উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস // কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // তৃতীয় পর্ব


মোমেন মেহেদি উঁকি দিয়ে যখন বলল, ভাই, আপনাদের তো কোনো রা-শব্দ নাই, খাবেন না?
তখন পিয়াল ও জহির দুজনেই নড়েচড়ে বসে।
দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে জহির বলল, ও মাই গড, সাড়ে এগারোটা। চল মোমেন, খেয়ে নিই, চল রে পিয়াল।
তিন ব্যাচেলর খাবারের টেবিলে গোল হয়ে বসে রাতের খাবার খেতে শুরু করল।
খেতে খেতে পিয়াল জানতে চাইল, কী খবর তোর মেহেদি?
মেহেদি কাঁচুমাচু হয়ে উত্তর দেয়, ভাই তেমন কোনো খবর নাই। তবে আমার একটা গল্প আগামী শুক্রবার ‘দিন দিন প্রতিদিন’-এ যাচ্ছে।

  • তা-ই নাকি! খুব ভালো খবর। জহির উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে।

পিয়াল মিনমিন করে বলে, আমারও একটা প্রবন্ধ যাচ্ছে, তবে দিন দিন প্রতিদিন-এ না, সেটা যাচ্ছে প্রভাত ফেরিতে।

  • কী বলেন ভাই, প্রভাত ফেরিতে! কী, কবিতা?
  • না একটা বড়সড়ো আর্টিক্যাল।
  • আর্টিক্যাল, তা-ও প্রভাত ফেরিতে, ভাই কেমনে সম্ভব। মেহেদি খাবার রেখে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে।

পিয়াল হাসতে হাসতে বলে, এই আর কি।
উত্তর না পেয়ে মেহেদি বলে, ভাই লেখাটা কীসের ওপর?

  • ওই তো কলিম স্যারের ‘বাঙালির সাহিত্যরস ও বাঙালি চরিত্র’ নিয়ে।
  • তা-ই নাকি? উনার এই বইয়ের নাম হওয়া উচিত ছিল, ‘বাঙালির লালাবোধ ও কলিমের চরিত্র’; তাহলে নামটা ঠিকঠাক হতো। জহির হাসতে হাসতে যোগ করে।

এ কথায় পিয়াল ক্ষেপে যায়, স্যারকে নিয়ে ফাজলামি করিস।

  • হা হা হা, ফাজলামো কেন, সবাই বলে, আর সুবিধাবাদী হিসেবে পুরো জাতিই তাঁকে চেনে। তার ওপর এখান থেকে একটু, ওখান থেকে একটু, এই তো পাণ্ডিত্য।
  • শোন, তোর সে যোগ্যতা নাই, স্যারকে পাঠ করার। ফলে গালিগালাজ করছিস। কোনো বাজে কথা বলবি না স্যার সম্পর্কে।
  • ও শালা তো একটা লুচ্চা, দেখলেই মনে হয় জিহ্বা দিয়ে লালা পড়ছে। এজন্যই বলি বইয়ের নাম হওয়া উচিত ছিল ‘বাঙালির লালাবোধ ও কলিমের চরিত্র’।
  • তোর সমস্যা কী জহির? পিয়াল আরো ক্ষেপে যায়।
  • সমস্যা আমার না, সমস্যা তোর স্যারের।
  • ভাই, স্যার তো পিয়াল ভাইয়ের না, স্যার সবার, পুরো জাতির।
  • তুই চুপ কর মেহেদি। জহির ধমক দেয়।

ব্যাপারটা এভাবে একটু একটু করে জটিল হতে থাকে। দুই বন্ধু পিয়াল আর জহির স্যারকে নিয়ে তর্কে নেমে পড়ে। মেহেদি বড় দুই ভাইয়ের এমন পরিস্থিতি দেখে কাঁচামরিচের খোঁজে কিচেনের দিকে হাঁটা দেয়। কিচেনে গিয়ে একটু সময় নেয়, মানে উঁকি দিয়ে দেখে ব্যাপারটা কোন দিকে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কাঁচামরিচ ধুয়ে তারপর ফিরে আসে। ততক্ষণে পিয়াল আর জহিরে বেশ জমে উঠেছে। মেহেদি লঙ্কা হাতে ফিরে এসে মনোযোগ দিয়ে খাবার খেতে থাকে।

এ কাহিনি এই তিন চরিত্রকে ঘিরে, যারা এক টেবিলে রাতের খাবার খেতে বসেছে। কবি এবং লেখকযশোপ্রার্থী এই তিন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দিয়ে রাজধানীর একটি বাসায় একসঙ্গে বসবাস শুরু করে। উদ্দেশ্য, এ শহরে টিকে যেতে হবে। উদ্দেশ্য, তাদের একজন কবি হতে হবে, তাদের একজন লেখক হতে হবে। তারা সাহিত্যের ভেতর যেতে চায়, এই শহরকে নিজের মতো করে পেতে চায়। প্রেম চায়, অনুভূতি চায়, দেহখানি চায়, খ্যাতি চায়, পুরস্কার চায়, অর্থ তো চায়-ই চায় আরও আরও অনেক অনুষঙ্গ। আমরা এই তিন চরিত্রের সঙ্গে থেকে তাদের কর্মতৎপরতা এবং শিল্প-সাহিত্য-কাব্যতৎপরতা উদ্ধারে ব্রত হব।

পিয়াল

পাবলিক লাইব্রেরিতে কবিতা পাঠের আসর বিকাল ৫টায়। সে-ও কবিতা পাঠের তালিকায় আছে। ফলে একটা কবিতা পকেটে ভরে পিয়াল বেরিয়ে পড়ে দুপুরবেলায়। বাসে কাওরান বাজার নেমে ঘাম মুছতে মুছতে প্রভাত ফেরির অফিসের দিকে পা বাড়ায়। হাতে একটি কবিতার বই ফালি ফালি করে কাটা দুপুরের মুণ্ডু।
রিসিপশনে পিয়ালকে আটকায় না। দারোয়ান দেখে সালাম দিয়ে বলে, পিয়াল ভাই কেমন আছেন, খাদেম সাবের কাছে যাবেন?

  • ভালো আছি, হুম… বলে পিয়াল সোজা দোতলায় উঠে পড়ে। সাহিত্য সম্পাদকের রুমের সামনে এসে দেখে কিংকর খাদেম মনিটরে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা পড়ছে।
    পিয়াল নিচু স্বরে সালাম দেয়, ভাই সামালাইকুম, কেমন আছেন?
    খাদেম চোখ তুলে পিয়ালকে দেখে ভ্রু-কুঁচকায় কী বিষয়, আপনি আমার কাছে?
  • না, মানে ভাই বেশ ক’দিন তো দেখা হয় না।
  • আমার সঙ্গে দেখা হতে হবে কেন? আপনি বড় মানুষ, দেখা করবেন এডিটরের সঙ্গে।

খাদেমের এ কথায় পিয়াল একটু চমকায়। তারপর লাজুক হাসি দিয়ে বলে, ভাই সরি আমি এর কিছুই জানি না। ব্যাপারটা হয়েছে কি…

  • হুম হবে আর কী, আগে বসেন। স্বরে স্নেহ টের পাওয়া যায়।

পিয়াল চেয়ারে বসতে বসতে একবার ঢোক গিলে; বলে, ভাই এক গ্লাস পানি হবে?
খাদেম পানির জন্য বেল টিপে।

  • হয়েছে কি, কলিম স্যার উনার ‘বাঙালির সাহিত্যরস ও বাঙালি চরিত্র’ বইটি দিয়ে একদিন বললেন, পড়ে দেখো তো…। আমি পড়ে স্যারকে একটা আলোচনা দিই, আমার কাঁচা হাতের লেখা, তা-ও মনে হয় যা লিখেছি দিই। উনি লেখাটা পছন্দ করেন, বলেন, রেখে যেতে। উনি যে এটা সম্পাদক সাহেবকে দিবেন তা তো ভাবি নাই। আমি ভেবেছিলাম আপনাকে দিব। কিন্তু উনি আবারও বলেন, রেখে যাও কৈফিয়তের স্বরে সে বলে যায়।
  • আচ্ছা হয়েছে, বলে খাদেম পিয়ালকে থামিয়ে দিয়ে বলে, নেন পানি খান।

পানি খেতে গিয়ে পিয়াল হাতে করে আনা বইটা টেবিলের একপাশে রাখে। বইটা বেশ পুরনো, মলাট অস্পষ্ট, ঠিক বোঝা যায় না এর কভার কেমন ছিল। এ সত্ত্বেও বইটা টেবিলে রাখামাত্র সাহিত্য সম্পাদক কিংকর খাদেমের চোখ যায় সেদিকে, আপনি এ বই কোথায় পেলেন?
পিয়াল একটা লাজুক হাসি দেয়। তারপর মাথা চুলকে বলে, কেন, পল্টনের ফুটপাত থেকে।

  • আপনার কাছে নাই তো কী হয়েছে আমার কাছে তো আছে।
  • হা হা হা, হেসে ওঠে কিংকর খাদেম, আপনার কাছে থাকলে আমার কী লাভ। এ বই তো দূর পরাহত, এর পরের বইটার কোনো কপিও নাই আমার কাছে।
  • মাত্র তিনটা বই, ‘ফালি ফালি করে কাটা দুপুরের মুণ্ডু’, ‘লাফিয়ে ওঠা ঢেউয়ের ডানা’ আর ‘তুমি একটি দীর্ঘশ্বাস’। অথচ প্রতিটি বই-ই আলাদা আলাদা। কোনোটার চিত্রকল্প পাঠককে চমকে দেয়, কোনোটার অনুপ্রাস, মাই গড, খুব মনে পড়ে আপনার ‘লাফিয়ে ওঠা ঢেউয়ের ডানা ও নদী দেখাও তোমার কতবড় সিনা।’ অদ্ভুত!
  • থামেন, থামেন। আপনি যেভাবে মুখস্থ বলছেন, আমি তো অভিভূত হয়ে গেলাম।
  • আর আপনার কবিতা পড়ে আমি যে অভিভূত হয়েই আছি, খাদেম ভাই। এই কপিটা নিয়ে এসেছি আপনার অটোগ্রাফের জন্য। আপনার হাতের স্পর্শ আমার কাছে রেখে দিতে চাই। তাছাড়া কখনো খুব জরুরি দরকার হলে আপনার বই আপনাকেই ধার দেবো। কথাগুলো বলে পিয়াল হা হা হা করে হাসতে থাকে। আর এ বইগুলো কবির কাছে না থাকুক, কবিপ্রেমী প্রত্যেকের ঘরেই থাকা উচিত।
  • হুম, বাদ দেন, বলেন আর কী খবর; শিল্প-সাহিত্যের খবর কী?
  • এইতো ভাই আছি, কয়েকদিন আগে কবি আল মাহমুদের বাসায় গিয়েছিলাম।
  • মাহমুদ ভাই? তিনি বড় কবি, তবে প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালি খান।
  • অনেক কথা হলো সেদিন, আপনার এই বই আমার হাতে ছিল, ওইদিনই পল্টন থেকে কিনেছি। বইটা উনি দেখতে চাইলেন।
  • তাই নাকি ইন্টারেস্টিং, তারপর?
  • বইটা হাতে নিয়ে বললেন, এটা তো কিংকর খাদেমের প্রথম বই ‘ফালি ফালি করে কাটা দুপুরের মুণ্ডু’। ছেলেটার বিরাট সম্ভাবনা দেখি, অথচ একদম লেখে না।
  • বলেন কী, মাহমুদ ভাই এই কথা বললেন? একটু থামে খাদেম, তারপর বলে, আচ্ছা মাহমুদ ভাই না চোখে দেখেন না, আমার বই চিনলেন কীভাবে।
  • আরে যেটুকু দেখেন, অস্পষ্ট, আমাকে তো চিনতে পারেন দেখলে, আশ্চর্য যে আপনার বইটা হাতে নিয়ে ঠিক চিনে ফেললেন।
  • মাহমুদ ভাইয়ের কথার দাম তো দিতেই হবে, বহুদিন উনাকে অবশ্য ফোন করা হয় না, আপনার বদৌলতে উনার কথা মনে পড়ে গেল। যেতে হবে একদিন। কিংকর খামেদের মুখে হাসি লেগে থাকে। মনে হয়, সে একটা দিলখোলা মানুষে পরিণত হয়েছে। বলে, আসেন দু’ভাই একসঙ্গে লাঞ্চ করি।
  • না ভাই, আপনি খান, মিনমিন করে বলে পিয়াল।

কিংকর খাদেম পিয়নকে ডেকে স্টার থেকে দুটা কাচ্চি, সঙ্গে বোরহানি আনার জন্য পাঠায়।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস// কবি আসছে //ফারুক আহমেদ// দ্বিতীয় পর্বধারাবাহিক উপন্যাস // কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // চতুর্থ পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *