প্রবন্ধ।। কাজী নজরুল: ‘যে-পথে যেতে হবে, সে পথে তুমি একা’।। আবদুল্লাহ আল আমিন

বাংলা সাহিত্যের কুলীন বয়ানে যখন রবীন্দ্রনাথ প্রধান আলোকস্তম্ভ হয়ে উঠেছেন;  ঠিক তখন নজরুল ইসলামের সক্রিয় সাহিত্যকাল। এ কালপর্ব গত শতকের বিশের দশক থেকে ত্রিশের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ সময়কালে রচিত হয় তাঁর কালজয়ী শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তিগুলি। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা’। তখন নজরুল তেইশ বছরের এক টগবগে যুবক। সারা ভারতবর্ষ তখন উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে উত্তাল। অসহযোগ আন্দোলন, চরকা আন্দোলন. সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলনের উম্মাদনায় প্রকম্পিত চারদিক। ভারতবষের্র অন্যান্য তরুণের মত নজরুলও সেই অগ্নিযুগের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। মহাত্মাগান্ধী দেশমুক্তির জন্য যে সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন তাতে তরুণ নজরুলের মন গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু খুব বেশিদিন তিনি গান্ধীবাদে আস্থা রাখতে পারেননি, কারণ গান্ধীর অহিংসতত্ত্বে তার তেমন আস্থা ছিল না। কারণ ইংরেজ আমলের যে রাষ্ট্র তার প্রবল-প্রতাপ ও সহিংস চরিত্র সম্পর্কে তিনি বেশ সচেতন ছিলেন। খুব শীঘ্রই তিনি গান্ধীবাদ ত্যাগ করে শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য বিপ্লববাদের দিকে যাত্রা করেন। সেই সময়ের অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ করে রচিত হয় ‘বিদ্রোহী’, কবিতা ছিল বিপ্লবীদের ইশতেহারের সাথে তুলনীয়। ‘এ কবিতা সে সময়ে তরুণ প্রজন্মকে সংগ্রামে সংঘবদ্ধ হতে, কারাগারের অন্ধকার আর ফাঁসির মঞ্চকে অগ্রাহ্য করতে এবং মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে সাহস যুগিয়েছ’। এই কবিতার ভাব-ঐশ্বর্য বিশ্লেষণ করলে যুগান্তর, অনুশীলন সমিতির সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন তথা বিপ্লববাদের সঙ্গে গান্ধীজীর ধর্মচেতনার সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়। নজরুলের আগে বাংলা সাহিত্যে আর কেউ এমনটি করেননি বা করতে পারেননি। এক্ষেত্রে তিনি নিশ্চিত ভাবেই পথিকৃতের দায়িত্ব পালন করেছেন।  ‘বিদ্রোহী’ তে পাওয়া গেল এমন এক নজরুলকে যিনি সর্বঅর্থেই অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সম্প্রীতি সাধক। বিদ্রোহী তথা অগ্নিবীণা কাব্যই তাকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে; তারপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। অগ্নিবীণা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সম্ভবত কারণে অকারণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুগলরূপে নজরুলের নামটিও উচ্চারিত হতে থাকে।

নজরুল ছিলেন কিঞ্চিৎ চঞ্চল ও অস্থির। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও উপনিবেশ বিরোধিতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন উচ্চকন্ঠ, দৃঢ় ও অবিচল। নজরুল ইসলাম সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং মানবধর্ম ছিল তার কাছে সবচেয়ে বড় ধর্ম। তিনি ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করার নীতি কখনই সমর্থন করেননি। ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘অবতার পয়গম্বর কেউ বলেনি আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রিশ্চানের জন্য এসেছি, তারা বলেছেন আমরা মানুষের জন্য এসেছি, আলোর মতন সকলের জন্য’। তিনি রাজনীতির মানুষ ছিলেন, রাজনীতি ও রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। তারপরও ধর্মভিত্ত্বিক রাজনীতির ছিলেন ঘোর বিরোধী।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক পর্যায়ে ধর্মীয় উগ্রতায় রূপ নেয় এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধর্মীয় উন্মত্ততা হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৬ সালের ২-এপ্রিল কলকাতার রাজারাজেশ্বরী মিছিলকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেধে যায়। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর মদদপুষ্ট এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নজরুলকে ভীষণভাবে পীড়িত করে। দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মাখানো বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ‘ কান্ডারী হুশিয়ার’  কবিতায় লেখেন:

’অসহায় জাতি মরেছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ/ কান্ডারী। আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ/‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম’? এই জিজ্ঞাসে কোন জন/ কান্ডারী! বলো, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।” (সর্বহারা)

হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক যখন দাঙ্গায় রূপ নেয় তখনও তিনি হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা বলেছেন, প্রচার করেছেন আকবরের দ্বীন ই-ইলাহি মতবাদ। মধ্যযুগের সন্ত কবীর-দাদু ধর্ম সমন্বয়ের জন্য যে পথে চলার সাধনা করেছেন, সে পথে নজরুলও চলতে চেয়েছেন আমৃত্যু। ১৯২৬ সালে দাঙ্গার বিরূদ্ধে রচিত ‘মন্দির- মসজিদ’  প্রবন্ধেও তিনি লিখেছেন : ‘হিন্দু মুসলমানি কান্ড বাধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপরে মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লাহ ও মা কালীর প্রেস্টিজ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চিৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতেছিল দেখিলাম, তখন আর তাহারা আল্লামিঞা বা কালী ঠাকুরানীর নাম লইতেছে না।’  ধর্মন্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে মানুষের শুভবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতা ধ্বংস করে হিংসায় উন্মত্ত পশুতে পরিণত করে, তা তিনি  ‘মন্দির মসজিদ’ প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন। নজরুল যে-সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ‘পশুর দল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই পশুর দল আজও বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে। তারা আজও নানা ফ্রন্টে বিভক্ত হয়ে সমাজ-রাষ্ট্রে বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মন্দিরের পুরোহিত, মঠের যাজক, আশ্রমের ঋত্বিক ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের হত্যা করে চলেছে। রাজনীতির পাশাপাশি কেউ কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক রাস্তায় খন্ডিত ও বিকৃত বক্তব্য উপস্থাপন করে হিংসা -বিদ্বেষ প্রচার করে চলেছে। নজরুল এই ধর্মান্ধ জাল জালিয়াত বদমায়েসদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন তার গানে-কবিতায়, সাথে সাথে তাদের বিরূদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। ‘ জাতের নামে বজ্জাতি’  কবিতায় তনি জাতপাত, ছুঁৎমার্গ, ধর্মের নামে বাড়াবাড়িকে তিরস্কার করে বলেছেন, ঈশ্বরের কোনো জাত নেই, তার কাছে সকল ধর্ম ও মানুষ সমান, টিকি-টুপির মূল্য নেই। ধর্মের নামে যারা খুনোখুনি করে, নজরুল তাদের ‘ধর্ম-মাতাল’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে,‘ ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের এলকোহল পান করিয়াছে।’ মদ-মাতালদের যেমন হিতাহিত জ্ঞান  থাকে না, তেমনই ধর্ম-মাতালদেরও  স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি থাকে না। তারা মানুষরুপী হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হয়। হিংস্র জানোয়ারের পরিণতি যেমন এক পর্যায়ে করুণ মৃত্যু, তেমনই ধর্ম-মাতালের সামনেও করুণ মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকে না।

নজরুলের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা ও মানবিক ধর্মচেতনা সমকালে সর্বতোভাবে প্রশংসিত হয়নি বরং নিন্দিত হয়েছে ঢেরবেশি। হিন্দু সমাজ বিশেষ করে, রক্ষণশীল হিন্দুরা তাকে উপেক্ষা করতে চেয়েছে। সংস্কৃতিবান হিন্দুরা তার গান পছন্দ করতেন, তাকে কখনও কখনও গৃহেও আমন্ত্রণ জানাতেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ নয় জেনে নজরুলের উপস্থিতিতে অন্যরা অস্বস্তি বোধ করতেন। আর মুসলমান রক্ষণশীলরা তো তাঁকে ধর্মদ্রোহী, কুলাঙ্গার,শয়তান, নাস্তিক, ফেরাউনসহ নানা অপঅভিধায় অভিহিত করে। নজরুল তার সমালোচকদের আচরণ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, কিন্তু তাদের খুব একটা পাত্তা দিতে চাননি। বৈরী পরিবেশ, বিরূদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও ধর্মীয় গোঁড়ামির কাছে অত্মসমর্পণ করেননি তিনি। বিরূদ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে ‘ আমার সুন্দর’  প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন, ‘আমার কেবলই যেন মনে হত, আমি মানুষকে ভালবাসতে পেরেছি। জাতি, ধর্ম, ভেদ আমার কোন দিনও ছিল না আজও নেই।’

ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়, মানুষই ছিল তার আরাধ্য।  ব্রিটিশদের ভেদনীতির কারণে ধর্মীয় বিরোধ ও হানাহানি যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখনও তিনি আচার সর্বস্ব ধর্মের বিরূদ্ধে এবং মানব সম্প্রীতির সপক্ষে বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করেন:

’আমি ব্রহ্ম চাই না, আল্লাহ চাই না, ভগবানও চাই না। এই সব নামের কেউ যদি থেকে থাকেন তিনি নিজে এসে দেখা দিবেন। আমার বিপুল কর্ম আছে। আমার অপার অসীম ধরিত্রী মাতার ঋণ আছে।’

 নজরুল মনে করতেন, ইসলাম বা কোনো বিশেষ ধর্মের শাস্ত্র নিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায় না,তবে ধর্মের অন্তর্নিহিত নির্যাস বা সারসত্য নিয়ে করা যেতে পারে।  তার অবস্থান ছিল চিরন্তন ও সত্যধর্মের সপক্ষে। সব সৃষ্টিশীল সাধককে সম্ভবত আঁধার পেরিয়ে আলোর পথে একাই এগিয়ে যেতে হয়, নজরুলকেও একা যেতে হয়েছে ধর্মান্ধতা, শাস্ত্রাচার, গোঁড়ামি পেরিয়ে। এই পথচলায় তিনি সন্ত্রস্ত, ক্লান্ত বা দ্বিধান্বিত ছিলেন না কখনও। কারণ তার সঙ্গে ছিল বাংলার অন্তর ও বাহিরের পরম ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য। তার মনে হয়েছে, ‘ এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর,এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া, আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ–আল্লাহ ভগবানের উপাসনা, উপবাস, উৎসব আর কোথাও নেই।’ তার কাছে─‘বাংলা মহামানবের মিলন তীর্থ, বাংলা নিত্য সুন্দর, নিত্য পবিত্র।’

নজরুল তার সমকালে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন;  একালেও তিনি জনপ্রিয়। তিনিই একমাত্র সাহিত্যিক প্রতিনিধি যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সখ্য সম্পর্ক ছিল এবং তাদের আবেগ বুঝতে পারতেন। তাদের ভাষায় লিখতে ও বলতে পারতেন।  তার কবিতা, প্রবন্ধ ,পরে গান একেবারে আমজনতার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। প্রশ্ন জাগে, কীভাবে তা সম্ভব হল? হুমায়ুন কবিরের ভাষায় বলা যায়, বাংলার বিপুল কৃষকসমাজের সঙ্গে ছিল নজরুলের গভীর আত্মীয়তা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও ওই কথা প্রতিধ্বনিত করে বলেন, নজরুল কৃষক পরিবারের সন্তান, সে কারণেই তাঁর রচনা এত দ্রুত কৃষকসমাজকে আচ্ছন্ন করতে পেরেছ। আজও নজরুলের সুরে স্বরে অনুষ্ঠানের প্রথম প্রদীপ জ্বলে,সব ধর্মের পার্বণে-উৎসবে আমেজ তৈরি হয়।

নজরুলকে আমরা নানা পরিচয়ে চিনি। কিন্তু তিনি ছিলেন মূলত পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল বা জনবুদ্ধিজীবী। সুষম ও ভেদবুদ্ধিহীন, কল্যাণময় সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তার স্বপ্ন। চারদিকে আজ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। চলছে লুণ্ঠন, অন্যায় ও অবিচার। হিংসায় উন্মত্ত এই অশুভ শক্তি পান করতে চায় কেবল রক্তের বৈভব। বিভেদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে তলোয়ার, বোমা-গ্রেনেড হাতে পথে ঘাটে, প্রান্তরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ওরা। যে কোনো সময় বেদখল হয়ে যেতে পারে আমাদের বাংলাদেশ। এই অন্ধ অপশক্তিকে প্রতিহত করে আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হতে পারেন প্রধান সহায়ক ও সারথি। এজন্য অসাম্প্রদায়িক, মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে নজরুলচর্চা খুবই দরকারি।

আবদুল্লাহ আল আমিন: গবেষক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপ, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *