উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ ।। পর্ব ছয়

চোখের সামনে ল্যাপটপের মনিটর ঝাঁপসা হয়ে আছে। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি স্তন ক্যানসারের আরও কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে যা স্তন ক্যানসারের উপসর্গ। এরপরেই আবার চিকিৎসায় স্তন ক্যানসার ভালো হয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে। স্তন ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থাতেই শনাক্ত করা গেলে ৯৮.৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই সারিয়ে তোলা যায়। এজন্য স্তন ক্যানসারের পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র দেরি করা উচিত হবে না।


আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে শুরু করি। যেভাবে ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন টেস্টের পরীক্ষার আগে পড়েছিলাম। ৪০ বছর বয়স থেকেই প্রতি বছর ক্যানসার পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যাদের পরিবারে এই রোগের ইতিহাস আছে কিংবা কোনো কারণে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাদের আরও আগে থেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনায় থাকতে হবে। বংশে স্তন ক্যানসার থাকলে সবচেয়ে কাছের আত্মীয়ের যে বয়সে এই রোগ শনাক্ত হয়েছিল সেই বয়সের ১০ বছর আগে থেকেই নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। আর বয়স যত বাড়বে ততই এই পরীক্ষাগুলোর গুরুত্ব বাড়বে। স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে হলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। স্থূলতা স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ায় বলা হচ্ছে। আমার মারিয়ার কথা মনে পড়ে। ওর কত ওজন হবে? এখন হয়তো কিছু বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে ওর ওজন ছিল সাতচল্লিশের মতো। একবার স্টাডি ট্যুরে আমরা জাফলং গিয়েছিলাম। একটা পাহাড়ি ঝিরি পার হওয়ার সময় ওকে পিঠে করে পার করছিলাম। ঝিরির পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে ওর ভয় করছিল। তাই পিঠে তুলতে হয়েছিল।  

 
ডা. ক্রিস্টি ফাঙ্ক নামে আরেকজন স্তন ক্যানসার বিশেষজ্ঞের সন্ধান পেলাম। তিনি বলছেন, পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ স্তন ক্যানসারের পেছনে বংশগত কারণ দায়ী থাকে। ১৩ শতাংশ রোগীর ‘ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ’ থাকেন যাদের এই রোগ ছিল। এই লোকটির একটি বই পেলাম একটি সাইটে। পিডিএফ ডাউনলোড করে নিলাম। মারিয়াকে পড়তে দেব। ‘ব্রেস্টস : দ্য ওনার’স ম্যানুয়াল’ বইতে তিনি লিখেছেন, জিনগত ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের বাইরে হলেও, মনে রাখা জরুরি যে সিংহভাগ স্তন ক্যানসার নারীর নিজের নিয়ন্ত্রণে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে এই প্রাণঘাতী রোগকে দূরে রাখা সম্ভব। সেখানে বলা হচ্ছে
প্রতি মাসেই পিরিয়ড শুরু হয়ে গেলেই প্রতিটি নারীর উচিত নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করানো। দেখতে হবে স্তনে এমন কোনো দাগ কিংবা গোটা টের পাওয়া যায় কি-না যা আগে ছিল না। আজকাল ইউটিউবে নানা বিষয়ে টিউটোরিয়াল পাওয়া যায়। কীভাবে পরীক্ষা করতে হবে তা জানতে অনলাইনে ‘টিউটোরিয়াল’ আছে কি না খুঁজে দেখতে হবে। আচ্ছা, মারিয়া আগে মাঝেমাঝে বলত যে, পিরিয়ডের দিনগুলোতে ওর পেটব্যথা হয়। আবার সবসময় যে হতো তাও না। পিরিয়ডের সময়ে পেটব্যথার সাথে কী ধরনের অসুস্থতার সম্পর্ক থাকতে পারে? কোথায় পাব এই প্রশ্নের উত্তর। তবে সবাই যেটা বারবার বলছেন, বয়স যখন ৪০-এর কোঠায় পৌঁছাবে তখন নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে।


স্তন ক্যানসার রোগীরা কী খাবে বা কোন ধরনের খাবারে রোগপ্রতিরোধ করবে এ বিষয়ে একটু জানার চেষ্টা করি। উদ্ভিজ উৎস থেকে আসা খাবার স্তনের সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী লেখা রয়েছে। এ ধরনের খাবার ক্যানসারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা কবচ তৈরি করে বলা হয়। অপরদিকে প্রাণিজ উৎসের খাবার ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। স্তন ক্যানসার থেকে সুরক্ষিত থাকতে প্রতিদিন ব্রকলি, সয়া এবং তিসির গুঁড়া খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্রকলি বিষয়টা মন্দ না। সবুজ রঙের এই সবজিটা আমার পছন্দ। একবার শীতকালে পলাশী দিয়ে রিকশায় যাচ্ছি। সকালের রোদ উঠেছে কেবল। রাস্তার পাশে ভ্যানে সাজানো একটি সবজির দোকান দেখে চোখ আটকে গেল। টমেটো, ফুলকপি, গাজর, ব্রকলি, শিমের বিচিতে একটা পেইন্টিংয়ের মতো মনে হয়েছিল।

 
স্তন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. ফাঙ্ক বলছেন, আধা কাপ কাঁচা কিংবা ভাপে সেদ্ধ ব্রকলি খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইকারী ‘আইসোথাইয়োসায়ানেইটস’ নামক উপাদানের মাত্রা বাড়ানো যায়। খাওয়ার সময় ব্রকলি ভালোভাবে চিবাতে হবে। এটি স্তন ক্যানসারের জন্য দায়ী কোষগুলো খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে কাজ করে। প্রতিদিন দুই থেকে তিন বেলা সয়া খেতে হবে। সয়া স্তন ক্যানসার হওয়া, একবার সেরে যাওয়ার পর আবার ফিরে আসা সবকিছুই দমাতে অত্যন্ত সহায়ক। এর সাথে আরও খেতে হবে এক টেবিল-চামচ তিসির গুঁড়া।

 
ডা. ফাঙ্ক বলছেন, অ্যালকোহলের কোনো নিরাপদ পরিমাণ নেই। এটি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে। কোনো অবস্থাতেই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত  রোগী অ্যালকোহল গ্রহণ করতে পারবেন না। হঠাৎ মনে পড়ল বাসায় ফ্রিজে একটা জিনের বোতল রয়েছে। গত মাসে জন্মদিনের সময়ে পেয়েছিলাম। এছাড়া আছে দুটো বিয়ারের ক্যান।

 ল্যাপটপের সামনে থেকে সোজা ডাইনিংয়ের ফ্রিজের সামনে যাই। প্রথম জিনের বোতলটা নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়াই। ছিপি খুলে বোতলটি উপুড় করে দাঁড়িয়ে থাকি। ঢকঢক করে গলায় ঢালার মতো করে বেসিনের পাইপের গলায় ঢেলে দিই। এটা শেষ হলে বিয়ারের ক্যান দুটোর মুখ খুলে বেসিনের ওপর রেখে আবারও ল্যাপটপের সামনে বসি।

 
স্তন ক্যানসার বিষয়ে খুঁটিনাটি যা পাই তা মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি।  দৈনিক মাত্র ১১ মিনিট ব্যায়াম করলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমে ১৮ শতাংশ। শুধু হাঁটাহাঁটির মাধ্যমে এই ব্যায়াম হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

 
মারিয়া হাঁটতে পছন্দ করে। সেই শুরু থেকেই দেখে আসছি হাঁটাতে ওর আনন্দের কমতি নেই। পরিচয় পর্বের দিনগুলোতে আমরা তখন হেঁটে হেঁটে কথা বলতাম। ওর হল থেকে বের হয়ে নীলক্ষেত মোড়ের দিক দিয়ে পলাশী ফুলার রোড হয়ে টিএসসিতে এসে চায়ের জন্য বসতাম। এভাবে মাঝেমাঝে আমরা দুই রাউন্ড দিয়ে ফেলতাম। তবুও আমাদের কথা ফুরোতে চাইত না। আমি বলতাম চলো, রিকশা নিয়ে ঘুরি। ও বলত, মেয়ে মানুষের সাথে রিকশায় চড়ার খুব শখ, না? বলেই আবার হাসত।

 
একদিন মিরপুরে চলে গেলাম ভরদুপুরে। দুপুর দেড়টার ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসের ডাবল ডেকার বাসে মিরপুর এক নম্বরে গিয়ে নামলাম। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন। বিকেল পর্যন্ত মারিয়া আমাকে হাঁটিয়ে ছাড়ল গার্ডেনের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে। প্রায় প্রতিটি গাছের কাছে গিয়ে তার নাম পরিচিতি পড়ে পড়ে শোনাল।

 
আমি একবার বিরক্ত হয়ে বললাম, গার্ডেনে কত প্রজাতির গাছ আছে তা আমাকে মুখস্থ না করিয়ে থামবে না, না?


মারিয়া হাসল। আরও উৎসাহ নিয়ে গাছের পরিচিতি পড়ে যেতে লাগল। শেষ বিকেলে আমার পাশে এসে বসল। আমি ততক্ষণে ঘাসের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছি।
আমার মাথার ওপর হাত রেখে বলল, ‘খুব টায়ার্ড হয়ে পড়েছ, না?’


আমি কথা বললাম না। রাগে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। তাই চুপ থাকতে চেষ্টা করছি।
মারিয়া আমার চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দিতে লাগল। এভাবে কতক্ষণ গেল। আমার ঘুম চলে এলো। মারিয়া ওর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আমার চোখেমুখে ছিটিয়ে দিল। আমি লাফিয়ে বসলাম। ও হাসতে শুরু করল। আমি বিরক্ত হচ্ছি আর ও হাসছে। একসময়ে মারিয়া হাসি থামাল। হাত থেকে পানির বোতল আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি গলা ভিজিয়ে নিলাম। মারিয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘কী দেখো?’ আমি বললাম।
‘তোমাকে।’
‘নতুন দেখো? এটা তো রোজই দেখো।’
‘তবুও। আজ আমার জন্য দেখছি।’
‘তোমার জন্য দেখছ মানে কী? বুঝিনি।’
মারিয়া হঠাৎ সামনের পুকুরের দিকে চোখ সরিয়ে নিল। ওর চোখ অনুসরণ করে আমিও সেখানে তাকাই। তিনটি হাঁস সাঁতার কাটছে। দুটি হাঁস পাশাপাশি অপরটি দলছুট।
মারিয়া আমার দিকে ফিরে বলল, ‘ওই দলছুট হাঁসটি আলাদা কেন বলো তো?’
‘আমি কী করে বলব?’ আমি বিরক্তি গোপন করার চেষ্টা করি না।
মারিয়া অল্প হাসল।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সুখ খুঁজছে। আলাদা থেকে সুখ পাওয়া যায় কি না তা খুঁজে দেখছে।’
‘তুমি বেশ দার্শনিক হয়ে যাচ্ছ।’
মারিয়া আমার পিঠে কিল মেরে সোজা হয়ে বসল। বলল তোমাকে একটা গল্প শোনাই।
আমি মাথা নাড়লাম।

 
মারিয়া শুরু করল :
‘এক সন্ধ্যেবেলা রাবেয়া বসরি তার কুটিরের সামনে রাস্তার ওপর কিছু খুঁজছিলেন। প্রতিবেশীরা এসে জিজ্ঞেস করল, কী হারিয়েছে? কী খুঁজছ। রাবেয়া বললেন, আমার একটি সুই হারিয়েছে। প্রতিবেশীরা রাবেয়ার সাথে মিলে খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু কেউ কিছু পেল না। এক প্রতিবেশী বলল, তুমি কোথায় সুই হারিয়েছ? রাবেয়া বললেন, আসলে আমি সুইটা ঘরের মধ্যে হারিয়েছিলাম। এই কথা শুনে সবাই হাসাহাসি করল। একজন প্রতিবেশী বলল, তুমি তো দেখছি বোকা। ঘরে যে সুই হারিয়েছ তা বাইরে খুঁজে সময় কাটাচ্ছ কেন? রাবেয়া বললেন, কারণ ঘরে কোনো আলো নেই। বাইরে সামান্য আলো আছে। তাই এখানে খুঁজছি। এই কথা শোনার পর প্রতিবেশীরা আবারও হাসাহাসি করল। এইবার রাবেয়া বসরি বললেন, শোনো, তোমরা সবাই কিন্তু এই কাজটিই করো। কেবল তোমাদের সামনে উদাহরণ দেওয়ার জন্য আমি এটি করছি। তোমরা সবাই নিজেদের সুখ বাইরে খুঁজে বেড়াও। আসলে সুখ কি বাইরে রয়েছে? রাবেয়া বসরি তার প্রতিবেশীদের আবার বললেন, আমরা আমাদের সুখ বাইরে খুঁজি। কারণ, আমাদের দেহের পঞ্চইন্দ্রিয় সেভাবেই তৈরি আছে। আমাদের চোখ বাইরে দেখে, আমাদের কান বাইরে শোনে, আমরা স্পর্শ করি বাইরের বস্তু। আবার স্বাদ-গন্ধ নিই বাইরে থেকে। কাজেই আমরা ভাবি, বাইরে খোঁজাটাই ঠিক আছে। আমিও আগে একইভাবে করতাম। কিন্তু যেদিন অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে সবকিছু খুঁজতে শুরু করলাম, আমি অবাক হলাম। বুঝতে পারলাম, আমার সুখ নিজের ভেতরেই হারিয়েছে। তাই সেখানেই খুঁজে নিতে হবে।’

Series Navigation<< উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব পাঁচউপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব সাত >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *