উপন্যা।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।।এহসান মাহমুদ।।প্রথম পর্ব
- উপন্যাস ।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব তিন
- উপন্যা।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দশ
বাসায় ফিরে সোজা গিয়ে আমার টেবিলের সামনে বসি। বাসায় পড়াশোনা ও নিজের লেখালেখির জন্য একটা রুম সাজানো আছে। বাসায় থেকেও অফিসের কাজ যাতে করা যায় এমন একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা শুরু হয়েছিল আরও আগে থেকেই। তবে করোনার সময়ে পুরো দেশে যখন লকডাউন শুরু হয়ে গেল, আমরা ঘরবন্দি হয়ে গেলাম, তখন বেশ দ্রুত এসব করা হয়েছিল। একটা খোলামেলা টেবিল, ইন্টারনেটের ভালো ব্যবস্থা আর পাশেই খোলা ব্যালকনিতে একটা রোলিং চেয়ার ও সিগারেটের অ্যাস্ট্রে। লেখালেখি বা কাজের ফাঁকে বিরতি দিতে চাইলে ব্যালকনিই ভরসা। অফিসের সিঁড়ির চিপা আর হারুনের গলির মোড়ের আড্ডার ব্যবস্থা এই ব্যালকনিতেই। করোনা বেশ নতুন একটা ছকের মধ্যে রেখে গিয়েছিল। টানা প্রায় ৪ মাস ঘরবন্দি থেকে থেকে নতুন এক নিয়ম রপ্ত হয়েছিল।
বাসায় ফিরেই ড্রয়ার থেকে ল্যাপটপ বের করে বসি। দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মায়ামি ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে চোখ রাখি। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ বলছে, মার্কিন নারীদের প্রতি আটজনের একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। বয়স্ক নারীদেরই এই রোগ বেশি হয় ঠিক, তবে অনেক সময় ৪৫ বছরের কম বয়সী নারীদেরও এতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পাশেই একটা জরিপ দেখানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে─ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯ শতাংশ নারী ৪৫ এর আগেই স্তন ক্যানসারের শিকার হন। মায়ামি ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ‘ব্রেস্ট সার্জারি’ বিভাগের প্রধান ডা. জেন মেন্ডেজের স্তন ক্যানসার নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার পেয়ে যাই। মেন্ডেজ বলছেন, স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই দেখা দেয় একটা ‘ম্যাস’ বা পিণ্ড আকারে। স্তনের ভেতরে গোটার মতো কিছু অনুভব করা যায়। তবে এটা জানাও জরুরি যে সবসময় এই রোগ একই উপসর্গ নিয়ে আসে না। আবার একইভাবে স্তনের ভেতরে দেখা দেওয়া সব পিণ্ড যে ক্যানসার সেটা ভেবে নেওয়াও হবে ভুল। এজন্যই নিয়মিত পরীক্ষা করার কথা বলা হচ্ছে।
এই পর্যন্ত পড়েই আমার মারিয়ার কথা মনে পড়ল। মারিয়ার বুকে হাত রেখেছিলাম কবে প্রথম? আমরা তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। যদিও আমাদের চেনা পরিচয় ভার্সিটির সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। মারিয়াকে প্রথম দেখেছিলাম সম্ভবত নাসরিন ম্যাডামের ক্লাসে। গণমাধ্যম ও জেন্ডার বিষয়ের একটা ক্লাস ছিল সেদিন। অত কথা আজ আর মনে পড়ছে না। তবে মারিয়াকে প্রথম দেখার পরেই আর চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। যাকে বলে চোখ আটকে গিয়েছিল। কুসুম রঙের একটা কামিজ পরেছিল মারিয়া। কাঁধে ঝোলানো ওড়নাটা একপাশে সরে ছিল। বুকের একপাশ খোলা হয়ে পড়েছিল তাতে। মুহূর্তেই আমার চোখ ঝলসে গেল। আর কিছু মনে পড়ে না প্রথম দিনের কথা। সেই মারিয়াকে পেয়েছিলাম আরও বছর তিনের মাথায়। তারও আগে ক্লাসের নোট নিয়ে আলাচনা করতে করতে, নীলক্ষেত, পলাশীতে ফটোকপির দোকানে আর ফুলার রোডে বসে বসে আমাদের একটা সম্পর্ক হয়েছিল। এছাড়া ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বারান্দায় কিংবা হাকিম চত্বরের ধুলোবালি মাখামাখি কম হয়নি। মারিয়ার সাথে প্রথম নিরিবিলি বসেছিলাম কার্জন হলের পুকর পাড়ে। ওইদিন সন্ধ্যার পরে আমরা রিকশা নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। মারিয়া আমার পাশে বসেছিল সেদিন। সেদিন মারিয়ার গন্ধ আমার নাকে এসে লাগে। আমি প্রথম বুঝিনি এটা মারিয়ার গন্ধ। আমি আশপাশে তাকাই।
মারিয়া হাসে আর বলে:
‘কী খুঁজো চারদিকে?’
‘কিছু না।’
‘তাহলে আশপাশে তাকাও কেন? তোমার পাশে একটি সুন্দরী মেয়ে বসে আছে, আর তুমি তাকে না দেখে অন্যদিকে কী খোঁজো?’ কপট রাগ করে কথা শেষ করেই মারিয়া হাসে। হাসতে হাসতে আমার উরুতে হাত রাখে। আমার সারা শরীরে কী যে হয়! কী হয়? মারিয়া কি তা টের পায়?
আমি বোবা হয়ে যাই। এই মারিয়াকে আমি চিনি না। কোনোদিন এইভাবে হাসতে দেখিনি। এইভাবে হাসতে হাসতে ঢলে পড়তে দেখিনি সোনালু ফুলের মতো। মারিয়াকে আমার একগুচ্ছ সোনালু ফুল মনে হচ্ছে। আমাদের গ্রামের বাড়ির পুকুর ধারে সোনালু গাছটি এইভাবে বাতাসে দুলতে থাকে। মারিয়া কি তবে সোনালু ফুল হয়ে গেল! না। পরক্ষণেই টের পাই সোনালু ফুলের গুচ্ছটি এবার পুরো গাছসহ আমার কাঁধের ওপর হেলে পড়েছে। এইবার আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা ঠিক সোনালু ফুল নয়। মনে হচ্ছে আমাকে কোনো মখমল কাপড়ে কেউ জড়িয়ে ধরেছে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। সন্ধ্যার অন্ধকার আমার চোখের ওপর নৃত্য শুরু করে দিয়েছে। এরপরেই আমার নাকে এসে লাগে বকুলের ঘ্রাণ। মনে হচ্ছে বকুলের রসে টইটম্বুর একটা জলাশয়ে আমাকে হাত পা বেঁধে কেউ ফেলে রেখেছে। আমার মাথা অবশ হয়ে আসে। আমি সম্ভবত অবশ থাকি। এইভাবে কতক্ষণ পড়ে থাকি জানি না। মারিয়া আমার কাঁধ থেকে ওর মাথা সরিয়ে নিয়েছে। মারিয়া নিজেকে বেশ সামলে নিয়েছে বলে মনে হলো। আমার চোখের সামনে হাত দিয়ে ইশারা করে দূরে পুকুরের অপর পাশে ইঙ্গিত করে। একটি গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ওখানে থেমে আছে। মারিয়া বলে ওঠে, প্রক্টরিয়াল টিমের গাড়ি। চলো আজ যাই। আমি মারিয়াকে অনুসরণ করি। একটা রিকশায় গিয়ে উঠি। মারিয়া হুড তুলে দিতে বলে। আমি হুড তুলে দিই। এই প্রথম রিকশায় হুড তুলে বসি। ঢাকা শহরে কোনোদিন নিজে কোনো দিন কাউকে নিয়ে রিকশায় হুড তুলে বসব আমি ভাবিনি। না ভাবতেই আমি মারিয়াকে নিয়ে রিকশায় হুড তুলে বসতে পারছি। রিকশায় বসে মারিয়া আমার একটি হাত মুঠোবন্দি করে বসে থাকে। মুহূর্তেই মনে হলো─ আমার এই হাতটিকে আমি হিংসে করি। আমার শরীরের অন্য প্রত্যঙ্গগুলোও এই হাতটিকে হিংসে করে। মনে হয়, কেন মারিয়া কেবল এই হাতটিকেই মুঠোবন্দি করে রেখেছে। আমার আরেকটি হাত, পা, নাক, কান, মাথা আমার সবটা কেন মারিয়া মুঠোবন্দি করছে না? কেন এই হাতটি মারিয়ার উত্তাপে গলে যাওয়ার সুযোগ পাবে! আমি মারিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলি:
‘হাতটা এভাবে ধরেই রাখবে? ছাড়বে না?’
‘না। ছাড়ব না।’
‘আমার কষ্ট হয়। ছেড়ে দাও।’
‘তোমার কোথায় কষ্ট হয়?’
আমি মারিয়ার সামনে অপর হাতটি তুলে ধরে বলি :
‘এই হাতটির কষ্ট হয়।’
মারিয়া আমার হাতটিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে। হাতটিকে নিয়ে ওর বুকের মাঝে রাখে। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে :
‘এইবার কষ্ট হয়?’
‘আমি মরে যাব। আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে।’
‘এত অল্পতেই মরে যেতে চাও কেন তুমি?’
‘জানি না।’
‘কী জানো তুমি?’
‘কিছুই জানি না’।
মারিয়া আমার হাতটিকে ওর কামিজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। আমার ভয় করে। আমার এই খসখসে হাত মারিয়ার গলায় যদি দাগ পড়ে যায়! আমার আঙুলগুলো যেন প্রাণ পায়। কেমন অক্টোপাসের মতো মারিয়ার কামিজের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করে। আঙুলগুলো হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে যায়। আমার কথা শোনে না। আমার আঙুলগুলো আরও বেপরোয়া হলে মারিয়া গলে যায়। একটু আগেই সোনালু লতার মতো মারিয়াকে এখন মনে হচ্ছে একটা গোলাপি মোম মধ্যরাতে গলে গলে নত হয়ে পড়ছে। আমার আঙুলগুলো এবার সীমাহীন বেপরোয়া হয়ে যায়, মনে হয় ওরা সাগরের তলদেশ থেকে মণিমুক্তো খুঁজে বেড়াচ্ছে। মারিয়া হঠাৎ সোজা হয়ে বসে। আমার হাত ছেড়ে দেয়। কামিজের ভেতর থেকে আমার হাত বের করে আনে। গলার ওড়না ঠিক করে। আমার মাথার চুল ঠিক করে দেয়। কানের কাছে মুখ এনে বলে:
‘আজ আর নয়। আমি সহ্য করতে পারব না।’
‘কী সহ্য করতে পারবে না?’
‘তুমি বুঝবে না।’
‘বুঝিয়ে দাও।’
‘এখন না। আরেকদিন।’
আমাদের রিকশা জগন্নাথ হলের সামনে দিয়ে ফুলার রোড ব্রিটিশ কাউন্সিল ভিসি চত্বর পেরিয়ে রোকেয়া হলের গেটে চলে আসে। রিকশা থেকে নেমে আমরা বাদাম আর বুট ভাজা কিনি। মারিয়া আর দেরি করে না। হলের ভেতরে চলে যায়।
সেই রাতে আমি নিজের রুমে ফিরে বেহুঁশ হয়ে থাকি। আমার কিছু ভালো লাগে না। রাতে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙে মারিয়াকে স্বপ্ন দেখে। আমি মারিয়ার বুকের মাঝে নাক ডুবিয়ে বকুলের ঘ্রাণ নিচ্ছি। মারিয়া নিজের দুই হাতে বুকের দুটি অংশ আমার নাকের সাথে ঘষে চলেছে। আমি নাক তুলে আশ্চর্য এই দুটি মাংসপিণ্ডকে নিজের মুঠোবন্দি করি।