ঈদসংখ্যার গল্প।। পরিযায়ী।। কানিজ পারিজাত

বেশ আয়োজন করে অথচ অনাড়ম্বরে চলে গেলেন ফজলুল হক সাহেব। আয়োজন করে বলতে উনি
বেশ কয়েকবার চলে যাবার উদ্যোগ নেন— প্রস্তুতি চলে। তারপর উনি আবার থেকে যান। এবার
সকলেই যখন প্রস্তুতি নেয়া ছেড়ে দিয়েছে, ফজলুল হক সাহেবকে আইসিইউ থেকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়েছে— তখনই উনি টুস করে কাউকে না বলে চলে গেলেন। আত্মীয়-স্বজন যারা পথিমধ্যে ছিল, যারা দূরে ছিল— সকলেই ছুটল, পড়িমড়ি করে ছুটল। কে কতটা
কাঁদতে পারে, কার কত কাছের ছিল, কত ভাল মানুষ ছিল— ক্রন্দন আর আহাজারিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে স্মৃতিচারণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো অনেকেই। ফজলুল হক সাহেবের স্ত্রী মাতিয়া বানু কেবিন থেকে কিছুক্ষণ আগেই ঘরে ফিরেছেন। আকস্মিক ফোনে তিনি বিমূঢ়, নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। শোক ভালো করে যেন স্পর্শ করতে পারল না তাকে।
তিনি সবে গোসল সেরে এসেছেন, খেতে বসবেন— রাতজাগা, দুশ্চিন্তা, ক্লান্তিতে ক্ষিদেটা কেবলই জাঁকিয়ে বসেছে— এমন সময় খবরটা এলো। খবরটা আসার পর প্রথমেই মাতিয়া বানুর বিশ্বাস হলো না। তিনি শুধু ভাবলেন এখনই ছুটতে হবে, খাওয়াটা আর হলো
না। ছেলের বউ আর কাজের বুয়া রহিমার মা কাঁদছে, তাদের উচ্চস্বরে ক্রন্দন ও মাতমে মাতিয়া বানু নিজে ভাল করে কাঁদার ফুরসৎ পেলেন না, তার খালি মনে হলো কী যেন বাকি রয়ে গেল। কী যেন বলা হলো না।
বাড়িতে গমগম করছে মানুষ। গুমোট পরিবেশ, আতর লোবান ও আহাজারিতে বাতাস ভারী। শেষ যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন। ফজলুল হক সাহেবকে নেয়া হচ্ছে শেষ ঠিকানায়। মাতিয়া বানুর হঠাৎ মনে হলো, ফজলুল হক সাহেবকে তার কিছু বলা প্রয়োজন, কিছু একটা বলতে চান তিনি। তিনি এগিয়ে গেলেন। তাকে আটকে দেয়া হলো। কেউ একজন বলে উঠল—
—আপনি এখন ওনার পর, ছুঁয়ে দেখার নিয়ম নাই।
এত বছর একসাথে থেকেও শেষ মুহূর্তে মানুষটা পর হয়ে গেল! মাতিয়া বানু অদ্ভুত এক
শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন— একা। শোক তাকে এই প্রথম স্পর্শ করলো।

দুই

বাড়িতে লোকজন গিজগিজ করছে। থেকে থেকে কান্না। একে অপরকে সান্ত¦¦না। মাতিয়া বানুর দুই মেয়ে এক ছেলে। মেয়েরা দেশের বাইরে। টিকিট, সময়, নানাবিধ জটিলতায় তারা আসতে পারেনি। ছেলে-ছেলের বউ, নাতি আছে, আরও আছে আত্মীয়-স্বজন। প্রথম দুইদিন কান্না ও সান্ত্বনা পর্ব গেল, তৃতীয় দিন থেকে সান্ত্বনা দিতে আসা লোকগুলোর স্মৃতিচারণ স্মৃতিআড্ডায় রূপ নিলো। তরুণ ছেলেমেয়েরা একটা বনভোজন আমেজে মেতে উঠল, বড়রা স্মৃতির গুঞ্জনে মুখরিত। মাতিয়া বানু একটু একা থাকতে চাইছেন। ভিড় থেকে সরে নির্জনে, একটু একা, অনেক কিছু ভাবার আছে তার। অনেক কিছু।
কয়েকদিনেই পরিবেশটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। শোকপর্ব স্তিমিত। সবাই স্বাভাবিক। ভিড় থেমে গেছে। থেমে গেছে গুঞ্জন। একটা পরিবর্তনের বাতাস এসে স্পর্শ করছে মাতিয়া বানুকে। সংসারের হাল তার হাতে আর নেই। হাল কী করে বদল হলো তিনি বুঝতে পারছেন না।
তিনি আগেও খুব হিসেবি সংসারী ছিলেন না। তবু অদৃশ্যভাবে হাল তার হাতেই ছিলো।
ফজলুল হক সাহেবের প্রস্থানে তিনি হালহীন নাবিক হয়ে গেলেন।
সেদিন গোসলের পর বাথরুমে গিয়ে দেখেন তার কাপড় ভেজানো। রহিমার মা অন্য দিনের মতো
তার কাপড় ধুয়ে দেয়নি। তিনি জিজ্ঞেস করলে রহিমার মা জানায়, তার মনে ছিল না। এরকম ভুলমাঝে মাঝেই হতে থাকে রহিমার মায়ের। ভুল হতে থাকে তার ছেলের বউয়েরও। সেদিন পুডিং বানিয়ে সকলে খেলেও তার কথা কারও মনে ছিল না। মাতিয়া বানু ক্রমশ হারাতে লাগলেন। চলে যেতে লাগলেন সকলের অগোচরে। যেমন করে শ্যাওলা জমে ঘাট আড়াল হয়, যেমন করে লতা-গুল্ম ঢেকে দেয় পুরোনো স্থাপত্য— তেমনি আড়াল হতে লাগলেন মাতিয়া বানু।

তিন

ইদানিং একটা ব্যাপার ঘটছে। ছেলের শাশুড়ী এই শোকের বাড়িতে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন, শোক কেটে গেলেও তিনি রয়ে গেলেন। অস্থায়ী শোক তাকে স্থায়ী করে দিল। এই ভদ্র মহিলা তার মুখের সামনে কারণে-অকারণে এসে বসে থাকছেন। মাতিয়া বানু অস্বস্তিতে ভুগছেন, ভীষণ অস্বস্তি। নিজ বাড়িতেই নিজেকে কেমন বন্দি মনে হচ্ছে। তার একটু নির্জনতা প্রয়োজন। একটু একা থাকার, একটু ভাবার প্রয়োজন। জীবনের একটা অধ্যায় থেমে গেছে। ভাবতে চান তিনি। অনেক কিছু।
বিকেলের দিকে মাতিয়া বানু গোসলের পর আলমারি থেকে ন্যাপথ্যালিনের গন্ধযুক্ত কলাপাতা রঙের একখানা শাড়ি বের করে পরলেন। ফজলুল হক সাহেব কিনে দিয়েছিলেন অনেক আগে।
ছেলের শাশুড়ী চমকে উঠে বলে—
—এ আপনি কী পরেছেন আপা? চল্লিশ দিন পার হয় নাই। আপনি পরবেন সাদা থান। আর চল্লিশ দিন পার হলেও আপনার তো রঙিন কিছু পরা নিষেধ, উনি তো আর নাই!
ফজলুল হক সাহেব নিজে গেলেন, যাবার সময় মাতিয়া বানুর জীবনের রঙটুকুও নিয়ে গেলেন।
নাহ! বেঁচে থাকতে তিনি কখনও বাড়তি রঙ ধরাননি মাতিয়া বানুর জীবনে। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল মাতিয়া বানুর। ফজলুল হক সাহেব স্বল্পভাষী, হিসেবি। মাতিয়া বানুর কোমল মনের নরম উদ্যানে কখনও জল ঢালতে যাননি তিনি। জলের অভাবে সে উদ্যানের গাছগুলো যায় শুকিয়ে, ফুলগুলো যায় ঝরে। এক শূন্য বিরাণভ‚মি হয়ে ফজলুল হক সাহেবের পাশে পাশে
হেঁটেছেন মাতিয়া বানু। পরপর তিনটি ছেলেমেয়ের জন্ম হয়েছে, তাদের বড় করেছেন। কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন তিনি ফজলুল হক সাহেবকে, সারা জীবনে তা আর বলা হয়ে ওঠেনি।
দুইদিন পর সন্ধ্যায় ছেলের বউ দু’খানা শাড়ি নিয়ে এলো। রঙহীন— সাদা আর অফ হোয়াইট।
সাদা রঙ কোনদিনই ভাল লাগেনি তার। কোথায় যেন তার মনের কোণে একটু হলেও রঙের ঘুড়ি ওড়ে, রঙধনুরা আঁকে জলছাপ। মাতিয়া বানুর হঠাৎ অস্বস্তি হতে লাগলো। তার মনে হলো চারপাশের সবকিছু কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে, তিনি যেন বন্দি হয়ে যাচ্ছেন— কারা যেন
তাকে বন্দি করে ফেলছে। আটকে দিচ্ছে এক অন্ধকার আলোহীন প্রকোষ্ঠে।

চার

হঠাৎ করেই হামিদা এলো। দুইবোন তারা— মাতিয়া ও হামিদা। সারা ঘর মাতিয়ে রাখতেন বলে ছোটবেলায় নানা আদর করে নাম রেখেছিলেন মাতিয়া। শৈশব কিংবা কৈশোরে হামিদা মাতিয়ার থেকে বুদ্ধিতে খানিকটা এগিয়ে থাকতো, তবে সৌন্দর্যে মাতিয়া এক ও অতুলনীয়।
—বুবু চল্লিশ দিন পার হইছে। আমার সাথে চলো, আমার বাড়ি কয়দিন বেড়াও। মনটা একটু হালকা করো।
হামিদার কথা শুনে ছেলে বললো—
—না, মা এই সময়ে কেন যাবে? মা না থাকলে বাড়ি খালি খালি লাগবে!
হামিদা বললেন—
—সারাজীবন তো আছেই তোর সাথে, এই সময়ে একটু পরিবর্তন দরকার, একটু হাওয়া বদলানো দরকার, বুকটা একটু হালকা করা দরকার।
বুকটা আসলেই ভার কিনা, কতটুকু ভার, তাও বুঝে উঠতে পারছেন না মাতিয়া বানু। শেষের কয়েক বছর অসুস্থ ফজলুল হক সাহেবের সেবা করেই দিন-রাত পার করেছেন। আর এখন নিজ বাড়িতেই যেন বন্দি তিনি। মাতিয়া বানুর মনে হলো, তিনি ভীষণ ক্লান্ত-অবসন্ন। সত্যিই তার হাওয়া বদল দরকার। মুক্তির হাওয়া। অনেক দিন পর মাতিয়া বানু মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলেন। পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাবার শব্দ।

হামিদার বাড়ি গোছানো— ঝকঝকে। স্বামী, সংসার, ছেলে, ছেলের বউ সবকিছুর চাবি হামিদার হাতে। বুদ্ধিমতী চৌকষ হামিদা টিভির রিমোট হাতে রাখার মত সংসারের রিমোট রেখেছে নিজ হাতে। যখন খুশি ভলিউম বাড়ায়-কমায়, চ্যানেল অদল-বদল করে। সব নিয়ন্ত্রণ তার হাতে।
প্রথম কয়েকদিন মাতিয়া বানু ভাবলেন। শুধুই ভাবতে লাগলেন। নিজের কথা, শৈশবের কথা, জীবনের কথা। শৈশবে দুটো বেণী করে ছুটতেন, পাড়া মাতিয়ে রাখতেন। বাড়ির সকলের কত আদরের ছিলেন। স্কুলে থাকতেই বিয়ে হয়, বয়সে বেশ বড় স্বল্পভাষী ফজলুল হক হঠাৎ যেন শিকলএনে বেঁধে দিলেন তার পায়ে, গন্ডী হলো সীমাবদ্ধ— মাতিয়া বানুর চলা নিষেধ, বলা নিষেধ, হাসা নিষেধ। কান্নায় নিষেধ ছিল না। তবে মাতিয়া বানু কাঁদেননি। সারাজীবন তার চোখে জলের বড়ই অভাব।

পাঁচ

ঠিকরে পড়ছে আলো। চাঁদের আলো। ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেছে মাতিয়া বানুর। হামিদার বাড়ি একতলা এল শেপ ডিজাইন। বাম পাশের কোনায় একটি রুমে বিছানায় শুয়ে আছেন মাতিয়া বানু। চাঁদের আলোয় সারা ঘর মাখামাখি। মাতিয়া বানু হারিয়ে গেলেন— স্মৃতির খেয়ায় ভেসে ভেসে পৌঁছে গেলেন অনেকবছর আগের এক রাতে।
নানা-নানীর সাথে বেড়াতে গিয়েছিলেন খালার বাড়ি। সেখান থেকে ফিরছিলেন। ট্রেনে করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। স্টেশন থেকে খানিক হেঁটে নদী পার হতে হয় নৌকায়। সে নৌকাতেই দেখা— তখন রাত, গলুইয়ের কাছে মাঝির পাশেই বসে ছিল সে। কুড়ি বছরের তরুণ। আর মাতিয়া বানু পনেরো বছরের কিশোরী। সে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে ছিল মাতিয়া বানুর দিকে। মোমের মত গলে গলে পড়ছিল চাঁদের আলো। নদীতে, নৌকায়, মাতিয়া বানুর মুখে, তার মুখে। সে অপার্থিব চাঁদের আলোর মুখোমুখি হতে হতে মাতিয়া বানু আবিষ্কার করলেন ভিন্ন কিছু— মুগ্ধতা— দুটি চোখের অপলক মুগ্ধতা। নৌকা ঘাটে ভেড়ে। যাত্রীরা নামে। আরও খানিকটা পথ হেঁটে গিয়ে পৌঁছাতে হবে তাদের গ্রামে। যে পথে তারা হেঁটে এসেছেন সে পথে সেও হেঁটে এসেছিলো পাশাপাশি— নির্বাক অথচ মনে হচ্ছিল
তাদের যেন কেউ পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে নিরাপদে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিলো
মাতিয়া বানুর। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাবার অনুভূতি। সেদিন রাতে ফিরে এসে আরক্তিম আড়ষ্ট মাতিয়ার তার কথা মনে পড়েছে বারবার। তার পরই দেখা হয় তার সাথে— তার সই সাজেদাদের বাড়িতে। বেড়াতে এসেছে শহর থেকে, সাজেদার খালাতো ভাই। কথা হয়নি, শুধু দুই একবারসাজেদাদের বাড়ির উঠোনে দেখা হলে মাতিয়া বানু চোখ নামিয়ে ভেতরের বাড়িতে পা রেখেছেন আর অনুভব করেছেন একজোড়া মুগ্ধ চোখ অপলক চেয়ে আছে তার দিকে। সেই একজোড়া চোখের মুগ্ধ দৃষ্টিতে অল্প কয়েকদিন ঘুরপাক খেতে খেতেই মাতিয়া বানুকে বসতে হলো বিয়ের পিঁড়িতে— ফজলুল হক সাহেবের সাথে। ফজলুল হক সাহেব কখনও মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকাননি, চাঁদের আলোয় মাতিয়া বানুও আর কোনদিন হননি আরক্তিম, আড়ষ্ট।
আস্তে করে দরজা ঠেলে কেউ নিঃশব্দে ঘরে ঢোকে। সোমা, হামিদার ছেলের বউ। খুব যত্ন করে মশার কয়েল জ্বেলে দিয়ে যায়। মেয়েটিকে খুব ভাল লাগে মাতিয়া বানুর। বেশ নরম মনের উদাসী মেয়ে, অনেকটা তার মতোই। মেয়েটি যেন হালকা ফড়িং, উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় ফুলে ফুলে পাতায় পাতায়, তারপর হঠাৎ ডানা ভেঙে পড়ে যায় ঘাসের বুকে। হামিদা সবসময় কেমন যেন তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় সোমার দিকে। সোমার অস্তিত্ব যেন বিলীন করে দিতে চায়। হয়তো নিজেই অস্তিত্ব সংকটে ভোগে তাই।
হামিদা বেশ যত্ন করছে মাতিয়া বানুকে। সেদিন বিকেলে মাতিয়া বানুর রুমে একঝুড়ি ফল রেখে বলল—
—বুবু, সারাজীবন সংসারের ঘানি টানছো, এবার নিজের দিকে খেয়াল করো, যত্ন নাও নিজের।
মাতিয়া বানুর যত্ন নিতে নিতে হামিদা বানু খুব যেত্নর সাথে একখানা ঘিয়ে রঙের মোটা দাগের কাগজ এগিয়ে দেয়। দলিল। শীতলাখোলা মাঠের একটা জমির দলিল। পৈতৃক সূত্রে হামিদার সাথে মাতিয়াও জমিটার অংশীদার। অস¦স্তিতে পড়েন মাতিয়া বানু। যদিও তিনি অত হিসেবি নন, তবুও। হামিদা খুব মুষড়ে পড়ে যেন— কী কী কারণে জমিটা বিক্রি করা
প্রয়োজন, টাকা পেলেই মাতিয়া বানুর প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেবেন, এই মুহূর্তে নগদ টাকা ভীষণ প্রয়োজন, জমি বিক্রির টাকা তিনমাসের মধ্যেই মাতিয়াকে বুঝিয়ে দেবেন।
মাতিয়া বানুর অস্বস্তি বাড়তে থাকে।
অবশেষে অস্বস্তিতে, অনিচ্ছায় অথচ চক্ষুলজ্জায় মাতিয়া বানু দলিলে স্বাক্ষর করে দিলেন।
কৃতজ্ঞতায় চোখের জলে ভেসে যায় হামিদা।
পরিবর্তনের বাতাস লেগেছে হামিদার গায়ে। মাতিয়া বানুর যত্ন করলেও মনোযোগ বেশ কমে গেছে। রুমে এসে ফলের ঝুড়ি রেখে যায় না। আগের মত কাছে এসে মন খুলে কথা বলে না। তবে একজন বলে সোমা। মন খুলে কথা বলে। খুব আপন হয়ে গেছে সে মাতিয়া বানুর।
সেদিন বিকেলে হামিদা হঠাৎ মাতিয়া বানুকে বলে—
—বুবু, অত আহ্লাদ দিও না।
মাতিয়া বানু অবাক হন।
—কাকে? কিসের আহ্লাদ?
—কাকে আবার, আমার ছেলে যাকে ধরে আনছে পাগল হয়ে, কী দেখে পাগল হইছিলো কে জানে? এ মেয়ের বাপের বাড়ি তেমন কিছু নাই, অথচ ওর বাবার পরিচিত এক বন্ধু একটা প্রস্তাব নিয়ে আসছিলো, সেই মেয়ের বাপ খুব ধনী। আমার ছেলে তো বুঝলো না— হাদা একটা।
মাতিয়া বানু কিছু বললেন না, তবে হামিদার সামনে সোমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে আর পারেন না, অস্বস্তি হয়। সেদিন হামিদা বাড়ি ছিল না। সোমা রান্না করছিলো, মাতিয়া বানু তাকে একটি রান্না শিখিয়ে দেন। কলাপাতায় মুড়ে ডিমের এক বিশেষ ব্যঞ্জন, খুব স্বাদের—
সোমা খুব খুশী হয়। হঠাৎ হামিদা ফিরে এসে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে—
—সোমা রান্না ঘর এলোমেলো করে ফেলেছে, কোন সাহসে সে তার রান্না ঘরে ঢুকলো?
কী প্রমাণ করতে চায় সে? সে হামিদার থেকে ভাল রান্না শিখেছে? রান্না দিয়ে স্বামী- শ্বশুরের মন জয় করবে? হামিদাকে টেক্কা দিতে চায়?
মাতিয়া বানুর খুব খারাপ লাগে। এগিয়ে এসে বলেন—
—মেয়েটা ভাল বুঝে সবার জন্য রান্না করলো, এভাবে বলছিস কেন?
হামিদা জ্বলজ্বলে চোখে তাকায় মাতিয়া বানুর দিকে।
—এইসব আহ্লাদ নিজের সংসারে গিয়ে করো বুবু। আমার সংসারে না।
মাতিয়া বানু হতভম্ব হয়ে যান। কেমন এক অনুভুতি হতে থাকে তার। সারারাত ঘুম আসে না। ভোরের দিকে পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পান।
—ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। চোখ বুজে গভীরভাবে সেই শব্দ শোনার চেষ্টা করেন মাতিয়া বানু। খুব ছোটবেলায় গিয়েছিলেন বাবার সাথে পাখি দেখতে, অতিথি পাখি। বাড়ির কাছেই এক বিলে বসেছিলো অতিথি পাখির মেলা। পড়ন্ত বিকেলে সারি সারি
হলুদ সরিষা ক্ষেত পেরিয়ে তারা যতই এগিয়ে যাচ্ছিলেন বিলের দিকে, পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ ততই স্পষ্ট হচ্ছিলো। তার স্কুলশিক্ষক বাবা তার ছোট্ট হাত মুঠোয় রেখে বলছিলেন,
—বুঝলে মাতু, ওরা আমাদের অতিথি, ওরা পরিযায়ী।
মাতিয়া বানু বারবার ফিরে যাচ্ছেন শৈশবে, ফেলে আসা দিনে। সারারাত জেগে তিনি স্মৃতির পথ বেয়ে হেঁটে বেড়ালেন। সকালবেলা হতভম্ব মাতিয়াকে বিস্মিত করে দিয়ে হামিদা বলে,
—বুবু, চলো তোমারে রেখে আসি।

ছয়

হতভম্ব, সংকুচিত, বিহ্বল মাতিয়া বানু ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকেই কেমন অস্বস্তিতে পড়েন মাতিয়া বানু। সংসারের হাল একেবারেই বদলে গেছে। সবকিছু কেমন অচেনা, অপরিচিত লাগছে। নিজেকেই অতিথি মনে হচ্ছে। তার অনুপস্থিতিতে তার ঘরে ছেলের শাশুড়ী ঢুকেছে। তার উপস্থিতির পরও তিনি অদৃশ্য হলেন না, আঠার মত লেগে রইলেন তার সাথে— এক বিছানায় তার সাথে ঘুমাচ্ছেন, একসাথে খাচ্ছেন। মাতিয়া বানুর অস্বস্তি হচ্ছে, ভীষণ অস্বস্তি। একটু নির্জনতা চাই তার, একটু নির্জন অবসর— নিজের
মত করে।
সেদিন রাতে খাবার টেবিলে ছেলে তার সাথে খুব রেগে গেলো—
—তুমি কেন খালার কথায় সাইন করতে গেলা আম্মা? খবর পৌঁছে গেছে ছেলের কানে।
জানো ঐ জমির দাম কত? তিন মাসের মধ্যেই টাকা দিবে এমন কোনো কথা আছে? তুমি যে এত বোকা— তোমার নামে সম্পত্তি থাকা তো বিপদ!
মাতিয়া বানু চুপ হয়ে যান। সংসারের শতরঞ্চির খেলায় তিনি বড় আনাড়ি। বয়স ষাটের ঘরে অথচ শতরঞ্চির ষোলো দানও শিখে উঠতে পারেননি। জমি-জমা ফজলুল হক সাহেব নিজের নামে করে গেছেন, ব্যাংকের পয়সাও ফজলুল হক সাহেবের চিকিৎসাতেই চলে গেছে সব। ছেলে খুব গম্ভীর হয়ে যায়। সংকুচিত হন মাতিয়া বানু, কেমন একধরনের সংকোচ এসে যায় তার। সবকিছু বদলে যাচ্ছে। সব। ছেলে আগের মত মন খুলে কথা বলে না। ছেলের বউ সবসময় গম্ভীরথাকে। রহিমার মা’কে ডাকলে উত্তর দিতে ভুলে যায়। শুধু নাতি আসে, দৌড়ে দৌড়ে আসে, ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কোলে। আর একজন আসে, ছায়ার মত পেছনে পেছনে লেগে থাকে। ছেলের শাশুড়ী। যেন পাহারা দিচ্ছে মাতিয়া বানুকে। তার পাশেই থাকে, একসাথে খায়, একসাথে
ঘুমায়— অস্বস্তি হয় মাতিয়া বানুর, ভীষণ অস্বস্তি। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে দূরে। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নিতে ইচ্ছে করে শ্বাস, শুনতে ইচ্ছে করে শব্দ, পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
আলোচনা হচ্ছে, ছেলে-মেয়েদের আলোচনা। ফোনে ফোনে আলোচনা। বাড়ি ভাঙা হবে।
ভেঙে হবে বহুতল ভবন। ছেলে কতটুকু পাবে, মেয়ে কতটুকু পাবে, তিনি কার মধ্যে থাকবেন— সেই আলোচনায় বাতাস গরম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিনি কোথায় থাকবেন সে সিদ্ধান্ত ছেলে-মেয়েরাই নিচ্ছে। তার সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন কেউ মনে করছে না। মেয়েরা তাদের অংশ বিক্রি করবে। মাতিয়া বানু আবার অস্বস্তিতে ভুগছেন। দমবন্ধ লাগছে তার। সংসারের
সব জায়গায় কেমন অতিথির মত— ক্ষণিকের অতিথি। নিজের যেন কিছুই নেই।
সেদিন সন্ধ্যায় একটা কাণ্ড ঘটে গেল। মাতিয়া বানু নাতির সাথে ড্রয়িংরুমে ছিলেন, তার থাকা নিয়ে ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে বন্ধঘরে এক তুমুল ঝগড়া বেধে গেল। ছেলের বউ বলছে, “মাতিয়া বানুর মেয়েরা তাদের অংশ বিক্রি করে যে টাকা পাবে তা থেকে একটা অংশ কেন তাদের দিচ্ছে না, কেননা সারাজীবন মাতিয়া বানুকে তো তাদেরই টানতে হবে। উত্তরে
ছেলে বলছে, “তোমার মা যে এসে মাসের পর মাস খাচ্ছেন আমার বাড়ি, সেই খরচ কি তোমার ভাইরা দিচ্ছে নাকি?” চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে ছেলের বউ।
—আমার মায়ের থাকা নিয়ে খোটা?
বন্ধ দরজার ভেতর থেকে ভাংচুরের আওয়াজ ভেসে আসে। মাতিয়াবানু উঠে দাঁড়ান, নিঃশব্দে এসে ঢোকেন নিজের রুমে। রুমে ঢুকেই ভীষণ নাড়া খান তিনি, একজন কাঁদছে, নীরবে—
ছেলের শাশুড়ী। ধীরে ধীরে মাতিয়া বানুর দিকে তাকিয়ে বলেন—
—দেখছেন আপা, সংসারে আমাদের নিজেদের কিছুই নাই, আমরা কেমন অতিথির মতো!
সংকুচিত, হতবিহ্বল ছেলের শাশুড়ীর জন্য এই প্রথম মাতিয়া বানুর মায়া লাগতে শুরু করলো।

সাত

কোনও রকম আয়োজন ছাড়াই বেশ নীরবে বাড়ি ছাড়লেন মাতিয়া বানু। খুব ভোরবেলায়, এক কাপড়ে। গোছাতে গেলে ছেলের শাশুড়ির নজরে পড়তেন। সামান্য পয়সা ছিল কাছে। বাপের বাড়িতে ভাঙা একখানা ঘর আছে। পরিত্যক্ত। বহুদিন কেউ যায় না। লতাগুল্মে ঢেকে গেছে— শ্যাওলা জমেছে এখানে-ওখানে। আড়াল হতে চলেছে ঘরখানা। তিনি যাবেন। সব পরিষ্কার করবেন। দেবেন নতুন এক চেহারা। করবেন আবাদ। নতুন আবাদ। তৈরি করবেন নিজের জায়গা।
সম্পূর্ণ নিজের।
ট্রেন থেকে নেমে ভ্যানে উঠেছেন মাতিয়া বানু। বেশ মিষ্টি এক সকাল। পথের দু’পাশে খোলা মাঠ। ভ্যান এগিয়ে চলেছে। ঝিরঝিরে মিষ্টি এক বাতাস এসে লাগছে গায়ে ।
মাতিয়া বানু অনেক দিন পর বুক ভরে শ্বাস নেন। আর একটু এগোতেই তিনি শব্দ শুনতে পান— খুব চেনা এক শব্দ। পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ভ্যানওয়ালার কাছে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, খুব কাছেই চাপাই বিল। সেখানে এসেছে অতিথি পাখি— শত শত অতিথি
পাখি। মাতিয়া বানু চাপাই বিলের দিকে ভ্যান এগিয়ে নিতে বলেন। এগিয়ে চলেছে ভ্যান। এগিয়ে চলেছেন মাতিয়া বানু। শুনছেন শব্দ। শত শত পাখির ডানা
ঝাপটানোর শব্দ…।

One thought on “ঈদসংখ্যার গল্প।। পরিযায়ী।। কানিজ পারিজাত

  • এপ্রিল ২৬, ২০২৩ at ১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    সত্যিই অসাধারণ মনোমুগ্ধকর একটি গল্প। শব্দ গঠন, বাক্য চয়ন, বিষয় ভাবনা, গল্পের ভাব-ভাষা, টার্নিং, একাকীত্ব, মনোবাসনা, মনোসংযোগ এক কথায় অসাধারণ। অনেক দিন পর অসম্ভব সুন্দর একটি গল্প পড়লাম।
    কবি ও গল্পকার কানিজ পারিজাত আপার কাছে এমন মনোলোকে ঢেউতোলা আরও গল্প চাই।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *