ঈদসংখ্যার অণুগল্প।। প্রহেলিকা মন।। তাসলিমা কবীর রিংকি

মীরপুর একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে শাওন চৌধুরী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। ছেলের বয়স যখন দুই বছর তখন একটি রোড এক্সিডেন্টে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে শাওন চৌধুরী আর তার একমাত্র ছেলেকে রেখে ওপারে চলে যায় স্ত্রী স্নিগ্ধা। তারপর আর শাওন চৌধুরী বিয়ে করেনি। যদিও তার আত্মিয় স্বজন চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছে ।তাই বাব মা ছেলে আর অফিস নিয়েই ব্যস্ত সময় কেটে যাচ্ছে তার। তবে ইদানীং পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করে। সামান্য সময় পেলেই মনের অজান্তে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শাওন চৌধুরী।

বাবা মায়ের অনাদরে বাড়ির কাজের লোকের কাছে বেড়ে ওঠা অর্পিতার। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। গত দুমাস আগেই বাবা মায়ের সাথে নতুন বাড়ীতে উঠেছে।মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটি ছিল মূলত বৈরিতা। কারণ মায়ের মত যথেষ্ট মর্ডান সে হতে পারেনি। কাজেই মায়ের কথা শোনা তার নিত্যকার চালচিত্র। বাবা আছে নিজের বিজনেস নিয়ে। আর মা গভীর রাতে বাসায় ফিরে সভা সমিতি ও ক্লাবে আড্ডা দিয়ে। বাবার বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও তা প্রকাশ করে না। নিজের মত থাকতেই সে পছন্দ করে তাই ইনিভার্সিটি বাসা আর হাতেগুনা কটা বন্ধু এই তার জগৎ। আজও মায়ের আচরণে দিনভর মনখারাপ করে বারান্দায় বসে ছিল।
অর্পির চুল বেয়াড়া বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। দাঁড়িয়ে আছে ছাদের শেষ প্রান্তে। বাসার নীচে রাস্তায় লাল গোলাপ হাতে বসে আছে এক যুবক। যুবকটির মাথায় লম্বা চুল। চোখে নীল রোদ-চশমা। সম্ভবত, যুবকটি অর্পির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্পি দৃষ্টি দূরের আকাশে। সেখানে রূপালী মেঘ। আর চক্রাকারে ঘুরছে বিন্দুর মতো কয়েকটি পাখি। অর্পিতাদের এই বাড়িটি শহরের এমন এক প্রান্তে, যেখানে ভীড় ও গাড়ি ঘোড়ার বড় একটা ব্যস্ততা নেই।

আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী– ভালবাসা দিবস। ঘর থেকে বেরিয়ে মোড়ের দোকান থেকে একটি লাল গোলাপ কিনে শাওন। সে জানে অর্পি বাসায় আছে। অবশ্য অর্পিদের বাসার কেউ এখন বাসায় থাকার কথা নয়। আর অন্য দিনের মতো আজও নিশ্চয়ই সে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে। অর্পির আচার-আচরণে কিছুটা বুঝিয়ে দিয়েছে সে শাওন চৌধুরী কে কার ভাললাগে তাই তেমন কিছু না ভেবেই ঠিক করে অফিস যাওয়ার আগে দরকার হলে অর্পিতাদের বাসা হয়ে যাবে। কারণ আজ ভালবাসা দিবস। মনের অজান্তে তার চুলের প্রেমে পড়ে, কখন যেন অর্পিকে ভালবেসে ফেলেছে।
সমাজ সংসার বা অর্পির পরিবার এই ভালবাসার বিরুদ্ধে যদি যায়, তবুও তার ভাললাগা সে জানাবে।
কয়েক দিন পরে বাসার সবাই মোটামুটি জেনে যায় পাশের বাসার বিবাহিত পুরুষের সাথে অর্পির সম্পর্ক আছে। এই নিয়ে পারিবারিক সমস্যা বেড়েই চলেছে। অর্পিকে বাবা মা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় পাশের বাড়ির লোকটার সাথে কোন রকম যোগাযোগ বা কথা বলতে দেখলে বাসা থেকে বের করে দেবে। আর তার এ সম্পর্ক তারা মানবে না মেয়ের জন্য তো সমাজের মানুষের কথা শুনতে পারবে না। তারপর থেকে অর্পি বারান্দা যাওয়া বন্ধ করে দেয় সাথে শাওনের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ।

বেশ কয়েকদিন পর শীতের সন্ধ্যায় মিরপুরের নির্জন এক রাস্তা দিয়ে হাঁটছে শাওন একে তো শীত তারপর আবার কুয়াশা তাই সন্ধ্যার আগেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে। ফুটপাতের অপর পাশে আকাশ রঙা শাড়ি-পড়া একটা মেয়েকে দেখতে পেল, মেয়েটি হাসছে। দূর থেকে আমি ঠিক চিনতে পারলাম না। কাছে আসতেই অর্পিকা নিজেকে সামলে নিয়ে ফুটপাত বদল করে এপাশে এলো।
আমি বিনম্র হেসে বললাম, কেমন আছো, এতোদিন কোথায় ছিলে, ম্লান হাসলো। বিষন্ন কণ্ঠে বললো,
আপনি আর আমার সাথে যোগাযোগ করবেন না এই বলে দ্রুত হেটে চলে গেল। অর্পির চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে শাওন চৌধুরী। কিছুদুর গিয়ে একবার ফিরে তাকিয়ে দুই হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সামনের দিকে এগিয়ে যায় অর্পিতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *