উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফকিুর রশীদ ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এক
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব দুই
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফকিুর রশীদ ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব ছয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। শেষ পর্ব
পাঁচ
মাঝেমধ্যে আমাদের যাপিত জীবনে এমন সব ঘটনাও ঘটে, যার কার্যকারণ মিলিয়ে ব্যাখ্যা পাওয়া ভার হয়ে ওঠে। একটি ঘটনার সঙ্গে অপর একটি ঘটনার সাদৃশ্যের সূত্র খুঁজে না পেয়ে তার নাম দেয়া হয় কাকতালীয় সাদৃশ্য। সম্প্রতি এ রকমই রহস্যময় ঘটনা ঘটে গেল শওকত আলীর পরিবারে।
এমনিতে চাকরি ছেড়ে আসার পর থেকে শওকত আলীর অফুরন্ত অবসর। অস্বাভাবিক মনে হতে পারে তবু সত্যি ঘটনা হচ্ছে তার চোখে মুখে কোথাও উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ছাপ নেই। আগামী দিনগুলোতে সংসার চলবে কী ভাবে, তা নিয়েও বুঝি কোনো দুশ্চিন্তা নেই। নাওয়া-খাওয়া-ঘুম আর স্ত্রীর সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে খুনসুটি; মাঝে মধ্যে ছেলেমেয়ের সঙ্গেও চুটিয়ে আড্ডা আহ্, দিনগুলো যদি এমনই ভাবনাহীন ভেসে যেত রাতের মত কিংবা উড়ে যেত মেঘের মত! শাহানা বেগম দীর্ঘ কুড়ি বছরের দাম্পত্যজীবনে খুব কাছে থেকে চেনা মানুষটাকেই নতুন করে দেখে। দীর্ঘদিন পর স্বামীর এই নিবিড় মধুর সান্নিধ্যের উষ্ণতা সে গভীল মমতার সঙ্গে উপভোগ করে; কিন্তু এই উষ্ণ ওমও কখনো কখনো তাকে দগ্ধায়, রক্তাক্ত করে? কী হলো লোকটার? এমন নিরুদ্বিগ্ন নিরুদ্যম কোনো মানুষ হতে পারে? সে খুব ভয়ে ভয়ে আড়াল থেকে স্বামীর চোখমুখ জরিপ করে, কোনো উত্তর মেলাতে পারে না। তখন আবার একান্তে নিভৃতে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে। এ রকম এক রৌদ্রছায়ার দিনে শাখারীবাজারের বিমলবাবু বহু কষ্টে ঠিকানা যোগাড় করে ভর দুপুরে হাঁপাতে হাঁপাতে এই বাসায় এসে হাজির। তার দু’চোখ উড়ন্ত। চেহারা বিপর্যস্ত। ঘরে ঢুকেই সে শওকত আলীর দু’হাত জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে ওঠে,
আমারে আপনি বাঁচান শওকত ভাই।
শওকত আলী ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রথমে। তারপর দু’পা পিছিয়ে কপালেল উপরে হাত উঁচিয়ে চোখ সরু করে তাকায়, যেন বহুদূরের অস্পষ্ট কোনো ছায়ার ভেতরে মানুষটিকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। বিমল বাবু আবারও হাত ধরে ডুকরে ওঠে, ভাই আমি বিমল। চিনতে পারছেন না? বিমলকৃষ্ণ সাহা?
সহসা বিমলবাবুকে বুকে জড়িয়ে শওকত আলী হা হা করে হেসে ওঠে, আপনাকে চিনব না? কী যে বলেন বিমলদা! কী খবর বলুন তো!
খবর বলবে কি, শওকত আলীর এই অসময়োচিত হাসিতে তার চোখমুখ শুকিয়ে যায়। ভাবনা হয়? লোকটা কি সুস্থ নেই!
এত যে বুক ভাঙা আর্তি তাকে স্পর্শই করল না। তবে আর কী বলতে আসা এতদূর। বিমলকৃষ্ণ সাহা অতিশয় সজ্জন মানুষ। ঢাকার শাঁখারী বাজারে কয়েক পুরুষের বাস। বংশানুক্রমিক ব্যবসাধারা থেকে সরে এসেছে অনেক আগেই। বাংলা বাজারে বিউটি বোর্ডিং পেরিয়ে অপ্রশস্ত এক গলির মধ্যে তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বিমল বুক্স। প্রতিষ্ঠা প্রত্যাশী উঠতি লেখকদের স্বেচ্ছাপ্রদত্ত পয়সায় বছরে গোটা দশেক বই প্রকাশ করা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্ডার মোতাবেক বিভিন্ন বই সরবরাহ করাই তার কাজ। এই তার নেশা এবং পেশা। পুরানো ঢাকায় বাস করার কালে কার যেন একটা বই প্রকাশের তদবির নিয়ে বিমল বুকসে গিয়েছিল শওকত আলী। অনেক দিন আগের কথা। বিস্তারিত মনেও নেই। তো সেই থেকে বিমল বাবুর সঙ্গে পরিচয়। দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতা। এক সময় পারিবারিক যোগাযোগ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। কোনো কালেই শওকত আলীর তেমন সাহিত্যপ্রীতি ছিল না। যৌবনে দু’দশটা শরৎ কাহিনী পড়া পর্যন্তই। কিন্তু এই বিমল বাবু সন্ধ্যেবেলার আড্ডায় একালেল লেখকদের বই হাতে ধরিয়ে দেয়। পড়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করে। পড়া হলে তা নিয়ে আবার কথা তোলে। তলে তলে কখন যে একটু একটু করে অদৃশ্য আঠায় জড়িয়ে ফ্যালে! সেই আঠা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে শওকত আলীর বাসা বদলের পর। কালেভদ্রে দেখা হয়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে? দু’জন দুই ভুবনের বাসিন্দা।
কিন্তু এতদিন পর এই অসময়ে বিমল বাবুর এ বাসায় আসার কারণ কী? এ ঘটনার মূলে আছে স্বপন, শওকত আলীর বড় ছেলে। লেখাপড়ার নামে লবডঙ্কা! উড়নচন্ডীর একশেষ। কোথায় যে তার দিন কাটে আর কোথায় রাত কাটে? সে খবর পাওয়া ভার। বাপ মা কারো কিছু বলার উপায় নেই। চোখ উল্টে তর্জন গর্জন করবে। তার গর্জনের মুখে দাঁড়ানো মুশকিল।
শওকত আলী তো এই সব দেখেশুনে একদিন নাটকীয় এক ঘটনাই ঘটিয়ে বসে। সে ছিল মধ্যরাতের কান্ড। রাত বারোটা বাজিয়ে ঘরে ফিরছে ছেলে। মায়ের কিছু বলার সাহস হয় না। বাপের চাঁদি চড়ক গাছ। রাগে ক্ষোভে থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। তবু সবাইকে অবাক করে নাটুকে বাবার মত শওকত আলী তার ছেলেকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে। কোথায় ধমকধামক, কোথায় বকাবকি; সে নিজেই কেঁদে আকুল হয়? আজ তিনদিন তুই কোথায় ছিলি বাপ!
অবাক করা প্রশ্নই বটে! এ রকম দু’একরাত বাসায় না ফেরার দৃষ্টান্ত এক দুই নয়, বহু জমা আছে। ওয়ারী থেকে বাসা বদলের ঘটনাটি সে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। শাজাহানপুর চলে আসার পরও সে সারাদিন সেই পুরানো ঢাকাতেই টইটই করে ঘোরে, রাতও কাটায় কখনও কখনও। এ নিয়ে বিস্তর কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে ইতিপূর্বে। কিন্তু এরকম নাটকীয় আক্রমণ সেই প্রথম। তাই প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতে একটুখানি সময় লাগে স্বপনের। পরক্ষণেই চোখ উল্টে বলে, আমি কি আর পরীক্ষা দেব না? পরীক্ষার কাজে মুন্সিগঞ্জ গিয়েছিলাম।
পরীক্ষা?
মানে এসএসসি পরীক্ষা? সে তো পরপর তিনবার পরীক্ষা দিয়ে সে হ্যাট্রিক করেছে। মনের দুঃখে বড় ভাইকে পেছনে ফেলে রেখেই এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছে আপন। এতেই কি তবে টনক নড়লো স্বপনের? উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গমনের বহু দৃষ্টান্ত এ দেশে চাল আছে বহুদিন থেকেই। কিন্তু কেবল সার্টিফিকেট অর্জনের উদ্দেশ্যে রাজধানী কিংবা বড় জেলা থেকে গিয়ে অনেকেই মফস্বলের অখ্যাত অজ্ঞাত স্কুল- কলেজে নাম লেখানোর রেওয়াজও এখন প্রায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। তবে কি স্বপন সে রকমই একটা সুযোগ নিতে চাইছে?
শওকত আলী ছেলেকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেই বলে, তুই যে আমাদের অনেক স্বপনের ধন বাবা! তুই মানুষ না হলে আমরা কী করে মুখ দেখাব! তুইই বল… মধ্যরাতের এই নাটকীয় আবেদনে সাড়া দিয়ে স্বপন কিছুদিন তার আচরণে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করে। মাস খানেক তো সত্যিই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোয় না। কারো সঙ্গে বিশেষ কথাও বলে না। ছোট ভাই আপনকে তো চোখের কোনায় দেখতে পারে না। তার আগে এসএসসি পাস করে আপন যেন খুবই অপরাধ করে ফেলেছে! কথায় কথায় ওই আপনের উপরে যত রাগ ঝাড়ে। একদিন দীনাকে ডেকে শোনায়? দেখিস এবার পাসটা করলেই আমি হাওয়া।
হাওয়া মানে?
হাওয়া মানে হাওয়া। চলে যাব বিদেশ। অনেক টাকা কামাব, অনেক।
অনেক টাকা? হাজার হাজার?
হা হা করে হেসেই আকুল হয় স্বপন, বলে, হাজার হাজার কি অনেক হলো? লাখ লাখ বল! কোটি কোটি বল!
শুধু সেদিন নয়, এরপরও বহুদিন সুযোগ পেলেই শুনিয়েছে? জীবনের জন্যে অনেক টাকার দরকার। অনেক টাকা। মাকে ডেকে জানতে চেয়েছে? এক সঙ্গে তুমি কত টাকা দেখেছ মা? আবার কখনোবা জিজ্ঞেস করেছে? টাকা দিলে তুমি কত টাকা পর্যন্ত গুনতে পারবে,
বলো দেখি মা?
শাহানা বেগমের বুকের ভেতর কেঁটে উঠেছে। তবু ঠোঁটে আলগা হাসি ঝুলিয়ে সে ছেলেকেই আঁকড়ে ধরেছে। কাতর কণ্ঠে অনুনয় করেছে, আমার টাকা লাগবে না। তুই মানুষ হ দেখি!
সেই স্বপনকে নিয়ে বিমল বাবুর যত কথা, যত আহাজারি। সে একবার সভয়ে জেনেও নেয়, স্বপন বাবাজি নেই তো বাসায়।
দিনে বেলা স্বপন থাকবে বাসায়? তাও ভর দুপুরে? তাই কখনো হয়? তার অনুপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হবার পর বিমল বাবু মুখ খোলে। সে জানায় ওয়ারী থেকে বাসা বদল করে শওকত আলী এখানে চলে এলেও স্বপনের সঙ্গে পুরানো ঢাকার সম্পর্ক কখনো বিচ্ছিন্ন হয়নি। তার যত খাতির সব মস্তান টাইপের ছেলেপিলের সঙ্গে। তা খাতির সম্পর্ক যার সঙ্গেই থাক, বন্ধু মানুষের ছেলে বাড়িতে গেলে তো আর তাকে ফেরাতে পারে না! বসতে দেয়, খেতে দেয়, তার মাধ্যমেই সবার খবর নেয়, সবাইকে বেড়াতে আসার আমন্ত্রণ জানায়। এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরের অধ্যায় যেমন মর্মান্তিক, তেমনই অমানবিক এবং এক রকম প্রতিকারহীনও বটে। দীনারই প্রায় সমবয়সী বিভা, বিমল বাবুর কনিষ্ঠ কন্যা। স্কুল থেকে ফেরার পথে স্বপন তাকে ফুঁসলিয়ে কোথায় কোন্; অন্ধকারের অতল তলে টেনে নিয়ে যায় এবং মহাসর্বনাশ ঘটায়। এরপর আর কী বাকি থাকে? প্রাণের হুমকি? সেই হুমকিও দেয়া হয়েছে? এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে…।
এরপর সেই রৌদ্রকরোজ্জল দুপুরে ঘনঘোর অন্ধকার নেমে আসে। স্তম্ভিত প্রহর কাটে বাক্যহীন। কার সাধ্য এই বজ্রপাতের পর স্ফূটস্বরে কথা বলে! সহসা সবার কর্ণকুহর যায় বধির হয়ে, বাগযন্ত্র হারায় ধ্বনি উৎপাদনের সক্ষমতা।