ছোটগল্প।।রক্তজলে ভেজা মাটি।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

দুপুর থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ খন্ডগুলো জমাট বেঁধে সকালের উজ্জ্বল নীলিমা বদলিয়ে
ছাই রঙা করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি—আলস্যে মানুষেরা ঘরবন্দি হয়। ঘরে বসে
কেউ কেউ ষোলগুটি কেউ কেউ দল বেঁধে বাঘবন্দি খেলায় মেতে ওঠে। হাইড আউটে থাকা
মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিতে থাকে রাতের অপারেশনের—বর্ষণমুখর অন্ধকার রাতেই
মৃত্যুভয়হীন অকুতোভয় যোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় পাক হায়েনাদের ঘায়েল করা কাজটি
বেশ সহজ। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর তন্দ্রায় ঢুলে কেউ কেউ, কেউ কেউ ঘুমোয়। রাতের
অপারেশনের প্রস্তুতি—যুদ্ধের জন্য শরীর ও মন চাঙ্গা রাখা জরুরি প্রয়োজন।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির চেয়ে প্রবল বর্ষণের প্রত্যাশায় বুক বাঁধে বিজনপুর গ্রামে হাইড আউটে
থাকা বিশজন মুক্তিসেনা।
সন্ধ্যায় আকাশের মেঘগুলো আরও নিবিড় হতে থাকে, ঘনীভূত থাকে। দক্ষিণের দূরের
আকাশ থেকেও বাতাসে ভেসে আসে আরও কালো মেঘ। জমতে থাকে ধীরে ধীরে নিবিড়
বন্ধনে।

খড়ের গোচালায় বসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে শাহেদের চোখ দুটি স্বপ্নময়
হয়ে উঠতে থাকে। এই সময় সামনে এসে দাঁড়ায় তাসলিমা। হালকা বৃষ্টিতে জামাকাপড়
ভিজা।
মেয়েটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শাহেদ।
তুমি কী দেখছো এমন করে?
দেখছি তোমাকে?
আমাকে কী দেখছো?
তুমি খুব মিষ্টি একটি মেয়ে। খুব মিষ্টি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, তাই। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি খুব ভালো। খু… উ… ব।
খুব ভালোবাসো?
হ্যাঁ খুব।
আজকে কি তোমরা যুদ্ধে যাবে?
কেন বলো তো?
এই যে, অস্ত্র পরিষ্কার করছো। অস্ত্র সাজাচ্ছো, তাই বললাম।
হ্যাঁ। আজকে আমরা যুদ্ধে যাব। রাতেই পাকিদের ক্যাম্প আক্রমণ করব।
এই এলাকাটা বিজয় করতে হবে।
আচ্ছা, তোমরা এই এলাকাটা বিজয় করে কি চলে যাবে?
হ্যাঁ। চলে যাব। অন্য জায়গা জয় করতে হবে।
না, যাবে না। কোথাও যাবে না। এখানেই তুমি ফিরে আসবে। এখানেই তোমাকেই ফিরে
আসতে হবে।
বারে, তাহলে যুদ্ধ করবে কে? দেশ স্বাধীন করতে হবে না?
করতে তো হবেই? কিন্তু এখান থেকে যুদ্ধ করবে। তুমি কোথাও যাবে না।
তাসলিমা শাহেদকে জড়িয়ে ধরে। বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। শাহেদ

তাসলিমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। রেশমের মতো নরোম চুলে বিলি কাটে।
তারপর চুমো খেয়ে বলে, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছো তাহলে এখানেই থেকে যাব।
এই সময় কমান্ডারে ডাক শোনা যায়, শাহেদ, শাহেদ।
শাহেদ তাসলিমাকে বলল, তুমি এখন যাও। কমান্ডার ভাই ডাকছে। তাসলিমা দৌড়ে ঘর
থেকে বের হয়ে যায়। তার চোখের নিচে পানির দাগ রয়ে গেছে।

মুক্তিসেনার এই দলটির কমান্ডার সাত্তার। শাহেদ সাত্তারের কাছে গিয়ে বসে। সাত্তার
বলল, সন্ধ্যার পরই আমরা রওনা হয়ে যাব। সবাইকে বলে দাও। কাদের ভাইকে
বলেছি, তিনি সন্ধ্যার পরই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবেন। আজকের
অপারেশনটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শাহেদ সবাইকে ফলইন হতে বলে। সাত্তার সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধকৌশল বর্ণনা করে
আর শাহেদ তার পাশে। সাত্তারের কথায় উজ্জীবিত তরুণ যোদ্ধাদের শিরা-উপশিরায়
প্রেরণার রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। চোখেমুখে বিজয়ের আনন্দ চলকে পড়ছে। স্বাধীনতার
কাছে মৃত্যু অতি তুচ্ছ, পারে তো এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আকাশ ভেঙে মুষলধারায় বৃষ্টি নামে। মুক্তিযোদ্ধারা সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ছুটে চলে পাঁচ
মাইল দূরের ক্যাম্পের দিকে। তিন ভাগে ভাগ হয়ে ছুটে তারা।
ভাগলপুর ক্যাম্পে তিন দিক থেকে মুক্তিসেনারা আক্রমণ চালায়। সুজন আর বিমলকে
নিয়ে শাহেদ ক্রলিং করতে করতে চলে নদীর পাড়ের ঝোপের আড়ালে। এখনও বৃষ্টি
পড়ছে। শরীর জলকাদায় ভিজে একাকার। শাহেদ বলল, বিমল তুই গ্রেনেড চার্জ কর।
বিমল গ্রেনেড চার্জ করতেই তিন দিক থেকে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। বিমল আর
সুজন বেশ উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে চলে আরও সামনের দিকে। শাহেদ ঝোপের আড়াল
থেকেই অবিরাম ব্রায় ফায়ার করতে থাকে। ক্যাম্প থেকেও নানা রকম অস্ত্র থেকে গুলি
ছুড়ছে পাকসেনারা। কানফাটা শব্দে শব্দে প্রকম্পিত চারপাশ। আশপাশের গ্রামের
মানুষেরা প্রাণ ভয়ে গ্রাম ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। পাকসেনারা
মর্টার সেল ছুঁড়ছে।
হঠাৎ একটি মর্টারের সেল এসে শাহেদের বুকের বাম পাশে বিদ্ধ হয়। তীব্র বেগে
রক্তপাত শুরু হয়। শাহেদ আরও কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে অবসাদে আক্রান্ত হয়ে
আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে যেতে থাকে। তার চোখের তারা ধীরে ধীরে নিস্প্রভ হতে শুরু
করে।
তুমুল বর্ষণ কমে আসে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে একসময় দেখা যায় এক ফালি চাঁদ আর
দূরে, অন্তহীন দূরে মৃদু কম্পমান নক্ষত্রের আলো মিটমিট করে। নদীর ওপারে
গ্রামগুলো আবছা চোখে পড়ে শাহেদের। সে বুঝতে পারে তার সময় শেষ হয়ে
এসেছে। হাতপা ক্রমে অসাড় হয়ে আসে। আর একটি গুলিও ছুড়তে পারছে না।
নদীর ভাঙা পাড়টা খাড়া ও উঁচু, ঢালু হয়ে নদীতে মিশেছে,
একহাতে এলএমজিটি ধরে কোনো মতে সামান্য শক্তি সঞ্চয় করে যদি ফিরে যেতে
পারত এমন আশা-নিরাশার মাঝখানে তার চোখে আরও অন্ধকার নিবিড় ও প্রগাঢ় হয়;
দুপক্ষের গোলাগুলি থামেনি।
শাহেদ আস্তে আস্তে চোখের পাতা খুলে দেখে আকাশের চাঁদ, আবছা জোছনা, অসাড়
চোখে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, এই জোছনা আর দেখা হবে না।
চাঁদের নরম আলোয়, ঝিরঝির বাতাস, হিমের পরশে বেদনাকাতর শরীরেও অনুভব করে
শান্তির পরশ, নদীর ছলছল আওয়াজ মুখর হয়ে উঠতেই অর্ধমুদিত চোখ মেলে একটু
তাকাবার চেষ্টা করে দেখে‒নদী প্রবাহমান। আজ জীবনের শেষ মুহূর্তে রাতজাগা
পাখিদের দুর্বোধ্য ভাষা কানে আসে। শাহেদ একটু নড়েচড়ে বসতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
সে অনুভব করে পায়ের কাছে থেকে মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসছে। বুকের রক্ত নদীর
ঢালু বেয়ে মিশে যাচ্ছে নদীর প্রবাহমান পানিতে।

কোথায় যাবে এই শোণিতের ধারা। নদী থেকে নদীতে। তারপর সাগরে মিশে যাবে এই
আবছা জোছনামাখা রাতে?
কিছুক্ষণ পর সে ধীরে ধীরে ডান হাতটা নাড়াতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আধফালি চাঁদের
জোছনায় ও সীমাহীন আকাশের নিচে, রাত্রির ঘোরে আচ্ছন্নতায় ঢেকে যায় তার দেহ
যেমন ঠিক মনও; প্রায় অনুভূতিহীন নিস্তরঙ্গ অসাড় নিস্পন্দ দেহটি সে পড়ে থাকে
নদীর ঢালুতে, এখানে আর কেউ নেই, সতীর্থরা যুদ্ধে লিপ্ত‒তারা হয়তো জানেও না
শাহেদ নদীর ঢালুতে বিলিয়ে দিচ্ছে বুকের টাটকা রক্ত, ভিজিয়ে দিচ্ছে মাটি, জলের
প্রবাহকে করছে গতিশীল। ধীরে ধীরে গভীর অন্তিম ঘুমে আচ্ছন্ন হতে থাকে, এই ঘুম
থেকে সে আর কখনও জাগবে না।
চাঁদের আলো আরও ক্ষীণ হয়ে আসে, আকাশ ভরে যায় নক্ষত্ররাজিতে, শাহেদ চোখ
মেলে তাকায়, আর ভাবে, তাসলিমার কথা। চার বছরের একমাত্র কন্যা যাকে বলেছিল
দেশ স্বাধীন করে ফিরবে।

যেদিন এক বর্ষণমুখর বিকেলে কাদের ভাইয়ের বাড়িতে ওরা হাইড আউটে এসেছিল সেদিন
কাদের ভাইয়ের কোলে বসেছিল ফুটফুটে মিষ্টি একটি মেয়ে। শাহেদ বলেছিল, কী নাম তোমার?
তাসলিমা।
বাহ। আমারও একটি মেয়ে আছে। তার নামও তাসলিমা। তুমি আমার কোলে আসবে?
হাত বাড়িয়ে কোলে এসেছিল সেদিন। মেয়েকে দেখার অনেক দিনের তৃষ্ণাকাতর তপ্ত বুকে
যেন শান্তির ঢল নামে। তাসলিমা হাত নেড়ে নেড়ে বলেছিল, তোমার মেয়ের নামও তাসলিমা?
হ্যাঁ। আমার মেয়ের নামও তাসলিমা।
তোমার মেয়ে আমার মতো পাকনা পাকনা কথা বলতে পারে? হি হি হি।
তোমার মতই পাকনা পাকনা কথা বলতে পারে।
আমার মতো পুতুল খেলতে পারে?
হ্যাঁ। খেলতে পারে।
আমি তোমাকে কী ডাকব?
তুমি আমাকে চাচ্চু ডাকবে।
দুজনের কথা শুনে কমান্ডার আর কাদের ভাই খুব হেসেছিল। সেই হাসি, সেই তাসলিমার কথা
বাতাসে তরঙ্গিত হয়ে শাহেদের কানে বাজতে থাকে। কত সুন্দর কত পবিত্র ওদের ডাক আর
মিষ্টি হাসি।
শাহেদের চোখের পাতা ভারী হয়ে মিশে যায়, শরীরের সমস্ত পেশি অসাড় হয়ে আসে, মস্তিস্কে
রক্ত সঞ্চালন করার মতো রক্ত ধমনীতে আর নেই। ধীরে ধীরে নদীতে পানির বান শুরু হয়ে,
তরঙ্গে তরঙ্গে মিশে যায় শাহেদের রক্ত, সারা শরীর অবসাদে ঢাকা পড়ে। বিশাল আকাশের
তলে অর্ধমুদিত চোখে ঝুলন্ত চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে শাহেদ, তবে সে চোখ দেখতে পায়নি
জোছনা। নদীর প্রবল বান এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় শাহেদকে—দূর থেকে দূরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *