উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস / আমাদের আগুনবিহীন কাল / জাকির তালুকদার / তৃতীয় পর্ব

গ্রহণ করিতে হইত। ঘটনাক্রমে ঘটনাটি আমার কর্মজীবনের শেষ বৎসরে সংঘটিত হইয়াছিল। এই প্রজাবিদ্রোহ সাফল্যের সহিত দমন করিতে পারায় আমার প্রমোশন হয়, সদাশয় মহারানী ভিক্টোরিয়ার ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট আমাকে উক্ত সনে দ্বিগুণ ইনক্রিমেন্ট প্রদান করেন। কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে এই গ্রামের অসন্তোষ এবং প্রজাবিদ্রোহ ছিল নিতান্তই বিরক্তিকর। বিদ্রোহীদের সমুচিত শিক্ষা বঙ্গীয় পুলিশ বাহিনী আমার নেতৃত্বেই প্রদান করিয়াছিল বলিয়া কলিকাতাস্থ বঙ্গীয় পুলিশ বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেব আমাকে একটি সার্টিফিকেটও প্রদান করিয়াছিলেন। আমার খান বাহাদুর খেতাব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই সুপারিশপত্র বড়ই কাজে আসিয়াছিল।’

ইমরুল মনের চোখে দেখতে পায় তার পিতার পিতামহ আবদুল করিম ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত পার্কার কলমে জার্মান কালিতে এই চামড়া-বাঁধানো ডায়েরিতে নিজের কৃতিত্বের কথা লিখছেন। ‘আত্মগ্লানি’ শব্দটি একবার লিখেছেন বটে, কিন্তু বাকি ডায়েরিগুলোর কোথাও অনুতাপ বা অনুশোচনার চিহ্নমাত্র নাই। বরং তিনি ছত্রে ছত্রে বর্ণনা করেছেন এই ঘটনা কীভাবে তার বীরত্বব্যঞ্জক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছিল, সরকারি মহলের আশীর্বাদ কীভাবে তার পরিবারের উত্তরপুরুষদের এদেশে একেবারে সমাজের উপরের তলায় অবস্থান নিতে সহায়তা করেছিল। আজ যে ‘করিম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’ ছোট্ট এই ব-দ্বীপের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তার সূত্রপাত তো সেদিনই ঘটেছিল। সেই দিনটাতে, যেদিন এই উপজেলার মহিষচরা গ্রামে গোরা পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ২২ জন কৃষক নিহত হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে, হাটভর্তি জনতার মধ্যে।

তোমার জন্য সবকিছু পারি। তুমি জানো ইমু ফর ইয়োর সেক ওনলি আই ক্যান চেঞ্জ মাইসেলফ, আই হ্যাভ অলরেডি চেঞ্জড মাইসেলফ।

পরিবর্তন তো আমারও হয়েছে নিশি।

তোমার হয়েছে রিভার্স সাইডে। আমি নিজেকে পরিবর্তন করেছি তোমার জন্য, তোমার দিকে। আর তুমি চেঞ্জ হয়ে গেছো অপোজিট ডিরেকশনে।

এসব থাক নিশি। আমি সামনের কোনো এক উইকএন্ডে আসছি। মুখোমুখি কথা হবে। ডিটেইল কথা হবে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে দু’জনেই। তারপরে নিশি ঈষৎ ভঙ্গকণ্ঠে বলে গুড বাই। টেক কেয়ার।

ইমরুলও বলে বাই।

ফোন রাখতে যাওয়ার সময় যেন খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে নিশির কণ্ঠ লাভ ইউ জান!

সেই কাতরতা অনেকটা সময় ধরে বেজে চলে ইমরুলের কণ্ঠে। সে মনে মনে বলে আমি দুঃখিত নিশি। কিন্তু জীবনে এই প্রথম আমি একটি মিশন খুঁজে পেয়েছি। জীবনকে এখন আর আমার কাছে অর্থহীন ভোগসর্বস্ব মনে হচ্ছে না। কিন্তু সেই মিশন তোমার চিন্তারও অগম্য নিশি। তুমি কোনোদিনই সেই মিশনের পার্ট হতে পারবে না। স্যরি মাই বিলাভেড!

মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও জীবনটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। সেদিনটার কথা মনে পড়ে।

তখনও জীবনটা ছিল উদ্দেশ্যবিহীন। তাই বিষণ্ন থাকত ইমরুল। এড়িয়ে চলতে চাইত চেনা মহল। কিন্তু নিশি তাকে এড়িয়ে চলতে দেয় না। আবার তাকে এড়িয়ে চলার সুযোগটাও দেয় না ইমরুলকে।

আজকেও কোনো পূর্বসংকেত না দিয়েই নিশি ঢুকে পড়ল ইমরুলের ঘরে। এমন হুড়মুড় করে সে ঢোকে যে ইমরুল বিরক্ত হওয়ার সময়টুকুও পায় না। ঘরে ঢুকেই খলবলিয়ে উঠল নিশি কী ব্যাপার তোমার কোনো সাড়াশব্দ নাই ক্যান? আমি কতবার তোমাকে মোবাইলে ট্রাই কঢ়লাম, বাট তোমাঢ় রেসপন্স নাই। শেষে আমি বাধ্য হলাম চলে আসতে। বাট তুমি তো বুঝতে চাও না আমাঢ় পক্ষে ফ্রিকুয়েন্ট বাইঢ়ে আসা একটু ডিফিকাল্ট।

অর্থাৎ নিশি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সে একজন স্টার এবং সেলিব্রেটি। লাক্স ফটোসুন্দরী তারকা। পত্রিকায় মাঝে মাঝেই তার ছবি ছাপা হয়। টিভিতেও দুই-একটি বিজ্ঞাপনের মডেল সে। এমনিতেই সুন্দরী তরুণীর দিকে রাস্তার মানুষও কমপক্ষে দুইবার তাকায়। আর নিশির মতো কেউ বাইরে বেরোলে তার দিকে কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি যে আছড়ে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে।

কিন্তু ইমরুল এখন গল্প করার মুডে নেই। সে সরাসরি আক্রমণ করল নিশিকে ভাগ্যিস তোমাদের ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতায় কোনো কথা বলতে হয় না। তাহলে তোমার ভাগ্যে আর পুরস্কার জুটত না।

বড় বড় চোখ তুলে তাকায় নিশি- ক্যান? আমার ভয়েস কি খারাপ? টিভির ভাইয়ারা তো বলে আমি নাকি গান শিখলে ফাটাফাটি হয়ে যাবে।

তোমার টিভির ভাইয়ারা! তাচ্ছিল্যের হাসি ফোটে ইমরুলের ঠোঁটে আমি তোমার ভয়েসের কথা বলছি না, বলছি তোমার উচ্চারণের কথা। এত জঘন্য তোমার উচ্চারণ!

ক্যান? কোন উচ্চারণটা খারাপ?

বুঝতে পারলে কী আর লোকের সামনে এত নির্লজ্জভাবে স্টাইল করে ভুল উচ্চারণ করতে!

কোনটা ভুল করেছি বলবে তো!

র-এর উচ্চারণ করার সময় জিভটাকে রসে ভিজিয়ে ঢ় উচ্চারণ করো।

না না তুমি ঠিক বুঝতে পারোনি। আমরা অলমোস্ট সব্বাই তো এভাবেই কথা বলি।

সবাই বললেই যে ভুলটা শুদ্ধ হয়ে গেল তা তো নয়। আর কথার মাঝখানে বারবার ইংরেজি শব্দ ঢোকানোর দরকারটা কী? তারপরে আছে বিরক্তিকর ন্যাকা ন্যাকা ভঙ্গি।

রাগে না নিশি। উল্টো খিলখিল করে হেসে বলে- তুমি বুঝতে পারোনি পণ্ডিত মশাই, এটা ন্যাকা ভঙ্গি নয়। এটি হচ্ছে সেক্সি ভঙ্গি।

যার-তার সাথে কথা বলার সময়েও সেক্সি ভঙ্গি আনতে হবে? বাপ-চাচার সঙ্গেও?

এই কথায় থতমত খেয়ে যায় নিশি। বলে- আসলে বোঝোই তো এখন গ্লোবালাইজেশনের পিরিয়ড। অ্যাপিলিং না হলে কি চলে?

এমন নির্লজ্জ কথাগুলো এমন স্বাভাবিকভাবে বলতে শুনলে কার আর মাথা ঠিক থাকে। রাগের চোখে গালি বেরিয়ে এলো ইমরুলের মুখ থেকে- পারভার্ট!

তা বললে তো আমাদের জেনারেশনের সবাইকে বলতে হয়।

না। সবাই নয়।

সবাই না হলেও অলমোস্ট সবাই। অন্তত ঢাকা সিটির…

রেগে উঠল ইমরুল ঢাকা সিটির কতটুকু জানো তুমি? তোমার টিভি স্টুডিওগুলোই কি ঢাকা সিটি?

রেগে উঠল ইমরুল ঢাকা সিটির কতটুকু জানো তুমি? তোমার টিভি স্টুডিওগুলোই কি ঢাকা সিটি?

কাছে এসে ইমরুলের চুলের মধ্যে আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করে নিশি। ইমরুল মাথা সরিয়ে নিলেও উজ্জ্বল চোখে হাসে নিশি- আচ্ছা বাবা আচ্ছা! এখন থেকে আমি তোমার কথামতো ঠিক উচ্চারণ করার চেষ্টা করব। আচ্ছা একটু ভুল উচ্চারণ হলে কী হয়?

গম্ভীরভাবে বলে ইমরুল- এই ভাষাটা শুধু তুমি-আমি তৈরি করিনি লামিয়া। শত শত বছর ধরে ভাষার চর্চাকারী উন্নত মেধার মানুষরা ভাষার গতি-প্রকৃতি-চরিত্র লক্ষ্য করেছেন, তারা ভাষার প্রমিতায়ন করেছেন, সঠিক উচ্চারণবিধি তৈরি করেছেন, সঠিক লেখন-রীতি তৈরি করেছেন। হাজার হাজার মনীষীর এই কাজগুলিকে তুমি এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে যা খুশি সেভাবে ভাষার ব্যবহার করা তো ভাষার ওপর রীতিমতো বলাৎকার করা।

কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে ইল্লিটারেট মানুষরা তো সবসময় ভুল উচ্চারণ করে?

তাতে ক্ষতি নেই। তারা কথা বলে নিজস্ব ছোট পরিমণ্ডলে। কিন্তু তোমরা যখন কথা বলো টেলিভিশনে বা সিনেমায় বা অন্য কোনো মিডিয়াতে, তখন ভুল করা অন্যায়। কারণ দর্শক-শ্রোতাদের অনেকেই তখন মিডিয়ার উচ্চারণটাকেই মডেল হিসাবে নেয়। তারা নিজের অজান্তেই ভুল জিনিস শেখে। এতে ক্ষতি হয় মারাত্মক। পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এতক্ষণে যেন ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে নিশি। বলে স্যরি ইমরুল! আমি এভাবে কখনও ভাবিনি। আই স্যাল চেঞ্জ মাইসেলফ।

দ্যাটস ফাইন। ইমরুল ধন্যবাদ জানায় এভাবেই।

এবার দুষ্টুমির হাসি নিশির ঠোঁটে- কিন্তু তার বিনিময়ে আমি কী পাব?

কী পাবে মানে? কী চাও?

তোমাকে চাই।

যেন নিশি খুব দারুণ একটা রসিকতা করেছে এমনভাবে হেসে ওঠে ইমরুল। বলে আমাকে আবার চাওয়ার কী আছে! আমি তো এমনিতেই তোমাদের সাথে সাথেই আছি।

আমাদের নয় আমার করে চাই তোমাকে। নিশির কণ্ঠে গাঢ় আবেগ।

ইমরুল একটু হাসে। জিজ্ঞেস করে- তোমার কি এখন টাইমপাস করা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিশি?

ঝাঁঝিয়ে ওঠে নিশি- এটা টাইমপাস নয়! তুমি কেন বুঝতে চাও না আমি রিয়েল…

না নিশি! মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় ইমরুল- উচ্চারণ করো না শব্দটা! যা বলতে চাইছ সেই ‘ভালোবাসা’ শব্দটা আমাদের কারও উচ্চারণ করাই উচিত নয়। আমরা, মানে তুমি-আমিসহ এই জেনারেশনের এবং ঢাকা শহরের এই পরিবারগুলোর সদস্যরা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি ভালোবাসার অনুভূতি। আমাদের এই সমাজে সবকিছু হয় লাভ-লোকসানের হিসাব, নয়তো টাইমপাস, নয়তো জাস্ট স্পোর্টস। আমাদের মুখ থেকে সত্যিকারের ভালোবাসার কথা উচ্চারিত হলে সেটাকে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বাংলা নাটকের ডায়ালগের মতো হাস্যকর মনে হয়।

এবারে রক্ত সরে যায় নিশির মুখ থেকে। কোনোমতে বলতে পারে- তুমি আমার এই ফিলিংসটাকেও অভিনয় বলছ?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ইমরুল। তারপর বিষণ্ন গলায় যখন কথা বলে, তখন মনে হয় তার অবস্থান এখান থেকে অনেক অনেক দূরে- এটি তোমার-আমার ব্যাপার নয় নিশি, এটি আমাদের সমাজের এবং সময়ের অভিশাপ। আমাদের এই পশ সোসাইটির মানুষ, এই আমরা যে জীবন বেছে নিয়েছি, সেখানেও প্রতিমুহূর্তে গ্লোবাইলাইজেশন আর ওপেন মার্কেট ইকোনমির কমপিটিশনে অবৈধভাবে জয়লাভের নিশ্চয়তা। তার বিনিময়ে আমাদের যা যা হারাতে হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ভালোবাসা।

অসহিষ্ণু হয়ে নিশি বলে- আমি তোমার এত তত্ত্বকথা বুঝি না। আমি স্ট্রেট জানতে চাই তুমি আমাকে চাও কি না?

ম্লান হাসে ইমরুল- চাওয়া বা পাওয়ার সাথে ভালোবাসার তো কোনো সম্পর্ক নেই নিশি। আমাদের সোসাইটির লোকজন আমরা চাওয়া বুঝি, ছলে-বলে-কৌশলে তা পাওয়া বা আদায় করে নেওয়া বুঝি। কখনও কখনও ভুল করে তাকেই ভালোবাসা মনে করি।

নিশি একগুঁয়ে- আচ্ছা তা-ই হলো! তবু আমি তোমাকে চাই!

এই কথার কী উত্তর দেবে ইমরুল! কিন্তু নিশি ছাড়ে না তাকে। জেদের সুরে বলে বলো তোমাকে পাওয়ার জন্য কী করতে হবে আমাকে? তুমি যা করতে বলবে আমি তাই-ই করব।

ইমরুল একটু ফাঁপরে পড়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- কিন্তু তুমি আমাকেই বা চাও কেন? কতজনই তো আছে তোমার জন্য পাগল! তাদের যে কোনো একজনকে বেছে না নিয়ে তুমি আমাকে চাইছ কেন?

কারণ… কারণ তুমি ডিফারেন্ট।

হো হো করে হেসে উঠল ইমরুল- একই রকম মানুষের সাথে চলাফেরা করতে করতে একঘেয়েমি এসে গেছে নিশি? তাই এবার স্বাদ বদল করতে চাইছ?

মুখটা ম্লান হয়ে গেল নিশির। বলল- তুমি আমাকে যতই অপমান করতে চেষ্টা করো না কেন, আমি আমার অনেস্ট অনুভূতির কথা বলতেই থাকব।

ইমরুল আবার একটু গম্ভীর- ভালোবাসার তুমি-আমি কিছুই জানি না নিশি। ভালোবাসা জানে হাসারি পাল।

হু ইজ দ্যাট ফেলা?

হাসারি পাল। ডোমিনিক লাপিয়েরের ‘সিটি অব জয়’ মুভিটা দেখোনি?

দেখতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু খুব মনোটোনাস মুভি কোনো সাসপেন্স নেই। পুরোটা দেখতে পারিনি।

হাসারি পালদের জীবনে তো সাসপেন্স থাকে না নিশি। মুভিজে সাসপেন্স আসবে কোত্থেকে! তবে তাদের জীবনে আছে ভালোবাসা।

কই সেই ছবিটাতে কোনো প্যাশনেট সিন আছে বলে তো মনে পড়ছে না!

এবার জোরেই হেসে ফেলল ইমরুল- ভালোবাসা দেখাতে হলে প্যাশনেট সিন দেখাতে হবে তাই না? নারী-পুরুষের তীব্র দৈহিক মিলন? একজন হামলে পড়ছে আরেকজনের ওপর? প্রায় বেসিক ইন্সটিংক্ট! না নিশি অতখানি গ্ল্যামারাস সেক্স দৃশ্য হাসারি পালদের হয় না। তবে ভালোবাসা হয়। হাসারি পাল নিজের পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে শহরে এসে রিকশা চালাচ্ছে। তারপরে তার টিবি। তখন টিবির ওষুধ হয়নি। মৃত্যু নিশ্চিত। সে মরলে পরিবার বাঁচবে কী খেয়ে? হাসারি পাল তখন মৃত্যুর আগেই দালালদের কাছে বিক্রি করে দিল নিজের কঙ্কাল।

ইস্! আনবিলিভেবল! আমি মুভিটা আবার দেখব।

মৃদু হাসল ইমরুল- মুভি না দেখলেও আমাদের চারপাশে অনেক হাসারি পাল দেখা যায়।

মোবাইল নামিয়ে রেখে ডায়েরিটাও বুক থেকে সরায় ইমরুল।

বেরিয়ে আসে বাইরে। ট্রাউজার এবং টি-শার্ট পরেই। দুপুর গড়ান দিয়েছে বিকেলের দিকে। এলাকাটাই ঘুরে দেখা হয়নি। ফরদু মিয়া বলেছিল- কী আর দেখবেন ছার! নেহাত পাড়াগাঁ। নাম হইছে টাউন। হইছে উপজেলা। কিন্তু আছে সেই পাড়াগাঁ-ই।

তাদের হেলথ কমপ্লেক্সটা লোকালয়ের একেবারে দক্ষিণ মাথায়। তারপর উপজেলা পরিষদের অফিসগুলো। উত্তর দিকে মূল বাজার। সেটাই আসল কেন্দ্র। একা একাই বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করে ইমরুল।

এই পড়ন্ত দুপুরে এবং উঠতি বিকেলেও বাজারে বেশ ভিড়। ইমরুল আগেই শুনেছে চলনবিল এলাকার কয়েকটা বড় বাজার এবং মোকামের মধ্যে এটি একটি। বর্ষাকালে চলনবিলের সমস্ত পণ্যই ভেসে আসে এই বাজারে। বিশেষ করে সপ্তাহের দুই হাটের দিনে। অন্য সময়েও বিলের উত্তর অঞ্চলের ফসলাদি আসে এই মোকামেই। মাড়োয়ারিদের অন্তত তিনটা কুঠি আছে। কেউ কেউ দাবি করে এদের কুঠি আছে সেই জগৎ শেঠের সময় থেকেই। জগৎ শেঠের বিভিন্ন বাণিজ্য কুঠি ছিল চলনবিলের বিভিন্ন বাজারে, এ কথা সবাই জানে। কাজেই এখানেও হয়তো ছিল।

গ্রামে-গঞ্জে এখন বাইরের মানুষ আসে হরদম। কাজেই নতুন লোক দেখে খুব ঔৎসুক্যের চোখ নিয়ে আর ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে না তারা। দশ বছর আগে হলেও এখানে ইমরুলের পদার্পণ সকলের চোখের কড়া খোরাক হয়ে থাকত। কিন্তু আজ কেউ তেমন একটা লক্ষ করে না তাকে। ব্যাপারটা একটু স্বস্তি দেয় ইমরুলকে। সে বিনা বাধায় বিনা নজরদারিতে বাজারটা ঘুরে বেড়াতে পারবে। তাকে দেখে এলোমেলো ঘোরাঘুরির কথা মনে হলেও আসলে সে সুনির্দিষ্ট একটা জিনিস খুঁজছে। সে একজনের কাছে শুনেছিল বাজারের ঠিক মাঝামাঝি আছে জিনিসটা। কিন্তু প্রায় আধা ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বাজারের এমাথা-ওমাথা ঘুরে আসে সে। রোদ পুরোটা সময়ই তার মাথার ওপর। হাঁটাহাঁটির তেমন অভ্যেস নেই। তাই হাঁপ ধরে গেছিল পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। কিন্তু গা না করে ঘোরাঘুরি চালিয়ে গেছে সে। ঘামে প্রায় ভিজেই গেছে টি-শার্ট। চুল বেয়ে ঘাড়ে-পিঠে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। সঙ্গে রুমাল রাখার অভ্যেস নেই। ঢাকা শহরে টিস্যুর চল এখন। এখন থেকে পকেটে রুমাল রাখতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে কী করা যায়? দোকানের তাকের দিকে চোখ তুলতেই সে দেখতে পায় আছে। ছোট পকেট টিস্যুর প্যাকেট ঝুলছে বেশ কয়েকটি মনোহারি-মুদিখানা দোকানে। খুশিমনে কিনে নেয় ইমরুল। না একেবারে গন্ড কোনো গ্রামে আসেনি সে। কিন্তু যা খুঁজছে সেটা তো নেই! হতাশ হয়ে ফিরে যাবার কথা ভাবে ইমরুল।

ঠিক সেই সময়েই পাশের ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে আসে এক যুবক। তার কাছে এসে দাঁড়ায় স্লামালেকুম স্যার!

তার দিকে তীক্ষè চোখে তাকায় ইমরুল। ইতস্তত করে। যুবকটি সপ্রতিভ কণ্ঠে বলে বাজার দেখতে আইছেন স্যার? আসেন। আমার দোকানে বসে এক কাপ চা খান স্যার।

আপনি আমাকে চেনেন?

একটু দ্বিধা করেও শেষ পর্যন্ত বসারই সিদ্ধান্ত নেয় ইমরুল। সে যা খুঁজছে তার জন্য তো তাকে নানারকম সংযোগ-সূত্র খুঁজে বের করতে হবে। স্থানীয় লোকের সাথে তার যোগাযোগ করতেই হবে। সেটা এই যুবক ওষুধ ব্যবসায়ীতে দিয়ে শুরু হলে মন্দ কী! সে পা বাড়ায় রওশন ফার্মেসির দিকে।

মৃদু হেসে যুবক উত্তর দেয়- চিনি তো স্যার। আপনে আমারে হেলথ কমপ্লেক্সের নতুন ডাক্তার। আমি স্যার ওষুধের ব্যবসায়ী। আপনাদের না চিনলে কি আর আমার চলে স্যার। আসেন স্যার। আমার দোকানে একটু বসেন!

বেশ বড়সড় দোকান। ভেতরে ঢুকে একটু আরাম করেই বসে ইমরুল। তাকে ডেকে নিয়ে যুবককে বলে কিছু মনে করবেন না। আমি আপনার নাম জানি না।

আরে জানবেন কী করে স্যার? আমি তো আর আগে সামনাসামনি হয়নি আপনার। আমার নাম রতন স্যার। সাইদুর রহমান রতন।

দোকানে তার চেয়ে কম বয়সী সহকারী আরও দুইজন আছে। তাদের একজনের দিকে তাকিয়ে রতন বলে- কালামরে, একটু কার্তিকের দোকানে যা। টাটকা রসগোল্লা আনবু বড় সাইজের। তারপরে চা আনবু রাজেনের ঘরেত থেকে।

একটু আপত্তি জানায় ইমরুল- না আমি মিষ্টি খাবো না। শুধু চা হলেই চলবে।

এই প্রথম আমার দুয়ারে পারা দিলেন স্যার। ইকটু মিষ্টিমুখ না করলে মনে দুঃখ পাবো স্যার। খান স্যার। কার্তিকের মিষ্টি খুব ভালো। নিজের হাতে ছানা তৈয়ার করে কার্তিক। চলনবিলের দশগাঁয়ের মানুষ কুটুমবাড়ি যাওয়ার সোমায় কার্তিকের মিষ্টি নিয়া যায়।

আর সে প্রসঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ইমরুল বলে- এই দোকান কতদিনের।

তা বলতে পারেন স্যার প্রায় চল্লিশ বৎসরের। দ্যাশ স্বাধীনের পরপরই আমার আব্বা সরকারি চাকরি ছাড়া দিয়া এই দোকান খুলিছিল। এই অঞ্চলে এইটাই প্রত্থম ফার্মেসি স্যার। আপনাদের দোয়ায় এখনও সবচায়ে বেশি চালু ফার্মেসি এইডাই। খুচরা বিক্রি দিনে কয়েক হাজার টাকা হয় স্যার। আর পরায় দুইশো দোকান আছে চলনবিলের নানান গাঁয়ে যারা আমার কাছ থেকে হোলসেলে ওষুধ কিনে স্যার।

এসব কথা খুব অস্পষ্টভাবে কানে ঢুকছে ইমরুলের। সে ভাবছে তার উদ্দিষ্ট জিনিসটার খোঁজ কোথায় পাওয়া যাবে। রতন থামতেই সে চট করে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা… আমি শুনেছিলাম এখানে একটা পুরনো স্মৃতিসৌধ আছে। শুনেছি সেটা এই বাজারের মধ্যেই। আমি অনেকক্ষণ ধরে ঘুরলাম, কিন্তু দেখতে পেলাম না। বলতে পারবেন ওটা কোথায়?

একটুও চিন্তা না করে রতন বলে- সেইটা তো এইখানে না। গণ্ডগোলের, মানে মুক্তিযুদ্ধে যারা মারা গেছিল, তাদের একটা শহীদ মিনার আছে হাইস্কুলের মাঠে।

ইমরুল মাথা নাড়ায়- না সেটা নয়। অনেক পুরনো একটা স্মৃতিসৌধ। ব্রিটিশ আমলের।

মাথা চুলকায় রতন- এমন জিনিসের কথা তো স্যার আমার জানা নাই। ঠিক আছে আপনে চা-মিষ্টি খান। আমি বাজারের চৌকিদারেক ডাক দিচ্ছি। বুড়া মানুষ। সে-ই জানলে জানতে পারে।

আরেক সহকারীকে পাঠায় রতন চৌকিদার রজব আলিকে খুঁজতে।

মিষ্টি এবং চা খেতে খেতে একটু অসুবিধাতেই পড়ে ইমরুল। রসগোল্লাটা সত্যিই খুব বেশি মিষ্টি। আর চা-ও একেবারে সর ভাসা দুধের চা। গলা পেরিয়ে নামতে চায় না। কিন্তু যেচে আসা হলেও মেজবানকে অপমান করা যায় না। তাই বেশ কষ্ট করে হলেও মিষ্টি এবং চা দুটোই গিলে ফেলতে হয় তাকে। কিন্তু মুখের মধ্যকার অস্বস্তিকর অনুভূতিটা কুট কুট করতে থাকে। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ডাক্তার মানুষের জনসমক্ষে ধূমপান অনেক কথার জন্ম দেবে মনে করে চেপে থাকে সে। কিন্তু রতন দেখা যায় তার এই অভ্যাসের কথা ঠিকই জানে। সে বেনসনের প্যাকেট আর দেশলাই সামনে ধরে। ইতস্তত করে ইমরুল- লোকজনের সামনে সিগারেট খাওয়া…

খান স্যার, কিচ্ছু হবি না। টিএইচও স্যার তো এই জাগাত বসেই একর পর এক টেনে যায়। অন্য ডাক্তার স্যারেরাও খায়। আপনি নিশ্চিন্তে খান স্যার।

সিগারেট শেষ হবার আগেই আরেক সহকারী ফিরে আসে। রজব আলিকে বাজারের মধ্যে দেখা যায়নি। রতন একটু ভুরু কুঁচকায়- বুড়া আবার গেল কুন জাগাত! তার তো কামের মধ্যে আছে বাজারের এই দোকানে ওই দোকানে ঘুরা আর বিনা পয়সাত চা-পান-বিড়ি খাওয়া। আচ্ছা ইউনিয়ন পরিষদে নাই তো? ঐ জাগাত যায়া একবার দেখবু নাকি?

তাকে নিরস্ত করে ইমরুল। বলে- আর একদিন হবে রতন সাহেব। আমি এখন উঠি।

রতন বেশি কিছু বলার আগেই উঠে পড়ে ইমরুল। হাঁটতে থেকে ফেরার পথ ধরে। ফেরার পথেও দুইদিকে তাকায় তীক্ষ্ন চোখে। নাই কি স্মৃতিসৌধটা? ধ্বংসাবশেষ হলেও যদি থেকে থাকে? বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা ডানা ঝাঁপটায়। সেখানে নামগুলো তো লেখা থাকবে। ওটাকে খুঁজে না পেলে এই এলাকায় পোস্টিং নিয়ে আসাই ব্যর্থ হবে ইমরুলের।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // দ্বিতীয় পর্বধারাবাহিক উপন্যাস /আমাদের আগুনবিহীন কাল /জাকির তালুকদার /চতুর্থ পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *