গদ্য।। বাংলাদেশের ঈদঃ একটি পর্যালোচনা।। আমীরুল ইসলাম ফুআদ

মানব জীবনে ঈদ আসে খুশির চেরাগ জ্বালিয়ে দিতে। পরস্পরে সাম্যের ফুল ফুটিয়ে দিতে। মানবতাহীন আকাশের মিনারে প্রেমার্ত পূর্ণিমার চাঁদ উদিত করে দিতে। দূর্নীতির মচ্ছব তাড়িয়ে নিপীড়িত জনগণের তরে ন্যায় বিচার দাঁড় করাতে। সত্যিই মানব জীবনে দুইবার ঈদ আসে সাম্যের পরিচয় দিতে। ধনী-গরিব, উঁচু -নিচু, সাদা-কালোর জাহেলি বৈষম্যকে ভেঙে দিতে।
কিন্তু,বাংলাদেশের ঈদ প্রসঙ্গে বলতে গেলে— আফসোস আর পরিতাপ করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। যেদেশে মানবতার খোঁজ পাওয়া যায় না। বৈষম্যের প্রাচীর দাঁড় করানো গোত্রে-গোত্রে। মানুষের মাঝে। তৃষ্ণায় কাতর পথশিশুর বুকফাটা আর্তনাদ শুনেও যেদেশের মানুষের হৃদয়ে রহমতের শিশির ঝরে না। উদয় হয়না একটুও মানবতা বোধ। অপর দিকে লুটে নেয় দেশের ঐশ্বর্য স্বৈরাচারী লুটতরাজেরা।সেদেশের ঈদ আনন্দ বয়ে আনার চেয়ে নিরানন্দকেই বয়ে আনে বেশি।
দু’টি ঈদ উপলক্ষে মুসলিমদের হৃদয়ে কতো স্বপ্ন জমা থাকে। হাজারো ভীড়-ভাট্টা ঠেলে, একশত টাকার পরিবহন ভাড়া হাজার টাকা দিয়ে হলেও নাড়ির টানে বাড়ি ফিরে। ঈদের সময় কমলাপুর রেলস্টেশন কিংবা বড় বড় বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায় আগত যাত্রীদের নির্মম ভোগান্তি। অস্থিরতার ছাপ লেগে থাকে রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের টাইলস জুড়ে। সান্ত্বনাশূন্য চোখের জল দরবদর করে ঝরে পড়ে জনপদের আবর্জনায়।ট্রেনের ছাদে কিংবা পিছনে ঝুলে বাঁচা-মরার ঝুঁকি নিয়ে পথ ধরে স্বপ্নবাজ মুসলিম জনতা। যে কিছুর বিনিময়ে হোক দোশে ফিরতেই হবে। পরিচিত মুখগুলো থেকে মলিনতার ছাপ মুছে দিতে হবে। কপালের বঙ্কিম ভাঁজ সরিয়ে দিতে হবে। এই যে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথ চলছে— এক্সিডেন্টও তো কম হচ্ছে না। অহরহ ঘটছে নানান দূর্ঘটনা। কেড়ে নিচ্ছে সরলমনা মানুষের প্রাণ। কেঁদে বুক ফাটাচ্ছে তাদের আত্মীয়-স্বজন। কে নিবে তার দায়ভার? না সরকার না অন্য কেউ।
শুধু কি তাই! প্রতি বছর ঈদের মৌসুমে কলকারখানা ও গার্মেন্টসগুলোতে পুঁজিবাদী চিন্তা লালনকারীরা শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে মেশানো পয়সাগুলো দিচ্ছে না। নানান বাহানায় তাদের হক মেরে খাচ্ছে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। কোন কোন কলকারখানা ও গার্মেন্টসের কর্তৃপক্ষ আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে তাদের কারখানাগুলোতে। এতে তাদের দুটি ফায়দা হচ্ছে— একদিকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আনা লোন আর দেওয়া লাগছে না। অপরদিকে খুব সহজেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা চাপিয়ে দিতে পারছে শ্রমিকদের ঘাড়ে। আমারা প্রায় প্রতি ঈদেই দেখতে পারি— সম্মিলিত শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের মিছিল ও ভাঙচুর। রাস্তায় রাস্তায় ফেস্টুন টানিয়ে ধর্মঘট পালন করার চিত্র। কিন্তু, তারা কখনো পেল না তাদের অধিকার। অবশেষে পায় শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের হাতের পিটা আর লাথি ঘুষি। এভাবেই গরীব শ্রমিকদের ঈদ আনন্দকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রায় প্রতি বছরই।
অধিকার বঞ্চিত, জুলুম নির্যাতিত ,নিপিড়ীত পথশিশুদের ঈদ কেমনে কাটছে? তার খেয়াল কজনই বা রাখছে? অথচ আমাদের জীবনে এসেছে দায়িত্বহীনতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে ইনসাফের বাণী শিখাতে। বেইনসাফির উৎসব মহড়া বন্ধ করে দিতে। নাস্তিক্যবাদী বুদ্ধিজীবীদের কুচিন্তায় মুসলিম উম্মাহর সাম্প্রতিক সম্প্রীতি দূর হয়ে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পরস্পরের ভালোবাসার জৌলুশ। তাই তো পথ-প্রান্তরে পথশিশুদের ক্রন্দন আর আর্তনাদ শুনেও উঁচু ভবনের লোকগুলোর হৃদয়ে আঁচড় কাটছে না। প্রীতির হাত সম্প্রসারিত করছে না তারা অধিকার বঞ্চিত লোকদের দিকে।নিজেরাই ঈদ আনন্দকে উপভোগ করছে। বঙ্গদেশের পাথর দিল মানুষের মাঝে সহমর্মিতার চাঁদ উদিত হতে চায় না তেমন।
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব উপলক্ষে বিশাল বিশাল মার্কেট, টাওয়ার, হাউজগুলো রাজকীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ রূপ ধারণ করে। ঈদের পূর্বমুহূর্তে মার্কেটগুলো তিল ধারণের ঠাঁই পাওয়া যায় না। প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের অর্থের দাপটে পরিদর্শন ও কেনাকাটার চিত্র নজরে আসে। অন্যদিকে পুঁজিবাদী লালনকারী ব্যবসায়ীরা তাদের পেয়ে মহাখুশি। দেদারসে লুট করছে তাদের অর্থবিত্ত। সাধারণ দোকানের দুই-তিনশত টাকার ত্রিপিছ,লেহেঙ্গা, শাড়ীগুলো বসুন্ধরা,বনানী ও নিউমার্কেটের দোকানগুলোতে চারা দামে বিক্রি হয়। ২০১৯ সালের এক রিপোর্টে জানা যায়— চার-পাঁচশত টাকার লেহেঙ্গা, শাড়ীগুলো পাঁচ-ছয় হাজার টাকায় দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। আবাল মার্কা বিত্তশালীরাও তা লুফে নিচ্ছে খুব সহজেই। এই যে অর্থের একটা বিরাট ক্ষতি হচ্ছে— তা কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবেও ক্ষতিভার নিতে হচ্ছে।ক্রমে ক্রমে দেশটা এগুচ্ছে দেউলিয়াত্বের দিকে। এখনো যদি আমাদের বোধের উদয় না হয় তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের কপালের জন্য মহা দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে— মুমিন জীবনের ঈদ শুধু মাত্র ভোগ-বিলাসীতা আর জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর নাম নয়। অশ্লীলতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার নাম ঈদ নয়। মুমিন জীবনে ঈদ আসে আমলী জীবনের নান্দনিক পাঠ নিয়ে। ঈদের মহমান্বিত তাকবীর হেঁকে চলার জন্য। ইবাদতে নতুন জাগরণ আর আত্মসচেতনতায় ঝঙ্কার তুলার জন্যই মানবজীবনে ঈদ আসে।ঈদোৎসবকে আমরা বানিয়ে নিয়েছি নিছক বিলাসিতা হিসেবে। ঈদের তাৎপর্যকে জীবনে প্রতিফলিত করতে রাজি নই আমরা।অথচ, আমাদের ঈদ অভিযাত্রা পৃথিবীর নরকীয় পরিবেশকে জান্নাতের সৌরভে মুখরিত হয়ে ওঠার কথা। বিপর্যয়ের পথ রুদ্ধ করে সিরাতে মুস্তাকিমের উপর অবিচল থাকার জন্যই মানবজীবনে ঈদ উৎসবের আগমন।
আসুন আমাদের ঈদ উৎসবের আনন্দকে ভাগাভাগি করি।সুবিধাবঞ্চিত মানুষের হৃদয়েও খুশির চাঁদ উদিত হোক। আমরা যদি একটু সচেতন আর সহমর্মিতার পরিচয় দিতে পারি— তাহলে সমাজের উচ্চবর্গের মানুষগুলো গরীবের পেটে লাথি মেরে তাদের ঈদ উৎসবের আনন্দকে নিরানন্দে পরিণত করতে পারবে না। এখনই আমাদের সময় সমাজের চিত্র পাল্টিয়ে দিতে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। তাহলেই এই ঈদ আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হবে সফলভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *