উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এক
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব দুই
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফকিুর রশীদ ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব ছয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। শেষ পর্ব
দশ.
দীনা কলেজে ওঠার পর আবিষ্কার করে যে তার নামটা মোটেই ভালো না। কেমন যেন দুখি দুখি ভাব।
সেই সঙ্গে দারিদ্র্যের দুর্গন্ধও বেরিয়ে পড়ে দীনা শব্দটির গা থেকে। এত যে বিশ্রী পঁচা একটা নাম, তবু
কলেজে ভর্তি হবার পর দেখা গেল ওই একই ইয়ারে আরো দু’দুটো দীনা আছে।
একজন তো ভীষণ মোটা, তার খুব ইচ্ছে চিকন হবার; নানান কসরত করেও সেটা হচ্ছে না। তার
নামও দীনা।
কেন, নামটা পাল্টিয়ে ক্ষীণা রাখো না! তা রাখবে না। ওই দীনাই চাই। আরেক দীনা ঠিকই পাতলা
লিকলিকে, কিন্তু তার গায়ের রঙ কালো কুচকুচে। আচ্ছা, তা না হয় হোক,
তার স্বভাব আবার ভয়ানক ঝগরুটে। এই সব দেখেশুনে বাড়িতে এসে একদিন সে মনের দুঃখে
জানায়, মা, আমার এই পঁচা নামটা বদ্লে দিলে হয় না?
মা তো অবাক, কোনটা পঁচা নাম?
দীনা! দীনা! তোমাদের আদরের দীনা! বাব্বা! দুনিয়ায় আর নাম পাও নি! শাহানা বেগম তো
হাসিতে লুটিয়ে পড়ে, আবার সেই দীনা তোর পিছু লেগেছে! না না, সেই দীনাটা নয় তো মা!
আরো দুটো দীনা আছে কলেজে।
দীনার মা হাসতেই থাকে, হাসতেই থাকে। দীনার এ দিকে রাগ চড়ে যায়, আমার নামটা
একদম পঁচা। এই নামটা আমি আর নেব না? বলে দিলাম, হ্যাঁ।
শাহানা বেগমের এত হাসির নেপথ্যে সামান্য একটু রহস্য আছে। মেয়ের নাম-বিভ্রাটের
সংকট আগেও একবার দেখা দিয়েছিল। ক্লাস সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত অন্য এক দীনার
সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাকে। ‘দীপু নাম্বার টু’ এর মত তাকেও ক্লাসে ‘দীনা নাম্বার টু’ ডাকা
হতো। পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে রোল নাম্বার ওয়ান হয়েছে, কিন্তু ‘দীনা নাম্বার ওয়ান’ হয়নি।
ক্লাস নাইনে ওঠার পর সেই অপর দীনার বাবা বদ্লি হওয়ায় সেও টিসি নিয়ে স্কুল
থেকে চলে যায়।
‘দীনা নাম্বার ওয়ান’ হবার পথে আর কোনো বাঁধাই থাকে না; তবু বাস্তবে হয় না।
সবাই ওই আগের মত‘টু’ বলেই ডাকে। তখনও সে জোর দাবি তুলেছিল?
এই নাম আর নেব না। বদ্লে দাও।
আচ্ছা, এ কি জামা কাপড়, খাতা পেন্সিল বদ্লানোর মতো ব্যাপার হলো!
ইচ্ছে হলেই বদলে ফেলা যায়! কে বুঝাবে মেয়েকে। সেই ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ার
সময় বলত? তোমার নামটা কী যে সুন্দর মা!
ওই শাহানা নামটাই আমাকে দাও না! সন্তানের জন্যে কোনো মা-বাবার অদেয় কিছু
কি থাকে! কিন্তু দীনার দাবি যদি এই রকম অবাস্তব হয়, তাহলে? না, এবারের
প্রস্তাবটাকে সে ভেঙেচুরে অন্য কৌশলে উত্থাপন করে,
আচ্ছা ঠিক আছে তোমাদের ওই দীনাই থকুক, উচ্চারণটা ইংরেজিতে কর? ডিনা।
শাহানা বেগম হাসতে হাসতেই বলে, কলেজে উঠে পড়লি, তবু সেই ছেলে মানুষই
থাকলি তুই!
অথচ এই শাহানা বেগমই যখন রাতের বেলায় স্বামীর কাছে কথা তোলে, তখন
আর দীনা ছেলেমানুষটি থাকে না। এমন এক লাফ মেরে গা গতরে বেড়ে ওঠে
যেনবা দুশ্চিন্তায় মায়ের চোখে ঘুমনেই, গভীর উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে কণ্ঠে,মেয়ে
যে সেয়ানা হচ্ছে, সেদিকে নজর আছে তোমার?
কে সেয়ানা হচ্ছে? আমার দীনা?
দীনা নয় দীনা নয়, ডিনা।
মানে?
এখন থেকে ডিনা। মেয় নিজেই পাল্টে নিয়েছে।
বাহ্! চমৎকার! ডিনা? বেশ তো!
এক বাক্যে বাবার অনুমোদন হয়ে যায়? ভালোই হয়েছে। ওর নামটা নিয়ে মনের
মধ্যে ভয়ানক খচখচানি ছিল। হবে না? স্কুলে ছিল একটা দীনা, কলেজে নাকি
আরো দুটো দীনা আছে।
বাব্বা! আরো দুটো?
ওই দুঃখেই তো নিজের নাম পাল্টে নিল!
নাম পাল্টালেই বুঝি মেয়েরা সেয়ানা হয়ে যায়?
আমি কি তাই বলেছি!
কী মুশকিল! তুমি বললে না? মেয়ে সেয়ানা হচ্ছে, আমার নজর নেই? বললে না?
সত্যিই তোমার নজরে কিচ্ছু পড়ে না!
মা বাবার চোখে সন্তান কোনোদিন বড় হয়! তোমার নজরটাই কেমন, বলো দেখি!
শাহানা বেগমের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়ে, ঠিকই বলেছ? আমার নজরেরই দোষ।
তবু বলি, মায়ের চোখটা যদি তোমরাও পেতে!
কী বলছ, একটু খোলাসা করে বলো তো!
বলছি আমার গুণধর বড় ছেলের কথা… ওর সঙ্গী সাগরেদের কথা…
এমন গুণের ছেলে যে মা পেটে ধরেছে, তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কে আছে বলো!
শওকত আলী উঠে বসে। স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী হয়। শুরু হলো মেয়ের প্রসঙ্গ
দিয়ে, সে কথা ঘুরতে ঘুরতে এভাবে ছেলের প্রসঙ্গে বাঁক নেবে কে জানতো!
তাও কোন ছেলে? বড় ছেলে স্বপন। সকল অর্থেই যে এখন মুঠোর বাইরে চলে
গেছে। তাকে নিয়েই যত উদ্বেগ।
স্বপন আর আপন। দুই ভাই। অথচ কত না বৈপরীত্য দু’জনে! কত না বৈসাদৃশ্য!
চেহারার সামান্য আড়া ব্যতীত এখন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়াই ভার। সেই যে তিন
বছরের ব্যবধান অতিক্রম করে আপন চলে গেল এগিয়ে, তারপর আর কোথাও
দাঁড়ায়নি, কখনো পেছনে ফিরে তাকায়নি। নটরডেম থেকে বেরিয়ে সোজা
বুয়েটে ভর্তি হয়েছে। দু’আড়াই বছর শাজাহানপুরের এই বাড়ি থেকেই ক্লাস
করেছে। এখন থাকে কাজী নজরুল হলে। তাই বলে বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক মোটেই শিথিল হয়ে যায় নি।
সেটা হয়েছে স্বপনের বেলায়।
তার শেকড় বাকড় পোঁতা পুরানো ঢাকায়। পুরানো ইয়ার দোস্তের সঙ্গে আরো নতুন দোস্ত যুক্ত হয়েছে।
শোনা যায় মুন্সীগঞ্জের শ্রীপুর না অন্য কোন উপজেলার বেশ কয়েকটি স্কুল কলেজ বদ্লাবদ্লি করে
ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পাসও করেছে, এমন কী জগো বাবুর পাঠশালায় কোন সাবজেক্টে নাকি ভর্তিও
হয়েছে। জগন্নাথ কলেজকে এখনো কেউ কেউ ওই নামেই ডাকে। সে যা-ই হোক, পুরানো ঢাকায়
থাকার ওটা একটা অজুহাতও হতে পারে। সে এখন মেতেছে, রাজনীতি নিয়ে। রাজপথে আন্দোলনরত
দুটি প্রধান দলের মধ্যে একটি তার অতিপ্রিয়, অপরটি সমান অপ্রিয়। না না, সমান হবে কেন! প্রিয়
অপেক্ষা অপ্রিয়টিই তার অধিক মনোযোগ কাড়ে। ফলে একই সঙ্গে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ? যার বিরুদ্ধে
আন্দোলন এবং যাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন, শত্রু তার দুটোই। করে সে ছাত্ররাজনীতি,ঘোড়া
ডিঙিয়ে ঘাস খায়? খুঁড়িয়ে চলে আসে মূল রাজনীতিতে।
এই ছেলেকে কী বলে শাসন করবে শওকত আলী? কেমন করে বাগ মানাবে? এখন সে টাকা
পয়সার জন্যেও বাপের উপরে নির্ভরশীল নয়। বরং বলা যায়, পাশা উল্টে গেছে। এখন
ক্ষেত্রবিশেষে ছেলের উপরেই বাপকে নির্ভর করতে হয়। গত বছর এই বাড়ির পাঁচতলার
উপরে এক্সটেনশনের কাজে হাত দিলে এ পাড়ার চাঁদাবাজ মস্তানরা এসে কাজ বন্ধ করে
দেয়। তাদের চাঁদা দিতে হবে এক লাখ? এই দাবি। অথচ দিন দশেক পরে স্বপন এসে
ছাদের উপরে দাঁড়ালে সেই মস্তানদেরই দু’জন ছুটে আসে পিছেপিছে। ক্ষমা চায়
শওকত আলীর কাছে।
সেদিন স্বপনের দিকে তাকিয়ে বাপের চোখেও সমীহ ভাব জাগে। ছেলের ক্ষমতা দেখে চমকে
ওঠে? এই আমাদের স্বপন! স্বপনেরই উদ্যোগে এইসব স্থানীয় যুবকেরা অচিরেই সংগঠিত হয়ে
এই গলির মুখের স্পোর্টিং ক্লাবকে রাজনৈতিক দলের যুবসংগঠনের অফিসে রূপান্তরিত করা
দলের বিশিষ্ট যুবনেতা এসে ফিতা কেটে সে অফিসের উদ্বাধন করে যান। স্বপন সেদিন
একটুখানি বক্তৃতাও করে। এখন সেই অফিসের সামনে দিয়ে কলেজে যেতে ভয় পায়
স্বপনেরই বোন ডিনা। পা কাঁপে তার। রুদ্ধশ্বাসে পার হয় ওই পথটুকু। না, ডিনাকে কেউ কিছু
বলেনি তেমন। বরং অনেকেই অভয় দিয়েছে, কেউ কেউ বাড়ি পর্যন্ত এগিয়েও দিয়েছে বেশ
কয়েকদিন। এইসব অতিভক্তিই দিনে দিনে শাহানা বেগমের দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুনতে শুনতে সে দুর্ভাবনা শওকত আলীর অন্তরেও সঞ্চারিত হয়। গায়ে কাঁটা দিয়ে লোম খাড়া
হয়ে ওঠে। দু’চোখ থেকে পালিয়ে যায় রাতের ঘুম। দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয় ঘরের বদ্ধ বাতাস।