শিশুতোষগল্প।। মুক্তিযােদ্ধা নূরুল ইসলাম।। আনােয়ারা সৈয়দ হক

লােকটার রাস্তার সামনে দাড়িয়ে থাকে। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় রুক্ষ কাঁকড়া চুল। পরনে ময়লা হেঁড়া জামাকাপড়। আমরা যখন সকালে পড়তে বসি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি লােকটা দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ, তার মধ্যে যাবতীয় জিনিস, যেন ওটা তার ঘর – সংসার।
প্রথমদিন জিতু ভাইয়া দূর থেকে লােকটাকে দেখে আমাদের ভয় দেখিয়ে বলল, ‘ওই দেখ, ছেলেধরা। বাইরে বেরােলেই তােদের ধরে নিয়ে যাবে।’ আমার মাত্তর আট বছর বয়স, কিন্তু নিতুনের দশ। তার হাত – পা খুব লম্বালম্বা। সে আমার মতন ভয় না পেয়ে ঠোট উল্টে বলল, ‘আহারে, অতাে সােজা না। ওর ওই ঝোলায় আমার একটা ঠ্যাং—— ও ধরবে না।’ কিন্তু মুখে বললেও আমরা দু’জনে দূর থেকে লােকটাকে খেয়াল করতে লাগলাম। কোনােদিন তাকে দেখি নি, হঠাৎ লােকটা কোথেকে উটকো এসে হাজির হল। আবার ভাত – টাত খায় না দেখি, শুধু পাউরুটি খায় আর শুকনাে চিড়ে। মুখ নাড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়, গালের হাড় দুটো খুব উচু লাগে সে সময়। ঝোলায় একটা এনামেলের গেলাস আছে, সেটা মাঝে মাঝে বের করে রাস্তার কল থেকে পানি ভরে নিয়ে ঢক ঢক করে খায়। এর মধ্যে জিতু ভাইয়া একদিন এসে বলল, ‘জানিস, লােকটা না লিটনদের বাড়ির বারান্দায় শুয়ে থাকে রাত্তিরে। একেবারে গায়ে কিছু না দিয়ে। ওর একটুও শীত লাগে না।’
শুনে আমরা তাে অবাক হয়ে যাই। আমাদের কত যে শীত লাগে কী বলব। ডিসেম্বর মাস । রাতে লেপের নিচে শুয়েও হি হি করে কাঁপি। আর সকালে ঘুম থেকে উঠে মােজা, জুতাে, জামা, সােয়টার, পুলওভার ছাড়াও গায়ে একটা চাদর জড়াতে হয়, নইলে ভীষণ শীত লাগে। আর শীত লাগলেই ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা লাগলেই নাক বন্ধ, কানে তালা, বুকে হাঁফানি, কত কি।
আমরা এবার একটু মন দিয়ে লােকটাকে দেখি। সত্যি, তার গায়ের জামাটাও জায়গায় জায়গায় হেঁড়া, পরনে সাত তালি দেওয়া একটা ঢোল ফুলপ্যান্ট। পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। আমাদের এভাবে কৌতূহলী হয়ে উকি – ঝুঁকি মারতে দেখে লােকটা একদিন হাতছানি দিয়ে ডাকল। তাই দেখে ভয়ে তাে আমি মরে যাই। কিন্তু নিতুন খুব সাহসী।
সে বলল, ‘ভয়ের কি আছে রে, বােকা? মানুষ তাে বটে ! বাঘ না যে আমাদের খেয়ে ফেলবে। চল না দেখি কি বলছে লােকটা।’
জিতু ভাইয়া বাড়ি ছিল না। আমি আর নিতুন দরজা খুলে পায়ে পায়ে লােকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লােকটা হাত বাড়িয়ে তার ঝোলার ভিতর থেকে একটা পাউরুটি বের করে বলল, ‘একটুখানি খাবে?’
নিতুন আর আমি খুব জোরে মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম। লােকটা তখন নিজেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে সেই রুটি খেতে লাগল। নিতুন তখন থাকতে না পেরে বলল, ‘তােমার নাম কী?’ লােকটা একটু ভেবে নিয়ে বলল, আমার নাম? ‘দাঁড়াও মনে করে দেখি, হা, মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম?’
শুনে তাে আমরা অবাক! মুক্তিযােদ্ধা? এই লােকটা মুক্তিযােদ্ধা? মুক্তিযােদ্ধারা কি এমন আধপাগলের মতন দেখতে হয়।

নিতুন বাড়ি ফিরে এসে বলল, ‘লােকটা ডাহা মিথ্যে বলল রে সবুজ। ছেলেমানুষ পেয়ে আমাদের সাথে ঠাট্টা করল। ও কী করে মুক্তিযােদ্ধা হবে? বন্দুক নেই, পিস্তল নেই, জামা নেই, কাপড় নেই, জুতাে পর্যন্ত নেই, ফুঃ।’
কিন্তু মুখে একথা বললেও নিতুনের মনের সন্দেহ গেল না। জিতু ভাইয়া বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘটনাটা বলল। জিতু ভাইয়াও বিশ্বাস করল না। সে আমাকে আর নিতুনকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে লােকটার কাছে গেল। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাড়ি বাড়ি বাতি জ্বলে উঠেছে। রাস্তার মােড়ে সাদা নিয়নের বাতি জ্বলছে। আমরা তিন জনে হাত ধরাধরি করে লােকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে দেখি সে কতকগুলো ছেঁড়া কাগজ রাস্তার এক ধারে জড়ো করে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা করছে। আমাদের দেখে সে মুখ তুলে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। জিতু ভাইয়া বলল, ‘তুমি– আপনি নাকি একজন মুক্তিযােদ্ধা?’
লােকটা একথা শুনে আবার মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে চুপ করে নিজের কাজ করতে লাগলো।
জিতু ভাইয়া তখন চোখ মটকে আমাদের দিকে তাকাল। ভাবটা দেখলি তাে, কেমন হাতেনাতে ধরেছি। লােকটা উত্তর না দিতে জিতু ভাইয়া জোরের সাথে বলল, ‘অথচ আপনি আমার ছােট ভাইবােনদের কাছে সেই পরিচয় দিয়েছেন।’
এই কথা শুনে লােকটা আস্তে করে বলল, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা বটে।’
জিতু ভাইয়া অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘ তাহলে কই আপনার সার্টিফিকেট? সেটা দেখান।’
লােকটা একথায় যেন একটুখানি হাসল। বলল,’সার্টিফিকেট দিয়ে কী হবে? আমার কথা বিশ্বাস হয় না বুঝি। যারা আসল মুক্তিযােদ্ধা, তাদের কী সার্টিফিকেট লাগে? তবু আমার একটা সার্টিফিকেট ছিল। বছর পাঁচ – ছয় কাছে রেখেছিলাম, তারপর ফেলে দিয়েছি।’
জিতু ভাইয়া বলল, ‘সে কি?’
লােকটা বলল, ‘হ্যা, কত ফলস সার্টিফিকেট নিয়ে লােকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার মধ্যে আমার ওটার দাম কী? আমি ছিলাম এফ. এফ. সিরাজুল ইসলামের প্লাটুনে। আমি ছিলাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একই ফিল্ডে দাড়িয়ে দু’জনে যুদ্ধ করেছি। পাঁচ নম্বর সেক্টরের সাচনা – জামালগঞ্জ এলাকায় আটই আগস্টে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর এক বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। সেখানে আমার বন্দু সিরাজুল ইসলাম মাত্র এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে পাক- সেনাদের মজবুত ঘাটি সাচনা আক্রমণ করে। পাকসেনারা বাজার থেকে গুলি এবং গােলাবৃষ্টি করতে থাকে। সেই গােলাবৃষ্টির মধ্যে মুক্তিবাহিনী সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। আমার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম শত্রু বাঙ্কারের মুখােমুখি হয়ে গ্রেনেড চার্জ করে। এই আক্রমণে শত্রু-সেনাদের দু’টি বাঙ্কারই বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে সিরাজুল ইসলাম নিজেই শহীদ হন। আমাদের আরাে ক’জন মুক্তিযােদ্ধা তার সাথে শহীদ হয়। বন্ধু এবং সমবয়সী সহযোদের মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। তবু বুকে পাথর বেঁধে আমি অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকি এবং পরে আমরা পিছু হটে আসি। সেই বীভৎস কাল রাত্তিরের কথা ভাবলে এখন আমার গা শিউরে ওঠে।’

এই বলে একটু চুপ করল মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলাম। তারপর বলল, ‘এর বদলা মাত্র আড়াই মাস পরেই আমরা সুদে – আসলে নিলাম। বড় ছড়া সাব -সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনের দশ হাজার মুক্তিবাহিনীর নয় হাজারই ছিল গণবাহিনী। সেই বিশাল গণবাহিনীর একজন ছিলাম আমি। চব্বিশে অক্টোবর এই সাব -সেক্টরের ট্রুপস্ ক্যাপ্টেন মুসলিমের তত্ত্বাবধানে মুক্তিবাহিনীর যে প্লাটুন আটগ্রাম হানাদার ঘাঁটি আমণ করে সেই পাটুনে আমিও ছিলাম। আধ ঘণ্টা স্থায়ী সংঘর্ষের পর আমরা এটি দখল করি। দুই জন পাকিস্তানী আত্মসমর্পণ করে, বাকিরা ভয়ে পালিয়ে যায়।’
এই বলে মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলাম থামল। ছেঁড়া কাগজের আগুনে তার মুখটা কেমন লাল দেখাচ্ছে। জিতু ভাইয়া একটু উসখুস করে বলল, ‘তাহলে এখন আপনি কেন এমনি করে ঘুরে বেড়ান?’
নুরুল ইসলাম যেন জিতু ভাইয়ার প্রশ্ন শুনতেই পায় নি এমনি ভাবে বলল, ‘যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে দেখি আমার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। যুদ্ধের সময়ে একদিন হানাদার বাহিনীর লােকজন আমার পৈতৃক গ্রাম আক্রমণ করে। বেলা তখন ঠিক দুটো। আমার ছেলেমেয়ে দুটো ক্ষিদে পেটে নিয়ে ভাতের থালার সামনে বসেছে, এমন সময় আক্রমণ। রাজাকার পিশাচেরা ওদের ডেকে এনে আমার বাড়ি চিনিয়ে দেয়, আমি তখন যুদ্ধক্ষেত্রে। রক্ত পিপাসু হায়েনারা আমার স্ত্রী আর সন্তানদের ধরে নিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধ শেষে, দেশ স্বাধীন হবার পরে আমি পাগলের মতাে তাদের খুঁজেছি। কোথাও পাই নি । তাই আমি নিজের গায়ে থাকি নে, ঘুরে ঘুরে বেড়াই।’
জিতু ভাইয়া তার কথা শুনে ইতস্তত করে বলল, ‘সে তাে সেই উনিশ বিশ বছর আগের কথা, তারা কি এতদিন …’
জিতু ভাইয়ার কথায় মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলাম বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তাতে কী!’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার চল্লিশ বছর পরেও মানুষ বন -জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে, তেমনি ভাগ্যচক্রে আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরাও যদি তাদের কাছ থেকে পালিয়ে…
জিতু ভাইয়া কেমন বিষন্ন স্বরে এবার বলে, ‘তাই কি আপনি খুঁজে বেড়ান তাদের এইভাবে ঘুরে ঘুরে?’
এই কথা শুনে সেই মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলাম তার ঝোলার ভিতর থেকে বের করলেন দুটো ক্ষয়ে যাওয়া চৌকো ছােট ঝপসা ফটোগ্রাফ। আগুনের কাছে তাদের ধরে নিয়ে বললেন, ‘দেখাে, আমার ছেলেমেয়েরা কত সুন্দর। তোমাদের মতাে সুন্দর। আমার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হবার আগে তার বাবাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল, আব্বাজান, দােয়া করবেন, মৃত্যু হলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।—– আমিও একজন বাবা, আমিও সেই ডাকের অপেক্ষায় আছি।’
হঠাৎ করে জিতু ভাইয়া বলে উঠল, ‘আপনি কখনাে ভাত খান না কেন, শুধু রুটি আর চিড়ে খেয়ে থাকেন?’ মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলাম বললেন, ‘বাবা, আমার সােনার ছেলেমেয়ে দুটো যে ভাত মুখে তুলতে গিয়েও তুলতে পারে নি, হানাদারেরা তাদের সেই অবস্থাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি তাে জানি কেমন ক্ষুধার্ত ছিল আমার ছেলেমেয়ে দুটো, ক্ষিদে। লাগলে যে তাদের হুঁশ জ্ঞান থাকত না। ভাত যে বড় সুস্বাদু বাবা! থালায় বেড়ে রাখা সেই ভাত তারা মুখে তুলতে পারে নি। আমি তাদের বাবা হয়ে কীভাবে এই তাত মুখে তুলি, তােমরা বলাে?’
জিতু ভাইয়া হঠাৎ করে আমাকে আর নিতুনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বাড়ির দিকে ডেকে নিতে নিতে বলল, ‘বাবা, এখন তাহলে যাই। দোয়া করবেন আমরা যেন আপনার মতন দেশ রক্ষায় বীর যােদ্ধা হতে পারি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *