মিনার মনসুরের বর্ষার কবিতা

এলিজি

এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর॥
─বিদ্যাপতি
কেঁদেও পাবো না তোমাকে বর্ষার অজস্র জলধারে─সে আমি জানতাম। আমার মন্দির তবু কানায়
কানায় পূর্ণ ছিল তোমার শূন্যতায়। অকস্মাৎ সেই শূন্যতাটুকুও কেড়ে নিলে তুমি!
আমাকে ছেড়ে গ্যাছো তাতে কী! তোমার ভেতরে তো ছিলে তুমি। বিপন্ন ধরিত্রীর আলো-
হাওয়ায় মিশেছিল তোমার আশ্চর্য সজীব নিঃশ্বাস। আষাঢ়ের বৃষ্টিস্নাত প্রথম কদম ফুলে
আমি তোমাকে দেখতাম। এই আষাঢ়েই তুমি তোমাকেও ছেড়ে চলে যাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি
আমি।
তোমাকে নিয়ে এটাই আমার শেষ শোকগাথা কি-না জানি না। সিসিফাসের মতো আমিও
তো পাথরের বুকে সেই একই কবিতা খোদাই করে চলেছি অবিরাম। নিজেকে নিয়ে কী আর
ভাববো? আমার হৃদয় সে তো এক পরিত্যক্ত নগরী। তার আর কীই-বা আছে হারাবার!
আমার সব কান্না তো তুমি সঙ্গে করে নিয়ে গেছো আগেই। আমার চোখ জলশূন্য বহুদিন।
তাতে কী, আষাঢ়ের আকাশে আজ অন্তহীন জলের প্লাবন। আকাশ কাঁদুক।

কাকে বলি তার এ বেলেল্লাপনার কথা

চাওয়া ছিল সামান্যই। আড়াল, আব্রু আর নিভৃতি─ এই ত্রয়ীর জন্যে কী যে তৃষ্ণা ছিল
আমাদের। আসলেই কি তারা ত্রয়ী─ নাকি তিনটি নামের মোড়কে একটিই বিশল্যকরণী? কার
কাছেই না হাত পেতেছি আমরা! পোড়া দেশ। কবরের স্মৃতিফলকও ধড়িবাজ ট্রেড ইউনিয়ন
নেতার মতো কর্কশ চিৎকার করে সারাক্ষণ। তার আজন্ম ক্ষুধার্ত হাত এতটাই কদর্য যে
জন্মদাত্রীকে বেআব্রু করতেও তা একটুও কম্পিত হয় না।
আষাঢ় আমাদের সবই দিয়েছিল। আড়াল, আব্রু আর নিভৃতি। সব। এমনকি আমরা যে প্রাচীন
গুহার ভেতর বন্দি ছিলাম বংশপরম্পরায়─ খুলে দিয়েছিল তার লৌহকপাটও। অনন্তের শুভ্র নার্স এসে তার
জাদুকরী হাতের ছোঁয়ায় সযত্নে সারিয়ে তুলেছিল চাবুকের বীভৎস ক্ষতগুলি। মুক্ত করে দিয়েছিল
আমাদের ডানা। সেই প্রথম আমরা উড়তে শিখেছিলাম। একমাত্র আষাঢ়ের আমন্ত্রণেই ছুটে
এসেছিলেন তিনি। কত যে কৃতজ্ঞ ছিলাম আমরা তার প্রতি!
আমরা নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবতাম। বলতাম, এমন আষাঢ় আর দ্বিতীয়বার আসবে না। গ্রাম্য-
বালিকার মতো সেও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতো তাতে। অথচ এখন ময়ূরের মতো রংধনু পেখম
ছড়িয়ে সে নাচছে সমগ্র আকাশ জুড়ে। তুমি নেই। কাকে বলি তার এ বেলেল্লাপনার কথা!

তুমিই সেই আলবাট্রস

তার আগমনবার্তাই জানিয়ে দেয়─ তুমি নেই। হাবভাব দেখে মনে হয় রাজাদেরও রাজা তিনি। কে
না জানে যে একালের স্বনির্বাচিত রাজাদের যাত্রাপথে বাতাসকেও থমকে দাঁড়াতে হয়। তার দাপট
আরও বেশি। আকাশে আকাশ থাকে না। বৃক্ষরাও মুহূর্তে মৃত্তিকাবিমুখ। কোনো এক গূঢ়
রহস্যের টানে স্বর্ণ-তৃষ্ণা ভুলে শকুন্তলার মতো মাতম করে কর্দমাক্ত পৃথিবীর প্রাণ।
তুমি থাকলেই কি সব আর্তনাদ থেমে যেত? মাটির শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেত রুদ্ধশ্বাস বৃক্ষদের
প্রাণ? বিপন্ন পৃথিবী ফিরে পেত তার লুপ্ত ডানার সুঘ্রাণ? আসলেই কি ডানা ছিল তার?
মাটি যদি শৃঙ্খলই হবে শেকড় তাকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়াবেই-বা কেন? জটিল এই সমীকরণ।
দূর সমুদ্রের আলবাট্রস তাকে শিখিয়েছে এইসব। বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে লবণাক্ত
দীর্ঘশ্বাস। হতে পারে তুমিই সেই আলবাট্রস
তুমি ছিলে। হয়তো-বা আজও তুমি আছো কারো বাহুর বন্ধনে। তবু নাই নাই রব উটের মতো
মাথা গুঁজে থাকে কুরুক্ষেত্রের তীব্র ধূলিঝড়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম তিনি। তার রাজকীয় পদশব্দে সরে
যায় সমস্ত আড়াল। কী যে হয়─ সন্ন্যাসী সংসার খোঁজে, সংসারী সন্ন্যাস!

বিসর্জন

কাগজের নৌকায় তোমাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম শ্রাবণের থইথই জলে। খেলাচ্ছলে। এখন অপরূপ
রৌদ্রের জলে ভেসে যাচ্ছে আমার বিষণ্ন অ্যাপার্টমেন্ট। দেয়াল ফুঁড়ে চতুর্দিক থেকে তারা
আসছে। চমকাচ্ছে টিপু সুলতানের তরবারির মতো; ─কেননা আকাশছোঁয়া রৌদ্রের রথে বসে
আছো তুমি!
আমি ভাসিয়ে দেবার কে? এদেশের সব নদী জানে, যখন যাবার সময় হয় মাটিসুদ্ধ সব ভেঙে
পড়ে। আবার মহাপ্লাবনের পর নূহের নৌকার মতো কেউ কেউ ঠিক ভেসে থাকে। বড় জটিল যাওয়া-
আসার এ সমীকরণ। যতবার তোমাকে ভাসিয়ে দিই ঘোর মনস্তাপের জলে, ততবার তুমি ফিরে
আসো সাড়ম্বরে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *