উপন্যাস

উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব এগারো

শেষে নিতান্তই হাল ছেড়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসে আবার।
ঘুমােত যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। মুখে ক্রীম ঘষে, চুলে চিরুনি বুলােয়। আর তখনই
ব্যাপারটা ঘটে যায়, সে আগের মুহূর্তেও টের পায় না। চুলে চিরুনী আটকে গিয়েছিল।
সে জোরে টেনে চুল থেকে চিরুনি ছাড়াতে গিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। প্রথমে সে
বােঝে না, উঠে বসার চেষ্টা করে। পারে না, আবার গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। তখন ক্রমশ
অনাবিল হাসিতে তার মুখ ভরে যায়। ড্রেসিং-টেবিলের ওপর ভর রেখে আস্তে আস্তে
সে উঠে দাঁড়ায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে মৃদু কাঁপুনি নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে
নিজেকে দেখে। না, এখনাে চোখ-মুখে কোনাে পরিবর্তন নেই। কিন্তু সে টের পাচ্ছে।
শরীরে – মনে সে টের পাচ্ছে। শরীর যেন পাখির পালকের মত। ধ’রে না রাখলে যেন
উড়ে যাবে। আর কত যে আলাে সারা ঘর জুড়ে। লাল – নীল, সবুজ – বেগুনী। সে কত
রকম আলাে পুরাে ঘরে যেন বাতাসে ভেসে আছে।
পাখির মতাে শরীর, পাখির মতাে। খুশীতে শম্পার লাফাতে ইচ্ছে করে। দারুণ
মনে হয়, এই তাে এখন পাখির শরীর নিয়ে যাওয়া যায় যে কোন কোথাও। যে
কাউকে খুলে বলা যায় লাল – নীল – সবুজ আলাের কথা। সে ঘর থেকে বেরােয়।
ইচ্ছে হয়, প্রথমে যাবে ইস্তিয়াকের ঘরে। পা কাঁপে তার, তবে ইস্তিয়াকের ঘর
পর্যন্ত পৌছানাে যায়। কিন্তু দরােজা বন্ধ। মৃদু ঠেললাে সে দরােজা , মৃদু নক করলাে। কিন্তু
ঘরের ভেতর রবিশঙ্কর, ইস্তিয়াকের দরােজা খােলে না। ইপ্তিকে বলা যেত, শম্পা
একটু নিরাশই হয়, ইস্তি বুঝতো। তা, রুম্পাকে বললেও হয়। কিন্তু রুম্পা কেয়ার করে।
দরােজা সে খােলে বটে। এক পলক শম্পাকে দেখে, ‘গেট লস্ট’ বলে দরােজা বন্ধ
করে দেয়। তবে কি বাবার কাছে যাব, শম্পা ভাবে। বাবা বুঝবে, অনেক কিছু বলার
আছে তার। আর এখনই সে বলতে পারে প্রায় সবকিছু। কিন্তু হয় না, বাবার ঘরের
দরােজা থেকে সে ফিরে আসে। বাবা কি এখন মুখে ভুরভুরে গন্ধ নিয়ে জ্ঞানহীন? নাকি
শিভাস রিগ্যালের বােতল খুলে ভিসিআর- এ হার্ভ- পর্নোয় ডুবে আছে? শম্পা হাসে,
থাকুক। এখন তবে বাবাকে কিছুই বলা যাবে না। তবে কি মা? মা’র ঘরের দরােজার
সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সে। সামান্য হেসে একসময় মৃদু গলায় বলে—
‘না মা। তােমাকে বলা যায় বটে, তুমি মন দিয়ে শুনবেও সব, কিন্তু বুঝবে না কিছুই।’
হাঁটতে হাঁটতে ড্রইংরুমের দরজা খুলে বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। শরীর
ক্রমশই মাটি ছেড়ে উড়ে যেতে চাচ্ছে। চারপাশে নানা আলাে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে
অবিরাম। কিন্তু কাকে সে বলে। ইচ্ছে হয়, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, রাস্তায়। গেট পর্যন্ত
এগােয়ও সে। কিন্তু গেট বন্ধ, তালা। সেই তালার চাবি নেই তার কাছে।
সে এদিক – ওদিক তাকায়। দারােয়ান ঘুমােচ্ছ। পােয কুকুরটা তাকে দেখে মৃদু
হংকার ছাড়ে। শম্পা একটু হাসে। তারপর ফেরার জন্যে পা বাড়ায়। তখন খুব হঠাৎ
চোখের সামনে যেন কিছু লাল অক্ষর ফুটে ওঠে। একটু চমকায় সে। শরীর ক্রমশই
নুয়ে পড়ছে। দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। দু’চোখ মুছে নেয় সে। লাল অক্ষরে কি
ভেসে ওঠে চোখের সামনে? এন্ট্রান্স না এক্সিট? আবার সে চোখ মােছে। বারান্দায়
এসে থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে খুব চেষ্টা করে। কি দেখলাে সে? এনট্যান্স না
এক্সিট? শম্পা টের পায় না, অজান্তে বারান্দায় বসে পড়ে। স্নান হাসে সে, পেছন ফিরে
ঘরের দিকে একবার তাকায়, একবার তাকায় তালাবন্ধ গেটের দিকে। তারপর সামান্য
মাথা নেড়ে মৃদু গলায় বলে— ‘আসলে, ও দুটোর একটাও না। আসলে ওটা নাে – এক্সিট হবে।’
ঘরের ভেতর কোনাে শব্দ নেই। তার চারপাশে ঘিরে বসা কেউ কোনাে কথা বলে না।
তারা সবাই তাকিয়ে থাকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে, কথা শেষ করে সে নতমুখ
তােলে। একটু আগেও যেটুকু জোরের সঙ্গে শব্দগুলাে উচ্চারণ করেছিল, চারপাশের
নিরবতায় তার সে জোরটুকুও ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তবে সে তাকায় সবার দিকে, এক
এক করে। সে সার্কাসের ক্লাউন নয়, সে জানে, অযৌক্তিক কোন বক্তব্য নয় তার,
সে নিশ্চিত — কিন্তু চার পাশে কারাে মুখে মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি, কেউ খুব অবাক হ’য়ে
তার আপাদমস্তক দেখছে, বাকিরা নির্বিকার ব্যস্ত নিজেদের আঙ্গুল, নখ, চোখের পিছুটি
নিয়ে। এই নীরবতা অসহ্য হয়ে ওঠে, সে সিগারেট ধরাতে থিগুণ সময় নেয়। মৃদু
কাঁপছে হাত, সে টের পায়, দেশলাইয়ের পােড়া কাঠিও সে হাতছাড়া করে না।
যারা ব্যস্ত ছিল চোখের পিছুটি নিয়ে, আঙ্গুলের নখ নিয়ে তারা আড়মােড়া ভাঙে।
এরা মাঝারি মর্যাদার কর্মী, অন্য কিছু ভাবে না, পাটির সুপ্রীম কাউন্সিলের যে কোনাে
আদেশ বেদবাক্য ভেবে মেনে নেবে, পাটির ভেতর যে অংশ দলে ভারী, তারা প্রয়ােজন
মত সেদিকেও। সে কি এখন উঠবে? কারাে কোনাে উত্তর নেই, যুক্তি তর্কে কেউ
এগােবে না, এভাবে বসে থাকা নিরর্থক । কিন্তু সে জানে, নিজেদের প্রতিরােধ ক্ষমতার
সীমাবদ্ধতা, হঠাৎ একটা আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে অল্প সময়ের মধ্যে বুদ্দুদের
মতাে বিলীন হবে, তা অর্থহীন। আর এত সহজেই সব সিদ্ধান্ত তৈরি হয়ে যাবে,
সিদ্ধান্তের বাইরে থাকবে পুরাে জনগণ, পরিবেশ-পরিস্থিতি, দেশের ইতিহাস এবং
ভূগােল, তাও হয় না। এসব ভেবে একটু জোর পায় সে, সােজা হারুনের মুখের ওপর
চোখ ফিরিয়ে আনে — প্রতিরােধ ক্ষমতা, কমরেড, আপনি অভিজ্ঞ, আপনার বােঝা
উচিত। দুহাতে নাড়লাে হারুণ, যেন শব্দগুলাে তার কানে এসেও না পৌছায়— ‘ডিসিশন
ততা নেয়া হয়ে গেছে, সুপ্রীম কাউন্সিল এ্যালুত করেছে …. আপনি খামােখা কথা
বাড়াচ্ছেন, ফাঁক – ফোকড় খুজছেন, কিসের ফাঁক – ফোকড় খুজেছেন, এ্যাঁ?’
ফাঁক – ফোঁকড়া তা আছে বৈ কি, সে একটা একটা করে তুলে ধরতে পারবে।
কিন্তু সেই প্রথম থেকে হারুনের এমন রুক্ষ মেজাজ, যেন শুধু ঝাঁপিয়ে পড়া বাকী,
ফাঁক – ফোকড়ের কথা বলতে গেলে তাকেই কোন ফোকড়ে চেপে ধরবে। সে চারপাশে
একবার ও চোখ বুলিয়ে পর মুহুর্তে বললাে— ‘আমি এবার উঠবাে।’
আপনার শেষ কথা?
‘সুপ্রীম কাউন্সিলের সঙ্গে আমারও কিছু কথা থাকতে পারে।’
‘অত সময় কোথায় সুপ্রীম কাটপিলের, আর এতগুলাে পােক এতক্ষণ আপনার সঙ্গে ইয়াকি মারলাে,
আপনার কি তাই মনে হচ্ছে?’
‘না, তা নয়, তবে যৌক্তিকতা, সময় এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি বিচার; এসব কিছু ব্যাপার অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে।’
হারুন চেয়ার ছেড়ে সােজা হয়ে দাঁড়ালাে। তার লম্বাটে রুক্ষ্ম শরীর,
হলদে শরীর, আর খুব ক্ষীপ্র গতি, বললাে— ‘সব কিছুই মীমাংসত … , আর অঞ্চলভিত্তিক বিচার
করলে আপনার সম্ভবত জানা আছে আপতত। এ এলাকার ডিসিশন – মেকার আমি।’

এখন আর অপেক্ষার কোনাে প্রয়ােজন নেই। সেও উঠে দাঁড়ালাে। তবে সে লম্বায় হারুন পর্যন্ত পৌছালাে না,
একটু সুখও সে, তবে যেন ব্যাপারটা হেলাফেলায় মিটিয়ে ফেলছে এমন আলস্যভরে চেয়ার সরিয়ে রাখলাে একপাশে।
‘আপনি যাচ্ছেন?’
‘হাঁ, যাব।’

তার পেছনে হারুন এসে দাঁড়িয়েছে। তার সামনে আধ খােলা দরােজা, ঘরের ভেতর। একবার তাকালাে সে,
হারুনের দিকেও, তারপর দরােজার দিকে এগােলাে। পেছন থেকে হাতের শক্ত মুঠো তার কাধ আকড়ে ধরলাে —
‘শেষ কথা?’ কাঁধের ওপর সজোরে এসে পড়েছে হাত, সে দ্বিধা এবং আশংকা মুহূর্তের মধ্যে কাটিয়ে উঠলাে,
উত্তর দিতে দেরি হল না তার, বললাে — ‘আমি এ্যাডঞ্চোরিজমে বিশ্বাস করি না।’

এ্যাডভেঞ্চারিজমে! ঘটা চারেকের আলােচনার পর এ প্রথম সামান্য হাসলাে হারুন, বেশ বেশ। সে ততক্ষণে কাঁধ
থেকে হারুনের হাত সরিয়ে দরােজার চৌকাঠ ছড়িয়েছে। স্বপ্নের এই পর্যন্ত এসে ঘুম ভেঙে যায় মাহমুদের।
কতক্ষণ সে আমনের মতাে পড়ে থাকে বিছানায়। টের পায়, ঘামে ভিজে গেছে শরীর। ডান পাটা বেকায়দা
মতাে রাখায় টান পড়েছে, বাথা করছে। কিন্তু তার একটুও ইচ্ছে করে না নড়ে – চড়ে শুতে। ঘর অন্ধকার।
প্রথম প্রথম কিছুই বােকা যাচ্ছিল না। এখন চোখ কিছুটা সয়ে এসেছে। মাহমুদ মশারীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাত কত হয়েছে বােকা যায় না। বালিশের পাশেই ঘড়ি। কিন্তু ঘড়ি দেখতে তার ইচ্ছে করে না। যেন ঐ স্বর্ণের
পর সবকিছুই কিন্তু এই রকম নিথর থাকাও হয় না। মাহমুদ বিছানায় উঠে বসে। পা’র ব্যথাটা বেড়ে গেছে।
কিন্তু কি করা। ব্যথা সারানাের কৃত্রিম কোনাে ব্যবস্থা জানা নেই। সুতরাং মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হবে।
তবু ডান হাতে পা কতক্ষণ মালিশ ক’রে মাহমুদ। সান্ত্বনা। শেষে সে বিছানা ছেড়ে নামে। সাবধানে পা রাখে
মেঝেয়। একবারে পুরাে ভর দেয় না। ঘরে এক চকর ঘুরে এসে বালিশের পাশ থেকে ঘড়ি এনে দেখে। রাত
শেষ হওয়ার পথে। ঘরের এক কোণে রাখা হ্যারিকেনটা জ্বালে। কতক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চেয়ার
টেনে ব’সে সিগারেট ধরায়। বাড়ির কোথাও কোন শব্দ নেই। থাকারও কথা নয়। ছােট বাড়ি, লােক কম। তার
দূর সম্পর্কের আত্মীয় ক’জন। বাবা – মা সেই কবেই মারা গেছে। ছােট বােনটা বিয়ে হয়ে অনেক দূরে।
বােনটার কথা ভাবে সে।

কিন্তু একটু পরেই বােঝে এভাবে হবে না। আজ বাকি রাতটুকু স্বপ্নটা জ্বালাবে তাকে। মান হাসে সে। যদি এমন
হত, ভুলে যাওয়া যেত সবকিছু, নিদেনপক্ষে তুলে থাকা। কিন্তু কোনােটাই হয় না। ভুলে যাওয়া যায় না। আর
ভুলে থাকা তাে আরও কঠিন। অথচ এসব মনে থাকা কী যে কষ্টের। যখন তখন ঘাই মেরে ওঠে, খোঁচায়,
ব্যতিব্যস্ত করে। এই যেমন আজকের স্বপ্নের ব্যাপারটা — ঘটনাটা বহু আগের এক যুগের বেশী হয়ে গেছে।
কিন্তু সবকিছু তার স্পষ্ট মনে। সে যেন মুখস্ত বলে যেতে পারবে। একটুও এদিক – ওদিক হবে না। স্বপ্নটা
মাঝপথে ভেঙে গেছে। কিন্তু তাতে কি। ঘটনার বাকী অংশ সে তাে চোখ খােলা রেখেও দেখতে পারে।
সিগারেট শেষ হয়ে গেছে, সে আগুনটুকু তবু ধ’রে রাখে হাতে। ঘটনার বার অংশটুকু কী অবলীলায়
তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

‘এ্যাকশন,-ডাইরেক্ট এ্যাকশনই হচ্ছে একমাত্র উপায়।’

হারুনের গলা এমন তীব্র ও তেজী শােনায়, ঘরের ভেতর আর সব আওরাজ চাপা পড়ে যায়। হারুন স্থির এবং দৃঢ়।
কথা বলার সময় তার গলা একটু কাঁপে না। তার বক্তব্য নিয়ে কথা এগােয়ও না। সবকিছু যেন আগে থেকে ঠিকঠাক,
প্রথম থেকে সে কোনঠাসা। হারুনের সঙ্গে কোনাে কারণ ছাড়াই বনিবনা নেই, প্রথম থেকেই। ইদানীং সুপ্রীম
কাউন্সিলের কিছু ফেভার পেয়ে হারুন এখন তুঙ্গে। তাছাড়া এতগুলাে লােকের সঙ্গে কিইবা করা যায়, ঘরের
ভেতর স্থানীয় ক্যাডার যারা বসে আছে, তারা হারুনের অনুগত, তারা যুক্তির ধারও ঘেষছে না। তবু সে স্থির রাখে
নিজেকে, খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি ব্যাখা করে। কিন্তু তার কথা হাওয়ায় ভাসে। দলের মধ্যে কি উপদল। এ
কোনাে নতুন ব্যাপার নয়, তবে হারুন বােধহয় অতটা এগােবে না, জোরগলায় কথা বলতে পারে বলে সুপ্রীম
কাউন্সিলের অযৌক্তিক ফেভার পেয়ে শুধু দলে ভারী। সে প্রসঙ্গক্রমে হলিগানদের কথা তুলেছিল।
এদের কোনাে রাজনৈতিক চিন্তা নেই, কনসেপশন বিন্দু মাত্র ক্লিয়ার নয়, এদের কি শুধু একশনেই ব্যবহার
করা হবে, কোনােরকম রাজনৈতিক দীক্ষা ছাড়া? হারুন মাথা ঝাঁকায় — ‘না, এভাবেই তারা তৈরী হবে।’
তাদের ক্যাপিটাল পড়ার দরকার নেই, তা সে জানে, কিন্তু প্রাথমিক জানা বােকা, আর দেশের আর্থ –
সামাজিক প্রেক্ষাপট বিচার না ক’রে তারা কোথায় ঝাপাবে? এসব হুলিগান নিয়ে অসুবিধেও প্রচুর,
হাতের একটা পিস্তলকে দূর পাল্লার কামান মনে করে, এবং এত বেশী স্কুল ও উদ্ধত, ডিল করা মুশকিল।
এদের দিয়ে কাজ হয়, তবে তার জন্যে প্রচুর সময় এবং পরিশ্রম প্রয়ােজন। অথচ হারুনকে সে বিন্দুমাত্র
প্রভাবিত করতে পারে না। হারুনের পড়াশােনা প্রচুর ক্যাপিটাল থেকে পাতার পর পাতা মুখস্থ বলে যায়,

এ ব্যাপারে সে হারুনের কাছে সুবিধা করতে পারে না। কিন্তু সে জানে, পরিস্থিতি বিচারে সে নির্ভুল। সে
খাতা কলমে প্রায় ছক কেটে দেখিয়েছে, বর্তমান আর্থ – সামাজিক পেক্ষাপট, জনগণের মানসিকতা
এবং হারুনের তত্ত্ব — এই দুই টক্কর। খায়, মেলে না, কিন্তু হারুন অনড়। এসব ব্যাপার সুপ্রীম কাউন্সিল
তলিয়ে দেখছে, হারুন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসেছে বারকয়েক, তাকে পরিস্থিতি বিচার করার প্রয়ােজনীয়তা
সম্পর্কে অবহিত করা অর্থহীন, সে ঠাণ্ডা গলায় জানিয়ে দিল।

কিন্তু সে জোর পায় না, ভেতর থেকে কোনাে সমর্থনও নয়। এর ভেতর দু’ এক জায়গায় তাকে যেতে হয়েছে।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে দেখেছে সবকিছু। এ মুহূর্তে কোনােরকম এ্যাকশন পাটির অপূরণীয় ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই
করবে না। দেশের লােকদের সে জানে, শান্তিপ্রিয়, অলস এবং যুগযুগ ধরে স্কুল। ন’মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্লান্তি
এখনাে চোখে মুখে। এখনাে স্থির বিশ্বাস করে অবস্থা বুঝি এ ভাবেই বদলাবে, বিপ্লবের ‘ব’ ও তারা বােঝে না।
একথাই সে বারবার বলছিল । পঞ্চাশ বছরেরও বেশী বয়সের ইতিহাসে ‘কমুনিস্ট’ শব্দটা কেউ ভেঙ্গে – চুরে
জনগণের কাছে পৌছে দিতে পারেনি। মাঝে মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ এদিক – ওদিক আগুন জ্বলেছে, কিন্তু তার প্রায়
সবগুলােই তাৎক্ষণিক, নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ। কখনাে কখনাে কাজ করেছে শুধুই সেন্টিমেন্ট। কোনােটাই
সুদুর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
‘ঐ সব আন্দোলন ব্যর্থ, অপ্রয়ােজনীয় ছিল, আপনি তাই বলছেন?’ — হারুনের গলা স্থির ও কঠিন।
সে মাথা নাড়লাে— ‘না, আমি তা বলছি না, পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস বিচারের পরও আমরা কি ঐ প্রক্রিয়াতেই
কাজ করবাে? আমি শুধু এটুকুই জানতে চাচ্ছি।’
‘কিন্তু আমরা কাজ আরম্ভ করছি অন্যভাবে।‘
‘আমি কোনাে তফাৎ দেখছি না।’
‘আপনার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে।’

’না, তা হচ্ছে না’ — সে মাথা নাড়লল— ’আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন, আমাদের আন্দোলন ব্যক্তি
বিশেষের বিপক্ষে না টোটাল সিস্টেমের বিপক্ষে?’ একটু ইতস্তত করে হারুন— ’আপনি কি ব্যক্তিকে
সিস্টেমের বাইরে ধরেছেন? সে হাসলাে,- না, আমার ব্যাপারটা উল্টো, আমি ব্যক্তিকে সিস্টেমের প্রােডাক্ট
মনে করি, একজন শ্রেণী শত্রুকে এলিমিনেট করলে ন্যাচারাল প্রােসেসেই অন্য একজন। তার ফাঁকা
জায়গা পূরণ করবে। অবস্থা এ রকম। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবাে?’ — হারুণ তেতাে হাসে।
না তাও নয়’— উত্তর দিতে তার দেরী হয় না— ’আমি বলছি দু’একটা গলা কাটা কিংরা বােমাবাজী
বিপ্লব নয়। স্বীকার করছি।’

Series Navigation<< উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব দশউপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।।পর্ব বারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *