ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব আট

এক্সপেরিমেন্ট ৮

পর্ব ।।৮।।

বেছে নেওয়া সুখ
সোহা ভর দুপুরের নির্জনতা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে হাসছিল লরার দিকে তাকিয়ে। লরাও হাসছে।
ওরা দু’জন আজ আশফাকের ফ্লাটে চড়ুইভাতি করছে। গরম খিচুড়ির সাথে ডিম ভাজি। সোহা খিচুড়ি রান্না করেছে, লরা করেছে ডিম ভাজি। তারপর মুখোমুখি বসে খাওয়া আর আড্ডা। আজ শুক্রবার, সোহার ছুটি। লরা বহু বহু দিন পর একদম ফাঁকা শুক্রবার পেয়ে গেছে। কাজেই আড্ডাটা বেশ লাগছে ওর।
আশফাকের কাছ থেকে জানা যায়, নিত্য নতুন প্রযুক্তির মতই পাল্লা দিয়ে ছুটছে সন্তান জন্মদানের প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা। কোন্ কোম্পানি কোন্ মডেল বের করল, তা নিয়ে যেমন কৌতুহলের শেষ নেই। সন্তান জন্মদান প্রযুক্তির খবরও যেন তেমন। স্বাভাবিক ভাবে সন্তান জন্মদানের বিষয়টি ইতিহাসে পরিণত হতে যাচ্ছে। লরা বলল, সম্ভাবনাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে। ইয়েস। দ্য পসিবিলিটি সিমস রিয়েল বাট ডন্ট ড্রপ য়্যুর গাই জাস্ট ইয়েট।
সোহার খুব কৌতুহল হচ্ছে, খুব উত্তেজনাও বোধ করছে ভেতরে ভেতরে। এ তো ডেঞ্জারাস খবর !
এরকম আরো অনেক অনেক ডেঞ্জারাস খবর দিতে পারি আমি। যদিও এর অনেকগুলো ধার করা। লরা রহস্য করে।
সোহা হাসে। কার কাছ থেকে ধার করা হচ্ছে, সে কি ও জানে না? লরাও হাসে। আশফাকের সাথে বন্ধুত্বের সুযোগে অনেক কিছু জেনে যাওয়ার তৃপ্তি কাজ করে ভেতরে। কিন্তু, সেই তৃপ্তি কেন যে আরো গভীর কোন অনুভূতির সন্ধান দেয় না। কেন যেন মনে হয়, মনের একদম গভীরে আছে কোন এক বোধের সাগর। দিন যাপনের ক্লান্তিতে লরা সেই দুরত্ব অতিক্রম করার শক্তি পায় না। যদি পেত, তবে নিশ্চয়ই নিজের সব দু:খ-শোক ঝেড়ে ফেলে ঐ সাগরে অবগাহন করত। সোহা যে মাঝে মাঝে বলছে, লরা ব্যস্ততা থেকে ছুটি নিয়ে অনেক দূরে কোথাও যেতে পারে, নির্জনতার সুযোগে ওর মনটা মেলে ধরবে নিজেকে, তখন সহজ হয়ে যাবে নিজের কাছে নিজেকে চেনানোর কাজটা।
সোহা লরাকে আচার তুলে দিতে দিতে বলে, আশফাক ভাই এবার দেশে ফিরলে বিয়েটা সেরে ফেলেন।
লরার চোখ পৌঁছে যায় কপালে। মজা করে জানতে চায়, কেন? আশফাক মিয়া দেশে ফিরলে বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে কেন?
আর কত দিন? প্রেম বেশি দিন ধরে করতে নেই। তাছাড়া বয়স হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর পরই বাচ্চা নিয়ে নেবেন। ওদের মানুষ করতে হবে না?
সোহা কোন কৌণিক গতিতে ভাবনা-চিন্তা চালিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারে লরা। এক গ্লাস পানি খেয়ে সোহাকে জানিয়ে দেয়, আশফাক আর ও স্রফে বন্ধু। প্রেম নিয়ে কোন পরিকল্পনা নেই লরার, বিয়ে নিয়ে তো নয়ই। আশফাক বিয়ে করেনি কেন, তার কারণ সম্ভবত ব্যস্ততা। এবার ফিরে এলে ব্যাটাকে বিয়ে করিয়ে দিতে হবে। পাত্রী বাছাইয়ের কাজ চলতে পারে।
সোহা বিষণ্ণ হয়। লরা আর আশফাক সুষ্ঠু যোগফল উৎপন্ন করলে ওর কাছে বেশি ভাল লাগত। কেন লরা আর আশফাক সমস্ত সম্ভাবনা সত্ত্বেও স্রফ বন্ধু হয়ে আছে, প্রেম কেন হচ্ছে না এদের ভেতর? কেন যে সোজা পথে সব ফলাফলের দেখা মেলে না!
আমাকে দিয়ে প্রেম-বিয়ে এসব হবে না। লরা ঘোষনা দেয়। আই এম টায়ার্ড! ভেবে দেখ সোহা, প্রেম বল আর বিয়েই বল, শারীরিক ও মানসিক খাটাখাটনি মূলতঃ কাকে করতে হয়? নারীপক্ষকে, তাই না?
তাই।
আমি খাটাখাটনির ভেতর নেই। ভাল্লাগে না।
কোন্ কোন্ ডেঞ্জারাস খবর দেবেন, বললেন না তো?
সোহার প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে আসতে খানিকটা সময় নেয় লরা। শুকনো মরুদ্যানে জন্ম নিয়েছে একখানা ক্যাকটাস্, ওটার শরীর খুঁড়ে বাঁশের খোলে জমা বৃষ্টির পানি আজলা ভরে নিতে কেন যে বৃথা চেষ্টা ওর!
সোহা স্বাভাবিক হওয়ার পর বলে, এক বেচারি স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীটিকে হারালো। ওদের কোন ছেলেপুলে নেই। বিয়ের পর পরই বাচ্চা নিতে চেয়েছিল, হয়নি। বেচারির ফেলোপিয়ান টিউবে ব্লক ধরা পড়েছিল। ফেলোপিয়ান টিউবে ব্লক থাকলে স্পার্ম কিভাবে ডিমকে নিষিক্ত করে জরায়ুতে পৌঁছাবে? সেরকম হয়নি, কাজেই বাচ্চাও হয়নি ওদের।
তাহলে?
মৃত স্বামীর শরীর থেকে দ্রুত স্পার্ম সংগ্রহ করা হ’ল স্ত্রীর অনুরোধে। সংগৃহীত স্পার্ম বরফে জমা রাখা হ’ল। এরপর স্ত্রীর ডিম্বানুকে গবেষণাগারে নিষিক্ত করা হ’ল ঐ স্পার্ম দিয়ে। মেয়েটি এখন অপেক্ষা করছে, কবে ও সন্তানের মুখে মৃত স্বামীর মুখের আদলটা খুঁজে পাবে।
আহা! সোহার চোখ ভিজে উঠেছে পরম মমতায়।
আশফাক বলেছে আরেকটি মেয়ের কথা। এড্রিয়েনে ডোমাসিন। ছত্রিশ বছরের এই মেয়েটি এখনো বিয়ে করেনি। করার ইচ্ছেও নাকি নেই। আশফাকদের প্রজেক্টের গবেষণায় নিজেকে গিনিপিগ করতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিল। এর ফেলোপিয়ান টিউব-ও ব্লক বলে ধরা পড়ল। এরকম হলে তো কৃত্রিম ভাবে ডিমকে নিষিক্ত করাও ঝামেলার। মেয়েটাকে স্যরি জানিয়ে দেওয়া হ’ল। মেয়েটা নাকি কাঁদছিল। বিয়ে না করুক, সন্তানের মা হওয়ার ইচ্ছে ওর খুব ছিল। ওকে কি কোন ভাবে সাহায্য করতে পারে না আধুনিক বিজ্ঞান, জানতে চেয়েছিল মেয়েটি।
ড. জেন ফ্রেডেরিকের তত্ত্বাবধানে ঐ মেয়েটির ডিম-কেও বরফায়িত করা হয়েছিল। পশ্চিমা দেশে এটা এখন সহজ একটি ঘটনা। ত্রিশে পা দেওয়া ক্যারিয়ারিস্ট মেয়েরা নিজেদের ডিম এভাবে জমিয়ে রাখে, যাতে পরে সুবিধাজনক সময়ে ওটাকে নিষিক্ত করে নিয়ে গর্ভধারণ করা যায়। বয়স বেশি হয়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মে মেয়েদের শরীরের সুস্থ ডিম উৎপন্ন করার হার কমে যায় বলেই এই সাবধানতা। তবে ঝামেলা কম নয় এতে। বরফায়িত হওয়ার ফলে ডিমের গঠনে বিকৃতি আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু বরফায়িত স্পার্ম অতখানি ঝামেলা বহন করে না, ভালই থাকে বলা যায়। এরপরও প্রতি বছর গড়ে ২০০টি বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে বরফায়িত ডিম থেকে।
ডোমাসিনের কি হ’ল তারপর?
সোহার বড় বড় চোখ তাকিয়ে আছে লরার মুখের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে লরা বলে, বরফায়িত ডিম আর বরফায়িত স্পার্মের সংযোগে ভ্রুন তৈরির চেষ্টা শুরু হ’ল। প্রথমে ডোমাসিনকে এমন কিছু ঔষুধ খেতে দেওয়া হ’ল, যা ওর শরীরে ডিম উৎপাদনকে উৎসাহিত করে। এরকম ডিম সংগ্রহ করে গবেষণাগারে ডিমটিকে বরফায়িত করা হয়। চার মাস পর দাতা ব্যক্তির স্পার্ম প্রবেশ করানো হয় এই ডিমে। নিষিক্ত ডিমটি অতঃপর ডোমাসিনের শরীরে ঢোকানো হয়।
এরপর?
ডোমাসিনের ছেলে নোয়াহ্ পিটার ডোমাসিন দিব্যি সুস্থ শরীর নিয়ে জন্ম নিয়েছে। মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙে ছেলের দেখভাল করতে কত ভাল লাগে, তা জানিয়ে ড. জেন ফ্রেডারিককে মেইল দিয়েছিল ডোমাসিন। আড্ডায় সেই মেইলের কথা বাকি সবাইকে জানিয়েছেন ড. ফ্রেডারিক। আশফাক তার মুখ থেকে শোনা ডোমাসিনের একটি বাক্য আমাকে জানাল। ডোমাসিন নাকি বলেছে, আই জাস্ট কেপ্ট সেই-ইং টু মাইসেল্ফ ‘হি ইজ মাই সান’।’
সোহার চোখ ভিজে যায় কথাটি শুনে। ডোমাসিনের ছেলেটি কেবল-ই কি ওর? বড় হয়ে অচেনা স্পার্মদাতার খোঁজ যদি নিতে চায় ছেলেটা? হিসেব মত ঐ স্পার্মদাতাই তো ছেলেটার বাবা? বুঝতে না পারা অংকের মত ধাঁধা তৈরি হয় সোহার মনে। কেবল মাত্র স্পার্ম দিল বলেই কি অচেনা ব্যক্তিটি বাবা হতে পারবে? এ তো রক্তদানের মত অজটিল ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে ওর কাছে। কোন মানসিক যোগাযোগ ছাড়াই ডোমাসিনের ছেলের বাবা কেন হবে ঐ স্পার্মদাতা? ছেলেটিকে চেয়েছিল একা ডোমাসিন, ছেলেটা কি কেবল ওর-ই নয়? বড় হয়ে ছেলেটা যেন মানুষ হয়, যেন ও বোঝে ডোমেসিনের মানসিক আর শারীরিক উভয় ইচ্ছার ফলে সে পৃথিবীতে আসতে পেরেছে। ছেলেটা যেন অচেনা স্পার্মদাতার জন্য কাতর না হয়, ছেলেটা যেন ডোমেসিনকেই মা এবং বাবা ভাবতে পারে।
ভাবা যায় না। সামাজিক শিক্ষাটা এমন, বাচ্চারা বাবা এবং মা দুই জনকেই চায়। যে বাচ্চাকে তার বাপ কোন দিন দেখেনি, দেখতেও চায়নি, সেই বাচ্চাটাও পাষন্ড বাবার খোলসে মায়াময় বাবার আদল গড়ে নিতে চায়। মা হারানো সন্তান বোঝে মা না থাকার কষ্ট। ডোমেসিনের ছেলেটা হয়তো সত্যিকারের একজন বাবাকে পাশে পেতে চাইতে পারে। তখন ডোমেসিন কি করবে? সোহার এরকম সেকেলে ভাবনার পাঁকে পড়ে দু’ সেকেন্ড ভাবে লরা। হাই তুলতে তুলতে বলে, প্রয়োজন মনে করলে ডোমেসিন একটা বিয়ে করে ফেলবে। এমন কাউকে করবে, যে ওর ছেলেটাকে পিতৃস্নেহ দিয়ে বড় করতে রাজি হবে। এরপর আর কি? হ্যাপি ফ্যামিলি। ডোমেসিন, ওর ছেলে আর ছেলের বাপ্ ডাকার মত ডোমেসিনের স্বামী।
আরিফকে একবার সোহা বলেছিল, এতিম খানা থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে এসে মানুষ করবে। নিজেদের বাচ্চা যখন হচ্ছে না, তখন একটি অসহায় বাচ্চাকে বুকে টেনে নিয়ে বাচ্চা না থাকার কষ্ট তো ভুলে থাকা যায়। খুব একটা ভাল কাজও হ’ল। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই খুশি হবেন। হয়তো, আল্লাহ্ পাকের খুশির বরকতে ওদের সত্যিই বাচচা হ’ল। হতেও তো পারে।
আরিফ রাজি হয়নি। পরের বাচ্চাকে নিজের বলে ভাবতে পারবে না, স্রফে বলে দিয়েছে। তাছাড়া কার না কার বাচ্চা, রক্ত খারাপ হলে তাকে মানুষ করতে চাইলেও মানুষ করা যাবে না, তখন ওটার যন্ত্রণা আরিফ কেন সইবে?
মানুষ না হওয়ার রিস্ক কিন্তু নিজের সন্তানের বেলায়ও থাকে। এরপরও তো বাবা-মায়েরা সন্তানকে ভালবেসে বড় করে তুলতে চায়। মানুষ যদি না হয়, এই চিন্তায় আগেই অস্থির হয় না। সোহার অমন যুক্তিতেও টলেনি আরিফ। ততদিনে সোহা জেনে গেছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেবল আরিফেরই আছে।
সেই আরিফকে মনে পড়ে গেল সোহার। ওর মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠল নিজেরই অজান্তে। বলল, পরের স্পার্ম থেকে জন্ম নেওয়া সন্তান, হোক্ না সে নিজের স্ত্রীর গর্ভজাত, তাকে ভালবাসবে এমন পুরুষ পাওয়া কিন্তু সহজ কাজ নয়। ডোমেসিন কি পাবে তেমন কাউকে?
লরা আবারো হাই তুলতে তুলতে বলে, না পেলে না পাবে। ওর সমস্যা কি? ছেলেকে নিয়ে দিন কাটাবে। ছেলেটাকে বলবে, ওহে বাচ্চা, তোর একখানা বাপ্ ছিল বটে, সে তোর জন্মের আগেই পটল তুলেছে। না না না, ওরকম বললে ছেলের আবার মায়ামমতা উথলে উঠতে পারে। ডোমেসিন বুদ্ধি করে যদি বলে, তোর বাপ্ হারামজাদা তোর জন্মের আগেই তোকে আর তোর মা-কে ছেড়ে আরেক হারামজাদির কাছে চলে গেছে, তাহলে ভাল হয়। ঐ ছেলে আর বাপের নাম মুখেও আনবে না।
খাওয়া শেষ করে লরা ফোন দেয় আশফাককে। ওদিকে তখন ভোর রাত। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আশফাক জানতে চায়, হঠাৎ কেন ফোন করেছে লরা।
তুমি বিয়ে করবে না?
হাই তোলে আশফাক।
কেমন পাত্রী চাই, বল তো? আমি আর সোহা তোমার জন্য মেয়ে দেখার কাজ হাতে নিচ্ছি। উই আর সিরিয়াস।
আবারো হাই তোলে আশফাক। তারপর বলে, য়্যু নিড হট কফি।
উহু, আমি সত্যি বলছি। ঠাট্টা ভেবো না। তোমার জন্য মেয়ে-টেয়ে দেখে রাখব। তুমি এলেই যাতে কবুল বলতে পার।
গুড।
কেমন মেয়ে লাগবে, সেটাই বল।
আশফাক কোমল গলায় বলে, সোহা কেমন আছে? দাও তো, ওকে হ্যালো বলি।
আহা, য়্যু ওয়ান্ট টু এভয়েড দ্য ম্যাটার। এ্যাশ!
সোহাকে বলি, আমি কাকে চাই?

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব সাতধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব নয় >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *