শিশুতোষ গল্প ।।বিজয়ের কথা।। হায়াৎ মামুদ

হ্যাঁ, সে একটা যুদ্ধ হয়েছিল বটে। সে – যুদ্ধ বিজয় কখনাে দেখে নি। শুধু বিজয় এইটুকু হয়েছিল ১৬ই ডিসেম্বর, আর ঐ যুদ্ধ জয় করেছিল বাঙালিরা। ঘটনাটা ১৯৭১ সালের। বিজয় জন্মেছিল তার অনেক – অনেক বছর পরে। কিন্তু জন্ম যেহেতু ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে, তাই সবাই মিলে তার নাম রেখে দিয়েছে ‘বিজয়’। এতে অবশ্য বিজয়ের কোনাে হাত নেই। নিজের নাম তাে আর কেউ নিজে রাখে না; রাখে বাপ-মা, দাদা -দাদী, নানা নানী, সব আত্মীয় -স্বজন আর কি। কিন্তু এই নাম পেয়ে বিজয় খুব খুশি। ভাগ্যিশ সে বিজয় দিবসে জন্মেছিল। নইলে কে জানে, হয়তাে একটা হেঁজিপেজি নাম তার কপালে জুটে যেত। এই দেখ না। – ছােট ভাইটার নাম আনন্দ। তা – এ নামটাও খারাপ না। কিন্তু ও তাে আর বিজয় দিবসে জন্মায় নি। বছরে যেকোনাে দিনে জন্মালেই তাে ‘আনন্দ’ নাম রাখা যায়। লােকে বুঝতেই পারে না কোন দিনে তােমার জন্ম। কিন্তু ‘বিজয়’? কাউকে কোনাে ব্যাখ্যা করতে হবে না, শােনামাত্র সব্বাই বুঝে ফেলে যে, বিজয়ের জন্ম বিজয় দিবসে না হয়েই যায় না। তা ছাড়া আরও একটা কথা সে শুনেছে। সেটাও ভারি অদ্ভুত। সচরাচর ঘটে না, সকলের বেলাতেও ঘটে না। সেটা এইঃ তার নাম কেউ যুক্তি -পরামর্শ করে রাখে নি। গােল হয়ে বসে আলােচনা, তর্ক – বিতর্ক, চেঁচামেচি, দশ জন দশটা নাম বলছে, তার ভেতর থেকে একটা নাম বাছাই করা – এসব কোনাে কিছুই তার ক্ষেত্রে ঘটে নি। যুদ্ধজয়ের দিন যে ছেলে জন্মেছে, সে – হলো ‘বিজয়’। এই নামটাই সকলের মনে একসঙ্গে নাকি এসেছিল। অবশ্য সবাই তার নাম ‘বিজয়’ না -রেখে জয়ও রাখতে পারত, দুটো নামের মানে তাে একই। কিন্তু, ‘জয়’ রাখলে ভারি একটা মুশকিলে পড়ত সে। মুশকিলটা এই যে, সবাই ভাবত তার নামটা বাংলা নয়, ইংরেজি শব্দ। ভাববেই তাে! ইংরেজি নামের যে – ছড়াছড়ি চারদিকে। তাে, ছােট ভাই ‘আনন্দ’, আনন্দর ইংরেজি তাে Joy! বেশ মজাই হয়েছে, সে–সে হল বাংলা বিজয় আর ছােট ভাইটা হল ইংরেজি জয়। প্রায়ই ভাবে – সবই না – হয় হল, কিন্তু একটা সমস্যার সমাধান তাে হচ্ছে না। সে যে বিজয়, বিজয় দিবসে তার জন্ম, ব্যাপারটা যে রীতিমতাে ঐতিহাসিক ঘটনা– তা হলে যুদ্ধ কোথায়, কার সঙ্গে, কবে, কে হারল কে জিতল, এ – সব তাকে জানতে হবে না? নিশ্চয়ই হবে। নইলে লােকে বলবে কী? মূর্খ বলবে, গর্ধভ বলবে, হাদা বলবে। মুখ ফুটে না বলুক, মনে – মনে তাে ভাববে। আচ্ছা মাথামােটা ছেলে তাে৷ নিজের নামের রহস্য নিজেই জানে – তা হলে এমন নাম বয়ে বেড়ানাের দরকার কী? এ -সব কথা মনে হলেই বিজয়ের দুশ্চিন্তা হয়। একাত্তুর সালে কী ঘটেছিল? ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধ। এটুকু খবর সে জানে। টুকটাক অন্য খবরও সে জানে, যেমন — বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙালিদের মেরেকেটে একেবারে সাফ করে দিয়েছিল। দু’- দশ জন নয়, একশ’ দু’শ ’ নয়, এক হাজার দু হাজারও নয়, লাখে লাখে মানুষ মেরেছিল।
তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে খুন করেছিল পাক – সেনা। বলে কি খুন। বিজয় কোনােক্রমেই ছবিটা মনে মনে আঁকতে পারে না। কোরবানির গরু – ছাগল জবাই পর্যন্ত সে দেখতে পারে না। রক্ত দেখলেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। মানুষ খুন? ভাবা যায়? তাও কিনা তিরিশ লাখ লােক। আবার, ঐ বজ্জাত পাকিস্তানীদের সঙ্গে বাঙালি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ – ওরাও নাকি ছিল। কী শয়তান রে বাবা! বাঙালি হয়ে বাঙালি খুন করলি? পাকিস্তানীরা না – হয় ভিনদেশী ছিল, তােরা তাে দেশের মানুষ। ভাই হয়ে ভাই খুন করলি? হাত একটুও কাপল না? ছি ছি ছি, ঘেন্না, ঘেন্না। এসব মানুষের মুখ দেখলেও পাপ হয়। আচ্ছা, রাজাকার আলবদররা দেখতে কেমন? আমাদেরই মতাে? মানে – এই রকম হাত – পা – নাক – কান – মুখ চোখওলা মানুষ? ওরা নাকি আমার মতাে বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও মেরেছে? তার মানে – আমি যদি তখন থাকতাম আমাকেও তা হলে ঘ্যাচাং? বিজয় আর ভাবতে পারে না। সব্বোনাশ আমাকেও মেরে ফেলত? ভারি নিঠুর তাে, কী শয়তান! কেন, আমায় মারবি কেন? আমি তােদের কী করেছি? আমি স্কুলের কোনাে ছেলের সঙ্গে মারামারি করি নি এ পর্যন্ত। না, ঝগড়াও না। তা হলে আমায় মারবি কেন? দাড়াও, বড়াে হই, তােদের সব খুঁজে খুঁজে বের করব, তারপর তােমরা মজাটা টের পাবে। বিজয় কেবল একটু বড়াে হােক। তারপর রাজাকার আলবদরের গুষ্টি খতম। এ রকম সময়ে নিজেকে খুব বড়াে এক জাদরেল বীর বলে মনে হয় বিজয়ের। বীর আলেকজাণ্ডার দ্য গ্রেট। আর বেশি দিন বাকি নেই। খালি একটু বড় হতে দাও। কত ধানে কত চাল ব্যাটারা তখন টের পাবে। সব বুঝলাম। কিন্তু ঐ মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা আসলে কী? পরিষ্কার করে কেউ বুঝিয়ে দেয় না কেন? বিজয়ের ভীষণ রাগ হয় আধু – আম্মুর ওপরে। জিগ্যেস করলে টুকটাক উত্তর দেয়, কিন্তু বুঝিয়ে বলে না। কেবল বলে – বিজয় বাবা, প্রতিটি বাঙালি হল মুক্তিযােদ্ধা, তুমিও এক জন মুক্তিযােদ্ধা, কেবল ঐ রাজাকার – আলবদররা ছাড়া। বই পড়াে, বই পড়, তা হলেই সব বুঝবে। কী যন্ত্রণা দেখ তাে। কত বই পড়ব? পড়ার বই – ই কম নাকি? বাইরের বই এত পড়লে পড়ার বই পড়ব কখন? আবার, যদি পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করি তখন তাে বাপু তােমরা হেসে কথা বলবে না। যত জ্বালা হয়েছে আমার। বিজয় মনে – মনে ভাবে। একদিন অবশ্য রাগ করে বলেছিল – খালি পড়তে বল, নিজেরা কিছু বলবে না, কেবল আমাকে উপদেশ, তা বই দাও, পড়ব। বলে তাে মহা ফ্যাসাদ। উরেবাপ রে, সে কত বই। আলু তক্ষুণি সরু মােটা লঘ – বাটকু কত সাইজের কত রংবেরংয়ের বই যে বের করে দেখাল । বলল বিজয়বাবু, এইসব বই আস্তে আস্তে পড়া শুরু কর, যে – জায়গা বুঝবে না, আমাকে বললা, বুঝিয়ে দেব। আল্লু আরাে বলেছিল – তাের নাম বিজয়, কত বড়াে যুদ্ধ জয় করেছিস, জানিস? আর তুই কিনা বই পড়তে ভয় পাচ্ছিস! পড়, নিজে না – পড়লে কি বােঝা যায়? সে যে এক বিশাল ব্যাপার, আমি আর কতটুকু বলতে পারি? বিজয় এখন ধীরে ধীরে ঐ সব বইয়ের পাতা ওল্টায়। কিছু পড়ে, কিছু পড়ে না, কিছু বােঝে, কিছু বােঝে না। কত বইয়ে কত কত ছবি। একটাও ভালাে নয়, বীভৎস সব ছবি। মরা লাশের, ঘােরতর যুদ্ধের, মুক্তিফৌজের ট্রেনিংয়ের। এই বইগুলাে তার ভালাে লাগে। ভাবে – আমি তাে বিজয়। ইতিহাস থেকে উঠে এসেছি। আমাকে এই যুদ্ধ আর যুদ্ধজয়ের ইতিহাসটা জানতেই হবে। সবচেয়ে বড়াে শত্রু সেইসব কুলাঙ্গার। বাঙালি যারা বাংলাদেশ চায় নি, বাঙালি মেরেছে নিজেরা বাঙালি হয়ে – সেই শত্রুদের। চিনতেই হবে, ধ্বংস করতেই হবে, নইলে আমি বিজয় বেঁচে থাকব কী করে? বিজয়ের এবার নিজেকে মনে হয় বীর আলেকজাণ্ডার। সে শুনেছে আলেকজান্ডারকে পড়াতেন মহাজ্ঞানী আরিতােতলস। সে মনের ভিতরে শিক্ষক বানায় ইতিহাসকে। দেশের ইতিহাসই তার শিক্ষক, গুরু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *