উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব দুই
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এক
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব দুই
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফকিুর রশীদ ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। র্পব ছয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব বারো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ায় খেলা।। রফিকুর রশীদ।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। বৈরী ছায়ার খেলা।। রফিকুর রশীদ।। শেষ পর্ব
দুই.
প্রমোশন পেয়ে নতুন চেয়ারে বসলেও অফিসের কারও সঙ্গেই শওকত আলীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনো হেরফের হয়নি। নতুন পদে গিয়ে তার মাইনে বেড়েছে। সেই সুবাদে কেবল তার বাসা বদল ঘটেছে মাত্র। পুরানো ঢাকার ঘিঞ্জি গলির মধ্যে নোনাধরা দেয়ালের এক স্যাঁতসেতে বাড়িতে দম বন্ধ হবার দশা ছিল। তার স্ত্রী এ্যাজ্মা রোগি। বুকে হাঁপানির টান। বাসা বদলটা সত্যিই খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল। যদিও এই পরিচিত প্রতিবেশ এবং বন্ধুবান্ধব ছেড়ে আসতে দুই ছেলেই প্রবল আপত্তি জানায়, তবু এই একটি কাজ এক রকম ঝটপট করেই ফেলে। শাজাহানপুর রেলগেটেরও বেশ খানিক আগেই তিন রুমের এক ঝকঝকে বাড়িতে এসে ওঠে। আলো হাওয়ার প্রাচুর্যে স্ত্রী শাহানার শরীরও অচিরেই ঝরঝরে হয়ে ওঠে। বড় ছেলে স্বপন যদিও মন বসাতে পারেনি, পুরানো ইয়ার বন্ধুদের টানে প্রায়ই চলে যায় ওয়ারী। সারাদিন হৈ হুল্লোড় করে কাটায়। রাত করে বাড়ি ফেরে। কোনোদিন হয়তো ফেরেই না। বাপমার টেনশন বাড়ায়। ওই এক স্বপন ছাড়া এই নতুন বাসা সবাই বেশ পছন্দ। কাছেই দীনার স্কুল। এমন কি শওকত আলীর অফিসের দূরত্বও অনেকখানি কমেছে। স্বস্তিকর এই বাসায় এসে স্ত্রীর সঙ্গে সে একদিন তামাশায় মেতে ওঠে, তোমার সিনেমা হলটাই কেবল দূরে পড়ে গেল শাহানা!
কী করবে বলো!
না, শাহানা বেগমের নির্দিষ্ট কোনো সিনেমা হল নেই। ভালো বই হলেই হলো। সিনেমাকে শাহানা বইই বলে। আর ভালো বই বলতে সামাজিক সেন্টিমেন্টের কাহিনীই তার সবচেয়ে প্রিয়। তা, এই এলাকায় সত্যিই সিনেমা হল নেই বললেই চলে। স্বামীর কথায় মুখ ঝামটা দেয় শাহানা বেগম, কত যে সিনেমা দেখও তুমি! আমি যেন রাতদিন কেবল
সিনেমা হলেই থাকি, কেমন? কী যে পেয়েছ আমাকে!
শওকত আলীও খুনসুটি করে,
এই নতুন বাসা থেকে তাহলে আর সিনেমায় যাবে না,
বলছ!
কী মুশকিল! ছেলেমেয়ে সেয়ানা হবার পর আমি কটা বই
দেখেছি, বলো!
দ্যাখোনি ঠিকই। রাজ্জাক-কবরীর বই এনে আমাকে তো
বেশ খুঁচিয়েছো!
আমি খুঁচিয়েছি! আচ্ছা মিথ্যুক তো!
হো হো করে হেসে ওঠে শওকত আলী। স্ত্রীর কাছে আপোষ প্রস্তাব দেয়,
আচ্ছা যাও, সামনে রবিবারে তোমাকে জোনাকী হলে নিয়ে যাব।
কাজ নেই আমার বই দেখে!
এই কৃত্রিম রোষ দেখে আবারও লাগামছাড়া হেসে ওঠে শওকত আলী। শাহানা বেগমও উঠে অন্য ঘরে চলে যায়। ঘরে বাইরে এমনই স্বস্তিকর সময়ে সহসা একদিন শওকত আলীর বুকের কপাট হাট করে খুলে ফ্যালে তারই অফিসের বস মেজর ইমরান চৌধুরী। নিভৃতে বুকের গভীরে প্রস্ফুটিত রক্তজবা দুমড়ে মুচড়ে ছিন্নভিন্ন করে দেন; ফলে পুরানো ক্ষতস্থানে খোঁচা লেগে আবার রক্তাক্ত হয়, সেই রক্তক্ষরণে শওকত আলীর অন্তর জুড়ে নেমে আসে উদ্যমহীন বিসাদ। মেজর ইমরান চৌধুরী পাকিস্তান প্রত্যাগত রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। সিলেটের মানুষ। অথচ জেনারেল ওসমানীকে দু’চোখের কোণায় দেখতে পারেন না। তাঁর সামনে ওসমানীকে জেনালেও বলা যাবে না। অমনি তেতে উঠবেন- কিসের জেনারেল! সব তার ভূয়া। গোঁপসর্বসব একটা মানুষ। রিটায়ার্ড লাইফ শুয়ে বসে এনজয় করার বদলে উনি লাফিয়ে উঠলেন গোটা জাতির কাঁধে। রাজনীতি করার খায়েশ হয়েছে! হুঁ! এতটাই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অতবড় একজন মানুষকে কটাক্ষ করেন যে ইমরান চৌধুরী, তিনিও কিন্তু রিটায়ার্ড লাইফ শুয়ে বসে কাটাননি মোটেই।
পাকিস্তান থেকে এসেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে
বুড়ি ছোঁয়ার মত জয়েন করার পরপরই গেলেন
রিটায়ারমেন্টে। কিন্তু অবসর নেয়ার অবকাশ কোথায়? স্বাধীন দেশের একটি অসামরিক সংস্থারও খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাঁর সেবা গ্রহণের। সংস্থার মাথার উপরে বসেই অফিসার থেকে পিওন পেয়াদা পর্যন্ত সবার পলিটিক্যার ব্যাকগ্রাউন্ডের ঠিকুজি উদ্ধারে তৎপর হন। এটাই যেন তাঁর সবচেয়ে জরুরি কাজ। দেশের সব রাজনীতিই তখন বুটের তলায় আর্তনাদ করছে, প্রকাশ্যে মুখ খুলবে কে? শেখ মুজিবের মত ক্যারিশম্যাটিক লিডারকে সপরিবারে হত্যার পরও যখন সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে না, জেলহত্যার মত নারকীয় ঘটনারও যখন মানবিক প্রতিবাদ হয় না; সেই দুঃসহ দুঃসময়ে মেজর ইরানের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কে? সর্বোচ্চ আসনে বসে নব টিপলেই সব তথ্য যার টেবিলে এসে হাজির হয়, শওকত আলী যে মুক্তিযোদ্ধা-এই সামান্য তথ্যটুকু জানতে তার কতটুকই বা সময় লাগবে! হেড অফিসের সর্বসাকুল্যে ১২৩ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর মধ্যে ক’জনই বা মুক্তিযোদ্ধা আছে! শওকত আলী ছাড়া আছেন এক মনিরুজ্জামান সাহেব, তিনি মুক্তিযোদ্ধা বটে, কিন্তু শওকত আলীর মত
ঘাড় বাঁকা স্বভাবের নন। ফলে উঠতে ঠুতে তিনি
এজিএম পর্যন্ত উঠে গেছেন। সামনে জিএম হবার মুলো ঝুলছে, তিনি গিললেই হয়ে যায়। কিন্তু তার নাকি, এ চাকরিতে আর পোষাচ্ছে না। বিমানবন্দর কেন্দ্রিক ক্লিয়ারিং ফরোয়ার্ডিং বিজনেসের সঙ্গে ইনডেন্ট-ইনভয়েস যুক্ত করার ফলে সাংঘাতিক ব্যস্ততা বেড়ে গেছে; যে কোনো দিন এ চাকরি ছেড়ে দেবেন। প্রায়শ তিনি ঘোষণা করেন- এ দাসত্ব আর নয়। যাত্রার ডায়ালগের মত টান টান উচ্চারণ তাঁর। তাঁকে নিয়ে আদৌ কোনো সমস্যাই কারো নেই। যত গভীর সমস্যা পারচেজ অফিসার শওকত আলীকে নিয়ে। এমনিতে ভীষণ সহজ সরল মানুষ, বিনয়ের অবতার, কারো সঙ্গে কোনো প্রকার হৈ হাঙ্গামা নেই। কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নে ভয়ানক ঘাড় বাঁকা। খুঁতখুঁতে। সব কিছু তলিয়ে দেখা স্বভাব। রাশভারী চেয়ারম্যান একদিন তাঁর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ডেকে সে কথাই বলেন, একটু ভিন্নভাবে, আপনি ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন, সেটা আমি জানি
শওকত সাহেব।
ছিলেন? ক্রিয়াপদের এই অতীতাাশ্রয়ী রূপ শওকত আলীর ভালো লাগে না মোটেই। বলতে ইচ্ছে হয়, আমি এখনো বেঁচে আছি এবং আপনার সামনেই আছি। এটা অতীত নয়, বর্তমান। কিন্তু সে কথা বলার আগেই চেয়ারম্যান সাহেব জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম ত্যাগের প্রতি তিনি সাংঘাতিক শ্রদ্ধাশীল। তবে প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধারই প্রধান দোষ-তারা অন্যের দিকটা বুঝতেই চায় না।…আরে ভাই পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের রাজাকার বলার মানে হয়? তারা কি সাধ করে মামাবাড়ি গিয়ে পড়েছিল? শওকত আলী খুব বিপন্ন বোধ করে। মনে করতে চেষ্টা করে-সে কি কোথাও এমন বেফাঁস মন্তব্য করেছে? বুক ঢিপ্ ঢিপ্ করে, সঠিক উত্তর পায় না। একবার আড়চোখে দেখে, তার বস হাতের পাইপে টোব্যাকে গোঁজার কাজে
ব্যস্ত। সে উঠে দাঁড়ায়, বলে,
স্যার, আমাকে কি…
বাক্য শেষ করতে দেন না চেয়ারম্যান সাহেব। মুখের পাইটে আগুন জ্বালিযে রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে তিনি বলেন, সিট ডাউন প্লিজ। আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, আমাদের এই কর্পোরেশন আপনাকে নিয়ে প্রাউড ফিল করে। অলওয়েজ উই প্রাউড অফ ইউ। শওকত আলী সত্যি সত্যি ধপাস করে বসে পরে, গদিআঁটা চেয়ারের গহবরে। তার কপালে ঘামবিন্দু ফোটে, গলা শুকিয়ে তেষ্টা পায়। সে হিসেব করেই উঠতে পারে না-আপাত প্রশংসার আড়ালে প্রকৃত গর্জনটা কতখানি ভয়াবহ হবে। এরই মাঝে হঠাৎ চড়–ই চড়–ই
ভঙ্গিতে উড়তে উড়তে রুমে ঢোকে পাবলিক রিলেশন্সের
এরিনা খান। কী যে উৎকট পারফিউম মেখেছে সে-ই
জানে। সারা ঘরে গন্ধ ছড়িয়ে সে চলে আসে
চেয়ারম্যানের বিশাল টেবিলের বাম পাশে, ঝটপট নিজের
উপস্থিতি জানায়,
এক্সকিউজ মি স্যার, আমায় ডেকেছিলেন!
রেডিও টেলিভিশনের নাটকে নায়িকাদের মত মিষ্টি গলায়
আবার ডেকে ওঠে,
স্যার!
একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে এতক্ষণে বস্ এদিকে দৃষ্টি দেন,
অ এরিনা! তোমাকে আমি কখন ডেকেছি?
স্যরি স্যার।
নো স্যরি নটি গার্ল। সিট ডাউন। সিট ডাউন।
দ্বিধাজড়িত চোখে এরিনা একবার শওকত আলীর দিকে তাকায়। তারপর ঝুপ করে বসে পড়ে ওই বাম পাশের চেয়ারেই।
বস্ তখন এরিনাকে বলেন,
ডু য়্যু নো শওকত আলী, আওয়ার গ্রেট ফ্রিডম ফাইটার!
এরিনা খল্ বলিয়ে ওঠে,
জ্বি স্যার। শওকত ভাইকে চিনব না কেন! খুব চিনি।
কিন্তু…
বাক্য শেষ করে না মহিলা। শওকত আলী দুর্ভাবনায় পড়ে, কী
বলতে চায় মহিলা? বস্ তাকিয়ে আছেন অর্থপূর্ণ
দৃষ্টিতে,
কিন্তু কী বলো!
আমি চিনলে কী হবে স্যার! শওকত ভাই তো কাউকে
চিনতেই চায় না!
শওকত আলী আকাশ থেকে পড়ে, বলে কী মেয়েটা! পাবলিক রিলেশন-এ কাজ করলে কি এরকম সর্ববিদ্যাপটিয়সী হতে হয়! আড়ালে আবডালে সবাই জানে সে চেয়ারম্যানের পেয়ারের লোক বলেই কাউকে পাত্তা দেয় না। এখন এই উল্টো ধারার অভিযোগ! অভিযোগই তো, নাকি? বস্ অবশ্য গাম্ভীর্য ভেঙে হা হা করে হেসে ওঠেন,
ফ্রিডম ফাইটার যে! সবাইকে চিনবে কেন!
প্রতিবাদ নয় ঠিক, বিনম্র আপত্তি জানাতে চায় শওকত
আলী,
স্যার…
আহ! ফ্রিডম ফাইটারদের ও রকম একটু ঘাড়বাঁকা হয়।
আমি জানি।
স্যার, আমাকে একটু বলতে দেবেন?
আপনি আর কী বলবেন! করাচি থেকে এসে নাগাদ তো দেখছি-মাথা নোয়াতেই চায় না। বাব্বা! সবাই যেন কাজী নজরুলের সেই উন্নত মম শির…নিজের কাব্যবোধে মশগুল হয়ে চেয়ারম্যান সাহেব নিজেই হা হা করে হাসেন। এর মধ্যে কখন তার পাইপের টোব্যাকো নিভে এসেছে। তিনি আগুন জ্বালাতে তৎপর হন। কিন্তু শওকত আলী পড়ে মহা গোলকধাঁধায়-কোন পাকে জড়িয়ে তাকে কোথায় কত দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে নির্ণয় করতে পারে না। এই যে ‘উন্নত মম শির’-এর মধ্যে প্রশংসা কতটুকু আর কটাক্ষ কতটুকু কে বলবে সেই কথা! নিজের রুমে ডেকে এনে এ সব হেঁয়ালির কী যে মানে হয়! ঠোঁটের কোনে পাইপ লট্ধসকে ধূব্ররেখা ভাঙচুরের সঙ্গে সঙ্গে বস্ তাঁর অন্তর্গত বাসনার কথা প্রকাশ করেন, শোনেন শওকত সাহেব, এই কর্পোরেশনের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা হিসেবে আমি আপনার জন্যে একটা কিছু করতে চাই।
শওকত আলী চমকে ওঠে। বস্ তখনো ঘোরের মধ্যে আছেন,
নিজে তো যুদ্ধ করতে পারিনি! এখন আপনার জন্যে যদি কিছু একটা করতে পারি! কিন্তু কী করা যায়, বলুন দেখি! বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে যায় শওকত আলীর। বড় অদ্ভুত খেয়াল তো চেয়ারম্যান সাহেবের! কী করতে চান তা জানেন না, তবে একটা কিছু করবেন। শওকতআলী খুবই আতঙ্কিত, গরীবের পেটে ঘি সইবে তো! সে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে জানায়,
এখানে আমি তো একা নই স্যার, একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা বলছেন কেন?
আপনি কি মনিরুজ্জামান সাহেবের কথা বলছেন?
জ্বি স্যার।
কিছু মনে করবেন না-মনিরুজ্জামান আদৌ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কি না আমার ঢের সন্দেহ আছে। বলেন তো- তাকে দেখে মুক্তিযোদ্ধা মনে হয়? বোগাস!
শওকত আলীর হাসি পায়। ছাগলে আর ভেড়াতে যেমন শনাক্তযোগ্য পার্থক্য আছে, দেখলেই বুঝা যায়, -মুক্তিযোদ্ধা কি সেই রকম কোনো প্রাণী বিশেষ হলো! মনিরুজ্জামানের কী যে দেখেছেন তিনি, কে জানে! একটু বিরতি দিয়ে পাইপের ধোঁয়া গিলে তিনি জানান, যুদ্ধ যদি করেও থাকেন, এখন হান্ড্রেড পার্সেন্ট পার্ভাটেড। সেভেনটি ওয়ানে আদৌ কোনো কমিটমেন্ট ছিল কিনা কে জানে! দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পাবলিক রিলেশন অফিসার
এরিনা খান বলে ওঠে,
আমি এখন উঠি স্যার!
উঠবে?
স্যার!
সিরিয়াস কোনো বিষয়ের মধ্যে মেয়ে মানুষের থাকতে নেই বুঝি!
আপনার কমেন্টসের পরে আমি কিছু বলতে পারি স্যার!
মাথা খারাপ! তুমি ফ্র্যাঙ্কলি বলো দেখি!
স্যার! আমার বিবেচনায় এখানে এখন একজনই মুক্তিযোদ্ধা, তিনি শওকত আলী।
এরিনা খানের এই মন্তব্যে শওকত আলী স্তম্ভিত। একেই বলে-যেমনে নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ!
চেয়ারম্যান সাহেবও একেবারে লুফে নেন, ঠিক বলেছ!
অনলি দি শওকত আলী।
এদিকে শওকত আলী কাৎরে ওঠে,
স্যার, আমার জন্যে আপনার কিচ্ছু করা লাগবে না।
রিভলভি! চেয়ার ঘুরিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব এবার একেবারে মুখোমুখি হন। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, এই হচ্ছে সত্যিকারের ফ্রিডম ফাইটার।
এরিনা খানও যোগ দেয়,
আমিও তো তাই বলি স্যার, শওকত ভাই হচ্ছে সাচ্চা মুক্তিযোদ্ধা।
বস্ তখন প্রচন্ড মুডে আছেন। মুখে তাই খই ফোটে, ফ্রিডম ফাইটার হবে আপনার মত ঘাড়বাঁকা, আপনার মত ত্যাঁদোড়, সেটাই তো স্বাভাবিক। সেটাই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, আপনি কী চান? কী করতে পারি আপনার জন্যে?
কী বলবে শওকত আলী! নিজে থেকে কীইবা বলার আছে তার! সে একেবারে কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ঘাড়মাথা চুলকিয়ে নিতিবিতি করে অবশেষে সে কেবল জানায়,
আমার গত বছরের ইনক্রিমেন্টটা হেল্ডআপ হয়ে আছে স্যার।
ইনক্রিমেন্ট? গুল্লি মারেন ইনক্রিমেন্ট!
সামান্য এই প্রস্তাবটি গৃহীত নাকি প্রত্যাখ্যাত হলো
প্রথমে সেটা বুঝেই উঠতে পারে না শওকত আলী। এটুকু তার ন্যায্য পাওনা। ঠুনকো এক অজুহাতে বন্ধ হয়ে আছে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট। আপাতত এটুকু ছাড় হলেই তার স্বস্তি। সেই আশ্বাস দেয়ার আগে বস্ পুনর্বার পাইপের মুখে টোব্যাকো ঠাসেন, আগুন জ্বালেন, হুসহাস করে বেশ ক’বার দম নেন। তারপর ঠোঁটের কোনে নিশ্চিন্তে পাইপ ঝুলিয়ে বলেন,
সে হয়ে যাবে।
এটুকু আশ্বাসেই শওকত আলীর মন অপার আনন্দে ভরে যায়।
দু’চোখে ছলছলিয়ে ওঠে কৃতজ্ঞতা। সে কৃতজ্ঞতা উপচে পড়ার আগে সে টেবিলের দিকে আরো এগিয়ে আসে। আর তখনই চেয়ারম্যান সাহেব সরাসরি জানতে চান, খান এ্যান্ড খান আপনাকে কত অফার করেছিল? এতক্ষণে শওকত আলী ভেতরে ভেতরে প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করে। আবারও কপালে ঘাট ফোটে। কানের লতি গরম হয়। তোলপাড় হয় বুকের বন্দরে। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারে না। চেয়ারের পেছনে নিশ্চিন্তে হেলান দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব মিঠেকড়া ধোঁয়া ছাড়েন। অপেক্ষা করেন। তারপর নিজেই বলেন,
আপনি ফ্রাঙ্কলি বলতে পারেন শওকত সাহেব।
কী বলবে শওকত আলী! সে স্পষ্ট টের পায়, শাঁখের করাতে তার পা পড়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কীইবা করার আছে! সে হতাশ চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়্ কী ভেবে বস্ নিজে থেকেই প্রস্তাব দেন,
আপনি অযথা সংকোচ বোধ করছেন। ঠিক আছে, আমি
ওদের বলে দেব, ওরা এক লাখই দিয়ে যাবে। আপনি ওদের মালগুলো ঝটপট রিসিভ করে নেবেন।
আর কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারে না শওকত আলী। সে জানায়,
আমাদের কোটেশন অনুযায়ী ওদের কোনো আইটেমই যে কোয়ালিফাই করে না স্যার।
সেটা আপনি ম্যানেজ করে নেবেন।
শওকত আলী চোখে সর্ষে ফুল দ্যাখে। হতাশায় ফ্যাসফেসে গলায় সে বলে,
আমি কীভাবে ম্যানেজ করব স্যার?
ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করবেন। সে আপনি পারবেন।
বসের এই আচ্ছা দেখে শওকত আলী ভয়ানক বিস্মিত হয়। খানিকটা ভীত সন্ত্রস্তও হয়। সে ভয়ে ভয়েই বলে,
আমি পারব কীভাবে স্যার!
খবরের কাগজ অলাদের যেভাবে ম্যানেজ করেছেন, ওইভাবেই সব দিক সামলান।
কী বলছেন স্যার?
ঠোঁটের ঝুলন্ত পাইপ নামিয়ে রেখে চেয়ারম্যান সাহেব একটা খবরের কাগজের ভাঁজ খুলে সামনে মেলে ধরেন,
সব কী লিখিয়েছেন কাগজে?
মাথায় বাজ পড়ে শওকত আলীর। কানের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ শব্দ হয়। দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে মেলে ধরা কাগজের দিকে তাকায়,
কী লিখেছে স্যার?
চেয়ারম্যান সাহেবের কণ্ঠ উত্তপ্ত হয়, বেশ চড়া গলাতেই বলেন, যা লিখিয়েছেন, তাই লিখেছে।
হঠাৎ এরিনা খানের দিকে ঘুরে আদেশ দেন,
তুমি এখন যাও। পরে ডাকছি।
এরিনা খান উঠে চলে যাবার পর শওকত আলী মরিয়া হয়ে বলে, খবরের কাগজে আমি লিখিয়েছি?
হ্যাঁ, খান এ্যান্ড খান কোম্পানির এমডি আমার ভায়রা ভাই-সে তথ্যও খুঁড়ে খুঁড়ে বের করেছেন, আবার সাংবাদিকদের কাছে কেচ্ছাও ঝেড়েছেন।
স্যার!
না, ভালোই করেছেন। এখন আমি বলছি-আপনি ওদের সাপ্লাই রিসিভ করবেন, এটাই শেষ কথা।
এক নিমেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে শওকত আলী। কাকুতি মিনতির পথেও আর নামতে ইচ্ছে করে না তার। সে এতক্ষণে স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেয়, আমাকে মাফ করবেন স্যার। এটা আমি পারব না।
‘পারিব না….’ এ কথাটি তো খুব খারাপ শওকত সাহেব!
চেয়ারম্যান সাহেব উত্তেজনাহীন শীতল কণ্ঠে ঘোষণা করেন,
‘তাহলে যে পারবে, তাকেই এনে বসানো হবে আপনার চেয়ারে, বুঝেছেন আশা করি।’
এরপরও শওকত আলী সবিনয়ে জানায়,
তবু বলছি স্যার, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
চেয়ারম্যান সাহেবও জানিয়ে দেন, বেশ তো! আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, আপনি করবেন না। কিন্তু আমাদেরই বা মুক্তিযোদ্ধা-ফোদ্ধা কী প্রয়োজন! প্রয়োজন হচ্ছে কাজের মানুষ। যাদে দিয়ে কাজ হবে তাকেই বসানো হবে ওই চেয়ারে!
আপনি কিন্তু বলেছিলেন-মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আপনি শ্রদ্ধাশীল!
বলেছি নাকি! তা বেশ, অশ্রদ্ধা তো আমি দেখাইনি জনাব!
তা ঠিক স্যার, আপনি শ্রদ্ধাশীল বটে।
এইবার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে সত্রিকারের কাল কুচুটে কেউটে। ত্রিশুলসদৃশ সরু জিভ লকলক করে নেচে ওঠে, ঝরে পড়ে তীব্র হলাহল। গোটা জাতি আপনাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, তাতেও হচ্ছে না! বেশ তবে আমরাও জানাব শ্রদ্ধা। বিজয় দিবসে স্বাধীনতা দিবসে গেটের বাইরে এসে দাঁড়াবেন।
ভিখিরিকে ভিক্ষে দেব। আপনাকে না হয় ফুলেল মালা দেব-হবে না? দাঁতে দাঁত পিষে উচ্চারণ করেন চেয়ারম্যান,
যত্ত সব বোগাস! আই ফাক দ্যা ফ্রিডম ফাইটার!
খুব নিকটেই কেথাও বজ্রপাত ঘটে যেনবা। সেই বজ্রবাহিত আলোকরেখায় এক মুহূর্তে শওকত আলীর চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে স্ত্রী এবং পুত্রকন্যার মুখচ্ছবি। এমন কি লোকান্তরিত পিতামাতার সকরুণ মুখও এরই মাঝে ভিড় জমায়। তবু সে এক সেকেন্ডের দশভাগেরও এক ভাগ সময়ের মধ্যেই শেষ সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলে এবং চেয়ারম্যানের মুখের উপরে বলে।
এক্ষুনি, এই মুহূর্তে আমি এই কর্পোরেশনের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। তবু কি আপনি মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে এই ভাষায় বলবেন?
চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন মানে? অতই সোজা?
হ্যাঁ, আমি ভেবেচিন্তেই বলছি, এ চাকরি করব না।
চেয়ারম্যানের সামরিক মেজাজ ধাঁ করে সপ্তমে চড়ে যায়। দু’চোখ বিস্ফোরিত করে তিনি মুখের লাগাম ছেড়ে দেন, চাকরি করব না বললেই হবে! ইয়ার্কি পেয়েছেন? হিসাব নিকাশ ক্লোজ করেন, তারপর আপনাকে এন্টিকরাপসন ফেস করতে হবে, হ্যাঁ! আর শোনেন, ফ্রিডম-ফাইটার সম্পর্কে আমার ভাষা এর চেয়ে সংযত হবে না। অল অব ইউ আর বাস্টার্ড!
মাল্টিকরাপসনের সিংহাসনে বসে আমাকে দেখাচ্ছেন এন্টিকরাপসনের ভয়?
ভয় দেখাচ্ছি নাকি জুজু দেখাচ্ছি, সময়মত টের পাবেন।
জাস্ট না, ইউ গেট আউট ফ্রম হিয়ার।
শওকত আলী উঠে দাঁড়ায়, শেষবারের মত সে বলে, যাচ্ছি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য ফিরিয়ে নিতে হবে যে!
আপনাদের জমানা শেষ মিয়া, কিসের হুমকি দিচ্ছেন?
এটা হুমকি নয়, এটা ভদ্রতা।
আমাকে ভদ্রতা শেখানো হচ্ছে! আউট। আউট নাও। নেভার আই উইথড্র মাই কমেন্টস অ্যাবাউট ফ্রিডম ফাইর্টার
হুঁ! মুক্তিযোদ্ধা! স্বগ্ধগগ থেকে দেবতা নেমে এসেছে!
আই ফাক ইয়োর মুক্তিযোদ্ধা। আউট ফ্রম হিয়ার।
টেবিলের উপরে পড়ে থাকা নিরীহ পেপার ওয়েট শওকত আলীকে হাতছানিতে ডাকে। গোলগাল জমাট কাচের খন্ড। পাথুরে ওজন। হাতে তুলে নেবে কিনা, উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারবে কিনা-দ্রুত ভেবে নেয়। এদিকে ওই জমাট কাচের ভেতরে ফুটে থাকা রঙবেরঙের ফুলের পরাগও যেন ইশারা করে, কাছে ডাকে। কিন্তু সকল আহব্বান সে উপেক্ষা করে। মাথার চুল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। অকারণেই সে হাতের মুঠো পাকায়। অতপর গোটা শরীর জোড়া থরথর কাঁপুনি নিয়ে চেয়ারম্যানের শীতল কক্ষ থেকে সে বেরিয়ে আসে। তখন কপালে তার ঘামবিন্দু। কপালের দু’পাশের রগ দাপায় দপ্ দপ্। মাথার চাঁদিতে আগুনের হলকা।