ জমিদারের জমিদারি তখন চলনবিলের এই অংশে। কলকাতার ঠাকুর পরিবার, ঢাকার বাঁড়ুজ্জে পরিবার, সলপের সান্যাল পরিবার, পোরজনার ভাদুড়ী পরিবার, স্থলের পাকরাশী পরিবার।

ঠাকুর পরিবারের জমিদারি! সেখানেও অত্যাচার।

ইমরুলকে অবাক হতে দেখে হাসে নয়ন। বলে জমিদার তো জমিদারই ইমরুল। ঠাকুর পরিবারের সবাই কি আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন? জমিদারি মানে স্থায়ী আয়। সেই আয় যে যতটা পারে বাড়িয়ে নেয়। তাছাড়া ঠাকুর পরিবারের প্রথম সিংহপুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তো এদেশের অনেক অপকর্মের হোতা। এই দেশে নীলচাষ নিয়ে যে বছরের পর বছর আন্দোলন হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ কষ্ট পেয়েছে, লক্ষ লক্ষ পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে, সেই নীলচাষ শুরুর দিকে সবচাইতে বড় ওকালতি করেছিলেন মহান রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর।

ইমরুলের বিশ্বাস হয়নি। পরে নয়নের ঘরে সুপ্রকাশ রায়ের বইতে তাদের দুই জনের চিঠি পড়েছিল সে। দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন নীলচাষের পক্ষে জোর সুপারিশসহ। তিনি লিখেছিলেন- ‘আমি দেখিয়াছি, নীলের চাষ এদেশের জনসাধারণের পক্ষে সবিশেষ ফলপ্রসূ হইয়াছে। জমিদারগণের সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং কৃষকদেরও বৈষয়িক উন্নতি সাধিত হইয়াছে। যে অঞ্চলে নীলের চাষ নাই সেই অঞ্চলের তুলনায় নীলচাষের এলাকাভুক্ত অঞ্চলের মানুষ অধিকতর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করিতেছে। আমি ইহা কেবল জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া বলিতেছি না, প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে নিজের অভিজ্ঞতা হইতেই ইহা আমি বলিতেছি।’

হরমুজ আলি বলে- ঠাকুর-ঠুকুর বুঝি না। সব শালা জমিদার আছিল হারামখোর।

খাজনা কি ইচ্ছামতো বাড়াতে পারত তারা? ব্রিটিশের নিয়ম বেঁধে দেওয়া ছিল না?

আর নিয়ম! মাপেই যে আছিল ফাঁকি?
মাপের ফাঁকি মানে?

এইডেই তো আসল জিনিস। ছইরউদ্দিন ধইরে ফেলল। দেখল নলে আছে ফাঁকিবাজি।

নল?

ইমরুলের প্রশ্নের উত্তরে নয়ন জানায় সেই সময় জমি মাপার ইউনিট ছিল নল। এখন যেমন বিঘা-কাঠা, তখন ছিল নল। বিশেষ করে জরিপের সময় নল ব্যবহার করা হতো।

ছইরউদ্দিন কলো যে নলে ফাঁকি আছে। এক নলে হোবার কথা সাড়ে চব্বিশ ইঞ্চি, কিন্তু এই নলে আছে আঠারো ইঞ্চি। তাহলে যার খাজনা হয় ১ টেকা, তার খাজনা জরিপে হয়া যাচ্ছে দ্যাড় টেকা। বান্ধো শালা জরিপকারী আর পেয়াদাগুলানেক!

এরপরেই হাঁক দিয়ে গান ধরে হরমুজ আলি

            ওরে জমিদারে চুরি করে

            অরে ছইরউদ্দিরে…

            কিষান কয়রে করব বিনাশ

            সকল চোরের গুষ্টি রে…

শুরু হয়্যা গেল বিদ্রোহ।

প্যায়দাগুলানের সামনে ইকটু বেশি ফটর ফটর করিছিল কালিপদ দাস। সে নিখোঁজ হয়া গেল বাড়ুজ্জেগোরে হাট থেকে ফিরার পথে। নিখোঁজ তো নিখোঁজ। জলজ্যান্ত একখান জুয়ান মানুষ, এমনভাবে নাই হয়া গেল য্যান তাঁই কুনোদিন আছিলই না। ছইরউদ্দিন কয় কালিপদরে গুম করিছে বাঁড়ুজ্জে জমিদারের লোক। চিঠি পাঠাও। যদি কালকার মদ্যে কালিপদক ছাড়ান না দেয়, তাইলে আমরা নিজেরা খুঁজবার যাব জমিদার বাড়িত।

এই কথার প্রকৃত অর্থ বোঝেনি বন্দ্যোপাধ্যায় জমিদাররা। তারা ভেবেছিল, এ তো কথার কথা! জমিদারবাড়িতে ঢুকবে কীভাবে চাষাভূষারা!

ঠিক সন্ধ্যার পরপরই হাজার খানেক কৃষক সঙ্গে নিয়ে ছইরউদ্দিন গেল জমিদারবাড়িতে। দাবড়ানি খেয়ে পলিয়ে বাঁচল জমিদারের ডজন খানেক পাইক আর ভোজপুরি দারোয়ানরা। এবার দশজনের একটা দল ঠিক করে দিল ছইরউদ্দিন। তারা জমিদারবাড়ির সব ঘরে ঢুকে খুঁজবে কালিপদকে।

এটা ছিল ছইরউদ্দিনের একটা চাল। কালিপদকে কি আর জমিদার নিজের বাড়িতে গুম করে রাখবে? কিন্তু দশজন চাষা বাড়ির ভিতরে ঢুকছে, অন্দরমহলে তল্লাশি চালাচ্ছে, জমিদারবাড়ির নারীদের সামনে জমিদারের লজ্জা রাখার জায়গা থাকে কোথায়! জমিদার তখন তড়বড় করে স্বীকার করে যে, কালিপদকে বেঁধে রাখা হয়েছে শল্লামারির কুঠিতে। জমিদারের পরোয়ানা নিয়ে লোক চলল আগে আগে। তার সাথে হাজার সশস্ত্র সঙ্গী নিয়ে ছইরউদ্দিন। উদ্ধার করা হলো কালিপদ দাসকে।

এবার পুরো চলনবিলের মানুষ বুঝে গেছে কৃষক সমিতির শক্তি। দলে দলে মানুষ যোগ দিচ্ছে কিষান সমিতিতে। গ্রামে গ্রামে গায়েনরা গান বাঁধছে ছইরউদ্দিনকে নিয়ে, কিষান সমিতি নিয়ে।

এর সঙ্গে আরেকটা কাণ্ড করল ছইরউদ্দিন। জমিদারকে খাজনা না দিয়ে সোজা চলে গেল সদরের ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে। সেখানে আগের নলের মাপ অনুযায়ী নিজের খাজনা শোধ করে রসিদ নিয়ে ফিরে এলো গ্রামে। তার দেখাদেখি সচেতন কৃষকরা একই ভাবে খাজনা জমা দিতে লাগল সদর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে গিয়ে। জমিদাররা মামলা ঠুকল। রায় গেল তাদের অনুকূলে। কিন্তু ছইরউদ্দিন দমার পাত্র নয়। সে আপিল করল জজ আদালতে। সেখানে হেরে গেল জমিদাররা। আদালত হুকুম দিল জমিদাররা বাড়তি যে খাজনা প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করেছে, তা অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে তাদের।

এতটা সহ্য করতে নারাজ জমিদাররা। তারা শুরু করল ষড়যন্ত্র, ইংরেজ অফিসারদের সাথে দেনদরবার। এদিকে বাড়তি খাজনার টাকা ফেরত নিতে রোজ প্রজারা ভিড় জমায় জমিদারের কাচারি বাড়িতে। কিন্তু রোজ তাদের ফিরে আসতে হয় খালিহাতে। তখন ছইরউদ্দিন ঘোষণা দিল যে, যতদিন পর্যন্ত জমিদাররা বাড়তি নেয়া খাজনার টাকা ফেরত না দেবে, যতদিন খাজনা-বহির্ভূত অর্থ আদায় বন্ধ না হবে, ততদিন চলনবিলের কোনো প্রজা জমিদারকে খাজনা দেবে না।

খাজনা-বহির্ভূত আদায় মানে?

ইমরুলের দিকে তাকিয়ে অনুকম্পার হাসি হাসে হরমুজ আলি- তোমরা তো বাপু জমিদারের আমুল দ্যাখো নি। দেখলে বুঝতে পারলেনি যে কত টেকা কত ভাবে উঠে যায় জমিদারের ঘরেত। যেমন ধরো একটা আছিল তহুরি আদায়। বচ্ছরের শ্যাষে যখন হিসাবপাতি করা হয়, তখন সেই হিসাবপাতি যারা করে, সেইসব মুন্সিগুলানেক দেওয়ার জন্য টেকা দেওয়া লাগবি প্রজার। সেই আদায়ের নাম তহুরি।

ইমরুলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- মাছের তেলে মাছ ভাজা!

তাইলে আর কচ্ছি কী রে বাপু! তারপরে আছে তোমার বিয়ার খাজনা। জমিদারবাবুর বেটির বিয়া জুড়িছে আরেক জমিদারের ছাওয়ালের সাথে। সেই বিয়ার খরচা বাবদ আদায়। বিয়া তো হলো। তারপরে ধরো ছাওয়ালও হলো। সেই ছাওয়ালের মুখে-ভাত। বাবুরা কত অন্ন-পাসন। সেই অন্ন-পাসনের জন্য বাড়তি টেকা দেওয়া লাগবি প্রজার।

ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ওঠে ইমরুলের- ছি!
এইটুক শুন্যাই ছিক্কার। আরও যে কত আছিল রে বাপ!
যেমন? এবার প্রশ্ন করে নয়ন।

পার্বণী। জমিদারের বাড়িত পূজা হবি। সেই পূজাত আসবি কলকেতা-লখনোতির বাইজি। সেই জন্য টেকা দেওয়া লাগবি সকলের। মুসলমানরাও বাদ যাবার পারবি না। তারপরে একখান আছে রসদ-খরচ। জমিদার বছরে একবার ভেট পাঠায় লালমুখা ইংরেজ সায়েবগুলানেক, তারপরে কলকেতাত ছোট লাটের কাছেত, নবাব-বাদশাগের কাছেত। সেই ভেট পাঠানের নাম করে টেকা আদায় চলে ফি বচ্ছর।

এইসব ল্যাঙোট-পরা অভাবী মানুষকে এত টাকা দিতে হতো বছর বছর!

আরে আরও অনেক আছে। পুলিশ-খরচের নাম শুনিছো?

না তো!

মাসে মাসে পুলিশের কেষ্টুবষ্টুরা আসে জমিদারের বাড়িত ফুর্তি করতে। তা তাগের খানাপিনা আমোদ-ফুর্তির খরচ দিতে হয় প্রজাগের। তার নাম পুলিশ-খরচা।

তার সাথে আছে ডাক-খরচা। জমিদারের নাকি রোজ চিঠি পাঠান লাগে সদরে দরবারে। সেইসব চিঠি পৌঁছানের জন্যে ডাক-খরচ। এইডার জন্যেও বছর বছর টেকা গুনতে হয় প্রজার।

রানিমার শখ হছে তীর্থে যাবি ভগমান দর্শনের জন্যে। টেকা দিবি কে? উঠাও প্রজাদের কাছ থিনি।

জমিদার তো লিচ্ছেই। লায়েব ব্যাটা বাদ যাবি ক্যা! তাঁই যখন গাঁয়ে পায়ের ধুলা দেয়, তখন তার হাতে তুলে দেওয়া লাগবি টেকার তোড়া। এইডার নাম নজরানা।

তারপরে আছে ইশকুল-খরচ, গ্রাম-খরচ, ভোজ-খরচ, সেলামি, খারিজ দাখিল।

শুনেই মাথা ভোঁ ভোঁ করছে ইমরুলের।

তার অবস্থা দেখে খ্যাক খ্যাক করে হাসে হরমুজ আলি। আর খালি একখান আদায়ের কথা কই শুনো। ভিক্ষার নাম শুনিছো?

ভিক্ষা মানে সাহায্য? দান-খয়রাত?

এই ভিক্ষা সেই ভিক্ষা না। এই ভিক্ষা হচ্ছে জোর কর‌্যা টেকা আদায়। কী কারণ? না, জমিদারব্যাটা কলকেতাত মাগিবাজি আর ফুর্তি মারাতে যায়া টেকার টান পড়িছে। তখন হুন্ডি নিছে শেঠের গদিত যায়া। সেই ঋণ শোধ করা লাগবি। তো টেকা দিবি কে? প্রজা। জোর করে আদায় করা এই টেকার নাম হচ্ছে ভিক্ষা।

এইসব অত্যাচার বন্ধ করার জন্যই ছইরউদ্দিন ডাক দিয়েছিল খাজনা বন্ধের। আর সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল চলনবিলের ২৩৬ গ্রামের সকল মানুষ।

Series Navigation<< উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// সপ্তম পর্বউপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব নয় >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *