উপন্যাস।। আমাদের আগুনবিহীন কাল।। জাকির তালুকদার।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল//জাকির তালুকদার//প্রথম পর্ব//
- ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // দ্বিতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস / আমাদের আগুনবিহীন কাল / জাকির তালুকদার / তৃতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস /আমাদের আগুনবিহীন কাল /জাকির তালুকদার /চতুর্থ পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পঞ্চম পর্ব
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // ষষ্ঠ পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// সপ্তম পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// পর্ব আট
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব নয়
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব দশ
- উপন্যাস।। আমাদের আগুনবিহীন কাল।। জাকির তালুকদার।। পর্ব এগারো
পরদিন আউটডোরে বসার কথা ছিল না। সকাল থেকেই মায়াদের আসার অপেক্ষা করছিল ইমরুল। বুকের মধ্যে কেমন যেন এক অচেনা অস্থিরতা। কোনো বইতেও মনোযোগ বসছে না। বাধ্য হয়েই আউটডোরে গিয়ে বসেছে। রোগীর ভিড়ে একটু পরেই ভুলেও গেছে অন্য সব কথা। বেলা এগারোটার দিকে ফরদু মিয়ার পেছন পেছন পরদা ঠেলে মায়া আর তার বাবা যখন ঢোকে, তখন আক্ষরিক অর্থে ইমরুলের টেবিলের চারপাশে মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করছে রোগীর দল। এই ভিড় ছেড়ে তাৎক্ষণিকভাবে উঠে পড়া অসম্ভব।
পকেট থেকে চাবি বের করে ফরদু মিয়ার হাতে দেয় ইমরুল। মুখে বলে- আমার আত্মীয়। আমার কোয়ার্টারে নিয়ে যাও।
সঙ্গে কিছু টাকা একটু হাত আড়াল করে গুঁজে দেয় ফরদু মিয়ার হাতে। চাপাস্বরে বলে কিছু নাশতা দিও। আমি এই রোগী কয়টা শেষ করে আসছি।
সেই রোগী কয়টা শেষ করতেই এক ঘণ্টা লেগে যায়।
খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে জোরপায়ে ডরমিটরির দিকে হাঁটে ইমরুল। এই-ই প্রথম নিজের ঘরে ঢোকার সময় কেউ একজন দরজা খুলে দেয় তাকে। মায়া নয়, মায়ার বাবা। হোক। তবু তো একটা পরিবর্তন।
পরিবর্তন আরও হয়েছে। বেশ অনেকটাই। পুরো ঘর ঝকঝক তকতক করছে। ঝাড়ামোছা করা হয়েছে নিপুণ ভঙ্গিতে। বিছানার চাদর-বালিশ টান টান সুন্দর করে গোছানো। যে খাবারগুলো ফরদু কিনে দিয়ে গেছে, সেগুলো যেন তারই জন্য টেবিলে সুন্দর করে বেড়ে রাখা।
ইমরুলে মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে- এসব কী?
মায়ার মুখে নির্মল হাসি। বলে- চুপচাপ বসে থাকার অভ্যাস নাই তো। বুঝেনই তো গাঁয়ের মেয়ে আমি। আমি কুনোদিন আপনাদের মতো ভদ্দরলোকের বাড়ি ঢুকিনি। তা-ও সাহস করা হাত লাগাইছি। খুব খারাপ হইছে গুছান?
সত্যি কথাটাই বলে ইমরুল- এখানে আসার পর থেকে আজই প্রথম মনে হচ্ছে এটা একটা বাড়ি।
মৃদু হাসির সাথে প্রশংসাটুকু গ্রহণ করে মায়া। জিজ্ঞেস করে- আপনের রান্ধন করা দেয় কে?
সালেহা খালা।
তার যদি আসার দেরি থাকে আমি আপনের চাল-ডাল ফুটায়া দিতে পারি। ইকটু রুচিবদল হবি তাহলে।
আজ থাক মায়া। আজ বরং আমরা কথা বলি। খুব জরুরি কয়েকটা কথা বলার আছে আমার।
বলেন।
ডাইনিং টেবিলেই বসে তিনজন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করে ইমরুল। একটু পরেই টের পায়, এভাবে চেষ্টা করা বৃথা। সে আসলে গতরাতে প্রায় সারারাতই জেগে জেগে চেষ্টা করেছে, কিন্তু নিজের চিন্তাকেই গুছিয়ে নিতে পারেনি। কাজেই গুছিয়ে কথা বলতে পারার প্রশ্নই ওঠে না। সে তাই প্রায় মরিয়া হয়েই স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর ছেড়ে দেয় নিজের জিভকে। তড়বড় করে বলে আপনাদের বংশের ছইরউদ্দিনকে রিভলবারের গুলিতে খুন করেছিলেন যে পুলিশ অফিসার, তার নাম ছিল আব্দুল করিম। করিম দারোগা নামেই সবাই চিনত তাকে।
মায়া এবং তার বাবা নিশ্চুপ বসে থাকে। প্রতিক্রিয়াহীন। এতদিন পর ছইরউদ্দিনকে কে গুলি করেছিল তার পরিচয় জানাটা আর মোটেই গুরুত্ব বহন করে না তাদের কাছে।
ইমরুল নিজের মতো করে বলে চলে- আব্দুল করিম পরে এই কাজের জন্য ইংরেজ সরকারের কাছে পুরস্কার পায়। প্রমোশন পায়। করিম দারোগা একসময় খেতাব পেয়ে হয় খান বাহাদুর আব্দুল করিম। তার ছেলে মুসলিম লীগের আমলে, মানে পাকিস্তানের আমলে, এমএলএ হয়েছিলেন। আরেক ছেলে অনেক বড় ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে আব্দুল করিমের এক নাতি প্রথমে আওয়ামী লীগের এমপি, পরে বিএনপির এমপি, পরে জাতীয় পার্টির এমপি, এখন আবার আওয়ামী লীগের এমপি।
এইসব কথা আমারে শুন্যা কী লাভ?
মায়ার প্রশ্ন যেন শুনতেই পায়নি ইমরুল। সে তো মায়াদের লাভের জন্য বলছে না, বলছে নিজের ভার লাঘবের জন্য। সেই তোড়েই সে বলে যায়- এই বিলাসপুরের হাটে ছইরউদ্দিনকে গুলি করেছিলেন যে করিম দারোগা, তিনি ছিলেন আমার পরদাদা।
এবার একটু চমকায় মায়া এবং তার বাবা দু’জনই।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ইমরুল। সামনে ঝুঁকে কথা বলতে থাকে ওদের আরও ভালো করে শোনানোর জন্য আমি এখানে, এই বিলাসপুরে এসেছি শুধু আপনাদের, মানে ছইরউদ্দিনের বংশধরদের খুঁজে বের করার জন্য।
তা খুঁজে তো পাইছেন। এখন কী করবেন? মায়া বলে কিছুটা লঘুস্বরে।
প্রায়শ্চিত্ত করব। আমার পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব।
কীভাবে?
সেটাই তো জানতে চাই। বলুন আমি আপনাদের জন্য কী করতে পারি?
চুপচাপ বসে থাকে মায়া। তার বাবার চোখ চকচক করছে। মনে মনে লোকটা অঢেল টাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে কত টাকা চাওয়া যায় ভাবছে। কত হাজার? দূর হাজার না, লাখের নিচে হওয়া যাবি না।
কিন্তু তাকে তো বটেই, ইমরুলকেও পুরোপুরি হতবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মায়া। বলেÑ চলো বাবা আমরা যাই। ডাক্তার সায়েব আরাম করুক।
মানে?
মানে আমরা বাড়িত যাচ্ছি।
তাহলে আপনারা কি আমার পরদাদাকে ক্ষমা করবেন না? কোনো মূল্যেই না?
ঐসব তো কবেই চুক্যাবুক্যা গ্যাছে ডাক্তার সাহেব। আপনে করতে চাইলে একখান কাম করতে পারেন। হাটে ঐ যে শহিদ বেদিডা ছিল, সেইটারে ভালো করে বানায়া দ্যান।
অবশ্যই দেব। আর কিছু চাইবেন না? নিজেদের জন্য, পরিবারের জন্য?
ক্লান্ত কণ্ঠে মায়া বলে- পরিবারে অভাব আছে বটে, কিন্তু সেইডা আর বেশিদিন থাকবি না। আমার ছোট বোইনডা গার্মেন্টে কাম করে। আর আমারও চাকরি হয়্যা গেছে।
কোথায়?
জর্ডানে। গৃহকর্মীর চাকরি।
হা হা করে ওঠে ইমরুল খবরদার ওই চাকরিতে যাবেন না। আরে আরব মানুষগুলোকে তো আপনি চেনেন না। ওরা সব শয়তানের হাড্ডি। আর অসভ্য। আপনার কিছুতেই ওখানে যাওয়া চলবে না।
তাহলে আমি কী করব? কাম তো করা লাগবি আমার।
টেবিলে ঘুরে একেবারে মায়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ইমরুল। হঠাৎ সে এমন একটা কাজ করে, যার কথা ঘরের অন্য কেউ তো দূরের কথা, নিজেও স্বপ্নেও ভাবেনি কোনোদিন। সে মায়ার একটা হাত টেনে নেয় খপ করে নিজের হাতের মধ্যে। কাতরকণ্ঠে ভিখারির মতো বলে- আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই মায়া!
বজ্রাহত সময় কাটতে থাকে তিনজনের। কতক্ষণ যে তিনজনই নির্বাক ছিল তা কারও মনে নেই। তবে এবারও সবার আগে নিজেকে ফিরে পায় মায়া। ইমরুলের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে- বড়লোকের খিয়াল। এক বড়লোকের ছাওয়ালের খিয়ালের দাম দিছি একবার। আর পারব না। চলো বাবা আমরা যাই।