উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব দশ
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল//জাকির তালুকদার//প্রথম পর্ব//
- ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // দ্বিতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস / আমাদের আগুনবিহীন কাল / জাকির তালুকদার / তৃতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস /আমাদের আগুনবিহীন কাল /জাকির তালুকদার /চতুর্থ পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পঞ্চম পর্ব
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // ষষ্ঠ পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// সপ্তম পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// পর্ব আট
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব নয়
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব দশ
- উপন্যাস।। আমাদের আগুনবিহীন কাল।। জাকির তালুকদার।। পর্ব এগারো
ছইরউদ্দিনের ভিটায় বসে আছে ইমরুল।
তার কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। ছিল দুই মেয়ে। তারা দু’জনেই এখন মৃত। ভিটায় আছে মেয়েদের ছেলেরা। ছোট ছোট মাটির ঘর। সামনে ছোট ছোট উঠোন। গেঁড়ি-গুঁড়ি বাচ্চারা উঠোনের মাটিতে খেলছে হাঁস-মুরগির সাথে। ছাগল-কুকুরের সাথে। বোঝাই যায় খুব দুরবস্থায় আছে এই ভিটার সব বাসিন্দা। ছইরউদ্দিনের ছোট মেয়ের পুত্র ষাট পেরিয়েছে। তার দুই মেয়ে। একজন ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করে। আর বড় মেয়েটা, খুব সুন্দরী ছিল, তাকে প্রায় জোর করে বিয়ে করেছিল এলাকার প্রভাবশালী মেম্বারের লুচ্চা পুত্র। বছরখানেক ভোগ করে তাড়িয়ে দিয়েছে। তালাকের নামে বাপের হাতে গুঁজে দিয়েছিল কয়েক হাজার টাকা। খোরপোশ দেয় না এক পয়সাও। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার সাহস নাই কারও। আর মায়া, মানে মেয়েটার তো কোনো ইচ্ছাই নাই। প্রচণ্ড ঘৃণা করে সে তার প্রাক্তন স্বামীকে। লেখাপড়া শিখছিল। কিন্তু এসএসসি পাস করা আর হয়ে ওঠেনি। বিয়ের জন্য। এখন আবার পড়ছে। কে কী বলে তার কোনো ধার ধারে না। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে মেয়েটা।
তাদের সামনে চায়ের কাপ আর কাঁসার গ্লাসে পানি এনে রাখল মায়াই। তাকে দেখে কেন যেন ইমরুলের মনে হলো ছইরউদ্দিন লোকটাও এই রকমের ব্যক্তিত্বই ধারণ করত। মায়ার দাঁড়ানো, কথা বলা, চলাফেরার ভঙ্গিতে এক দুর্লভ ভিন্নতা। মনে মনে মেম্বারের ছেলের জন্য অনুকম্পা বোধ করে ইমরুল। এই মেয়েকে বশ মানাতে চেয়েছিল বোকা পাঁঠাটা! ঘটে একটু বুদ্ধি থাকলেই যে কেউ বুঝবে, এ মেয়ে অত্যাচার সহ্য করবে দাঁতে দাঁত চেপে, কিন্তু অত্যাচারীকে মেনে নেবে না মন থেকে।
খুব সাবলীল আচরণ মায়ার। গ্রামের মেয়ে বলে কোনোরকম জড়তা নাই। আবার দরিদ্র বলেও কোনোরকম হীনম্মন্যতার প্রকাশ নাই।
তাকে জিজ্ঞেস করে ইমরুল- আপনি কি আপনার পরদাদা ছইরউদ্দিনের কথা জানেন?
জানি।
কী জানেন?
এই প্রশ্নে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মায়া। আস্তে আস্তে বলে জানি যে তাই আছিলেন একখান মানুষের মুতন মানুষ।
এই একটা বাক্যের মাধ্যমে চারপাশের বাতাসে অমানুষদের জন্য যেন রাশি রাশি ঘৃণা ছড়িয়ে দেয় মায়া। তারপরেই ইমরুলের উদ্দেশ্যে সোজা-সাপ্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ছইরউদ্দিনের খবর নিয়া কী দরকার আপনার? কী করবার চান আপনে?
নয়ন উত্তর দেয় ইমরুলের হয়ে- উনি একটা গবেষণা করবেন।
তাতে লাভ?
ছইরউদ্দিনের মতো বীরের কথা জানে না দেশের মানুষ। জানলেও ভুলে গেছে। তাকে আবার মানুষের সামনে হাজির করার জন্য ডাক্তার সাহেব কী পরিশ্রম যে করছেন!
ইমরুল অস্বস্তি বোধ করছিল নয়ন ভাই যেসব কথা বলছেন, সেগুলো মোটেও তার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এটাও সে বোঝে, নয়ন ভাই যা বলছে, এর অন্যথা বললে লোকে সেই কথা বুঝবে না। সে প্রশ্নটা থেকে দূরে সরে পাওয়ার জন্য প্রশ্ন করে আপনাদের কাছে এমন কিছু আছে… মানে স্মৃতিচিহ্ন, মানে ছইরউদ্দিন সাহেবের ব্যবহার করা কোনো জিনিস?
গরিবের বাড়িত কি টেকসই কুনো জিনিস থাকে? তাছাড়া তাক হত্যা করার পরে পুলিশ আর জমিদারের পাইকরা মিলে ভিটা পুড়ায়া ছাই কর্যা দিছিল। কিছুই বাঁচেনি।
না জেনে আবার একটা পুরনো ক্ষতে আঘাত করা হয়ে গেছে ভেবে আরও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে ইমরুল।
দেশ স্বাধীন হবার পরে আপনারা কোনো অনুদান পাননি?
এবার একটু জোরেই হেসে ফেলে মায়া কীসের অনুদান? আমারে বাড়ির কেউ তো মুক্তিযুদ্ধে মারা পড়েনি।
মুক্তিযুদ্ধেরও আগে তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেই প্রথম দিকের মুক্তিযুদ্ধের শহিদ ছইরউদ্দিন।
এই প্রথম এ ধরনের কথা শুনছে তারা। মায়ার বাপ একটু আশান্বিত চোখে তাকায় তাহলে আপনারা কচ্ছেন যে ছইরউদ্দিনের নামে দরখাস্ত করলে কিছু টেকা-পয়সা পাওয়া যাবার পারে? আপনেরা ইকটু দেখপেন চেষ্টা কর্যা। হলে বড় উবকার হয়।
কী যে কন না আব্বা আপনে! থামেন তো! সরকারের আশা বাদ দ্যান। যেমন চলতিছে সেইরকমই চলুক আমারে দিনকাল।
উঠতে চায় এবার তারা। নয়ন সঙ্গে আনা ক্যামেরার শাটার টিপতে থাকে। প্রশ্রয়ের হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে মায়া।
বিদায় নেবার সময় ইমরুল বলে- আমার আরও কিছু কথা আছে। কাল কি আসা যাবে?
শশব্যস্ত হয়ে বলে মায়ার বাবা- আরে আপনের এই জল-কাদা ভাইঙ্গা আসার কী দরকার! আপনে কন কখন যাওয়া লাগবি? আমি ঠিক হাজির হয়া যাব।
একটু ইতস্তত করে বলে ইমরুল- আমি মায়ার সাথেও কথা বলতে চাই। মায়া আসতে পারবেন আপনার আব্বার সাথে?
মায়া একটু ভেবে বলে- আমি সকালে মৃধাবাড়ির তিন বাচ্চারে পড়াই। সেইডা সেরে যাবার পারি। কিন্তু আপনি ঠিক কী জন্য ডাকতিছেন আমারে?
ইমরুল নিজেও পরিষ্কার না সে কী বলতে চায়। এখন তো সে-কথা বলা যায় না। বলে একটু কষ্ট করে আসেন, তখনই শুনবেন। আসেন। নাহয় আপনার একটা দিন নষ্টই হলো! তবু আসেন প্লিজ!
রাজি হয় মায়া।
হাসপাতাল কম্পাউন্ডে পৌঁছেই মাকে ফোন করে ইমরুল আমি খুঁজে পেয়েছি মা! আমি ছইরউদ্দিনের বাড়ির লোকদের খুঁজে পেয়েছি।
মা একটু থমকায়। তারপর বলে- এই জন্যই তুই বিলাসপুরে পোস্টিং নিয়েছিলি! এটাই তাহলে তোর সেই বিশেষ কাজ?
হ্যাঁ মা হ্যাঁ।
কী করতে চাস এখন?
প্রায়শ্চিত্ত। আমার পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত।
কীভাবে করবি? ওদের হাতে রক্তপণের টাকা দিবি?
একটু থমকায় ইমরুল। আসলে সে তো কোনোকিছু ভেবে রাখেনি। পাল্টা সে-ই জিজ্ঞেস? করে মাকে কী করা যায় বলো তো মা?
ওপারে মাকেও কিছুক্ষণ ভাবিত মনে হয়। একটু দ্বিধার সঙ্গেই মা বলে কী করবি বল! যদি ওদের টাকার খুব দরকার বলে মনে হয়, তাহলে টাকা দেওয়া তো কোনো সমস্যা নয়। যদি ইচ্ছা করিস, বাড়ি তুলে দিতে পারিস। যদি পরিবারে কাজ করার মতো কেউ থাকে, অথচ বেকার, তাহলে তাকে চাকরি দেয়া যায়। আর… আর… আর তো কিছু মনে পড়ছে না রে ইমু!
সবই তো টাকা আর ক্ষমতা সম্পর্কিত হলো মা। অবশ্য আমরা এর বাইরে আর কিছু তো ভাবতেও শিখিনি।
মা একটু লজ্জাই পেয়ে যায় বোধহয়। আমি তো বলেইছি আমার মাথায় বেশি কিছু খেলে না। তোর আব্বার সাথে কথা বলবি? ভাইয়ার সাথে? ওদের ব্যবসা করা মাথা, রাজনীতি করা মাথা, অনেক কিছু ভেবে বের করতে পারে।
ওরা আরও বেশি ভোঁতা এবং সংবেদনহীন কথা বলবে। কিন্তু একথা তো মাকে বলা যায় না। ইমরুল বলে আচ্ছা তুমিও ভাবো, আমিও ভাবি। যদি ভালো কোনো কিছু বের করতে পারি!
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মা বলে- দেখিস তুই ঝোঁকের মাথায় এমন কোনো কিছু দিতে চেয়ে বসিস না যা দেওয়া অসম্ভব।