শিশুতোষ গল্প।। রুপা ও টুনটুনি।। আশরাফ আলী চারু

শহরের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর হতেই রুপার মন খারাপ। সবসময় কেমন যেনো অন্যমনস্ক মনে হয় রুপাকে। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আগে কেমন প্রাণ চাঞ্চল্য ছিল, আর এখন মেয়েটির কি অবস্থা! শহরে থাকা, শহরে লেখাপড়া করা এসবে যেখানে খুশি থাকার কথা সেখানে রুপার মন খারাপের বিষয়টি বাবাকে ভাবিয়ে তুললো। বাবা অতি আদুরে গলায় রুপাকে ডেকে বললেন, ‘মা তোমার কি শহর ভালো লাগে না? নাকি শহরের বিদ্যালয় অপছন্দ হয়েছে?’
‘না-বাবা, এসবের কোনটাই না।’
‘তবে কেমন যেনো অন্যমনস্ক মনে হয় তোমাকে।’
‘বাবা- একটি কথা বলি?’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘আমাদের ঘরের পিছনে ঠোসকা গাছের টুনটুনি পাখিগুলো আমার খুব ভালো লাগে। ‘টুনটুনির পাঠশালা’ বই পড়ে ওদের প্রতি আমার কেমন যেনো মায়া পড়ে গেছে।’
‘ও, এইকথা!’ বাবা একগাল হেসে বললেন, ‘মা আমরা শহরের যে বাসায় উঠব তার আশেপাশেও টুনটুনিরা আছে।’
‘ওদের বাসা নেই বাবা?’
‘অবশ্যই আছে। থাকবে না কেন?’
মেয়েকে উৎসাহিত করার জন্য বাবা কথাগুলো বললেও মনেমনে ভাবলেন শহরের যে প্রকৃতি সেখানে টুনটুনি পাখির আদৌ দেখা পাওয়া সম্ভব কিনা কে জানে?
‘বাবা, টুনটুনিরা যদি থাকে তাহলে আমার আপত্তি নেই।’
শহরের বিদ্যালয়ে ভর্তি করার পর তারা গ্রাম হতে শহরের বাসায় থিতু হয়েছে। এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে রুপা। ক্লাসে ভালো ছাত্রী বলে সকলের সাথে মিশে পড়ালেখায় মনোযোগী হয়েছে। বাবা মনেমনে নিশ্চিত হয়েছেন মেয়েটি মনেহয় টুনটুনিদের কথা ভুলে গেছে।কিন্তু সে ভুলতে পেরেছে কিনা সেটা কেউ জানে না।

রুপারা শহরের যে বাসায় থাকে এ বাসাটির চারপাশজুড়ে বহু জমি চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। এখনো ঘরবাড়ি নির্মাণ হয় নি বলে এখানে সেখানে গাছগাছড়া জন্ম নিয়ে প্রকৃতির শোভা বর্ধন করেছে। বিভিন্ন রকম পাখিদের আনাগোনাও আছে। সাধারণত শহরের মূল্যবান এ জায়গা পরিত্যাক্ত থাকার কথা নয়। ভাগ্যক্রমে
এরকম একটি পতিত জমির বাসায় উঠতে পেরে রুপাদের পরিবারের সবাই খুবখুশি। শহরে বসবাস করে গ্রামের প্রকৃতির সাধ গ্রহণ কয়জনের ভাগ্যে জোটে। সব মিলিয়ে ভালোভাবেই সময় গড়াতে লাগলো।
এক শুক্রবারে রুপা বাবাকে বললো, ‘বাবা আজ আমাদের বাসার সামনের ঐ খুঁটিটায় একটা মাছরাঙা এসে বসেছিলো।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ বাবা, দোয়েলের আনাগোনাও আছে।’
‘যাক, ভালো হয়েছে। শহরের বাসাতেও আমাদের পাখিদের কলরব শোনা হবে।’
‘বাবা আরো একটা ভালো খবর আছে।’
‘বলো দেখি মা, কী ভালো খবর?’
‘বাসার পিছনে আজ টুনটুনির গান শুনেছি।কলাপাতার আড়ালে ছিলো বলে দেখতে পারিনি।’
‘বলেছিলাম না শহরেও টুনটুনিরা আছে’- এই বলে বাবা একটু হাসলেন।
আলোচনা চলছিলো, হঠাৎ মায়ের ডাকে রুপা চলে যাওয়ায় সেদিনের মতো টুনটুনিদের নিয়ে বাবা মেয়ের আলোচনায় ভাটা পড়লো। এরপর আরো কিছুদিন এ বিষয়ে আর কোনো কথা হল না।

বোশেখ মাসের দ্বিতীয় সন্ধায় বাবা বাসায় ফিরতেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে রুপা বললো, ‘বাবা ওরাই চলে এসেছে।’
‘ওরাই চলে এসেছে মানে? ওরা কারা?’
‘আমাদের গ্রামের বাড়ির টুনটুনি দুটো।’
মেয়ের কথা শুনে বাবা হাসলেন।
‘বাবা তুমি হাসছো? আমি তোমাকে প্রমাণ করে দেখাচ্ছি- একটু বসো তুমি। ওরা এখুনি চলে আসবে।’
বলতে বলতেই টুনটুনি পাখি দুটি সামনের ঠোসকা গাছের ডালে এসে বসলো।
‘দ্যাখো বাবা, আমাদের গ্রামের পাখি দুটোর গলায় দাগ কাটা ছিলো। এদের গলাতেও দাগকাটা! দেখতে পাচ্ছো, তুমি?’
‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। খুব ভালো কথা। পাখি দুটি আমাদের রুপা মামণিকে ভুলতে না পেরে চলে এসেছে। তুমি নিশ্চয় খুশি হয়েছো মা?’
‘ঠিক বলেছো, বাবা।’

টুনটুনির প্রতি রুপার ভালোবাসা দেখে বাবা খুশি হলেন। পাখিদের প্রতি যত্নশীল হতে পরামর্শও দিলেন। বাবা মেয়ের মধ্যে এ বিষয়ে আরো অনেক আলোচনা হলো।
এরই মধ্যে আরো কিছুদিন অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে যা কাউকে বলা হয়নি। রুপা মনেমনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবাইকে একটা সারপ্রাইজ দিবে।
বাসার সামনের ঠোসকা গাছে টুনটুনিদের বাসা আবিষ্কার করেছে আরো তিন সপ্তাহ আগে। ইতোমধ্যে ডিম ফূটে বাচ্চাও এসেছে বাসায়। এখন শুধু বড় হওয়ার পালা।বাচ্চা দুটি বড় হলেই বাবাসহ বাসার সবাইকে সারপ্রাইজটা দেবে। কিন্তু রাতে টিভির হেডলাইনে ঝড়ের পূর্বাভাস দেখে তার মনটা চুপসে গেল। রুপার খুব চিন্তা হল, সত্যিই যদি রাতে ঝড়বৃষ্টি হয়- তবে? টুনটুনির বাসাটা যদি ভেঙে যায়? বাচ্চাগুলোর কী অবস্থা হবে?- ইত্যাদি ইত্যাদি।

রাতে ভালো করে খাওয়া হল না, পড়ালেখাও হলো না, ঘুমও আসতে চাইলো না। খুব কষ্ট করে একটু ঘুম যখন আসছিল তখনই শুরু হল ঝড়বৃষ্টি। রুপা ধড়ফড় করে উঠে সন্তর্পণে দরজা খুলে এই ঝড়বৃষ্টিতে বাইরে বেরিয়ে টুনটুনির বাসার কাছে গেল। দেখতে পেলো বাতাসে গাছটা দুলছে, ডালগুলো দুলছে। পাতাগুলো যেনো ছিড়ে যাচ্ছে।পাতায় তৈরি বাসাটাও দুলছে। মা ও বাবা টুনটুনি একজন বাসার ভেতরে আরেকজন পাতার বোটায় বসে বাসাটা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রুপার আগমনে ওরা একটুও নড়লো না। বরং মনে যেনো বল পেলো। ঠায় বসে রইলো, যার যার জায়গায়।
রুপা এই ঝড়বৃষ্টিতে টুনটুনির বাসাটা আগলে রাখলো আর মনেমনে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো- রক্ষা করো বিধাতা।
এরপর রুপা আর কিছুই বলতে পারে না।যখন তার স্মৃতি ফিরে এলো, তখন সে বিছানায় শুয়ে আছে। মা কপালে হাত বুলাচ্ছেন, বাবা পাশে বসে আছেন।
‘বাবা, টুনটুনির বাসাটা?’
‘অক্ষতই আছে, মা। আমার লক্ষ্মী রুপা মা, যাদের জন্য বৃষ্টিতে ভিজে অজ্ঞান হয়ে পড়েছো, শরীরে জ্বর এনে ফেলেছো- সেখানে তাদের বাসা অক্ষত না থেকে পারে?’
‘বাবা, বাচ্চাগুলো?’
‘তুমি একটু সুস্থ হও, সবই ঠিক আছে।’
‘না বাবা, আমি এখনই দেখতে চাই।’
অসুস্থ মেয়ের পাখিদের প্রতি ভালোবাসার আবদার রক্ষা করতে বাবা মেয়েকে টুনটুনি পাখির বাসার পাশে নিয়ে গেলেন। রুপাকে দেখে বাবা ও মা টুনটুনি গাছের ডালে মাথা ঠুকিয়ে প্রণাম করলো। রুপা বাবাকে এ দৃশ্য দেখিয়ে বললো, ‘বলেছিলাম না বাবা, ওরা আমাকে কত্তো ভালোবাসে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *