গদ্য।। ইউসুফ শরীফের ‘চেনাঅচেনার মাঝখানের মানুষ’।। আবু সাইদ কামাল


শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ইউসুফ শরীফের কিছু গল্পে বিশ্বমানের গাল্পিকদের মতো গভীরতা আঁচ করা যায়। যা বারবার পাঠে আগ্রহী করে। ভাষার প্রসাদগুণ এবং বিষয়ের গভীরতায় তার গল্প অনন্য হয়ে ওঠে। অনেক প্রাবন্ধিকের মতে, তিনি নিজেকে গল্পকারদের গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
‘চেনাঅচেনার মাঝখানের মানুষ’ নামের গল্পগ্রন্থটি অন্তত সে প্রমাণই বহন করে। মোট পনেরটি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ইউসুফ শরীফের ‘চেনাঅচেনার মাঝখানের মানুষ’। এটি তার পঞ্চম গল্পগ্রন্থ। আমাদের চারপাশের মানুষই কখনো চেনা, কখনো অচেনা মানুষ বনে যায়। এমন কি প্রতিটি মানুষের আপন সত্তাটি নিজের কাছে কখনো চেনা, কখনো অচেনা হয়ে ওঠে। ইতিবাচক চেতনায় সত্যাশ্রয়ী মানুষ নিচের কাছে খুব চেনা। কিন্তু কখনো যদি অন্যায়ের সাথে আপস করে, তাহলে তার বিবেকের কাছেই তো অচেনা হয়ে ওঠে।
গল্পগ্রন্থের নাম গল্পটি সূচিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। উত্তম পুরুষের বয়ানে এগোয় গল্পের কাহিনী। গল্পের নায়ক এসেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে। স্ত্রী নাজনীন মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। তবে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য সততা। স্বামীর কাছে কোনো অসঙ্গত টাকা থাকলে জবাবদিহি করতে হয় স্ত্রীর কাছে। যদিও চলমান এ সমাজে এমন গৃহিনী শুধু দুষ্প্রাপ্যই নয়, বিরলও বটে। তার চাকুরে স্বামীর কাছে অফিসে পাঁচশ টাকার চারটে বান্ডেল উৎকোচ হিসেবে রেখে যায় কোনো এক স্বার্থান্বেষী মহল। সততার কারণে এতটাকা কখনো হয়তো বা চোখে দেখেননি। কিন্তু এতগুলো টাকা হাতে পেয়ে তার অতৃপ্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এমন একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে নিজের ভেতরে অবচেতনে পুষে রাখা অতৃপ্তিগুলো মিটানোর জন্য মনের আনন্দে কল্পযোগে চলে যান বিপণী বিতানে। কিন্তু হায়! দোকানে চেনা মানুষগুলোর কাছেই তিনি অচেনা হয়ে যান। অচেনা হন স্বজনদের কাছেও। অফিস শেষেও আত্মমগ্নতায় বেশ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর পিয়নের ডাকে সংবিৎ ফিরে পান। ফেরৎ দেওয়ার জন্য টাকাগুলো আলমারিতে রেখে গল্পের নায়ক বাড়ি ফিরেন। কিন্তু পাঠককুলকে আত্মজিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে যান।
এদেশে শুদ্ধাচার নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের যে কার্যক্রম চলছে, এ গল্পটি তাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে পঠিত হলে- সে কার্যক্রমে বেশ ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে হয়। এছাড়া বাড়বে সমাজ সচেতনতাও। নানাদিক থেকে ইউসুফ শরীফের এ গল্পটি বেশ সময়ানুগ এবং পাঠককূলকে নাড়া দেওয়ার মতো।
গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটির শিরোনাম ‘এইসব আচানক দৃশ্য’। আচানক দৃশ্য দেখে গল্পের প্রধান চরিত্র মালেক। দুবছর যাবৎ সে ঘুমায় না- আসলে ঘুমাতে পারেনা। ঘুমাবে কিভাবে? চোখ বন্ধ করলেই সে অবিশ্বাস্য সব ভয়ঙ্কর বা বীভৎস দৃশ্য দেখতে পায়। যে দৃশ্যগুলো সে দেখে, সেসব ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলোই একের পর এক সমাজে ঘটে যায়। এ সব ঘটনা লেখক এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করেন, যা অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়ারও উপায় থাকেনা।
তার চোখে ভেসে উঠে সামনে সমাজে ঘটতে যাচ্ছে এমন কোনো অন্যায়-অপরাধ বা অসঙ্গতি, এমন কি লোমহর্ষক খুনোখুনিও। আসলে মালেকের চোখে লেখক দেখিয়েছেন সমাজের দৃষ্টি, যে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পায় সে সমাজকে আর এ দেখা শাশ্বত। এখানেই লেখকের শক্তিমত্তার পরিচয়।
জাদুবাস্তবতায় লেখা উপরের এ দুটি গল্প অনন্য। নাম গল্পে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে উপজীব্য করে জাদুবাস্তবতার সফল প্রয়োগ করা হয়েছে। আর প্রথম গল্পটিতে আপাত আধ্যাত্মিক চেতনার চাদরে ঢাকা জাদুবাস্তবতা অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আরও বেশকিছু গল্প রয়েছে জাদুবাস্তবতার আর এ গ্রন্থের সব গল্পই এগিয়েছে চেতনাপ্রবাহ রীতিতে।
তৃতীয় গল্পের শিরোনাম ‘মিছিলের মানুষ’। গল্পটি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে লেখা। গল্পের প্রধান চরিত্র নকিব। গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র সাদুল্লা- পেশায় কবিরাজি ওষুধ বিক্রেতা। ‘মধুপুরের বটিকা’ নামে নিজের তৈরি ভুয়া ওষুধ বিক্রি করে। বুট-কলাইকে সন্দেশ বলে চালাবার এই বটিকা বানায় নিজের আবাসস্থলে। গ্রামের হাটে হাটে লোভনীয় প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়। গ্রামের সহজ-সরল ক্যানভাসের ফাঁকাবুলিতে ভুলিয়ে-ভালিয়ে মানুষের কাছে নকল ওষুধ বিক্রি করে মানুষ ঠকায়। প্রথমে সাদুল্লাহ পরিবার নিয়ে থাকে ঢাকার বস্তিতে। তার সহযোগী হিসাবে নেয় গ্রামের এক সুকণ্ঠ ছেলে নকিবকে।
সাদুল্লাহ তাকে শেখায় চটকদার কথামালা আর মানুষ আকর্ষণ করার
নানা কৌশল। নকিবকে সেসব কৌশল রপ্ত করতে হয়। আর নকিবের মাধ্যমেই সাদুল্লার ব্যবসায় আশাতীত উন্নতি হয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নকিব সাদুল্লার ছয়-সাত বছরের বোবা মেয়ে সকিনাকে বর্ণমালা শিখিয়ে কথা বলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু সকিনা কথা বলতে পারে না। অথচ কথা বলার জন্য মেয়েটির কী আকুতি! মায়ের ভাষায় কথা বলার আকুল প্রয়াস শিশুটির। কথা বলতে না পারার যে যন্ত্রণা তা মর্মস্পর্শী ভাষায় চিত্রিত করা হয়েছে গল্পে। এ জন্যই তা পাঠকের মনকে স্পর্শ করে। প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালি চেতনা যে কতটা তীব্রতর হয়েছিল, তার এক অসাধারণ প্রতীকী ব্যঞ্জনা তৈরি হয়েছে লেখকের ভাষিক শিল্পে। আর সে চেতনা যে একজন মূঢ়কেও জাগিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগঠিত মিছিলে অংশগ্রহণের প্রেরণা দিতে পারে- এই গল্পে তার যথার্থ চিত্র ফুটে উঠেছে। গল্পের প্রেক্ষাপট চিত্রণ, সেই সময়ের পরিবেশ-প্রতিবেশ, কালিক এবং ভাষিক চিত্র অত্যন্ত বিশ্বস্ততা এবং দক্ষতার সাথে শক্তিমান এ কথাসাহিত্যিক অঙ্কন করেছেন। বাংলা সাহিত্যে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত গল্পের মধ্যে ‘মিছিলের মানুষ’ গল্পটি বলতেই হয় এক অসাধারণ সৃষ্টি।
গল্পগ্রন্থটির সূচিক্রম অনুসারে ‘খুন করা যায়না’ গল্পের অবস্থান চতুর্থ। শহরের প্রেক্ষাপটে রচিত গল্পটির আকর্ষণীয় দিক হলো-এর ভাষার উৎকর্ষতা। গল্প-বয়ানে একের পর এক বাক্যের গাঁথুনি-কাঠামোতে মাঝে-মধ্যেই কাব্যিক ব্যাঞ্জনার অলঙ্কারে মনে হয় দ্যুতি ছড়িয়েছে- যেন কবিতার পঙক্তি। কখনো পরাবাস্তবতা, কখনো অসাধারণ চিত্রকল্প গল্পটিকে দিয়েছে বাড়তি শিল্পরস। গল্পপাঠে কখনো কখনো মনে হয়েছে কবিতা পড়ছি। এ থেকেই প্রতীয়মান হয়, ইউসুফ শরীফ গল্পে নিছক কাহিনী বয়ান করেন না, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে দক্ষতার সাথে সংবেদনশীল তলানিটুকুও স্পষ্ট করে তুলতে পারেন। তিনি কেবল কাহিনীর কঙ্কাল নির্মাণ করেন না, তাতে অস্থি-মজ্জা-মাংসের সংযোগ ঘটান অর্থাৎ তাতে প্রতীক, রূপক, বিশেষণ ও মনোগ্রাহী চিত্রকল্প জুড়ে দিয়ে শিল্পসম্মত ও লাবণ্যময় সরস গল্প সৃষ্টি করেন। তার এ গল্পটিতে শহুরে জীবন বাস্তবতার দ্বিমাত্রিক চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। একদিকে শহরের নষ্ট-ভ্রষ্ট ধনিক শ্রেণির ভয়াবহ চারিত্রিক স্খলন-চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি গৃহমালিক কর্তৃক গ্রাম থেকে আনা বিকাশমান কিশোরী গৃহপরিচারিকাকে টানা ক’দিন ধর্ষণের মতো নগ্ন চিত্রও ফুটে উঠেছে শিল্পীতভাবে।
ধর্ষণের শিকার হয়ে জীবনের সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় আলেয়া প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে গৃহমালিককে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে সারারাত ছুরিকাঘাত করলেও খুন করতে পারে না। পুরো বিষয়টি জাদুবাস্তবতায় উত্থাপিত হলেও এ এক নির্মম বাস্তবতা। এমন কত ঘটনাই তো সমাজদেহে ঘটছে। আর মুখ বুঁজে মেনে নিচ্ছে অসহায় আলেয়ারা। এসব নীরব ধর্ষণের ক’টি ঘটনাই বা আলোর মুখ দেখে। এমন গৃহমালিকেরা অর্থ-বিত্ত ও প্রতিপত্তিতে এতটাই প্রভাশালী যে, আলেয়াদের মতো নিরীহ মেয়েরা ওদের কিছুই করতে পারেন। এভাবে লেখক সৃজনধর্মী–সন্ধানী দৃষ্টি মেলে শহুরে সমাজ বাস্তবতার কঠোর জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন।
পাঁচ নম্বর গল্পের নাম ‘এক লাইলীর প্রতিকৃতি’। গল্পের শুরুতেই ‘তেছরা আলোর ত্রিকোণ মানচিত্র অথবা কাফনের কাপড় হেঁটে আসছে হালকা পা ফেলে-’ এ রকম বাক্যের ধীরযাত্রা পাঠকের মনোষোগ আকর্ষণ করে দারুণভাবে। গদ্যের এমন গুণ তাকে সঙ্গীতের মতোই ধ্রুপদী মেজাজে নিয়ে যায় যেন। ধীমান কথাকার ইউসুফ শরীফ তেমনই কিছু কাজ করেছেন এই গল্পে। এক ধর্ষিতা মেয়ের অন্তর্ভেদী কষ্ট আর আক্ষেপ এবং আমাদের পুরুষ-শাসিত সমাজের নিষ্ঠুর চিত্র শিল্পীতভাবে ফুটে উঠেছে। ধর্ষিতা মেয়েটির মনোজাগতিক ভাবনার বয়ান তার চেতনাপ্রবাহে ধরা পড়েছে এ গল্পে।
গল্পটি পড়লে মনে হয়, এ দেশের বা জগতের তাবৎ ধর্ষণের পৈশাচিক ঘটনাগুলো এ গল্পে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সব রকমের ধর্ষণের শাশ্বত এক ভাষিক চিত্র যেন এটি। সমাজ শক্তির বিরুদ্ধে একটি ধর্ষিতা কিশোরীর এমন জোরালো প্রতিবাদ বাংলা সাহিত্যে বিরল। বলা যায়, এই গল্পে বাংলাদেশের ধর্ষণচিত্রের বাস্তব পরিস্থিতিই ফুটে উঠেছে। একদিকে ধর্ষকের শাস্তি না হওয়া, অন্যদিকে পুলিশের বেহায়াপনা, আইনের আশ্রয় না পাওয়া, কিছু অসভ্য ডাক্তারের কুকীর্তি, মামলা তুলে নেয়ার হুমকি, শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকের ছবি তোলা– সব মিলিয়ে ধর্ষিতা যেন বারবার নানা কায়দায় নিপীড়নের শিকার হয়। যেখানে ধষর্ণের ঘটনা ঘটে, সেখানে পরীক্ষা করা, সংবাদ পরিবেশন, মামলা ও শাস্তি কার্যকর-এ সব কিছুতে ধর্ষিতার মান মর্যাদা নিশ্চিতভাবে রক্ষিত হয়, তেমন আইন করে তার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। আমাদের সার্বিক সমাজব্যবস্থার এক গভীরচিত্র উঠে এসেছে এ গল্পে। সমস্ত ধর্ষিতা মেয়ের প্রতিনিধি যেন এই লাইলী। চেতনাপ্রবাহ রীতিতে ধর্ষণের এমন শিল্পসম্মত গল্প খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না।
ছয়. ইউসুফ শরীফের ‘দুর্বিনীত’ শিরোনামের গল্পটি পড়লে মনে হয় এ যেন এই সময়েরই এক বাস্তব সমাজচিত্র। একথা সত্য যে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের ফলে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচারে নানা রকম পরিবর্তন এসেছে। এর প্রভাব পড়েছে সমাজের সর্বস্তরে। প্রযুক্তির অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে এর ইতিবাচক দিকও যেমন আছে, তেমনি রয়েছে নেতিবাচক প্রভাবও।
বিবেচ্য গল্পের নায়িকা রিভু। অভিজাত পরিবারের অবিবাহিতা এক আধুনিক তরুণী। থাকে চাচির কাছে। ব্রোকেন ফ্যামিলির একজন সদস্যও। এসব ছেলে-মেয়ের প্রবল একটা মানসিক সঙ্কট থাকবে-এটাই স্বাভাবিক।
রিভু এক পর্যায়ে ফেসবুকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। চ্যাটিংয়ে বন্ধুত্ব হয় সাবীরের সাথে। লোকটির সাথে তার নিবিড় মনের কথা হয় প্রায় প্রতিদিন। চলমান সমাজের জটিল ও কুটিল সমাজবাস্তবতা থেকে গল্পকারের শিল্পিত লেখনিতে মানুষের কঠিন বাস্তবতা এবং কালের কলস্বর ফুটে উঠবে-এটাই স্বাভাবিক। ওদের প্রথম সাক্ষাতেই আশাহত হয় রিভু। কারণ, সে যে তরুণের স্বপ্ন মনে লালন করেছে, বাস্তবে প্রথম দর্শনেই হয়েছে আশাহত। স্বপ্নে দেখা সুঠামদেহী তরুণের স্থলে দেখা পায় মাঝবয়েসি বেঢপ এক লোকের, যার চোখে লোভাতুর দৃষ্টি। সে দৃষ্টিতে কী ছিল, রিভুর মতো বিবেচনা সম্পন্ন মেয়ের তা আঁচ করতে দেরি হয়নি। আর তাই কালবিলম্ব করেনি। গল্পের এ বাক্যটিই গল্পের যবনিকা টানে:
‘ড্রাইভারের আগেই একটানে দরজা খুলে রিভু নিজেকে গাড়ির ভেতর ছুঁড়ে দিল।’
ছোটগল্পের আকর্ষণীয় এবং চমৎকার সমাপ্তি। নেট জগতের মাধ্যমে এসব প্রতারক পুরুষের লালসার শিকার হয়ে কত মেয়ের যে আশাভঙ্গ বিপন্নদশায় পতিত হচ্ছে, তার হিসেব নেই। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষ্কলুষ মেয়ে খুইয়েছে তার সর্বস্ব। হারিয়েছে স্বাভাবিক বিকাশের পথও। সেসবেরই প্রতিনিধিত্বশীল ঘটনার সরস এক গল্প এটি।
‘নিশিতে পাওয়া সায়লা’ নামের গল্পে সায়লা হাসপাতালের একজন সেবিকা। মিজান বিদেশ ফেরৎ ডাক্তার। উঠতি যৌবনে সায়লা বিশ্বাস করেছিল খাঁ বাড়ির মিজানকে। আর সে বিশ্বাস তার জীবনের শিকড় নিয়েছে কেটে। তার কারণ একটিমাত্র নির্বাচিত অথবা শিল্পমানের বাক্যের উদ্ধৃতি থেকেই স্পষ্ট হয়:
‘সেই নিষিদ্ধ মাতৃত্বের স্বাদ জেগে উঠলেও কখনও ভাবেনি আবার তারা মুখোমুখি হবে।’
এ যেন শুধু গল্প নয়, শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার মতো; কিছুটা আড়াল রেখে শিল্পসুষমায় পাঠককে মুগ্ধ করে। এ জন্যই গল্প থেকে উদ্ধৃতি দিতে হয়: ‘-যে জীবনের কোনো মানে হয় না, সে জীবনই টেনে নিতে হচ্ছে- আজ সতের বছর-নিশিতে পাওয়া জীবন তার।’
হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে সায়লা নামের যে মেয়েটি-তার কাছে বেদনা কখনো উপভোগ্য। যেনো ফাগুনের বাতাস জড়ানো আঁচলে সে বেদনা আটকে রাখে। কারও জীবনে অতি অল্প সময়ে অনেক কিছু ঘটে যায়- সায়লা তেমনি একজন মেয়ে। তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সেও জানে, বোধের জাগরণ না ঘটলে মানুষের পড়াশোনা অথবা পাণ্ডিত্ব কোনোটাই কাজে লাগেনা জীবনে।
নেত্রকোনার এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের টিন এজার মেধাবী মেয়ে শিউলির সেই দুর্ঘটনার পর বাড়ি থেকে পলায়ন করা, নাম পরিবর্তনসহ এই পেশা, কোনো কিছুই তার জীবনের আঁধার গোছাতে পারেনি। ওদিকে আত্মসম্মানের ভয়ে শিউলির স্বজনেরা দেশ ত্যাগ করে ওপারে চলে যায়।
নিয়তির নির্মম পরিহাসে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মিজানের স্ত্রী জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যায়। গভীর রাতে অপারেশনে সায়লাও সহায়ক হিসাবে উপস্থিত থাকে। সঙ্কটাপন্ন স্ত্রীর অপারেশন নিজের হাতে করতে না পারলেও পাশেই থাকে মিজান। কিন্তু অপারেশন সফল হয়না। ভোর রাতে প্রফেসর মিজান নিজের কক্ষে সায়লাকে ডেকে পাঠায়। সায়লা কক্ষে এলে নিজে উঠে গিয়ে সায়লার হাত ধরে ক্ষমা চায়। তখন তো জীবন যন্ত্রণায় ক্লান্ত সায়লা। যার জীবনে এত ভাঙন-ক্ষরণ, তার জন্য গল্পের শেষ বাক্যটি উদ্ধৃতি জরুরি বলেই মনে হয়- ‘তার ওপর ঝলসে ওঠল যে দৃশ্য, তাতে সে পরিস্কার দেখতে পেল-মৃত্যু ছাড়া তার আর বাঁচার কোনই পথ নেই-’
তাহলে কি মৃত্যুই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে-? মাঝে-মধ্যে দাশর্নিক উক্তিসিক্ত আকর্ষণীয় পঙক্তি দ্বারা গল্পটির কাব্যিক উপস্থাপনা অসাধারণ, সংবেদনশীল এবং অনন্য।
‘রক্তজবাবিষয়ক খসড়া’ নামের গল্পটি গ্রন্থসূচির আটে রয়েছে। ফ্রয়েডীয় চেতনায় লেখা গল্পটি রক্তজবা ফুলের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় বিকাশ লাভ করেছে। ভাষার প্রসাদগুণে যৌন বিকলন বিষয়ক গল্পটির গতিপ্রবাহ পাঠককে এক টানে নিয়ে যায় শেষ প্রান্তে। রক্তজবার প্রতীকে যৌনাকর্ষণের মাদকতাও পাঠককে গল্পপাঠে সম্মোহিত করে।
গল্পের নায়ক নবা। কাজ করে এক ফুলের বাগানে। বাগানের মালিক ঢাকায় অবস্থান করে। এ বাগানে কাজ করে আরও ক’জন কিশোর–কিশোরী। বাগানের পরিচর্যা করতে গিয়ে তার হাতে ফুলের স্পর্শ লাগে।
‘পরশ পাপড়ির বাঁধন ঢিলে করে দেয়। অকালে ফোটে যায় কলি বারবার পরশে।’
প্রতীকের আশ্রয়ে কোনো উঠন্ত কিশোরীর সাথে অকালে যৌনাচারের বিষয় উঠে এসেছে। এটি আরও স্পষ্ট হয় নিচের উদ্ধৃতি থেকে।
‘কলি চায় আলতো পরশ। পরশের লাবণ্য কলিকে উদ্দীপ্ত করে, কামতপ্ত করে- ক্রমান্বয়ে কলি দল মেলে, দল মেলতে মেলতে ফুল হয়ে ফোটে।’
ফ্রয়েডীয় চেতনায় গল্পের কাহিনী এমনভাবে উপস্থাপিত হযেছে যে, কোথাও সামান্যতম অশ্লীলতার স্পর্শ পায়নি। বরং ভাষার উৎকর্ষে তা সম্মোহনের সৃষ্টি করেছে। গল্পের নায়িকা কাজলের সাথে নবার যৌন সংসর্গ হয় যৌবনের প্রভাতে।
সেই কাজল মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার বাহিনীর হাতে ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়। স্বাধীনতার পর কাজলকে পাওয়া যায় পাগলি রূপে। অন্যদিকে নবা নিয়োজিত হয় বাগানের কাজে। রক্ত জবার মত এক কিশোরী মাতা সেখানে অবৈধ সন্তান প্রসবকালে প্রাণ হারায়। নবা তখন ভীত-সন্ত্রন্ত। যৌন বিকৃতির এ ঘটনার নায়কও কি নবা! চমৎকার ভাষার করুকাজ আর নিপুণ নির্মাণ শৈলিতে লেখা গল্পটি কেবল ইউসুফ শরীফের হাতেই পূর্ণতা পেতে পারে- তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
‘রুনি ভালো আছে তো’ শিরোনামের গল্পটি চমৎকার। যৌবনে স্বপ্ন ভাঙে অনেকের। সমাজের শাশ্বত বিধান বিয়ের মাধ্যমে অনেকে সুখি সংসার গড়ে। আবার কেউ কেউ প্রতারণার শিকার হয়। সেখান থেকে মুক্তির জন্যও খুঁজে পথ। এ গল্প সে রকম সমাজচিত্রই দক্ষ শব্দশিল্পীর হাতে ভাষিকরূপ পেয়েছে। ভাষার মাধুর্য পাঠককে টানে গল্পের শেষাবধি। অনুভূতি প্রকাশের জন্য ভাষার এমন জাদু তার ওপর আবার কাব্যিক আবহ থাকলে তো কথাই নেই। অনুপম এক ভাষিক শিল্প যেনো গল্পের সর্বত্রই গতিশীল। গল্পের সমাপ্তি অনুপম।
‘চারদিকে জোছনার করতালিতে রাতটাই ফেটে পড়ছিল’-অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনা। পরাবাস্তবতা, চিত্রকল্প কিংবা উপমা যেভাবেই অভিহিত করা যাক না কেন, বিষয়, বক্তব্য, শিল্প প্রয়োগশৈলী এবং অসাধারণ ভাষাভঙ্গিতে রচিত গল্পটি।
গ্রন্থটির সূচির ক্রমধারায় দশ-এ রয়েছে ‘সাহসী মানুষেরা বেরিয়ে আসছে’ শিরোনামের গল্প। কখনো কখনো যন্ত্রণাদায়ক নানা রকম বিপত্তি দেখা দিয়ে আমাদের সমাজজীবনকে অস্থির করে তোলে। কিছুদিন আগেও সমাজে সন্ত্রাস নামক বিষফোঁড়া মাথাচাড়া দিয়েছিল। সারাদেশে ওরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, তা দমনের জন্য বিশেষ একটি বাহিনীই গঠন করতে হয়েছিল। সেই দুঃসময়েরই সমাজচিত্র ফুটে ওঠা একটি প্রতিনিধিত্বশীল গল্প এটি। গল্পে সন্ত্রাসের ভয়াবহতা সে সময়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, মহল্লার অন্য লোকেরাও এ পরিস্থিতিতে পরস্পরের সাথে দেখা হলে চাপাস্বরে কথা বলে। ভাবে ওরা জিম্মি।
গল্পের রেফাত ও অনিক তরুণ সঙ্গীত শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ দুটি অসম সাহসী হয়ে গিটারে ঝঙ্কার তুলে, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী প্রায় সবক’টি গানের দুই চরণ গেয়ে একপর্যায়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। তাদের সাথে আস্তে আস্তে পথে যোগ দেয় মহল্লার তরুণ-যুবা নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষ। সম্মিলিত নিরস্ত্র মানুষের কাছে নতি স্বীকার করে সন্ত্রাসীরা পালায় বা পালাতে বাধ্য হয়। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে সব রকম অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে অমিত শক্তি ও সাহস যোগায়, অন্যদিকে মানুষের ঐক্যের কাছে যে সব রকমের অপশক্তিই হার মানতে বাধ্য হয়; তাও গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
মুগ্ধতায় অভিভূত হওয়ার মতো গল্পের সমাপ্তিই বিশ্বমানের এই গল্পকারের শিল্পীসত্তার পরিচয় দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে কতো অফুরান শক্তির উৎস এবং দুঃসময়ে তা যে কত কার্যকর ও মহিমান্বিত হতে পারে তা এ গল্পে সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে।
গল্পগ্রন্থের এগার নম্বরে সূচিবদ্ধ হয়েছে ‘ধূসর রাত আর উজ্জ্বল দিন’ নামের গল্পটি। সুক্ষ্ণ অনুভূতিগুলো শরতের পূর্ণিমার চাঁদের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠে ইউসুফ শরীফ’র গল্পে। ভাষার উৎকর্ষ, উপমা এবং চিত্রকল্পের সার্থক প্রয়োগে কখনো কখনো মনে হয়, গল্প নয় কবিতা পড়ছি। যেমন-‘তন্দ্রায় ঢুলু ঢুলু শার্মিনের টিকালো নাক শাহেদের বুকে কি কথা লিখেছে, দীঘল চুলের অদ্ভুত ভেজা ভেজা ঘ্রাণ কোন ধুপছায়াপথ দেখিয়েছে-’
শাহেদ তাহমিদার কথা হচ্ছিল অফিসের জরুরি কিছু কাজ নিয়ে। সেই সাথে অস্পষ্ট রহস্যঘেরা ছবিকে নিয়ে। তাহমিদা চলে যাবার পর ঘুরে বসা শাহেদের চোখ যায় কেবিনেটের উপর রাখা শারমিনের ছবির ওপর। অতঃপর যমুনার চর, শারমিনকে নিয়ে ভাবনা। আর ভাবতে ভাবতে দুজনের মিলগুলোর ফর্দ আঁকা। সমবায়, যৌথক্ষেত্র, যমুনার ভেজা বালিতে লেখা এবং তার স্থায়িত্ব অস্থায়িত্বের কথা বলতে বলতে যেন অশরীরি শারমিন থেকে শরীরি শারমিনের আবির্ভাব।
গল্প লেখায় ইউসুফ শরীফের এ এক নতুন ধারার সংযোজন। বলা যায়, অনেকটা মহাসড়কে গতিরোধকের ওপর দিয়ে গাড়িচালকের চেতনা ফিরিয়ে আনার মতো। তার লেখায় সমাজ-বাস্তবতার প্রসঙ্গ আসে সাবলীলভাবে। চরিত্রের মুখ দিয়ে অতি জরুরি কথাগুলোও পরিবেশন করান তিনি। যেমন-‘আঙ্গুলের ডগা দিয়ে পানি ছিটিয়ে ঘর ধোয়া যায় না। আমরা ক্ষুদ্র ঋণ দিচ্ছি, ও দিয়ে ওরা কী করবে? ঋণের ব্যবহারটা কি ওরা জানে, ঋণ সুষ্ঠুভাবে ব্যহারের জন্য মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয় আর সে জন্য প্রয়োজন পারিবারিক শান্তি। আর পারিবারিক শান্তির জন্য চারটা ডাল-ভাতের পাশাপাশি তৃপ্ত দাম্পত্য জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
ইউসুফ শরীফের গল্প মানেই এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যলোকে পরিতৃপ্তির পর্যটন যেন। কখনো তার গল্প পাঠ মানে– ধ্রুপদ শিল্পসরোবরে আয়েশি ভঙিতে সাঁতার কেটে যাওয়া। জীবনকে খুব ভেতর থেকে দেখার অনুবীক্ষণ যন্ত্র বিশেষ।
‘সেই বিরহিণী’ শিরোনামের গল্পের প্রধান চরিত্র আহমেদ আলফাজ। করিৎকর্মা মানুষ। তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে কিভাবে ওপরে উঠতে হয়, সে বিষয়টি চল্লিশ বছরের সাধনায় ভালোই রপ্ত করেন। আর এমন করেই নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে আসা তার। তাই বিত্ত-বেসাতের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করে সুনাম কুড়িয়ে সামাজিক অবস্থান দৃঢ় করার প্রবণতা। এভাবে তার উপড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি যে স্বচ্ছ না, তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য উপরে ওঠার সিঁড়ি মাড়াতে গিয়ে কোথাও কোনো ঝামেলা পাকাতে দেননি। কোথাও দেখা দিলে, কৌশলে গোড়াতেই তা মিটিয়ে ফেলেন।
আর উপরে ওঠার সিঁড়ি মাড়ানোর জন্য ‘বিরহিনী’ নামের একটি ভাস্কর্য অবৈধ কৌশলে সংগ্রহ করে পারিবারিক আভিজাত্য বাড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই শেষে তার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। সস্ত্রিক লন্ডন ভ্রমণ করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল কাজিনের দেবর ইকবালের সাথে। তার স্ত্রী নুসরাত। ওরা ঢাকায় আসে। তাদের একদিন দাওয়াত করে খাওয়ায়। আলফাজের বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখতে গিয়েই বিখ্যাত এক শিল্পীর খোয়া যাওয়া ভাস্কর্যটি চিনে চিৎকার করে নুসরাত তার স্বামী ইকবালকে জানায়।
এ ঘটনায় আলফাজের শঙ্কা এতটাই বাড়ে যে, মনে হয় তার বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। নুসরাত চলে গেলেও ঐশ্বর্য বৃদ্ধির সেই ভাস্কর্য যেন আলফাজের গলার ফাঁসে পরিণত হয়। কারণ, এটি না পারে রাখতে, না পারে ধ্বংস করতে বা ফেলে দিতে। আর বিষয়টা যদি একবার প্রকাশ পায়, তাহলে তরতর করে ঐ যে তার ওপরে ওঠা-সেখান থেকে মুহূর্তে একেবারে পঙ্কে পড়ে যাবে।
‘স্বপ্নবাড়ির কুসুম’ গল্পটি সূচিপত্রের ক্রমধরায় তের নম্বর অবস্থানে। এটি একবার পড়লে, শুধু ‘ভালো লেগেছে’ বললে সম্পূর্ণ বলা হয়েছে বলে মনে হয় না। গল্পটির শিল্প-কৌশল অবশ্যই শিক্ষণীয়। একবার পাঠে তৃপ্তি মিটে না। মনে হয় যতবার পাঠক পড়ে যাবেন, ততবারই রসাস্বাদন করতে পারবেন। এ গ্রন্থের আরো অনেক গল্পের মতো এ গল্পটিতে জাদুবাস্তবতার সফল প্রয়োগ হয়েছে।
নব্য ধনিকশ্রেণির বিষয়ে সাধারণের চোখে অদেখা এক বাস্তব চিত্র গল্পটিতে সুন্দর ও সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। কখনো মনে হয়, চেনা অচেনার মাঝখানের মানুষ কুসুম সবই বুঝতে পারে কিন্তু কিছুই করতে পারে না। তবে দক্ষ কথাকারের হাতে নন্দনশিল্পের উপকরণ হয়ে সমাজকে সচেতন করতে পারে-এমন ভিন্নমাত্রার গল্প এটি।
গ্রন্থসূচিতে ‘কোন এক মধ্যরাতে’ নামের গল্পটির অবস্থান চৌদ্দ। এ গল্পটিতে আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ রূঢ় বাস্তব চিত্র অত্যন্ত নিপূণ এবং শিল্পসম্মতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। গল্পের নায়ক ঝণ্টু আমেরিকায় থাকে। বেশ কাঁচা ডলার কামায়। পাঠায় বাংলাদেশে, তার পরিবারে। ঝন্টুর পাঠানো টাকায় দু’বছরের মাঝে পরিবারের সদস্যরা ক্রমে বদলে যায়। পুরোনো বাড়িটা ভেঙে রিমডেল করে। আসবাপত্র ও পোশাক-আশাকে আসে পরিবর্তন। কিনে গাড়িও।
এক পর্যায়ে স্বজনেরা সবাই বিদেশের টাকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যেন পরের টাকায় পোদ্দারি। তাদের বাড়ির কাঁচা ডলারের গন্ধ শুঁকে গরীব আত্মীয়-স্বজনও একে একে আসতে শুরু করে। অবস্থান নেয় রিমডেলের বাড়িতে। আর্থিক প্রাচুর্যে রাতারাতি চাঁদের হাট বসে এ বাসায়। এ খবর নিশ্চয়ই কর্মস্থল থেকে পায় ঝন্টু।
কোনো এক মধ্যরাতে একটি টেলিফোন আসে সে বাড়িতে। আমেরিকা থেকে ঝন্টুর বন্ধু জানায়, এক দুর্ঘটনায় ঝন্টু মারা গেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে তার লাশ কি বাংলাদেশে আনবে, নাকি সেখানেই দাফন করবে, জানতে চায়। কিন্তু কী নির্মম বাস্তবতা, ঝন্টুর বন্ধুকে কেউ কিছু জানাতে পারেনি। এমন কি পরেও তার লাশ কোথায়-কিভাবে দাফন করা হয়েছে অথবা আদৌ দাফন হয়েছে কিনা-সে খবর কেউ নেয়নি।
বরং এ দুঃসময়ে জ্ঞাতি বলে পরিচিত আগাছাগুলোর সবাই নানা অজুহাতে বাসা থেকে একে একে চলে যায়। বোন জামাইও অফিসে ধরাধরি করে আগের চাকুরিতে যোগ দেয়। কাউকে না জানিয়ে অন্যত্র বাড়ি ভাড়া করে সপরিবারে চলে যায় সে। তিনমাসের মাঝে ঝিমিয়ে পড়া বাড়ির লোকেরা পাওনাদারের ভয়ে ত্রস্ত থাকে। এমন দুঃসময়ের এক মধ্যরাতে বাসার কলিংবেল বেজে উঠে। বৃদ্ধ মা এসে সাহস করে দরজা খুলেই হতবাক, ‘ঝন্টু! তুই না মরে গেছিস?’
ঝন্টু হাসল, না মা আমি মরিনি। অন্য কারো কারো ভেতরে গজিয়ে ওঠা অন্য কিছু মরেছে-’
এমন শিল্পসম্মত একটি সমাপ্তি পাঠককে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভাবায়। শিল্পসম্মত সমাপ্তি এটি। দীঘদিন মনে রাখার মতো গল্পটি পাঠ করলে পাঠকের ভেতর ভাঙচুর হয়, বোধে নাড়া দেয়। শিল্পোত্তীর্ণ গল্পটি ধ্পরুদ সাহিত্যের মর্যাদা পাবে- তা জোর দিয়ে বলা যায়। তার কিছুটা প্রমাণও তো ইতোমধ্যে হয়েছে। এ কাহিনী নিয়ে রচিত একটি নাটক ২০০৭ সালে ঈদুল আযহা উপলক্ষে বিটিভিতে সম্প্রচারিত হয় এবং এটি টিআরপি রেটিংয়ে শীর্ষস্থান দখল করে।
গ্রন্থের শেষ গল্পটির নাম ‘হায় বালিকা’। বিদেশের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্পটি একদিকে যেমন ইউরোপের জার্মানী সম্পর্কে আমাদের পরিচিত করে, তেমনি এর কাব্যিক ভাষার প্রসাদগুণ পাঠককে বেশ টানে- পাঠের আনন্দ দেয়। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পটির নায়ক রহমান। জার্মানির বন-কলোন শহরে ভ্রমণের সময় যাকে গাইড হিসাবে পেয়েছিল, সেই গিশেলাই গল্পের নায়িকা। আর এ নায়িকাকে ঘিরে আকর্ষণীয় একটি রোমান্টিক আবহ তৈরি করে গল্পের প্লট গতিশীল হয়।
জার্মান-ইতিহাসের গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো গিশেলাই রহমানের কাছে স্পষ্ট করে। গল্পের নায়ক সেখানে সমবায়ভিত্তিক একটা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে। বুঝতে পারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য সমবায়, অন্যের সাহায্যের চেয়ে উন্নয়নে অনেক বেশি কার্যকর। বাংলাদেশে সমবায়ের সুফলের কথা না ভেবে বরং দাতাগোষ্ঠীর সাহায্যলাভের তদবিরের প্রয়াস বেশি। এ জন্যই শত শত এনজিও-এর অধিকাংশই সহযোগিতার নামে লাভজনক ব্যবসায় লিপ্ত। অথচ এদেশেও সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে সে বার্তাটি দিয়ে এ সমাজ- জাতিকে সচেতন করতে চেয়েছেন লেখক। কারণ, বাস্তবতা বলে, যন্ত্র ও প্রযুক্তিগত কৃষি ব্যবস্থার জন্য কৃষকদের মাঝে সমবায়ভিত্তিক কৃষি খামার গড়ে খাদ্য ও কৃষিপণ্যে দেশকে বহুদূরে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
এ নিবন্ধকার মনে করেন যে, জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশ যেমন গুরুত্ব পাননি, তেমনি ইউসুফ শরীফও অনালোচিত থাকছেন। তবে কালের পলেস্তরা খসে গেলে এই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক তার সৃষ্টির বিষয়-ভাষা-বক্তব্য এবং সর্বোপরি শিল্পগুণে অবশ্যই আলোচিত হবেন, বিশেষ গুরুত্ব পাবে তার সাহিত্য-কর্ম। এভাবে অনালেচিত থাকার হয়ত আর একটি কারণ রয়েছে। সম্ভবত এ লেখক কোনো মতাদর্শের আলোয় আলোকিত হতে চাননি। তবে একটি পক্ষের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভালোবাসা তো আছেই। নিজে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন নন্দনশিল্পী তিনি। বিশ্বমানের এমন গল্পকার এখনো জাতীয় কোনো পুরস্কারে ভূষিত হয়নি। কারণ, সময়ের গড্ডালিকা প্রবাহবিরোধী এ লেখক তদবির করে কিংবা কোনো মতাদর্শের আনুগত্য নিয়ে নিজেকে লঘু করতে চান না।
এ কথাসাহিত্যিকের গদ্যশৈলী নবীন কথাশিল্পীর জন্য যেমন অনুসরণীয়, তেমন তাদের আত্মবিশ্বাসও। অনেকেই স্বীকার করবেন- এ লেখক কথাশিল্পীদের কথাসাহিত্যিক। যারা সামান্য শিল্পমানবিহীন কথাসাহিত্য রচনা করে নিজেকে কথাশিল্পী দাবি করেন, তাদের অন্তত ইউসুফ শরীফের লেখা বারবার পড়া উচিৎ।
এ গল্প গ্রন্থের পনেরটি গল্পপাঠে-এটুকু মনে হয়েছে যে, ছোটগল্পে ক্রমাগত নিজের উত্তরণই তিনি ঘটাননি, বরং তার বেশ কিছু ছোটগল্পকে এমন এক অনন্য উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন, যে উচ্চতা জাতীয়মানকে অতিক্রম করে বিশ্বমানকে স্পর্শ করে। চেনাঅচেনার মাঝখানের মানুষ’ নামের গল্প গ্রন্থটি এজন্যই নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে বোদ্ধা পাঠকেরও পাঠ প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *