ম্যান বুকার বিজয়ীর গল্প //প্রাসঙ্গিক ও বাঙলায়নঃ মীম মিজান

[চলতি বছরের ম্যান বুকার পুরস্কার জিতে যিনি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি হচ্ছেন ওমানি লেখিকা জোখা আলহারথি। জোখা ওমানে ১৯৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ওমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। বিশ্বের নামকরা বৃটিশ বিশ্ববিদ্যালয় এডিনবার্গ ইউনিভারসিটি থেকে তিনি আরবি ধ্রুপদী সাহিত্যের উপর ২০১০ সালে ডক্টরেট অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ওমানের সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদভূক্ত আরবি সাহিত্য বিভাগের একজন নামকরা অধ্যাপক।

তাঁর সাহিত্যকর্ম বানিপ্যাল মাগাজিনে ইংরেজিতে, জার্মানিতে জার্মানভাষায় লিসান ম্যাগাজিন, কোরিয়ান, সেরবিয়ান, ইতায়ালিয়ানসহ অনেক ভাষায় প্রকাশ হচ্ছে এবং পাঠককূলে প্রশংসা কুড়োচ্ছে। তাঁর বিখ্যাত তিনটি উপন্যাসের মধ্যে ২০১১ সালে সাইয়্যিদাতিল কামার উপন্যাসটি শেখ যায়েদ পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছিল। এই উপন্যাসটিকে সেসময় ওমানের সর্বকালের সেরা উপন্যাস ঘোষণা করা হয়েছিল। পাঁচটি শর্টলিস্টেড বইয়ের ভিতর সর্বশেষ এই গ্রন্থটি চলতি বছরের বুকার পুরস্কার লাভ করে। তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থ উশ আল আসাফির ২০১০ সালে ওমানের শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ গ্রন্থ হিশেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁর ছোটগল্পগুলোও অনেক পুরস্কার জিতেছে। তাঁর বেশ কয়েকটি গল্পগ্রন্থ আছে। ‘কাঠ পার্কের বেঞ্চে..আমরা বসেছিলাম’ গল্পটি জোখা ডটকম থেকে সংগৃহীত ‘On the Wooden Park Bench..We Sat!’ গল্পের বাঙলায়ন। গল্পটি ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন ক্লায়ার রবার্টস]

কাঠ পার্কের বেঞ্চে..আমরা বসেছিলাম!
জোখা আলহারথি

কাঠ পার্কের বেঞ্চে..আমরা বসেছিলাম।

আমি ডানে দূরে, আর সে বাঁয়ে দূরে। যেন আমরা যদি ওভাবে না বসি তাহলে বেঞ্চটির ভারসাম্য থাকবে না।

উঁচু বৃক্ষ ছিল, ঘাস ছিল আদ্র আর সূর্যের উষ্ণতায় পার্কটি পরিপূর্ণ ছিল।

সে আমাকে বললো, ” বন্ধু নেই বলে আমি নিঃসঙ্গ, আর নিঃসঙ্গ বলে আনন্দিত।”

আমি তাকে বললাম, “বন্ধুছাড়া আমি নিঃসঙ্গ, আর এজন্য আমি বেজার।”

আমি ছোট্ট কক্ষটিতে ফিরলাম। হাতমুখ ধৌত করলাম, বাড়ির কাজ করলাম অতঃপর ঘুমোলাম।

পরেরদিন আমরা পার্কে একই বেঞ্চে বসলাম। বলখেলারত শিশুদের হুল্লোড় আমাদের চারপাশে ছিল।

সে বলল, “আমি বন্ধুদের অপছন্দ করি। প্রায় প্রত্যেক বন্ধুত্বই বিশ্বাসঘাতকতার দিকে ধাবিত হয়।”

আমি বললাম, “আমি বন্ধুদের ভালোবাসি। আমি এরকমটি কোথাও ঘটতে দেখিনি।”

শিশুদের হুল্লোড় স্তিমিত হলো। আর আমি কোণার সেই দোকানটি দিয়ে অতিক্রম করলাম। যাতে আমার কক্ষে ফেরার পূর্বে দুধ ও রুটি কিনতে পারি।

আমি বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম তাই পার্কে গেলাম না।

পরেরদিন সে বলল, “গতকল্য আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।”

আমি তাকে বললাম, “বৃষ্টির দরুন আমি আসতে পারিনি। আর তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলে ক্যানো? আমরা কী বন্ধু?”

সে বলল, “আমি তোমাকে বলেছি যে, আমি বন্ধুত্ব পছন্দ করি না। বিশেষ করে একজন ছেলে আর মেয়ের মধ্যে। এটা একটা হীনপন্থা প্রেমে পড়ার।”

আমি কিছুই বলিনি। আকাশে মেঘ জমল। ভারী বৃষ্টির আশঙ্কায় আমি কক্ষে ফিরলাম। টিভি দেখার পর ঘুমোলাম।

কাঠ পার্কের বেঞ্চে আমরা বসেছি। সে আমার দিকে মুখ ফেরালো, সে তার শৈশবের এক বেদনাময় স্মৃতির গল্প শোনালো। আমি তার কাছাকাছি হলাম এবং আমার ছোট্টবেলার এক মধুর গল্প শোনালাম। তার পায়ে শিশুদের বলটি পড়ায় সে ফুটবলটিতে লাথি মেরেছে। আর সে আরেকটি গল্প শোনালো।

আমার ফেরার পথে একটি লাইব্রেরি অতিক্রম করি। সেখানে কিছু রঙিন শিশুতোষ গল্প পড়েছি। পথিমধ্যে আমি কিওস্ক থেকে কিছু গরম কফি কিনলাম। খেয়াল করলাম পরিবেশ ভালো হচ্ছে।

কাঠের সেই বেঞ্চে আমি সামান্যই ডানে সরে গেলাম আর সে বামে সরে গেলো। সে তার শিশুকাল নিয়ে আরেকটি কষ্টের গল্প শোনালো। কীভাবে তার বাবা তাকে প্রহার করতো সেটা দেখানোর জন্য সে তার হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করল। আমার বাবা যে আমাকে কখনওই প্রহার করেননি তা বলতে আমার লজ্জা অনুভূত হলো। আমার মাও আমাকে প্রহার করতো, আমি তাকে বললাম। হালকা বৃষ্টির ফোটা বেঞ্চের উপর পড়তে আরম্ভ করলো। কিন্তু আমি আমার মা সম্পর্কে বলেই যাচ্ছিলাম।

আমার কক্ষে ফিরে তাকে ফোন করে করে ক্লান্ত হলাম, কিন্তু সে কল রিসিভ করলো না। টোস্ট বিস্কুটের উপর চিজ বানিয়ে দুগ্ধ দিয়ে খেলাম। আগামীকাল তাকে কী প্রশ্ন করবো তা আমার জানা আছে।

পরেরদিন সে তার শরীরকে খানিকটুকু আমার দিকে এগিয়ে নিলো আর আমি জিগ্যেস করলাম সেই প্রশ্নটি: “কতবার তুমি প্রেমে পড়েছো?”

“একবার”। সে শান্তভাবে উত্তর দিলো “আমার বয়স যখন ত্রিশ ছিলো।”

আমি একটি আইসক্রিম ভ্যানের ঝুনঝুন শব্দ শুনতে পেলাম। তখনো শীত ছিলো, তবুও দুটো কোন আইসক্রিম কিনলাম। একটা তার জন্য আরেকটা আমার জন্য।

আইসক্রিমটি খাওয়ার পর সে বললো: “প্রথমবার যখন আমি তাকে চুম্বন করেছিলাম, তখন তার অবয়ব আঁধার হয়ে গেছিলো। আমি সেটা দ্বারা বিমোহিত হয়ে গেছিলাম।” আমার হৃদয়ে ছোট্ট একটা আঘাত হানলো, আর সেখানে রয়ে গেলো। “তারপর” আমি জিগ্যেস করলাম। সে বলেই চললো। সে তার প্রেমিকার সব বিষয়ে বলেছিলো। তার আঁখির রঙ, তার কানের লতি, তার কাঁক, তার অবহেলা, তার নিষ্ঠুরতা, নিজের সুখ-দুখ। আর তার অবয়বে আঁধার নেমে এলো। আমাদের চারপাশেও আঁধার নামলো যা আমরা টেরই পাইনি।

আমি আমার কক্ষে ফেরার সমুদয় রাস্তা কেঁদেছিলাম। আর বাইরের পরিহিত পোশাকেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

পরবর্তী দিন আমি খেয়াল করলাম যে, সেই কাঠের বেঞ্চটি “অকাল প্র‍য়াত প্রিয় কন্যা”র স্মৃতির জন্য উৎসর্গিত হয়েছে। আইসক্রিমের ভ্যানটি আসেনি। সে আমাকে তার কন্যার কেশের বিষয়ে, তার ফোন কলের বিষয়ে আর জান্নাতে যখন উভয়ের মাঝে দেখা হবে তখন কীভাবে তাকে আদর করে উঁচুতে জাগিয়ে দিবে। আবারো একবার তার মুখাবয়ব আঁধারে ছেয়ে গেলো।

ঘুমোনোর আগে আমি একটি ছবির এলবাম দেখলাম এবং বোনকে ছোট্ট করে একখানা পত্র লিখলাম।

সূর্য উঠে গেছে, আমি বাড়ির সব কাজ শেষ করলাম। নিজ কক্ষে বসে ছোট্ট বাতায়ন দিয়ে রাস্তাটির দিকে তাকিয়ে আছি। আমি পার্কে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্ষুধার্ত অনুভব করছিলাম, পোশাক পরিধান করে বেরিয়ে পড়লাম। নিকটবর্তী একটি ক্যাফেতে তুনা স্যান্ডউইচ খেয়ে পার্কে গেলাম। আমি ডানে দূরে বসলাম। প্লাস্টিকের দুটো কফির কাপ তার সামনে দেখলাম। “তুমি দেরি করেছো”, সে বললো। “কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে”। আমার প্রশিক্ষকের ফিতা পুনঃ শক্ত করে বাঁধলাম। আর সে জিগ্যেস করলো, “তুমি এখানে কী করো?”

“আমি অধ্যয়ন করি”, বললাম। “তুমি কী করো?”

“আমি কাজ করি।”

আমরা ঠাণ্ডা কফি পান করি না।

সে বললো, “এই ধরণীতে কিছু লোক খুবই সৌভাগ্যবান যে তারা প্রেমের ছোঁয়া পায়।”

আনি ঋজুভাবে তার দিকে তাকালাম আর বললাম: “তাদেরকে সৌভাগ্যবান বলো না”।

“সৌভাগ্যবান”, সে বললো।

“না”।

“হ্যা”।

আর আমরা তর্ক করলাম।

অতঃপর আমি তাকে বললাম- আমি তাকে সবকিছুই বলেছি: কীভাবে আমি তাকে স্বল্পক্ষণের জন্য দেখেছিলাম; সে আমাকে কীভাবে ভালোবাসতো তা বললো; সে কীভাবে আমার কাছে প্রতিশ্রুতি দিতো আমরা অনেক শহরে দেখা করবো; যেগুলোতে আমি তার সাক্ষাৎ ছাড়াই ভ্রমণ করেছি; কীভাবে তাকে চেয়ে আমি লিখেছি; বৃহৎ চিঠিতে আমার লহূ ও অশ্রু ঢেলেছি; আর কীভাবে আমি তার প্রেমিকা থেকে একটি পত্র পেয়েছি যাতে সে লিখেছিল যে কত উপভোগ করেছিল উভয়কে পড়ে। আমার অস্বস্তি অনুভব করা আর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বিষয়েও তাকে বলেছিলাম।

সে খানিকটা ডানে সরে গেলো আর আমি তাকে জিগ্যেস করলাম: “আমি কি তাকে হত্যা করবো?”

“না”, সে দৃঢ়ভাবেই বললো। “আমি তাকে বললাম, ইতোমধ্যে সে মারা গেছে।”

আমি উঠে পড়লাম। আমার কক্ষে ফিরলাম। কয়েকটি বর্ণিল ম্যাগাজিন ও খবরের কাগজে চোখ বুলালাম, আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে গরম চকোলেট খেলাম।

ঘুমানোর আগে আমি নিজেকে বললাম, সে ও আমি একইরকম। আর এটা এজন্য যে প্রত্যেকদিন আমরা এক বেঞ্চে বসি।

পরেরদিন বেঞ্চটিতে আমার ডানপাশে ও তার বাঁপাশে খানিকটা ফাঁকা ছিলো। আমরা সব বিষয়ে কথা বললাম, হাসলাম, খালি প্লাস্টিকের কাপগুলিকে হাতে পিষলাম। সে তার শৈশবকালের ছবি দেখালো আর আমার ফোন নম্বর চাইলো। আমি সাড়া দেইনি। যখন আমি উঠছিলাম তখন সে আমাকে বললো: “আমি হাসপাতালেও ছিলাম, আমাকে কোন কারণ ছাড়াই তার ফেলে যাওয়া আর তাকে ফিরে আসার কাকুতির হাজারো পত্রের অবজ্ঞার পর।”

আমি আমার কক্ষে খেয়াল করলাম যে, তার শৈশবের ছবিগুলো আমার ছোট্টভায়ের ছবির মতোই, ক্যামেরার সম্মুখে হাসিছাড়া মুখ।

পরেরদিন আমি দেরি করে আসলাম, সে আমাকে তীক্ষ্ণভাবে দেখলো। আমরা কথা বললাম না। লুকোচুরি খেলারত শিশুদের চিৎকার বেড়েই যাচ্ছিল। আর আমি শীত অনুভব করলাম।

“তোমার ছবিগুলো কোথায়?” সে জিগ্যেস করলো। “আমি সেগুলোকে আনতে পারিনি”, আমি বললাম।

সে আমাকে বলেছিলো যে, আমি নিষ্ঠুর ছিলাম। আর আমি তাকে বললাম যে, সে কর্কশ ছিলো। আমি নিজ কক্ষে ফিরলাম। ফ্রিজে কোন দুধ, জুস অথবা রুটি ছিলো না। তাই না খেয়ে ঘুমোতে গেলাম।

অনেকদিন অতিক্রম হলো। আর সেই কাঠের বেঞ্চের ফাঁকা জায়গা কখনো বেড়ে গেছিলো আবার কখনো কমে গেছিলো আমাদের বন্ধুত্ব আর শত্রুতার মাত্রার উপর। একসময় আমাদের ভিতরে শত্রুভাবাপন্নতা বেড়ে গেলো। তাই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তর্কে লিপ্ত হতাম। আমি তাকে বললাম, আমি তার কর্কশতায় ক্লান্ত। আর আমার স্পর্শকাতরতায় সেও বিরক্ত, সে বললো।

পরীক্ষার কারণে আমি সেখানে দু’দিন আসতে পারিনি। আর যখন ফিরলাম তখন তাকে ক্ষিপ্ত দেখলাম:

“সেই মিথ্যাবাদীকে দেখার জন্য শহরে শহরে ঘুরতেছো ভাব নিয়ে তোমার অপেক্ষায় রেখে আমাকে অপমান করছো!”

আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম: “তুমি তাকে হাজারো পত্র লিখেছো আর এটাই আমি, এভাবেই চিৎকার করো?” কিন্তু সেটাই যখন এটা আমার সাথে ঘটলো।

কক্ষে ফিরলাম। কাঠের টেবিল আর বিছানাটি একটি শুকনো তোয়ালে দ্বারা মুছলাম, আর নোংরা কাপড়গুলোকে কমিউন্যাল ওয়াশিং মেশিনে ছুড়ে দিলাম। সাউন্ড ছাড়া টিভিতে কার্টুন দেখছিলাম আর সিদ্ধ করা শিমের বিচি খাচ্ছিলাম। নিচের ঠোঁটটি কঠিনভাবে কামড়িয়ে দিলাম। ফলে বালিশে আমার মাথাকে সমাহিত করলাম।

বাস্তব জীবনের কোন কিছুতে পরিবর্তন হলো না।

পরীক্ষা শেষ। আর আবহাওয়া তার আমুদে আবেশের খানিকটা হারাতে শুরু করেছে। আমি যখন পার্কে ফিরলাম, কাঠের বেঞ্চটিকে খালি পেলাম।

২ thoughts on “ম্যান বুকার বিজয়ীর গল্প //প্রাসঙ্গিক ও বাঙলায়নঃ মীম মিজান

  • সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০ at ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    লেখাটি পড়ে বেশ ভালো লেগেছে।

    Reply
    • সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০ at ১২:৩৮ পূর্বাহ্ণ
      Permalink

      কৃতজ্ঞতা জানবেন কবি

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *