ট্রাজেডির রাজপুত্র: অশ্রুভেজা রাসেল আখ্যান। ফারুক নওয়াজ

জীবন এমনই ছোট। মানুষ তো একটি বৃক্ষের সমান সময়ও বাঁচে না। তবু ছোট এই জীবন কতো কিছুই করতে চায়। স্বপ্ন তাঁর আকাশ ছুঁতে চায়। হয়তো পারে না; তারপরও মানুষ তার সীমাবদ্ধ জীবনায়ুর মধ্যেই বহু কীর্তি রেখে যায়। জীবনের শেষ মুহূর্তেও তার আকাক্সক্ষা থাকে আরো অনেক কিছুই করার। হ্যাঁ, পরিণত বয়স পর্যন্ত মানুষ কিছু অন্তত করতে পারে।
জগতের সুন্দর যা কিছু কীর্তি তা মানুষই করে যায়। অবশ্য এর জন্য চাই পূর্ণাঙ্গ জীবন। যেমন রবীন্দ্রনাথ, তলস্তয়, বার্ট্রান্ড রাসেল, দ্য ভিঞ্চি— এমন অনেকেই। এক জীবনে তিন জীবনের কীর্তিতে সমুজ্জ্বল তাঁরা।
আমাদের শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনের প্রাপ্তির ব্যাপকতা লক্ষ করি তাঁদের মতোই পরিণত জীবনের অধিকারীদের সৃষ্টিতে। কিন্তু আমাদের সেই প্রাপ্তির জন্য জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্বাভাবিক মৃত্যু এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর মাঝে বিস্তর ফারাক। আর যদি ফোটার আগেই কেউ ঝরে যায় তা হলে আক্ষেপটা থেকেই যায়। হয়তো তার কীর্তিতে মানুষ ও জগৎ নানাভাবে উপকৃত হতো আলোকিত হতো আগামীর পুঞ্জিভূত আঁধার।
‘বত্রিশের সবুজ পাতা’ তেমনই এক না-ফোটা ফুলের আখ্যান। চেয়েছিল সে পাপড়ি মেলে দিয়ে ছড়িয়ে দিতে আপন সৌরভ। হয়তো সে সেভাবেই ফুটে উঠত যেহেতু তেমনই এক বাগানের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সটান বৃক্ষের শিশু হয়ে সে আনন্দের কম্পন তুলেছিল।
না— ফুল নয়, পাতা নয়; সে সত্যিকারের এক মানবশিশু। তার একটা নাম ছিল। সুন্দর নাম। বিখ্যাৎ এই নামটা তার মহান পিতা তাঁর প্রিয় মনীষীর নামে রেখেছিলেন। আর সেই শিশুর পিতা— তিনিও তো বলব, আকাশ ছুঁয়েছিলেন। তাঁর জীবনটাও যে পরিণত আয়ু পেয়েছিল তাও নয়। মাত্র চুয়ান্ন বছর সাত মাসের জীবনেই তিনি একটি জাতিসত্তার পরিচয় হয়ে উঠেছিলেন।
শত শত বছরের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-ক্রন্দিত অধীন জাতিকে তিনি এনে দিয়েছিলেন অবারিত মুক্তির স্বাদ—স্বাধীনতা। বিশ্ব চমকিত হয়েছিল তাঁর দেশপ্রেম, সাহসিকতা, নেতৃত্বের অবিস্মরণীয় কীর্তিতে। বিশ্বজনদের কেউ বলেছেন, আমি হিমালয় দেখিনি; তবে তাঁকে দেখেছি। অনেকেই বলেছেন, রাজনীতির মহান কবি তিনি।
হ্যাঁ, তিনি। নাম তাঁর শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির সহস্র বছরের স্বপ্নের মহানায়ক— জাতির জনক তিনি। দেশপ্রেম, সাহসিকতা, সততা, দয়া মমত্ববোধ ও মানবিক সৌন্দর্যে দেদীপ্য অতুলনীয় সেই মৃত্তিকাপুরুষের ঘর আলো করা সবচেয়ে কনিষ্ঠ শিশুপুত্র রাসেল। শেখ রাসেল।
সেই রাসেলকে নিয়েই রচিত এক অনন্য আখ্যান— ‘বত্রিশের সবুজ পাতা’। সাহিত্যের শাখা বিভাজনে এটি যে একটি কিশোর উপন্যাস হিসেবেই দেখবে সবাই। কিন্তু আমি সেটা মনে করি না। এ যন কোটি হৃদয়ের আবেগ ও ভালোবাসার অমর আখ্যান।
সেই রাসেলকে নিয়েই রচিত একটি উপন্যাস— ‘বত্রিশের সবুজ পাতা’। একটি শিশুর জীবন নিয়ে সেরা অনেক গল্প-উপন্যাস অতীতে রচিত হয়েছে কিন্তু সেখানে ছিল লেখকের হৃদয় ভাবনার শিল্পিত প্রকাশ। হয়তো বাস্তব কোনো শিশু-জীবন তাদের অন্তর্লোকে স্থান পেয়েছিল সেই বাস্তবতার জীবনের সঙ্গে কল্পনার মিশেলেই সেসব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এই উপন্যাসটিতে লেখকের কল্পনার উপাত্ত সত্যের সংগ্রহ থেকে আহরিত হয়েছে।
১৫ আগস্ট— বাঙালির সবচেয়ে বেদনার দিন। ইতিহাসের শোকার্ত এই তারিখটি এলেই বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির চোখ। নৃশংসতার মাত্রা কতো দীর্ঘ হলে হিংস্র-পশুকেও অতিক্রম করে যায় মানুষ!
হ্যাঁ, তারা তো মানুষই ছিল; মানুষের চেহারাতেই তারা সেই মধ্য রাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালির আলোর ঠিকানা বত্রিশ নম্বরের বাড়িটিতে। ওরা কি শুধুই হত্যা করতেই এসেছিল বাঙালির সহ¯্র বছরের স্বপ্নের রূপকারকে? তারপরও তারা ভেবেছিল তাঁকে হত্যা করলেই সব শেষ হবার নয়; আলোর উৎস থেকে বিচ্ছুরিত দ্যুতিগুলোকেও নিভিয়ে দিতে হবে। সবাইকেই হত্যা করল ওরা— তারপরও সেই সবুজ পতাটিই বাদ ছিল। যে বাতাসে থরথর স্বরে কাঁপছিল, যে নিভে যাওয়া আলোর ভেতরে এক চিলতে দ্যুতি ছড়িয়ে তখনও জানান দিচ্ছিল— এখনও আঁধার হয় নি; বুঝেছিল ওই দ্যুতিটুকুই নক্ষত্র হয়ে উঠে সব আঁধারকে গ্রাস করতে পারে। এই ভয়েই ওরা সবশেষে সেই দ্যুতিটাকেও চিরতরে নিভিয়ে দিল।
শেখ রাসেল। ছোট্ট সুন্দর একটি শিশু। যে শিশুটিই আজ ইতিহাসের মহা শিশু হয়ে এদেশের প্রতিটি শিশুর অন্তরে ঠাই উজ্জ্বল হয়ে জেগে থাকে— পনেরই আগস্ট, আর আঠারোই অক্টোবরে। তার নিভে যাওয়ার, আর জন্ম নেওয়ার দুটি তারিখই। অর্ধশত বছরের জীবনের বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ সময় কেটেছে সংগ্রামে আর কারাগারে। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন শেষে স্বাধীনতার স্থপতি পাকিস্তানের বন্দি শিবির থেকে স্বাধীন স্বদেশে ফিরে মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি সন্তানদের নিবিড় সান্নিধ্য কিছুটা পেয়েছিল; তার মাঝেই বিধ্বস্ত স্বদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে ছুটে বেড়াতে হয়েছে দিনরাত। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে তিনি নিজের বাড়িটিতেই অফিস বানিয়েছিলেন অবসরেও। থাকেননি রাজকীয় রাষ্ট্রীয় ভবনে। রাজপথের, মঞ্চের, সংগ্রামের মানুষের নেতা শেখ মুজিব যে বাড়ি থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর বিপ্লবের যাতা— থেকেছেন সেই সাদামাটা দোতলা বাড়িটিতে। ছিল না নিরাপত্তার কোনো বালাই।
তিনি গণমানুষের আপনজন। মৃত্তিকা থেকে উত্থিত নেতার পা ছিল সে মাটিতেই। সন্তানরাও সেই সাধারণ জীবনের পথেই হেঁটেছিল যাচ্ছিল। বড় দুই ছেলে যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর যোদ্ধা। খেলাধুলা, সংস্কৃতি নিয়েই ব্যস্ত একজন, আর একজন দেশমাতৃকার অতন্দ্র প্রহরী হতে চেয়েছিল— তেমনই শিশু রাসেল প্রকৃতির মাঝে বেড়ে উঠছিল— এক রংধনু স্বপ্ন নিয়ে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সন্তানদের কখনোই রাষ্ট্রশাসনের জন্য গড়ে তুলতে চান নি। রাজনীতির মাঠে কেউই বেসামাল হন নি।
রাসেলকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন সে হবে ঠিক বার্ট্রান্ড রাসেলের মতোই একজন বিশ্বশান্তির প্রতীকপুরুষ— চিন্তানায়ক অথবা লেখক। সেই রাসেলকেও ঘাতকরা বাঁচতে দিলো না।
ছোট রাসেল তাঁর বিকেলটা কাটাতে ছোট সাইকেলে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিবেশী ছেলেরাই ছিল তার বন্ধু। সাধারণ শিশুদের মতো স্কুলে যেত পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে। সন্ধ্যায় পড়তে বসতো গৃহশিক্ষিকার কাছে। তাঁর সঙ্গে তার সখ্য। জন্মদিনে তার মন ছটফট করত … তার প্রিয় শিক্ষিকার অভাবে। হাসু আপু, রেহেনা আপু, আর ভাইয়াদের সঙ্গে তার কতো যে খুনসুটি, কতো আদর, আবদার…।
টবে কবে কখন কি ফুল ফুটল, পায়রাগুলোকে ঠিক মতো খাবার দেয়া হলো কি না, খোঁজ-খবর নেয় ছোট রাসেল। বাবার সঙ্গে সে কয়েকবার বিদেশে ঘুরেছে। হাসু আপুর ছেলে ছোট্ট জয়কে সে আদার করে কতোই চুমু দিতো…। ছোট্ট সুন্দর একটা রংধনু জীবন।
প্রজাপতি, ফড়িং আর ছোট লেজতোলা দোয়েলের সঙ্গে ছুটে ছুটে খেলা করত সে।
বাড়ির সবচেয়ে ছোট, সবার আদরের রাসুমনি। জীবনের সংজ্ঞা সে জানত না। পুণ্যপুত এক রূপকথার রাজপুত্র যেন। রূপকথার গল্পকে সত্য ভাবতেন; সেই ছোট্ট রাসেল— রাসেলের ছোট্ট জীবন। এত ছোট জীবন যে অনেক স্মৃতি, অনেক ঘটনা, অনেক ব্যঞ্জনা, উপমা ও কাহিনির নায়ক হতে পারে তা কথাকার মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ‘বত্রিশের সবুজ পাতা’র পরতে পরতে সৃষ্টি হয়ে ওঠে।
১৫ আগস্ট একটি ট্রাজেডির নাম। এই ট্রাজেডির ছোট্ট সুন্দর মায়াবী রাজপুত্র সে। সে ‘বত্রিশ নম্বরের শোকাবহ ইতিহাসের অক্ষরগুলোতে কচি প্রাণের রক্তের রংও তো মিশে আছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্য জাতির বুকে হাহাকার ওঠে, আর ছোট্ট রাসেলের জন্য কোটি কোটি চোখ ছলছল করে ওঠে। তাই তো সে আজ ইতিহাস।
ছোট্ট রাসেলকে নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে। যখনই ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে লেখা হয় সেখানে রাসেল অধ্যায় এসে যায়। সাংবাদিকের কলমে রাসেল উঠে আসে, ইতিহাসের তথ্যে রাসেল উঠে আসে, প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণে রাসেল উঠে আসে, সবার ভাবনায়। লেখকের রচনায়, গল্পে, উপন্যাসে, ছড়ায়, গানে রাসেল কতোভাবেই জেগে ওঠে।
নিয়োগীর এই উপন্যাসটিও সেই ধারাবাহিকতায় একটি অনন্য সত্য রূপকথা।
রাসেল জীবনের ছোট ছোট ঘটনা, স্মৃতি, গেঁথে গেছে কোথাও স্বপ্নের রং, কোথাও খুনসুটির আবীর, কোথাও মমতার প্রলেপ, বুলিয়ে বুলিয়ে ইতিহাসকে ধরে ধরে শিল্পের ক্যানভাসে মায়াবী তুলি দিয়ে লেখক এঁকেছেন এক অসাধারণ রাসেলের ছবি। পাঠক কি সত্যিই কোনো উপন্যাস পড়েছেন না কি কোনো অপরূপ রূপকথা পড়তে পড়তে বুক ভারী হয়ে আসবে, চোখ ভিজে যাবে, কী এক মায়ায় মন জড়িয়ে যাবে। তবুও মনে হবে সব সত্যি। সব ছিল। রাসেল— ছোট্ট রাসেল। ‘বত্রিশের ছোট্ট সুন্দর সবচেয়ে আদরের, মায়ামায়া চোখের মিষ্টি ছেলেটা। আহা! তাকে কেন মারল ওরা! তারপরও মনে হবে রাসেল মরে নি। আছে, আছে সে সবখানেই। বত্রিশের ওই বাড়িতে। ওই রবীন্দ্রসরোবরের ধারে। অথবা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে— ক্লাস ফোরের একেবারে সামনের বেঞ্চিতে রাসেল বসে আছে ঠিকই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *