কবি আবুল হাসান কী সংবাদ হে মর্মাহত রাজা।। আলমগীর রেজা চৌধুরী।।

নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক আইজ্যাক সিঙ্গার বলেছেন, ‘একজন লেখকের দায়িত্ব শুধু লেখা, তারপর তাঁর কর্তব্য শেষ। সে কম্যুনিস্ট লেখক ছিলেন নাকি বুর্জোয়া লেখক, তা থেকে তাঁকে মুক্ত করে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের। প্লাটফর্ম যাই হোক, মোরালিটির প্রতি লেখকের বিশ্বাস কতোটা সুদৃঢ় তা কেবল বিবেচ্য বিষয়।’

একজন কবি অথবা লেখককে আমরা কোন অভিধায় চিহ্নিত করবো! তাঁর রচনাশৈলী সমকালীন চিন্তা-চেতনায় কতোটা নাড়া দিতে পেরেছে, সাথে দেশ-কাল-পাত্রভেদে তা সার্বজনীন হয়েছে কি না! যদি, তিরিশোত্তর কবিতা নন্দিত, বহুরৈখিক, শিল্পমূর্ত হয়, তবে আশার কথা। দশকে দশকে বাংলা কবিতা নতুন অভিব্যক্তিতে ভূষিত হয়েছে। চিহ্নিত হয়েছে কালিক চিন্তা-চেতনার সমন্বয়। তারপরও প্রশ্ন জেগেছে, কবিতার অগ্রসরমান যাত্রায় নৌকোর মাল্লাগণ নতুন নতুন পাল তুলে দিচ্ছেন তো! কবিতায় মানুষ আশাকে জাগিয়ে রাখতে চায়।

মানুষ তার সময়কে সবচেয়ে উন্নততর বিবেচনায় রাখতে ভালোবাসে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বয়ঃপ্রাপ্ত কিশোর সারা পৃথিবীতে অস্ত্র প্রতিযোগিতার বহর দেখেছিল, সেই সময়কার চিন্তা-চেতনায় বিধৃত হয়েছে তাঁর কর্মকাণ্ডে। ঠিক তার পাশাপাশি বিশ দশকের মাঝ ভাগে নিউট্রন বোমা এলো। ব্যবধান চল্লিশ বছর। সময়ের সুফল-কুফল ভাগাভাগি করে গ্রহণ করলো মানুষ।

এ বিবর্তনের সঙ্গে পৃথিবীময় মানুষের মন ও মননের যে বহুরৈখিক বিস্তার ঘটে, তা কী চূড়ান্ত! তবে এটুকু বলা যায়, পৃথিবীর বয়স বাড়ছে, আর মানুষ প্রকৃতির সন্তান হিসেবে তার অংশীদারিত্ব গ্রহণ করছে। বিষয়টি অনিবার্য। ঠিক তেমনি তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার যে অবয়ব, ব্যঞ্জনা, বক্তব্য তা কি কালিক চিন্তায় খুব বেশি ব্যবধান রাখে। অবশ্য, সময় এখানে সবচেয়ে বড়ো মানদণ্ড। তবে তারা তো শুরু করেছেন নতুন কিছু। নতুন সবকিছু গ্রহণ এবং বর্জনের মধ্যে দাঁড়িয়ে, এবং বাংলা কবিতা, তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। চিন্তা, আঙ্গিক, ঐতিহ্য সমকালীন ভাষার সঙ্গে একীভূত করে দ্যুতিমান হয়েছে।

মূলত ’৪৭-এ দেশ ভাগের পরই বঙ্গীয় গোষ্ঠী সত্যিকার অর্থে নিজেদের আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়। আমাদের কবিতা বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পরই কাব্যভাষার পথের সন্ধান খুঁজে পায়। এ যাত্রাপথ বেশ দীর্ঘ। পূর্বসূরিদের পথ বেয়েই সৃষ্ট-পথের গভীরতর গহ্বর খুঁজতে হয়েছে। বাংলা কবিতায় যারাই এই পথযাত্রায় শরিক, তারাই আমাদের কাছে নমস্য। ষাট-এর মধ্যভাগে শুরু, সত্তর-এর মধ্যভাগে সমাপ্ত। এই আয়ুষ্কালের সবচেয়ে ফলবান কবি আবুল হাসান। প্রয়াত। জীবিতকালে প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তিন। ১. রাজা যায় রাজা আসে, ১৯৭২, ২. যে তুমি হরণ করো, ১৯৭৪ ৩. পৃথক পালঙ্ক, ১৯৭৫ এবং মুহম্মদ নুরুল হুদা, ফখরুল ইসলাম রচি, জাফর ওয়াজেদ সম্পাদিত আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা, গল্প ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। পরের গ্রন্থদয় তার মৃত্যুর চার বছর পর প্রকাশিত হয়েছে। আবুল হাসান-এর একটি কাব্যনাটক ‘ওরা কয়েকজন’ প্রকাশকাল বৈশাখ ১৩৯৫। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন যা পরবর্তীকালে তারিক সুজাত-এর সম্পাদনায় বেরিয়েছে আবুল হাসান গল্প সংগ্রহ শিরোনামে।

কবি আবুল হাসান কবিতা লিখতে শুরু করেন মূলত ষাট-এর প্রভাব-বলয়ের মধ্য থেকে। ষাট-এর আমাদের কবিতার অত্যন্ত মূল্যবান দশক। স্বাতন্ত্র্য কাব্যভাষা, নিগূঢ়তম সত্য, বাহুল্য শব্দমালা পরিহার, জীবন, দেশ, কাল-এর নিপুণ নির্ঘণ্ট। যা পরবর্তীকালে কবিতাকেই আমূল পাল্টে দিয়েছে। হাসানের এই সময়ের কবিতায় নস্টালজিক মাতম আছে। অনেকটা পরিব্রাজকের মতো। ‘প্রথম যে কার ঠোঁটে চুমু খাই মনে নেই/ প্রথম কোনদিন আমি স্নান করি মনে নেই। কবে কাঁচা আম নুন লঙ্কা দিয়ে খেতে/ দাঁত টক হয়েছিল মনে নেই। মনে নেই কবে যৌবনের প্রথম মিথুন আমি ঘটিয়েছিলাম মনে নেই…। আবুল হাসান ছিলেন মূলত কবি এবং কবি। তাই শিল্পের নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বৃত্তাবদ্ধ হতে চাননি। ক্রমাগত নিজেকে ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে যে কাব্যিক আকাশ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন তা কবিতার জন্যে প্রতিনিয়ত নিজেকে জাগরূক রাখা আর শিল্প-সুষমার অবগাহন করা।

মধ্যবিত্তের সংসারে যে শিশুর জন্ম, বরিশালে। জীবনানন্দের পড়শি। একই পরিবেশে বেড়ে ওঠা বাংলা কবিতার দুই ধীমান পুরুষ। প্রকৃতি, শস্যের সাম্বা নৃত্য, লক্ষ্মীপেঁচার লুকোচুরি, উদার আকাশ মিলিয়ে একাকার করে দেয় দু’সত্তার মোহান্ধ কবিতা বাসর। হলুদ সন্ধ্যায় একা একা, আমি হায় কার অভিশাপে/এতো নির্জনতা, বিমর্ষতা সঙ্গতা, এই না সেই হলদে পাখির মুখোমুখি/ নীল ঘাসে ঢাকা, শাক ও সবজির শ্যামলে বিছানো হাত আর পায়ের ক্রন্দন জীবনানন্দকে ধারণ করেনি আবুল হাসান। অগ্রজ কবি শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতাকে বর্ণাঢ্য, সমৃদ্ধ করেছে।’ সত্যি কী আবুল হাসানের কবিতা আমাদের কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে? অগ্রজ কবির স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে অনুজের যাত্রাপথের সুড়ঙ্গ। সেই পথেই এগিয়েছেন আবুল হাসান। কোনও ছলনা নয়, কবিতার সহজ, সাবলীল, কোমল কণ্ঠকে ধারণ করেই তার কবিতা নির্মিত। যা যে কোনও পাঠককে অন্য এক বোধে নিয়ে যায়। যে বোধ শিল্পের অমোঘ আশ্রয়। হাসান লিখেছেন, ‘শিল্প তো নিরাশ্রয় করে না। কাউকে দুঃখ দেয় না।’ অথবা ‘আমি তার হৃৎপিণ্ডে যাই। চিরকাল রক্তে আমি/ শান্তি আর শিল্পের মানুষ।’ তাই এ কথা বলা যায় জীবনানন্দের বরিশাল হয়ত এক। সেই ধানসিঁড়ি নদীর কলকল ধ্বনি, নক্ষত্রের রূপালি ভরা রাত। শুধু পৃথক সময়। আর এ কারণেই ভিন্ন মেরুকরণ।

২.

অগ্রজ প্রতিমেষু

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা

WHAT IS HOPE A PROSTITUTE! ALLURING TO ALL, SHE GIVES HERSELF ALL, UNTIL YOU HAVE SACRIFICE DA PRICELESS TREASURE YOUR YOUTH THEN SHE FORSAKES YOU.

পিটার সেন্ডারের এই পঙ্ক্তির ভেতর নিজেকে বিস্তার করি। উত্তরের জানালায় লুটোপুটি খায় দিগন্ত রেখায় লেপ্টে থাকা ঈষৎ কুয়াশার বেয়াদব আচরণ। ভাগ্যিস, আরও ছিল শেষ বিকেলের ছড়িয়ে থাকা আলোর জলছাপ খেলা। এ রকম কত ছবির লুকোচুরি, সুদক্ষবাদকের সুশ্রুত ভায়োলিনের করুণ বেহাগ। লাল নীল দীপাবলীর ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে যাপিত জীবনের অর্গলকে উন্মুক্ত রেখে বাইরে এলে যে সুবাসিত বাতাসের অস্তিত্ব ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক অলীক ভালোবাসার কাছে; ঋণভূমে দাঁড়িয়ে হঠাৎ খুব পরিশীলিত কণ্ঠে কে যেন বলে, ‘এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে?’ আমি বলি, ‘ঘরে তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার, প্রেমান্ধরা অপেক্ষা করছে।’

এ রকম কথা হয় তাঁর সাথে, তাঁহার সাথে। অনেকটা কাতর প্রেমিকের মতোন। যেন অহেতুক কথামালায় সন্ধিগ্ধ হয়ে ওঠে প্রণয়সিক্ত যুগল। যে কোনও সময় রিকসা থামিয়ে জনাকীর্ণ রাস্তায় নেমে হাত নাড়িয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানায়। আর তার সঙ্গে আমার লুকোচুরি খেলা। অকারণ অভিমান, শিশুসুলভ বালখিল্যতায় নিজেকে জড়াতে থাকি বাসন্তিকা যৌবনে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এ রকম। একজন মুগ্ধ নার্সিসাসের নস্টালজিক মাতম।

৩.

হাসান ভাই, এক বর্ষণমুখর বিকেল বেলায় নিউ মার্কেটের ‘মনিকো’ রেস্তোরাঁর আড্ডায় আপনাকে আবিষ্কার করি। শাহাদাত বুলবুল, সাবদার সিদ্দিকী, মোস্তফা মীর, রফিক সিদ্দিকী মিলে তুখোড় আড্ডায় মেতে আছি এ রকম সময় আপনি হন্তদন্ত হয়ে ‘মনিকো’তে প্রবেশ করলেন। বৃষ্টির ছাটে আপনার শরীর শার্ট-প্যান্ট ভিজে একাকার। রফিক সিদ্দিকী এগিয়ে দিল ওর ব্যবহার করা গামছা। শরীর মুছে আপনি বললেন, ‘সাবদার, এ রকম বৃষ্টি! ঠাকুর কতো কবিতা লিখতো চিন্তা করো দেখো।’ সাবদার ভাই আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিলেন- এ রকম ‘বেটা পাজির হদ্দ!’

বাইরে তুমুল বর্ষণ! রফিক আপনাকে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ‘মনিকো’র আগে আমি আপনাকে দেখেছি রেখায়ন-এর আড্ডায়। কাছে যেতে পারিনি। ওইদিন আবিষ্কার করি একজন কবি আবুল হাসানকে। গভীর রাত পর্যন্ত ম্যারাথন আড্ডা চলে। এর মধ্যে চলে আসে মহাদেব সাহা আর রফিক আজাদ। রফিক ভাই বলে, ‘আরে বেটা, কাব্য রোগে ধরেছে।’ আর আমাদের রফিক সিদ্দিকী পরম মমতায় চা’র সঙ্গে ওর সদ্য লেখা কবিতা শুনিয়ে যাচ্ছে। রফিক সিদ্দিকী ছিল ‘মনিকো’র বেয়ারার। কিন্তু ভারী চমৎকার কবিতা লিখতো। ওই সময় প্রথম শ্রেণির কাগজগুলোতে ওর লেখা ছাপা হতো। আপনার মতো রফিকও ছিল আমার আরেক বিস্ময়। ওই যে গ্রাম থেকে এসেছি! তো পরবর্তীতে রফিক সিদ্দিকী’র একটি কবিতাগ্রন্থ বের হয়েছিল। আজ ও কোথায় আছে, আদৌ কি কবিতা লেখে কিনা! আমার জানা নেই। আপনার ‘রাজা যায় রাজা আসে’ পড়ে তখন আমার মগজে ঘোর লাগা সন্ধ্যা। সেই কবিকে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে আমার যে অভিন্ন আত্মার উপলব্ধি তা পরবর্তীতে আপনাকে জানানো হয়নি।

এভাবে আপনার আত্মার কষ্টকে খুঁড়তে খুঁড়তে একজন কবিকে আবিষ্কার করা। যে কবি বাংলা কবিতাকে একটি ভিত করে দিয়েছে। আমরা কৃতজ্ঞ।

আপনি ছিলেন জাত বোহেমিয়ান। কবি নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাবদার সিদ্দিকী ব্যতীত আর কারও সাক্ষাৎ পাইনি, যে কবিতার জন্যে জাগতিক সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে।

‘মনিকো’ শরীফ মিয়ার কেন্টিন, রেক্স, রেখায়নে করে করে ততোদিনে একজন সদ্য যৌবনে পা দেওয়া যুবক আপনার মধ্যে কিঞ্চিৎ স্থান করে নিয়েছে। ভালোবাসায়। কাব্যঘোর তরুণের চরম প্রার্থিত। আপনি উদ্বাস্তু উন্মুল চরিত্রের মানুষ। ঢাকা শহরের কোন গৃহ আপনার নির্দিষ্ট তা কেউ বলতে পারবে না। আমি থাকতাম ইন্দিরা রোড। একদিন মধ্যরাত। আপনি হাজির। আমার তো বিস্ময় কাটে না। নিজেই আপ্যায়ন বন্ধ করে দিলেন।

বললেন, ‘হোটেলে খেয়ে এসেছি। ঘুমাবো।’ আমি সেদিন আমার মেস মতোন রুম ছেড়ে দিয়ে আপনাকে নিদ্রার সুযোগ করে দিলাম। না আপনি ঘুমাননি। শেষ রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেলে পাশের রুমে আলো জ্বলা দেখে উঁকি মেরে দেখি আপনি লিখছেন। বাংলা কবিতার অমর অজর পঙ্ক্তিমালা লিখিত হচ্ছে। আমি ডিস্টার্ব করিনি। আপনি ছিলেন শব্দ-শিকারি। কাব্য শিকারের ওই মুহূর্তকে কখনও ভোলা যায়! এভাবেই আবিষ্কার করা। আমাকে কখনও আপনি কবিতা লেখার কথা বলেননি।

বলতেন, ‘তুমি লেখা বাদ দাও তো ওস্তাদ। বরঞ্চ ঢাকার ছবির ট্রিপিকাল নায়কে মানাবে বেশ।’

আমি বলতাম, ‘আমি তো আপনার মতোন চোখের গভীরতা নিয়ে জন্মনিই নি। কী তীক্ষ্ণ চোখ আপনার।’ রবীন্দ্রনাথের মতো। বয়স ভেদাভেদ ছাড়াই আপনি অনেককেই ‘ওস্তাদ’ বলতেন। আমি কবি আবিদ আজাদকে বলছি, হাসান ভাইয়ের এটা অন্যায়।’ আবিদ ভাই বলে, ‘আরে ও শালাতো কবি।’ কী এতো অভিমান ছিল আপনার। রাজিয়ার বাল্যকালীন প্রেম, সুরাইয়া খানমের জগত প্লাবিত ভালোবাসার পর একজন কবির এত অভিমান কেন? ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা।’ তাতে কী? আপনার জগত ভিন্নতর। বাবা-মা-ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন প্রেমিকার উপচে পড়া হার্দিক অনুভূতির প্রতি উদাসীন থেকে জীবনকে নিয়ে ক্রমাগত এক আত্মবিনাশের খেলায় মেতে থেকে লিখেছেন, ‘ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও, ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও।’

৪.

ততোদিনে আপনার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো’ বের হয়েছে। আমার মতো তরুণদের নিকট তখন আপনি অজয় যুবরাজ। মনে আছে, আমি আর মোস্তফা মীর নিউ মার্কেটের ‘নলেজ’-এ ছুটে গেলাম বইটি কেনার জন্য। আহ! কী চমৎকার গ্রন্থ! চোখ বুঁজলে এখনও সেই আনন্দের আতিশয্যে হারিয়ে যাই। ‘বুঝি তাই দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও তুমি অনাবাদী রাখবে না আর’ অথবা ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম পৃথিবীতে তিন-চতুর্থাংশ লোক এখনও ক্ষুধার্ত।’ অথবা ‘মাটির ভিতরে তুমি সুগোপনে একটি স্বদেশ রেখে কেন কাঁদো? বৃক্ষ রেখে কেন কাঁদো? বীজ রেখে কেন কাঁদো? কেন তুমি কাঁদো? মগ্ন আনন্দের মধ্যে দুঃখের জমিন খুঁড়ে তুলে আনা পঙ্ক্তিমালায় শোভিত যে কাব্যগ্রন্থ তা কী কেবলি বক্রোক্তি! না জীবন ক্ষরিত স্পষ্ট উচ্চারণ। যুদ্ধ, সামাজিক বৈষম্য, রাজনীতি, সমাজনীতি কিছুই বাদ যায়নি অজয় কলমের নির্মম কালিতে। ‘আমি জানতাম হে অর্জুন অনাহারে অনেকেই যুবতী হয়েও আর যুবতী হবে না!’

আপনার সঙ্গে অনেক স্মৃতি আছে। বয়সের বেড়াজাল ভেঙে এক তরুণের সঙ্গে আপনার দিনরাত্রির স্মৃতিগুলো নেহায়েত কম নয়। রেখায়ন, শরীফ মিয়ার কেন্টিন, ‘মনিকো’ রেসকোর্চ, বাংলা একাডেমির আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ-এর টেবিলে কত সময় আমাদের হারিয়ে গেছে।

এ সময় মরণব্যাধি হৃদরোগ আপনার মধ্যে একটু একটু বিস্তার লাভ করছে। আপনি কী এ সবের তোয়াক্কা করেছেন! মনে হয় না। নইলে এমন প্রাণবন্ত, সজীব অস্তিত্ব বহন করে কীভাবে ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চষে বেড়িয়েছেন! ভাবতে অবাক লাগে। চুয়াত্তরে বার্লিন যাবার আগে কিছুদিন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। উন্নততর চিকিৎসার জন্য বার্লিন পাঠানোর আয়োজন চলছে। যেহেতু ‘রেখায়ন’ ছিল পিজি সংলগ্ন সেহেতু আপনাকে দেখা ছিল আমাদের সন্ধেবেলার নিয়মিত আড্ডার অংশ। যতটা না রোগী দেখতে গিয়েছি, তার চেয়ে কবি আবুল হাসানের সান্নিধ্যে কী আমাদের আপনার কাছে নিয়ে যায়নি! কী অমোঘ নিয়তি প্রতিনিয়ত আপনার কাছে টেনেছে। নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, মুহম্মদ নুরুল হুদা, সমুদ্র গুপ্তকে আপনার কেবিন থেকে বের হয়ে কাঁদতে দেখেছি। কবি রফিক আজাদ গাল দিল ‘হারামজাদা।’ কাকে উদ্দেশ্য করে এই গাল পরবর্তীতে কোনও দিন রফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।

একদিন আপনি বার্লিন চলে গেলেন। কী সজীব আপনার মুখ। যেন এ রকম- ‘আমি ঠিকই ফিরে আসবো। জাতিসংঘ আমাকে নেবে না। বাংলাদেশ আমাকে নেবে।’ ততদিনে বাংলাদেশের অনেক তরুণ কবি আপনার ভাব-শিষ্য হয়ে গেছে। আমি কী তার বাইরে ছিলাম!

বার্লিন হাসপাতালে শুয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে কবিতার খেলায় মেতে তুলেছিলেন। লিখেছেন বঙ্গ সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কিছু কবিতা। অসুখ, রোগশয্যায় বিদেশ থেকে, সাদা পোশাকের সেবিকা, অন্যরকম বার্লিন ইত্যাকার কবিতা বার্লিন থেকে পাঠিয়েছিলেন ‘বিচিত্রা’য়। আমরা অবাক! কী মমতা, কী মমতা! আসলে আপনি হলেন গিয়ে জাত কবি। যে কোনও পরিবেশে লিখতে পারতেন।

একদিন ফিরে এলেন বাংলা কবিতার অমর যুবরাজ। কেশর ফুলিয়ে গেয়ে উঠলেন-‘উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!’ আজ এসব কবিতা ভাসিয়ে দিল আমাদের কবিতার ভুবন। আপনাকে ধন্যবাদ।

পঁচাত্তরে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতিকে হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশে যে অশুভ চক্রের আগমন ঘটে তা আপনি মেনে নিতে পারেননি। আপনার উন্মুল উদ্বাস্তু জীবনের বন্ধুকবি নির্মলেন্দু গুণ প্রিয় ঢাকা শহর ছেড়ে বারহাট্টায় শেকড়ের কাছে ফিরে যায়। আপনাদের সেই বেদনার কথা দু’জনের পত্রালাপে জানতে পেরেছি। না তারপর ক্রমাগত ভাঙচুর। আপনাকে আর ফেরানো যায়নি।

কবি হাফিজুর রহমান। যে পরবর্তীতে আপনার প্রিয় বোন বুড়িকে বিয়ে করেছে। সেই হাফিজ ভাই মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আপনার শিয়রে ছিল। কবি হাফিজুর রহমান লিখেছে- ‘পঁচাত্তরে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ যে অনিশ্চিত রাজনৈতিক আবর্তে ডুবেছিল, তীব্র অনুভূতি প্রবণ কবি আবুল হাসান তা সইতে পারেননি। শেষবারের মতো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই যে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, আর ফেরা হয়নি। প্রথম ছিলেন ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে, পরে কেবিনে জীবনের শেষ কয়টা দিন।’ আর কবি কাজী সালাউদ্দিন কী গভীর মমতায় আপনার হাসপাতালবাস সময়গুলোতে যথার্থ সেবা করেছে ভাবতে অবাক লাগে। আপনার বন্ধু সুরাইয়া খানম, অগ্রজ রাহাত খান প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সঙ্গ দিয়ে আপনাকে উজ্জীবিত করার কঠিন প্রয়াসে লিপ্ত থাকতেন। সত্যি কী করে আপনি এ মমতাগুলো ছিন্ন করতে পারলেন। যার কথা প্রায়শ বলতেন- বুড়ি। আপনার ছোঁ বোন। সংসারের প্রতি অভিমানী কবি যে কেবল এ বোনটিকে আত্মার কষ্ট দিয়ে চেতনায় লালন করতেন। যে বুড়ি পরবর্তীতে আমাদের চমৎকার বন্ধু। কামাল চৌধুরী, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জাফর ওয়াজেদ, মঈনুল আহসান সাবের, ইসহাক খান, মঈনুস সুলতান, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহন রায়হান, ইমদাদুল হক মিলন-এর বুড়ি। অথবা আপনার ছোট ভাই লুলু (আবিদ হাসান বাদল) আমাদের প্রিয় বন্ধু, স্বজন। একসময়ের বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক আমাদের লুলু ওরফে আবিদ হাসান বাদল, যে কিনা আপনার চেহারার আদল নিয়ে জন্মেছে। অবিকল আপনার মতো। আড্ডায় নির্লিপ্ত। সবকিছু ঠিকঠাক, শুধু মাঝখান থেকে নক্ষত্র পতন। বাংলা কবিতার দুঃসময়।

৫.

‘২৬ নভেম্বর খুব ভোরে প্রাত্যহিক সূর্যদর্শনের জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েন কবি। আমাকে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও আমি সাহস পাইনি সেদিন বের করে নিতে। কারণ, তখন তাঁর শ্বাসকষ্টের জন্যে নাকে অক্সিজেন-এর নল ঢুকানো ছিল। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে নিজেই নামতে গিয়ে অক্সিজেনের নল স্থানচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। সেই যে দম হারালেন আর ফেরাতে পারেননি। ডাক্তার-নার্সের অস্বাভাবিক হুড়োহুড়ি দৌঁড়াদৌঁড়িকে অর্থহীন করে অভিমানী কবি সূর্যোদয়ের কোলে ঢলে পড়লেন। হাসানের বোন বুড়ি রাতে হাসপাতালে ছিল না, সেই সময়ে তাঁকে খবর পাঠানো হলো, অল্পক্ষণের মধ্যে সে এসে পড়ল। সুরাইয়া খানম এসে পড়লেন, মাহফুজ ভাই এলেন, রাহাত ভাইসহ সেই সাতসকালে বিষণ্ন ঢাকা শহর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল হাসাপাতালের কেবিনে।’ মানবজমিন-এ আপনার মৃত্যুশয্যার শেষ প্রত্যক্ষদর্শী কবি হাফিজুর রহমান এভাবেই লিখেছেন আপনার শেষ সময়ের গল্প। সত্যি সেদিন ঢাকা শহর আপনার শবদেহের পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। আপনার মৃত্যুলীন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেন যেন মনে হয়েছিল- ‘পাখি হয়ে যায়- এই প্রাণ।’ আপনাকে আর ফিরে যেতে হয়নি বরিশালের ধানসিঁড়ি নদীটির কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে বনানী গোরস্তানে চিরনিদ্রায় শোয়ানো হয়। মসজিদ প্রাঙ্গণে যখন আপনার খাটিয়া নামানো হয় তখন আমার কান দুটো আর্তরোদনের করুণ বিলাপ ব্যথিত করে তুলেছিল। বুড়ি, যে আপনার প্রিয় ছোট বোন এবং অন্যজন কবি সুরাইয়া খানম। আপনার আত্মার স্বজন। যে সবকিছু না ভেবেই একজন উন্মুল কবির আত্মায় প্রগাঢ় ভালোবাসায় স্থান করে নিতে চেয়েছিল। আর আপনিও তাকে আশ্বস্ত করেছেন-‘যতদূর থাকো ফের দেখা হবে। কেননা মানুষ যদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলন মৌলিক। মিলে যায়- পৃথিবী আকাশ আলো একদিন মেলে!’ সম্ভবত ১২ নভেম্বর আপনার শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’ বের হয় সন্ধানী প্রকাশনী থেকে। যে গ্রন্থ আপনাকে সবকিছু ছাপিয়ে একজন প্রাজ্ঞ কবির সম্মানের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আর আমরা আপনার কাব্যিক অমিয় ধারায় অবগাহন করতে করতে কী উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় খুঁড়তে খুঁড়তে নৈঃসঙ্গ্য এবং দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে উচ্চারণ করি- ‘পৃথিবীর প্রথম হ্রদের তলদেশ- উত্থিত ক্রন্দন ভরা মাটি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *