রাজু আলাউদ্দিনের কবিতা

তুমি আমার পৃথিবী

আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
মিগেল জানতে চায়: কোথায় তোমার দেশ?
বাংলাদেশ, শোনোনি কখনো?
না, কখনোই নয়।
কোথায় এ দেশ?
ভারতের কাছে।
ওহ্, তাই বলো।

আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
একদিন মারিয়ানা জানতে চেয়েছে,
কোথায় তোমার দেশ?
একই কথা বললাম তাকে।
লজ্জিত জানালো সে, হ্যাঁ,
ভারতের কথা আমি শুনেছি, যদিও
জানি না আসলে ঠিক কোথায় এ দেশ।
এশিয়ার কথা তুমি শোনোনি কখনো?
ওহ্, তাই বলো। বাংলাদেশ তবে সেই
এশিয়ার মাঝে!
ঠিক তাই।

যদি আমি কোনো দিন আরও দূরে চলে যাই
ধরা যাক, মঙ্গলগ্রহে।
তখন সেখানকার কেউ যদি জানতে চায়,
হেই, কোথায় তোমার দেশ?

আমি তো এসেছি দূর সবুজে আচ্ছাদিত
পৃথিবী নামক এক গোলাকার গ্রহভূমি থেকে।
সেখানে এশিয়া নামে বড় এক মহাদেশ আছে।
সেই মহাদেশে আছে ভারতভূমি।
আর সেই ভারতেরই কাছে এক সমুদ্র-তনয়া
হলো আমার স্বদেশ।

আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
বড় হতে হতে ক্রমে আমার নিকটে চলে আসে।
যখন নিকটে আসে, কানে কানে বলি তাকে:
যত ছোট মনে হয় তুমি তত ছোট নও, শোনো,
তুমি পৃথিবীর যেকোনো দেশের মতো বড়,
তুমি এই পৃথিবীরই মতো,
তুমি আমার পৃথিবী।

অপর-প্রবণ

কেন পর-নারীতে আমার এত লাল আর গোলাকার লোভ জেগে ওঠে?
কেন সাদা নারীতে আমার লোভ পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে শরণার্থী মানুষের মতো?
কেন নিজের জায়ার চেয়ে অন্য নারীরা বেশি প্রিয় মনে হয়?
কেন নিজের দেশের চেয়ে অন্যদেশ বেশি লোভনীয়?
কেন মেঘ চলে যায় দূরে, আরও দূরে তার উৎসভূমি ছেড়ে?
কেন অবৈধ সঙ্গম ছাড়া সুখ নেই কোনো?
কেন অপরের দৌলতে বাসনা প্রবল হয়ে ওঠে?
কেন ধর্মের চেয়ে আজ অধর্মে আমার প্রাণ মুক্তি খুঁজে পায়?
কেন মন ওঁৎ পেতে বসে আছে অন্য নারীর প্রত্যাশায়?
কেন মন মজে আছে অন্য কবির কবিতায়?

হে পাঠক, মহাত্মন, অপর-প্রবণ
আরও কিছু খোলামেলা বলবার কথা ছিল এই কবিতায়
তুমি তা একাকী লিখে নিও
দোসর যমজ ভাই আমার।

অসংখ্য মৃত্যু নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল

অসংখ্য মৃত্যু নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল।
মৃত্যু ছিল আমার ঘনিষ্ঠ সহোদর।
আমার রক্তের স্রোত নিয়ে তারা ছুটে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
তারা এতটাই কাছাকাছি ছিল, তারা এত বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল
মনে হতো প্রেমিকের মতো তারা পেছন থেকে কাঁধের বাদিক দিয়ে
আমার কপোলে চুমু খেতে চায়।
মৃত্যুগুলো প্রায় পোষ্য বেড়ালের মতো আমার কাঁথার নিচে শীত রাত্রে কাটিয়েছে পরম আরামে।
মৃত্যু ক্রমে, ধীরে ধীরে আমার প্রেমিকা হয়ে উঠেছিল এই ছোট্ট একাকী জীবনে,
অবসরে শুনাতো সে ঠাকুরের গান:
তুহুঁ মম শ্যাম সমান।
আমি বুঝতে পারিনি, মড়কের মতো অসংখ্য মৃত্যু আমার সাথে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এই পৃথিবীতে।
এইসব মৃত্যুগুলো এত বেশি বলীয়ান ছিল, এইসব মৃত্যুগুলো দলে দলে এত বেশি বড় হয়ে গেছে; আমি ক্রমে হয়েছি একাকী।
এসব মৃত্যুর চাপে আমার জীবন ক্রমে ছোট হয়ে গেছে।

আমার মৃত্যুগুলো নিয়ে কিছুদিন আগে বিশাল বিশাল সব প্রদর্শনী হয়ে গেছে ইরাক, তুরস্ক ও আফগানিস্তানের বড় বড় গ্যালারিগুলোয়।
এগুলোর উদ্বোধন করেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর তার নাতিদীর্ঘ মুখবন্ধ লিখেছিল জাতিসংঘের মহান সচিব।
বেশ কিছু মৃত্যু আমি গোপনে বিক্রি করে দিয়েছি সাংসদ ও মন্ত্রীদের কাছে।
থানায় থানায় আমি কিছু মৃত্যু বিক্রি করেছি চড়া দামে।
আরও কিছু মৃত্যু আমি ছড়িয়ে দিয়েছি আমাদের ব্যস্ত সড়কে।
এইসব মৃত্যুগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রতিদিন।
আমার মৃত্যুগুলো জ্যামিতিক হারে ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে দেশে ও বিদেশে।
আমার মৃত্যুগুলো ঘুমে ও নিদ্রায় আমাকে ক্লান্ত করে শুধু।
সুজলা সুফলা মৃত্যুতে ভরে গেছে আমার হৃদয়।

এপিটাফ

এখানে যে শুয়ে আছে বেঁচে ছিল বাঙালির গড় আয়ু নিয়ে।
বাবা-মা জন্ম তাকে দিয়েছিল ঠিকই,
কিন্তু পত্নী তাকে ধীরে ধীরে মানুষ করেছে।
পাশাপাশি আর যত প্রেমিকেরা ছিল
তারা তার যৌবন প্রলম্বিত করে গেছে বলে
অবৈধ সঙ্গমে আজীবন থেকেছে যুবক;
প্রেমিকেরা তাকে শুধু করেছে অশেষ।
খেয়ে, পড়ে ,পানে আর সঙ্গমে কেটে গেছে সুস্বাদু জীবন।

কিন্তু অন্য এক বিষন্নতা আমরণ সঙ্গী ছিল তার:
মানুষের ইতিহাস তাকে শুধু করেছে হতাশ,
মানবজাতিকে তার এমন এক নির্বোধ বুদ্ধিমান প্রাণি বলে মনে হয়েছিল,
সৃষ্টি যাকে ক্রমাগত ধ্বংস করেছে,
আনন্দ দিয়েছে বেদনা,
প্রাচুর্য যাকে ক্রমে নিঃস্ব করেছে।

–মানুষের এইসব জেনেও সে বেঁচে ছিল , লেখাপড়া অব্যাহত ছিল
শেষ দিকে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছিল ভলতেয়ার-বায়ুমণ্ডলে
পৃথিবীকে রেখে গেল যেমনটা পেয়েছিল জীবনের সূচনাকালে।

যে শরীর একদিন নারীদের বাহু, জিহ্বা, স্তন ও যোনীর আদরে কেটেছিল
এখন সে শুয়ে আছে একাকী নিথর;
মৃত্যুর বিপরীতে জীবনের প্রশস্তি নিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *