জ্যারড এন্ডারসন এর কবিতা।। ভাবতর্জমা: মঈনুস সুলতান

কবি পরিচিতি: বনানী সংলগ্ন গোরস্থানের কাছাকাছি একটি সাদা রঙের বাড়িতে বসবাস করেন কবি
জ্যারড কে এন্ডারসন। তিনি ‘ক্রিপ্টন্যাচারেলিস্ট’ শিরোনামের একটি পডকাস্টের রচয়িতা। এছাড়া অডিও ড্রামা প্রকরণের মাধ্যমে কবি সপ্তাহে দু’বার করে বর্ণনা করেন, অবিশ্বাস্য সব বন্যপ্রাণী ও অদ্ভুদ
জায়গায় তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। উপস্থাপিত কবিতাগুলো কবির ‘ফিল্ড গাইড টু দি হন্টেড ফরেস্ট’
শিরোনামের গ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে।

লৌহখন্ড

লোহিত বর্ণের অতিকায় এক দৈত্যাকৃতির নক্ষত্রের অভ্যন্তরে তৈরী হয়েছিল লৌহ, অজস্র যুগ আগে
কত দূরে.. দূর..বহুদূর.. সুদূরে..
নীরব বিষ্ফোরণে প্রকম্পিত হয়েছিল নীলিমা,
তারপর অজস্র আলোকবর্ষ
অতিক্রম করে শীতল কঠিন পথপরিক্রমা,
উড়ে চলা দন্দকলসের বীজের মতো
অন্ধকার থেকে সুগভীর অন্ধকারে
অবশেষে পৌঁছে এসে পৃথিবীর দুয়ারে;
তৈরী হয় তরবারী
হাতুড়ি কিংবা আঙ্গুরীয় অথবা কামান সারি সারি,
বিদীর্ণ করে ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে ছুটে চলা হারিণীর হৃৎপিন্ড,

এ ধাবতখন্ড তারপরও কিন্তু মূলত এক নক্ষত্র প্রবল
সুপ্তিমগ্ন শিশুর ধমনীতে বয়ে যায় যে লোহিত তরল,
তাও কিন্তু আদতে নীলিমা নিলয়ের আদি বিষ্ফোরণ
বয়ে এনেছে যা—
যেখানে সমাপ্ত হয়েছে মহাকাশে পরিব্যপ্ত ভ্রমণ ।

শিকল

এক সময় তুমি ছিলে তোমার জননীর শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ঠিক একই সূত্রে তোমার জননীও গাঁথা ছিলেন তাঁর মা-জননীর সঙ্গে,
একই ধারা পরম্পরায় জীবন প্রবাহ বয়ে চলছে সৃষ্টির আদি থেকে।
এ জৈব-শিকল সংযুক্ত আছে পৃথিবীর প্রথম জীবকোষের সাথে
যে জাগ্রত হয়েছিলো একদা— সমুদ্রজলে,
অযুত নিযুত কাল পাড়ি দিয়ে—
সুদূর অতীতে— যখন কোথাও উচ্চারিত হয়নি কারো কোন নাম।

আমরা সকলে সংযুক্ত আছি সেই শিকলের আংটায়—
অষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হয়ে,
তুমি কী অনুভব করতে পারো এর ওজন?
একটি পথরেখা স্মৃতি বিস্মৃতির সীমারেখা আতিক্রম করে
চলে গিয়ে মিশেছে মহাসমুদ্রের অনাদি জলধারায়..

দাঁড়িয়ে আছো তুমি এ মুহূর্তে— আধূনিক জগতে
প্রতিটি দৃশ্যপট তৃষ্ণার মতো সুপরিচিত

চিন্তা করে দ্যাখো— তোমাতে অন্য কিছুর অস্তিস্ত্ব আছে কী?

তোমার জননী এবং তাঁর জননী— তোমার মাতামহী
অতীতমুখী একই ধারাক্রম,
সম্পূর্ণ নওল হাল্কা এক আকাশের তলায়
আদি এক সমুদ্র.. জলে আলোময় তরঙ্গ ছলকে যায়..।

বিবৃতি

বিশ্ব-জগৎ থেকে উৎসারিত বর্ণমালায় রচিত একটি বাক্য তুমি
তোমার জন্মের অনেক আগে থেকেও অস্তিস্ত্ব ছিলো হরফের
তা দিয়ে নির্মিত হয়েছে যে গল্প,
প্রচলিত থাকবে তা— তুমি পুরোপুরি পঠিত হওয়ারও পর
তারপর,
অস্তিস্ত্বের পাঠ্যক্রমে তোমার বিন্দুবৎ অবস্থান
শুধু অবধারিতই নয়…চিরায়ত,
এ নিয়ে ভাবনাচিন্তাও এ মুহূর্তে নিষ্প্রায়োজন।

পরিচয়

তোমার পাঁজরের খাঁচায় আছে একটি রূপোর ঘন্টা
যখন চেষ্টা করো ঘুমিয়ে পড়তে,
তখন তুমি জিভের ডগায় ভাঙ্গা দাঁতের খোঁড়ল স্পর্শ করার মতো

অনুভব করতে চাও— কাজ করছে কী ধ্বনি প্রতিধ্বনীর কৃৎকৌশল?

কোন এক দিন,
তালাশ পাবে তার
হিম-শীতল ধ্বনিতে বাজবে তা
প্রতিধ্বনী ছড়াবে শরতের আকাশ ভাসা হ্রদে,
এই ধ্বনী প্রতিনিধিত্ব করবে তোমার
মনে হবে— আওয়াজটি তো বেশ কবোষ্ণ— তপ্ত সুরুয়ার মতো
যতোক্ষণ না তা ঠান্ডা হয়ে আসে।

তারপর, তুমি ফের সন্ধান করবে ধ্বনি প্রতিধ্বনির উৎস।

মোমবাতি

যদি জলন্ত মোমবাতির কাছে বলো তোমার গোপন কথাটি,
তাহলে জগৎ-সংসারের সর্বত্র জানাজানি হবে—
আছে যা লুকানো তোমার হৃদয়ের নির্জন নিভৃতে।

শব্দগুলো প্রতিটি ক্যাম্পফায়ারের অগ্নিকুন্ডে পুড়বে পড়পড়িয়ে
মথিত হবে সারাক্ষণ পৃথিবীর সমুদ্রগভীর পাকস্থলীতে।

তোমার অনুভব অনুদিত হবে অগ্নিতে
বিবর্তিত হবে ধোঁয়া ও ছাইভষ্মে,
এ বৃত্তান্ত আর কেউ নয়— জানবে শুধু আকাশ।

সীমা

বনানীতে পড়ে থাকা পাথরখন্ড সরিয়ে চাইলেও তুমি
দেখতে পারবে না এ গ্রহের তাবৎ তৎপরতা,
জানতে পারবে না— আছে কী জলতলে
বাতাস ও মৃত্তিকার রহস্যময় বিষয় আশয়—
আপাত অশ্রুত বারতা।

তারপরও এ সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষাপটে আছে যে আনন্দ
অনুভব করতে পারো কী?
যে কোন সময় চাইলেই আবিষ্কার করতে পারো নতুন কোন জিনিস নওল প্রজাতীর জোনাকি।

সমৃদ্ধ হতে পারো সম্পূর্ণ নতুন ধারায়
আর এ উদ্যোগ হবে স্বাধীন
যা কখনো করবে না তোমাকে ক্লান্ত— হবে না অসময়ে প্রবীন।

বাড়ি

তোমার মেঝেতে পেতে রাখা কার্পেটের উপর দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে একটি পিঁপড়া।

মাকড়শা বুনেছে যে জালের নক্সা— আকারে তা
তোমার সিঁড়ির নিচে বাসা করা বনবিড়ালের চেয়েও অনেক বড়।

বিষয়টি অনুভব করো
নিঃশ্বাস নাও
আরো ভাবো;

উত্তম
তাবৎ কিছু গতিহীন প্রশান্ত এখানে,
বনানী, পাহাড় ও মরুভূমি।

আমি ঘরে আছি এবং এটাই আমার বসতবাড়ি।

মেঝেতে পড়ে আছে যে কার্ডবোর্ডের বাক্স
পিঁপড়া কিংবা মাকড়শা নয়
সেই হচ্ছে অজানা আগন্তুক।

সাবধান বাণী

এইমাত্র তোমার জীবন পান্ডুলিপির শেষ পৃষ্টাটি পড়ে ফেললাম
মনে হলো— ভালোবাসতে হবে তোমাকে সারাক্ষণ সর্ব পরিস্থিতিতে
আমার প্রেম অতিক্রম করে যাবে অনুকম্পা ও প্রত্যাশা।

শব্দের সামাহার প্রতিটি জীবন

সমুদ্রের বিপুল গভীরে সাঁতার কাটে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাছ
জানে না সে বেলাভূমির বিষয় আশয়,
কিন্তু তার সঞ্চালনে তৈরী মৃদু ধ্বনি-তরঙ্গ—
যা এসে পৌঁছায় সৈকতে,
শরতের শিশির-ছোঁয়া ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে চলা হরিণও
মনে হয়—সচেতন নয় —তার চলাচলের শব্দ সম্পর্কে।

এই সব আপাত হারিয়ে যাওয়া ধ্বনিপুঞ্জে নির্মিত হয়েছে
যে অসমাপ্ত কবিতা,
যে রকম তোমার হাতের মুঠো থেকে গড়িয়ে পড়ে
যাপিত জীবনের প্রতিটি বছরের তাম্রমুদ্রা।

তোমাকে ছাড়া সমৃদ্ধ হবে না এই কবিতা।

অসম্ভব

শুধু শুনে আকার আকৃতি বুঝে নিতে কোন সমস্যা হয় না বাদুড়ের
উদ্ভিদ আহার করে আলো,
মৌমাছিরা নৃতকলায় সৃষ্টি করতে পারে মানচিত্র।

একত্রে জড়ো করতে পারি আমরা এই ধারনাগুলো
সাথে সাথে অনুভব করতে পারি তুমুল গুরুভার ও ওজনহীতা,
এবং অনুধাবন করতে পারি— তাবৎ কিছুর অযৌক্তিক সৌন্দর্য্য।

অলিখিত

পঞ্চাশ হাজার বছর আগে
বজ্রপাতে জখম হয়েও একটি হরিণ বেঁচে ছিল।

আঘাতের দগদগে দাগ তার শরীরে নিয়েও
সে বেঁচে ছিল আরো অনেক বছর।

আশপাশে সেই যুগে ছিলো না কোন মানুষ
যে প্রত্যক্ষ করেছিল বজ্রপাতের ঘটনাটি,
কিংবা কোন গাঁথায়ও শব্দছন্দে লিপিবদ্ধ হয়নি তা—

তারপর এই বৃত্তান্ত
পৃথিবীর চলমান ইতিহাসের একটি জরুরী অধ্যায়,
যে রকম কিছু সংগীত- কিছু ধ্বনি গুঞ্জরিত হয়

লাখ বিলাখ মানুষের হৃদয়-মনে সদা সর্বদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *