শিশুতোষ গল্প।। অনুর বন্ধু সুইচোরা।। মনিরা মিতা

একটা কমলা-হলুদ-নীলচে রঙের পাখি ফুড়ুঁৎ করে পাহাড়ের গর্তের ভেতর ঢুকে পড়ে। একটুপর পাখিটি গর্ত ছেড়ে আকাশে উড়াল দেয়। তার পিছুপিছু আরও একটি টুকটুকে পাখি। চোখ কচলে বড় বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে বেনু। একি কথা, পাহাড়ের গর্তের ভেতর পাখি! তাও আবার তাদের ঘরের কোণার পাহাড়ে!


বেনু দৌড়ে গেল অনুর কাছে। ও হ্যাঁ, তোমাদের তো বলা হয় নাই অনু আর বেনু ভাই-বোন। বেনুর হয়ন ৯ বছর আর অনুর বয়স ৪ বছর। বেনু ৪র্থ শ্রেনিতে পড়ে আর অনু তো খুব ছোট তাই স্কুলে যায় না। বেনুটা খুব দুরন্ত। এ পাহাড় থেকে ওপাহাড়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে চলে। পা দুটো কখনও এক জায়গায় রাখে না। ফুটফুটে বেনু দেখতে খুব সুন্দর। ওর সারা গায়ে লালচে পশম। দেখতে বড় ভালো লাগে। বেনুর বাবা বলে ওর জন্মের আগে যখন মায়ের পেটে ছিল তখন নাকি ওর মা ভেড়ার মাংস খেয়েছিল আর তাইত ওর শরীরে ভেড়ার মত পশম। দুরন্ত বেনু কিন্তু খুব লক্ষী মেয়ে। সবাইকে ভালোবাসে সে। দূরের ঐ বড় নীল পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা মেঘগুলো। ছরায় মাছ ধরতে আসা রঙ্গ বেরঙ্গের পাখি। পাহাড়ি লতা-পাতা। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণা সবকিছুকে ভালোবাসে বেনু। তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার ছোট ভাই অনুকে।
ছোট অনু তুরতুর করে কথা বলে। ছোট ছোট দুষ্টমী করে।এগুলো বড় ভালো লাগে বেনুর। পাহাড়ের গর্তে পাখির বাসা! এটাতো অনুকে দেখাতেই হবে। বেনু দৌঁড়ে গিয়ে অনুকে নিয়ে এলো পাহাড়টার কাছে। বেশ কিছুক্ষণ ওরা দাঁড়িয়ে গর্তটা দেখলো। অনু বলে আপা তুমি ভুল দেখেছ। পাখি তো গাছে বাসা বানায়। গর্তে কী করে আসবে? এমন সময় গর্ত থেকে চি-চি-চি আওয়াজ আসে।
বেনু বুঝতে পারে ভেতরে পাখির বাচ্চা রয়েছে। সে তার সরু চিকুন হাতটা ঢুকিয়ে দেয় গর্তের ভেতর। আর একে একে বের করে আনে ৩টি ছানা।
পাখির গর্তে যে সাপ ও থাকতে পারে সেটা কিন্তু একবারও ওর মনে হলো না। পাহাড়ের সাপ খুব বিষক্ত। কামড় দিলে আর রক্ষা নাই।
যাই হোক, পাখির ছানাগুলো দেখে অনু আর বেনু মহা খুশি। বাচ্চাগুলো নিয়ে দৌঁড়ে এলো মায়ের কাছে।
ওর হাতে এতটুকুন পাখির বাচ্চা দেখে মা ওদের হালকা বকুনি দিলো। বললো গর্তে রেখে আসতে। পাখির বাচ্চাগুলো খুব নরম। ওদের ধরলে ওরা মারা যেতে পারে। পাখিগুলোর নাম কী জানতে চাইলে মা বললো এগুলো সুই চোরা পাখি। ছরার পাশে পাহাড়ের গর্তে বাসা বানায় ওরা। সুই চোরাকে আবার উদয়ী বামনরাঙ্গা বলেও ডাকা হয়। ছোট দু’একটা মাছ, ব্যঙ্গাচি, কাঁকড়া, শামুক এগুলোই খায় এরা।
মায়ের ধমক খেয়ে অনু আর বেনু ছানাগুলোকে গর্তে রেখে আসে। বাচ্চাগুলোর কথা কিন্তু ওরা ওদের খেলার সাথীদের বলে না। অন্যদের বললে তারা যদি বাচ্চাগুলো নিয়ে যায় এভয়ে ওরা কাউকে বলে না।
অনু আর বেনুর সময় কাটে এখন বাচ্চাগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে। সকাল-বিকাল ওরা গর্তের কাছে এসে বাচ্চাগুলো বের করে দেখে। বাচ্চাগুলো একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ওদের বাবা-মায়ের মত ওদের গায়েও কমলা-হলুদ-নীল রঙগুলো ফুঁটে উঠছে। ওদের মা-বাবা খাবার নিয়ে এলে চি-চি-চি শব্দ করে খাবার খায় ওরা। অনু আর বেনু গর্তের কাছে এলেই ফুড়ুঁৎ করে গর্ত থেকে বেড়িয়ে গাছের ডালে গিয়ে বসে বড় পাখি দুটো। গর্তে হাত দিলেই পাখি দুটো মাথার উপর ভন ভন করে ঘোরে আর জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে ডাকে। আসলে পাখি দুটো ওদের বাচ্চাগুলোকে ভালোবাসে। অনু আর বেনু যদি ওদের কোন ক্ষতি করে তাই ওরা এমন করে। একদিন তো মা পাখিটা উড়ে এসে অনুর হাতে ঠোকরই বসিয়ে দিল।
বাচ্চাগুলো বেশ বড় হয়েছে। বেনু হাত ঢুকিয়ে ওদের ধরতে গেলে ওরা পাহাড়ের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে থাকে। বেনু ধরতে পারে না।
একদিন বেনু রেগে গিয়ে গর্তের ভেতর পানি ঢেলে দিল। ওমনি পানিতে ভিজে চুপচাপ বাচ্চাগুলো গর্তের মুখে চলে এলো। ভেঁজা ছোট শরীরগুলো যখন কাঁপছিল তখন বেনু আর অনুর খুব খারাপ লাগছিল। বাচ্চাগুলোকে আদর করে কাপড় দিয়ে গা মুছে আবার গর্তে ঢুকিয়ে দিল ওরা। আর মনে মনে ওয়াদা করলো কখনও আর গর্তে পানি ঢুকিয়ে ওদের কষ্ট দেবে না।
একদিন দুপুরে অনু বাড়ির অঙ্গিনায় পাহাড়ের কোলে একা একা খেলছিল। বেনু স্কুলে তাই অনুর এই সময়টা একা একাই কাটে।
হঠাৎ অনু পাখির দুটোর তিব্র চিৎকার শুনতে পেল। অনু ছুটে গর্তের কাছে গেল। অনু গিয়ে দেখে একটা ছানা পাহাড়ের একেবারে কোণায় ঝুলে আছে। এক্ষুনি হয়ত পরে যাবে। অনু খপ করে বাচ্চাটাকে ধরে ফেলে। একটুর জন্য বেঁচে যায় বাচ্চাটা। বাচ্চাটা গর্তে ঢুকিয়ে দিয়ে আসার পরও পাখি দুটোর চিৎকার থামছে না। অনু গুটিগুটি পায়ে পাহাড়ের কোণায় উঁকি দিয়ে দেখে আরেকটা বাচ্চা পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা লতার সাথে পা পেঁচিয়ে উল্টো হয়ে ঝুলে আছে। অনু অনেক কষ্টে ছোট দুটি হাতে লতাগুলো টেনে বাচ্চাটাকে উপরে তোলে। ওর পা থেকে প্যাঁচান লতা গুলো খুলে দেয়। আদর করতে করতে গর্তে বাচ্চাটা রেখে আসে। ঐদিন অনু বাচ্চা দুটোর জীবন বাঁচায়। বড় পাখি দুটো অনুর মাথার উপর ঘুরে ঘুরে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে ওদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
আসলে ঐ সময় বড় পাখিদুটো বাচ্চা গুলোকে ওড়া শেখাচ্ছিল। বাচ্চাগুলো উড়তে গিয়ে বারে বারে পড়ে যাচ্ছিল। একটু বেশি দূর উড়তে গিয়েই বোধয় ওরা ওমন বিপদে পড়েছিল। অনু এসে মাকে একথাটা বলতেই মা ওকে মন ভরে দোয়া করলেন। মা বললেন তুমি খুব ভালো কাজ করেছ অনু। বাচ্চাদুটোর জীবন বাঁচিয়েছ। এতে আল্লাহ তোমার ওপর খুব খুশি হয়েছেন।
ঐ দিনের পর থেকে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। বেনু আর অনু যখন গর্তের কাছে যায় বড় পাখি দুটো গর্ত থেকে বের হয়ে সামনের গাছে গিয়ে বসে। বেনু-অনু বাচ্চাগুলো বের করে আদর করে অথচ পাখিগুলো একটুও ডাকাডাকি করে না। আগের মত ঠোঁকর দিতে চায় না। হয়ত ওরাও বুঝে গিয়েছিল বেনু আর অনু ওদের বন্ধু। ওরা পাখিদের কোন ক্ষতি করবে না।
বেশ কয়েকদিন পর, বিকেলে হালকা একটু বৃষ্টি হলো। বৃষ্টির পর আকাশে মেঘগুলোর ভেসে বেড়ান দেখতে বড় ভালোবাসে বেনু-অনু। ওরা দাঁড়িয়ে সাদা-কালো মেঘগুলোর ছুটে চলা দেখছিল। হঠাৎ অনু দেখতে পেল কয়েকটা পাখি ওদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে ছড়ার ওপারের গাছে গিয়ে বসলো। ওরা দৌঁড়ে গর্তের কাছে গেল। হাত ঢুকিয়ে বাচ্চাগুলোকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু বেনু খালি হাত বের করে আনল। ঐ বাচ্চাগুলো তাহলে ভাল ভাবে উড়তে শিখেছে। ওরা এখন নিজেদের ডানায় ভর করে আকাশে উড়ছে। মনে মনে বেশ খুশি হয় বেনু। কিন্তু বাচ্চাগুলোর জন্য ভিষণ মন খারাপ হয় অনুর। পরদিন সকালে অনু আবার গর্তের কাছে যায়। বাচ্চাগুলো গর্তে ফিরে আসে নাই। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায় অনুর। অভিমানে গাল ফুলিয়ে ফুলিয়ে কাঁদতে থাকে সে। বেনু অনেক শান্ত্বনা দেয় অনুকে কিন্তু কিছুতেই কান্না থামে না অনুর।
দুই দিন কেটে গেল অনু ঠিকমত খায় না। ঘুমায় না। খেলে না। সারাক্ষণ পাহাড়ের গর্তের কাছে গিয়ে বসে থাকে। বেনু-অনুকে বোঝায় বাচ্চাগুলো এখন বড় হয়েছে নিজেরা উড়ে-উড়ে ঘুরে-ঘুরে বেড়াতে পারে। এখন আর ওদের গর্তে আসার দরকার হয় না। অনু তবুও মন খারাপ করে বসে থাকে। হঠাৎ অনু দেখে তাদের মাথার উপর পাখি ডাকছে। তাকিয়ে দেখে ঐ সেই বাচ্চা তিনটা। বেনুর মাথার উপর ঘুরে ঘুরে ক্যাচ-ক্যাচ ডেকে ডেকে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে। এরপর ফুড়ুঁৎ ফুড়ুঁৎ উড়ে হারিয়ে গেল দূরে পাহাড়ের আড়ালে। উড়তে পেরে পাখির বাচ্চাগুলো খুব খুশি। ওদের আনন্দ দেখে বেনু-অনুর মুখেও হাসি ফুঁটে উঠল। অনু বললো সুইচোরা পাখি তোমরা আমার বন্ধু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *