উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।।এহসান মাহমুদ।।প্রথম পর্ব
- উপন্যাস ।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব তিন
- উপন্যা।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দশ
৫
আমার সামনে যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ‘ব্রেস্ট সার্জারি’ বিভাগের প্রধান ডা. জেন মেন্ডেজের সাক্ষাৎকার। আমি পড়ে চলি- নানান রূপে দেখা দিতে পারে স্তন ক্যানসারের উপসর্গ। অনেক সময় স্তনের ত্বকেও অসংগতি চোখে পড়ে। দুই স্তনের আকার আকৃতির সামঞ্জস্য না থাকাও স্তন ক্যানসারের পূর্বাভাস। স্তনের বৃন্ত থেকে কোনো কারণ ছাড়াই কোনো প্রকার তরল বেরিয়ে আসতে পারে।
মারিয়াকে নিয়ে একদিন আজিমপুরে গিয়েছিলাম। আমাদের বন্ধু জুয়েলের বাসায়। জুয়েল একটি দুপুর আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল ওর বাসাটা। পহেলা বৈশাখের দিন ছিল সেদিন। আমরা সকাল থেকে টিএসসি চারুকলা দোয়েল চত্বরে ঘুরে বেড়ালাম।
ভরদুপুরে নাজিমউদ্দিন রোডের নীরব হোটেলে ভর্তা আর টমেটোর চাটনি দিয়ে ভাত খেয়ে আজিমপুরে জুয়েলের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আমি একটা লাল পাঞ্জাবি পরেছিলাম। মারিয়ার পরনে ছিল লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। আর নীল রঙের ব্লাউজ। আমরা বাসায় ঢোকার পরেই কারেন্ট চলে গিয়েছিল। মারিয়া বাসায় ঢুকেই শাড়ির সেফটিপিন খুলতে শুরু করল। তারপর হাতমুখ ধুয়ে ওর ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছলো। আমি মারিয়াকে দেখছি। একটা মেয়ে কতটা ধীরে ধীরে নিজের মুখ মুছতে পারে। যেন ত্বকের কোনো ক্ষতি না হয়। আমার তাকিয়ে থাকা দেখে মারিয়া হাসে।
আমার দিকে তাকিয়ে একবার মুখে ভেংচি কাটে।
মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলা শুরু করে।
‘কী দেখো?’
‘কই? কী দেখব!’
‘কিছুই দেখো না?’
‘উঁহু। দেখি না তো।’
‘দেখতে চাও?’
‘না দেখালে জোর করে দেখব।’
মারিয়ার চোখে কপট রাগ।
‘খুব সাহস হয়ে গেছে, না?’
‘হয়েছে তো।’
‘কোথা থেকে আসে এত সাহস? কে দিয়েছে?’ বলেই মারিয়া হাসে।
আমিও হাসি। মারিয়া হাতের টিস্যু কোলের ওপর রেখে চুল ঠিক করতে বসে। হাতব্যাগ থেকে একটি ক্লিপ বের করে চুলগুলোকে মাথার ওপরে চূড়া করে রাখে। আবার টিস্যু হাতে নিয়ে গলার নিচে ও ঘাড়ের ঘামটুকু মুছে নেয়।
হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে :
‘আরে তুমি তো ঘামে ভিজে গোসল করে বসে আছো! আসো ঘাম মুছে দিই।’ আমি মারিয়ার কোলের ওপর মাথা দিয়ে সটান হয়ে পড়ি। মারিয়া আরে আরে বলে ওঠে। তবে আমাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে না। আমার কপালে গলায় মারিয়া হাত বুলিয়ে ঘাম মুছে দেয়। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এভাবে কতক্ষণ চলে যায়। হঠাৎ কারেন্ট চলে আসে। ফ্যানের শব্দে ছোট্ট রুমটি ঝিম মেরে থাকে। ফ্যানের বাতাসে মারিয়ার আঁচল সরে যায়। আমার চোখ আবার ঝলসে যায়। মারিয়া বলে ওঠে :
‘দেখতে চাও?’
আমি মাথা নাড়ি।
‘তাহলে লাইট অফ করে আসো।’ মারিয়া হাসে।
‘লাইট অফ করব কেন?’
‘নইলে দেখাব না।’
‘লাইট অফ করলে দেখা যাবে?’
‘যাবে। তোমার চোখের পাওয়ার বেড়ে যাবে।’ বলেই মারিয়া হাসে।
আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘যাও বন্ধ করে আসো।’
আমি দীনহীন চাকর। মারিয়া আমার মনিব। আমি মনিবের কথা মতো লাইট অফ করে আসি। মারিয়া আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় আমি মারা যাব।
মারিয়া আমার কানে কানে বলে :
‘দেখতে হলে নিজে কষ্ট করে দেখতে হবে।’ কথা শেষ করেই মারিয়া আমাকে ছেড়ে দেয়। আমার পিঠে হাত রেখে পাশ ফিরে বসে থাকে। আমি মারিয়ার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। আমার দুই হাত হঠাৎ সচল হয়ে ওঠে। মনে হয় সুন্দর দেখতে হলে পরিশ্রম করতে হবে। আমার আঙুলগুলো আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় মারিয়ার ব্লাউজের বোতামে হাত রাখে। কী আশ্চর্য আমার আঙুলগুলো আজ এত দক্ষ হয়ে উঠল কী করে! শিল্পীর মতো তারা ব্লাউজের একটার পর একটা বোতাম খুলে চলেছে। মনে হচ্ছে সামনে বিশাল ক্যানভাস। রানী আদেশ করেছেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই রংতুলি দিয়ে সাজাতে হবে। ব্লাউজের শেষ বোতামটি খোলা হয়ে গেলে মারিয়া ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে শুয়ে পড়ে। আমি মারিয়ার ঘাড়ে মুখ রাখি। মারিয়া বিদ্যুতের মতো জ¦লে ওঠে। আমি মারিয়ার গমের মতো সাদা পিঠে হাত রাখি। হাত রেখে মনে হয় এত মসৃণ আমি কখনো স্পর্শ করিনি। নিজের হাতটিকে আমার মনে হচ্ছে কোনো ভাঙাচোরা রাস্তার মতো খসখসে। আমি মারিয়ার পিঠে আমার জিভ রাখি। এটাকেই আমার সবচেয়ে কোমল মনে হলো। মারিয়া মুহূর্তেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আমি মারিয়ার পিঠে আমার নাক রাখি। বকুলের গন্ধে আমার আয়ু বেড়ে যায়। আমি মারিয়ার বুকের দিকে আমার দুটি অযোগ্য হাতকে নিয়ে যাই। মারিয়া সরে গিয়ে আমার মাথাটি কাছে টেনে নেয়। কানের কাছে মুখ এনে বলে :
‘দেখ, তোমার জন্য সব।’
‘আমাকে সুন্দর দেখাও।’
মারিয়া আমার মাথাটি জড়িয়ে ওর বুকের মাঝে রেখে দেয়। আমি মাথা উঁচু করে সুন্দরের দিকে তাকাই। আমার চোখ এবার সত্যি সত্যি ঝলসে যাবে বলে মনে হলো।
আমি বললাম, ‘আমি অন্ধ হয়ে যাব।’
‘হবে না। তুমি চোখ রাখো।’
আমি মাথা উঁচু করে সুন্দরের দিকে তাকিয়ে থাকি। মারিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলি :
‘সুন্দরের স্বাদ নিতে চাই।’
‘নাও।’
আমি শৈশবের চৈত্রমাসে আইসক্রিম মুখে পুরার মতো করে মারিয়ার সব সুন্দর মুখের মধ্যে নিতে চাই। আইসক্রিমওয়ালার কথা মনে পড়ে। লাল, সবুজ রঙের বরফের টুকরো আর স্যাকারিন মেশানো সেই আইসক্রিম। মুখের মধ্যে গেলেই ঠাণ্ডায় দাঁত হিম হয়ে যেত। সামনের দুইপাটির দাঁত দিয়ে বরফের টুকরো কড়মড় করে ভেঙে ফেলা যেত। মারিয়া হঠাৎ আমার পিঠের মধ্যে ধুপ করে কিল দিয়ে বসল। আমি চোখ বন্ধ করে রাখি।