উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল//জাকির তালুকদার//প্রথম পর্ব//

বাস থেকেই নামতেই নিরীহদর্শন জনপদটি তাকে নীরব অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। হাইওয়ে নির্মিত হলে মানচিত্রের কারণে কিছু কিছু গ্রাম হঠাৎ করেই প্রমোশন পেয়ে বাসস্ট্যান্ডে পরিণত হয়। সেখানে দূরপাল্লার বাস হয়তো থামে না। কিন্তু লোকাল বাস, ট্রাক-লরি, নছিমন, ভ্যানরিকশার একটা জটলা সারাদিনই থাকে। তাই নিভৃতি পরিণত হয় সরগরমে। কয়েক বছর আগেও যা ছিল নিঝুম পল্লি, আজ সেখানকার বাসিন্দারা বাসস্ট্যান্ড হবার সুবাদে তাদের গ্রামকে দেখতে পায় হাটবারের মতো রোজই গমগম গিজগিজ করছো। বাসস্ট্যান্ড মানেই সেখানে যাত্রীছাউনির মতো কিছু একটা, কয়েকটা দোকান, বাঁধানো কোনো বট বা আমগাছের তলায় টেবিল-বেঞ্চি পেতে চায়ের দোকান আর ভ্যানরিকশার প্যাটলারের জটলা থাকবেই। এখানেও সে সবকিছুই ঠিকঠাক পেয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল বড় বড় দুটো স্যুটকেস, ট্রাভেল ব্যাগ, ল্যাপটপের ব্যাগ। তাকে বাস থেকে নামতে দেখেই যে রিকশা বা ভ্যানওয়ালারা এগিয়ে আসবে, এটাও তার জানা ছিল। ‘কই যাবেন ছার’ বলে এগিয়ে এসেছিল একাধিক প্যাটলার। প্যাটলার যে ভুল ইংরেজি এটা সে জানে। প্যাডেল মারে যে, সে প্যাডেলার। কিন্তু ভুল বা অপভ্রংশ প্যাটলার শব্দটিকেই তারা এখন গ্রহণ করে নিয়েছে। মনে হয়, এই শব্দটার বঙ্গীকরণ হয়ে যখন গেছে, তখন বাংলা শব্দ হিসাবেই প্যাটলার চালু থাকুক। প্যাটলাররা এগিয়ে এলেও সে তাদের হাত নেড়ে জানিয়েছিল- এখন না, একটু পরে যাবে সে। তারপর স্যুটকেস, বাক্স রাস্তার ঢালে ফেলে রেখেই চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছিল। যেন এখানে সে সেদিনই প্রথম আসেনি, আগেও বহুবার এসেছে, এখানকার নাড়ি-নক্ষত্র সব তার জানা। চা ছিল যথারীতি বাসস্ট্যান্ডের চায়ের মতো। সে অন্যমনস্কভাবে দু-একটা চুমুক দিয়েছিল। মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করে মাকে ফোন করে জানিয়েছিল সে তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। শুধু মাকেই ফোন করেছিল সে। ঢাকা শহরে এত এত সংযোগের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে কেবল মাকেই ফোন করেছিল। তার পরেই মোবাইলটা সাইলেন্ট বাটন টিপে পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিল। বাস থেকে নেমে চায়ের দোকানে কয়েক মিনিট কাটানোর মধ্যেই আকাশে হঠাৎ জমা মেঘ থেকে স্বল্পমাত্রার বৃষ্টি শুরু হলে দোকানদার তার জিনিসপত্র সব ভিজে যাচ্ছে বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সে গা নাড়ায়নি। খুব স্বল্পমাত্রার এবং স্বল্পস্থায়ী বৃষ্টি। গাঁয়ের লোকের ভাষায় ‘বকরি খেদানো বিষ্টি’ তার দামি তোরঙ্গগুলোর ওয়াটারপ্রুফ কভারগুলোকেও ভিজিয়ে সারতে পারেনি। এরপরে সে সিগারেট ধরিয়ে একটা ভ্যানঅলাকে ডেকেছিল, এবং কোনো বাড়তি ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই পৌঁছে গিয়েছিল কাজের এবং বসবাসের ঠিকানায়। তারপর অফিসিয়াল কিছু ফর্মালিটি, তার ডরমিটরি পরিচ্ছন্ন করা, রান্না এবং কাজের বুয়া ঠিক করা, পাশাপাশি পরদিন থেকেই হাসপাতালে রোগী দেখা শুরু করা, এবং থিতু হয়ে বসতে বসতে একটা পুরো সপ্তাহ কেটে গেছে। গত শুক্রবারে এসেছিল সে। আজ, পরের সপ্তাহের শুক্রবার, দুপুরের খাবারের পরে সে প্রপিতামহ খান বাহাদুর খন্দকার আব্দুল করিমের ডায়েরিগুলো বের করে পুনরায় পড়তে শুরু করার অবকাশ পায়।

Series Navigationধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // দ্বিতীয় পর্ব >>

One thought on “উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল//জাকির তালুকদার//প্রথম পর্ব//

  • এপ্রিল ২৫, ২০২০ at ১০:২২ অপরাহ্ণ
    Permalink

    খুব ভালো লাগা শুরু হলো।মনে হচ্ছে আশির দশকের আমার গ্রামটিই ধীরে ধীরে বাসস্ট্যান্ড হয়ে গেছে।জটলাটা সেখানকারই…।সাথে থাকলাম জাকির ভাই।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *