শামসুর রাহমানের কবিতায় রাজনৈতিকবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি।। গোলাম কিবরিয়া পিনু

শামসুর রাহমানকে চেনা যায়–তাঁর কবিতায়, কিন্তু কীভাবে? এ ভাবনাটুকু নিয়ে নিজে নিজে আমি অনুরণিত হই কিন্তু উত্তর পাওয়া কঠিন না হলেও–তা অনেকটা ব্যাখ্যা দাবি করে। বিস্তৃত রেখা টেনে টেনে তাঁর অবয়ব তৈরি করতে গিয়ে দেখি–তা অনেক সূক্ষ্ম মনোযোগের বিষয়, আরও গোপন-এলাকা উন্মোচন করার স্পর্ধা নিয়ে অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে তুলি ধরতে হবে, তা অল্প সময় কিংবা হালকা মেজাজে সম্ভব নয়। শামসুর রাহমানের কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক আমরা হয়তো অনেকে, তাঁর কবিতা পড়ে আমরা অনেকে আমাদের সময়কালের কাব্য-পাঠস্পৃহা মিটিয়েছি, ধারাবাহিকভাবে অনেকদিন। ব্যক্তি শামসুর রাহমান এখন আমাদের সম্মুখে শারীরিকভাবে নেই–কিন্তু তাঁর কাব্যকীর্তি রয়েছে।
শামসুর রাহমান যে সময়ে কবিতা লিখেছেন, সেই সময়ের অভিঘাত, রূপ-রস-গন্ধ কি তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় না? যায়! ভালোমতই পাওয়া যায়। কবি তো আর দূরালোকের অস্পষ্ট ছায়ার বাসিন্দা নন, তিনি তো তাঁর সময়কাল ও সমাজেরই একজন বাসিন্দা। কবি তাঁর সচেতনা ও সূক্ষ্ম বুদ্ধির মাধ্যমেই এক ধরনের বোধ সঞ্চারিত করেন–কবিতায়, কবিতার পাঠক সেই বোধে অভিষিক্ত হোন। শামসুর রাহমানের দৃষ্টিভঙ্গির যে মূলভূমি–তা আধুনিক মানুষের মনন ও চেতনারই বহু বিস্তৃত এলাকা নিয়ে উচ্চকিত, সেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা বিশেষ মূল্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। শামসুর রাহমানের দায়বদ্ধ কবিতার উচ্চারণ শুধু তাঁর কবিতাকে নয়–বাংলা কবিতাকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। বাংলা কবিতার মূলধারাকে করেছে আরও সংহত, গতিশীল ও কাব্যস্পর্ধায় দিগন্ত-প্রসারী।
শামসুর রাহমান লিখেছেন–
‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা,
এবার আমি গোলাপ নেবো।
গুলবাগিচা বিরান ব’লে,
হরহামেশা ফিরে যাবো,
তা’ হবে না দিচ্ছি বলে।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা,
এবার আমি গোলাপ নেবো।’
(ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা)।
এই কবিতাটি বেশ বড়, উল্লিখিত ক’টি পংক্তি কি নন্দনভাষায় সম্পর্কিত কবিতার পংক্তি নয়। মনে মনে ভাবি। তবে নিশ্চিত–আধিভৌতিক অনুভূতি-নির্ভর পংক্তি এগুলো নয়, এগুলো একজন আধুনিক কবির সূক্ষ্ম-অনুভব।
রাজনৈতিক কবিতা লেখার স্পর্ধা সংহত করেছেন শামসুর রাহমান দিনে দিনে। আবেগসর্বস্ব অবস্থান থেকে নয়–কবিতায় পুরোপুরি নিবেদিত থেকে সময়কালের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে তিনি রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন এবং সেই ধারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জোরালোভাবে বজায় রেখেছেন।
শামসুর রাহমান–সময় ও সমাজকে কবির দৃষ্টিতে অবলোকন করেই কবিতা লিখেছেন, এবং তাই তো ভেবেছেন–দেশব্যাপী যখন সর্বগ্রাসী অন্ধকার–তখন অন্যান্য ব্যক্তির মতই ব্যক্তি কবিও সংকটাপন্ন হোন, তাই এই অবস্থা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে অন্য কোনো ভূভাগে অবস্থান করা সমীচীন নয়–যা কবির নৈতিকতার বিরুদ্ধ বলেই তিনি মনে করেছেন। সেই নৈতিক-অবস্থান কবির জন্য বড় অহংকারের। এই অহংকার থেকে শামসুর রাহমান বহু কবিতা লিখেছেন, যা পাঠক হিসেবে আমাদের আন্দোলিত করেছে।
‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিম্বা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্মতায়;
বর্ষিয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালিম গাছের মৃদুছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’
(আসাদের শার্ট) এবং
‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?
তেমন যোগ্য সমাধি কই?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল সাগর জল–
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই।
তাইতো রাখি না এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই!’
(এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?)
এসব কবিতা আমাদের গণআন্দোনের পটভূমিতে লেখা হয়েছে, তারপর সেই কবিতা গণআন্দোলনের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা এক জনগোষ্ঠীর গণমুখী রুচিও তৈরি করেছে কবিতার দিক থেকে, অন্যদিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক বোধকে জাগ্রত রাখার দায় কবি বহন করেছেন।
আর এক কবিতা ‘ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯’, আমাদের গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটি জাতির রক্তাক্ত-অনুভব আর জেগে ওঠার স্বপ্নময় স্পর্ধা; এ সময়ে আর অন্য কোনো কবি কি এভাবে চেতনাকে ধারণ করতে পেরেছেন? ‘এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?
এখানে তো বোনাস ভাউচারের খেলা নেই কিম্বা নেই মায়া
কোনো গোল টেবিলের, শাসনতন্ত্রের ভেলকিবাজি,
সিনেমার রঙিন টিকিট
নেই, নেই সার্কাসের নিরীহ অসুস্থ বাঘ, কসরৎ দেখানো
তরুণীর শরীরের ঝলকানি নেই কিম্বা ফানুস ওড়ানো
তা-ও নেই, তবু কেন এখানে জমাই ভিড় আমরা সবাই?’
‘দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই
জনসাধারণ
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায়। সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ,
শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায়।’(ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯)
গণআন্দোলনের পথ ধরে আমাদের বাঙালি জাতির যে উত্থান তারই বিকশিত রূপ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আর তারই কণ্ঠলগ্ন মুক্তিযুদ্ধের কবিতা।
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?’
(তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা) ।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে শামসুর রাহমান লিখেছেন কবিতা।
আনিসুজ্জামান যর্থাথ বলেছেন–‘১৯৫৯ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থে শামসুর রাহমান দেখা দিয়েছিলেন নিভৃতিপ্রিয় আত্মমগ্ন মৃদুকণ্ঠ স্বপ্নচারী কবি হিসেবে। এদেশে তখন সবে সামরিক শাসনের সূচনা হয়েছে। সেই কঠোর যাঁতাকলে আমাদের প্রিয় মূল্যবোধগুলি যখন একের পর এক গুঁড়িয়ে যেতে লাগল, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল এমন সব কবিতা যাকে রাজনৈতিক বললে দোষ হবে না। এ রাজনীতি দলের নয়; এ কবিতা শ্লোগানের নয়, মর্মঘাতী ব্যঙ্গের, অব্যক্ত যন্ত্রণার, তীব্র ভালোবাসার। সেই থেকে শামসুর রাহমান আর ফিরে তাকান নি। যেখানেই স্বৈরশাসন, সেখানেই তিনি প্রতিবাদী; যেখানেই মানুষের সংগ্রাম, সেখানেই তিনি সঙ্গী। সমাজ ও পরিবেশের প্রতি কোনো সৎ ও বিবেকবান লেখক উদাসীন থাকতে পারেন না বলে তিনি মনে করেন। শামসুর রাহমান সেই অঙ্গীকার করেছেন দীর্ঘদিন আগে। তাই গণ-অভ্যুত্থানে ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি যেমন শরিক হন কবিতা নিয়ে, তেমনি স্বাক্ষর দেন রাজনৈতিক বিবৃতিতে, স্বৈরাচারের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন সরকার-নিয়ন্ত্রিত দৈনিকের প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে। জীবন, মনুষ্যত্ব ও শ্রেয়োবোধের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে যে-বাণী তিনি উচ্চারণ করেন, তাতে ধ্বনিত হয় বিবেকের কণ্ঠস্বর।’
জনগণের কাছে যা অকল্যাণকর, যা জনগণের নিয়ত বিরোধী ছিল তাঁর সময়কালে–তারই বিপক্ষে তিনি কবি হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মানসিক ও অন্যান্য যোগাযোগ সঙ্কুচিত করে জনগণ ও সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘেরাটোপে কখনো আটকে রাখেননি। আর সেজন্য তিনি ধর্মান্ধগোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন। শামসুর রাহমান নিছক স্বভাব কবির মত কবিতা লেখেননি, সমাজ ও কাল সচেতন আধুনিক কবি হিসেবে তিনি ছিলেন শিক্ষা ও কাব্য অভিজ্ঞতায় পরিশীলিত। তাঁর কবিতায় ধরা দিয়েছে সেই ব্যঞ্জনা, যা একজন সার্থক কবির শব্দ ও শৈলির পরিচয় মেলে ধরে । রাজনীতির ক্ষেত্রে কবির কাজ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মত নয় কিন্তু কবি রাজনীতিকে সূক্ষ্মভাবেই অনুভবের শৈলিতে পরিণত করতে পারেন। কবিতার ভেতর সেই জোর অনুভব করা যায়। শামসুর রাহমান সততায়-আন্তরিকতায় কবি হিসেবে রাজনীতি ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তাঁর কবিতায় তাঁকে যেমন চেনা যায়, তেমনি তাঁর কবিতায় আমাদের গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রাম ও ইতিহাসের কণ্ঠলগ্ন সময়কে চিনতে পারি।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক গোলাম কিবরিয়া পিনু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *