উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব নয়
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল//জাকির তালুকদার//প্রথম পর্ব//
- ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // দ্বিতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস / আমাদের আগুনবিহীন কাল / জাকির তালুকদার / তৃতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস /আমাদের আগুনবিহীন কাল /জাকির তালুকদার /চতুর্থ পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পঞ্চম পর্ব
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // ষষ্ঠ পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// সপ্তম পর্ব
- উপন্যাস// আমাদের আগুনবিহীন কাল// জাকির তালুকদার// পর্ব আট
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব নয়
- উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পর্ব দশ
- উপন্যাস।। আমাদের আগুনবিহীন কাল।। জাকির তালুকদার।। পর্ব এগারো
ছইরউদ্দিনকে মেরে ফেলা হয়েছিল, গুলিতে বুক ঝাঁজরা করে দিয়ে।
খান বাহাদুর আব্দুল করিমের ডায়েরি কী বলে দেখার জন্য আবার সেটাকে চোখের সামনে টেনে নেয় ইমরুল।
‘ছইরউদ্দিন ও তাহার দস্যুদলের দৌরাত্ম্য ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। তাহারা বিশীর কাচারি বাড়ি লুণ্ঠন করিল। প্রথমে তাহারা ধনী ও সম্পন্ন ভদ্রলোকদিগকে তাহাদের দলে যোগদানের জন্য আহ্বান করিত। তাহারা রাজি হইলে চান্দা লইয়া চলিয়া যাইত। কিন্তু রাজি না হইলেই তাহাদের বসতবাটিতে আগুন ধরাইয়া দিত, এবং লুটতরাজ করিত। এই দস্যুদলের আক্রমণে ভীত হইয়া ভদ্র ও ধনী-মানী লোকগণ পরিবার-পরিজন লইয়া গ্রামত্যাগ করিয়া সিরাজগঞ্জ সহরে আশ্রয় লইয়াছিলেন। কেউ কেউ সেখানেও নিরাপত্তার অভাব বোধ করিয়া পাবনা জেলা সদরে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তাহাদের আবেদন-নিবেদনে গভর্নমেন্টের টনক নড়িল। জমিদারগণ এই দেশে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রতিভূ। তাহাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হইলে তাহা গভর্নমেন্টের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হইয়া দাঁড়ায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং বিপুল সংখ্যক পুলিশ লইয়া বিদ্রোহী গ্রামগুলোতে টহল দিতে শুরু করিলেন। বিভাগীয় কমিশনারের আদেশে রাজশাহী হইতে আরও অর্ধশতাধিক সশস্ত্র পুলিশ এখানে আগমন করিল। বাংলার ছোটলাটের আদেশক্রমে গোয়ালন্দ হইতে প্রকাশ একটি সামরিক পুলিশ বাহিনীও আনয়ন করা হইল।
‘কিন্তু এত আয়োজনও দুর্বৃত্ত ছইরউদ্দিনের মনে ভীতির সঞ্চার করিতে পারে নাই। আমরা ঘোষণা করিয়াছিলাম যে, চারিজনের অধিক জনতা একত্রিত হইতে পারিবে না। দুর্বৃত্তগণ যাহাতে একত্রিত হইতে না পারে সেই জন্যই এইরূপ নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এই অবস্থাতেও তাহারা নিজেদের মধ্যে সংযোগ ঠিকই বজায় রাখিত। আমরা পরে জানিতে পারিয়াছি যে, তাহারা মাছ ধরার নামে পলো হাতে বিভিন্ন বিলে ও জলাশয়ে সমবেত হইত, এবং নতুন নতুন দুর্বৃত্তপনার শলাপরামর্শ করিত। আমাদের এইরূপ টহলদারির মধ্যেই তাহারা একই রাত্রে প্রায় ৪০টি গ্রামে দাদনদারদের কুঠি আক্রমণ করিয়া সকল বন্ধকি দলিল ভস্মীভূত করিল। মহাজনের পক্ষে আর সুদের সুদ তস্য সুদ আদায় করা তো দূরের কথা, আসল লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ারও আর কোনো ক্ষীণতম আশাও রহিল না।
‘এই সময় আমরা চর-মারফত সংবাদ পাইলাম যে ছইরউদ্দিন বিলাসপুর হাটে আগমন করিবে। নির্দিষ্ট দিনে ভোর না হইতেই বিপুল সংখ্যক ছদ্মবেশী পুলিশ লইয়া আমি গোপনে পুরা হাট ঘিরিয়া রহিলাম। ঠিক দ্বিপ্রহরের আগে আমাদের গুপ্তচর জানাইল যে ছইরউদ্দিন তাহার প্রায় দশজন সাঙাৎ লইয়া হাটে আসিয়াছে। আমরা তৎক্ষণাৎ আমাদের বেষ্টনী নিñিদ্র করিয়া তুলিলাম। তারপর আমি চোঙ হাতে লইয়া ঘোষণা করিলাম যে ছইরউদ্দিনকে চারিদিক হইতে ঘিরিয়া ফেলা হইয়াছে। সে যদি নিজের প্রাণ বাঁচাইতে চায় তাহলে অবিলম্বে নিরস্ত্র অবস্থায় বাহির হইয়া আসিয়া আত্মসমর্পণ করুক।
‘আমি হাটের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের মাথায় দাঁড়াইয়া ছিলাম। দেখিলাম ঘোর কৃষ্ণবর্ণ একজন প্রায় ছয় ফুট লম্বা লোক জটলা হইতে বাহির হইয়া আমার দিকে হাঁটিয়া আসিতেছে। তাহার একটি হাত পেছনে। অপর হাতটি উঁচু করিয়া ধরা। ভঙিতে মনে হইল সে আত্মসমর্পণ করিতেই আসিতেছে। কিন্তু আরও কিছু নিকটবর্তী হইবার পরে আমার সন্দেহ হইল সে একটি হাত কেন পিছনে রাখিয়াছে। নিশ্চয়ই তাহার লুক্কায়িত হাতে কোনো রিভলবার বা অন্য কোনো অস্ত্র আছে। আমি তাই রেঞ্জের মধ্যে আসবামাত্র তাহার বুক লক্ষ করিয়া আমার পিস্তলের ঘোড়া টিপিয়া দিলাম। সে যেন হোঁচট খাইয়া দাঁড়াইয়া গেল। তাহার বুক হইতে গল গল করিয়া রক্ত নির্গত হইতেছে। সে একবার নিজের বুকের দিকে তাকাইল। তারপর আবার আমার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। আমার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়া উঠিল। এ কী মানুষ না পিশাচ! এমন পিস্তলের গুলি খাইয়াও যেন তাহার কিছুই হয় নাই। আমি তখন একের পর এক পিস্তলের ঘোড়া টিপিতে লাগিলাম। সে আসিয়া আমার পায়ের সামনে হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া গেল।
‘তাহার পেছনের হাতে কোন বস্তু রাখা ছিল তাহা খোঁজ করিবার মতো মানসিক অবস্থা তখন আমার আর অবশিষ্ট নাই।
ছইরউদ্দিনের হাতে ছিল একটি রোল করা কাগজ। একটি দরখাস্ত। বাংলার ছোটলাটের দরবারে পাঠানোর জন্য একটি দরখাস্ত লিখেছিল তারা এই আশাতে যে তিনি জমিদারদের অন্যায় অত্যাচার থেকে চলনবিলের লক্ষ লক্ষ চাষিকে রক্ষা করবেন।
তাহলে সে ওইদিন বিলাসপুরের হাটে কেন এসেছিল? আর তা প্রকাশ্য দিবালোকে কেন?
বিলাসপুরের হাটে যে মুনশি ছিল, পুরো চলনবিল এলাকার মধ্যে একমাত্র সে-ই নির্ভুল বানানে ইংরাজিতে চিঠি লিখতে সক্ষম ছিল। তাকে দিয়ে দরখাস্ত লেখাতেই ছইরউদ্দিন সেখানে এসেছিল।
এর সাথে এটাও উল্লেখ করতে হবে যে দারোগা আব্দুল করিমও সেটা জানত।
জেনেও সে হত্যা করল ছইরউদ্দিনকে! কেন?
প্রমোশন। পুরস্কার। সাহেবদের নেকনজর পাওয়ার আশা। এটা তো প্রমাণিতই যে সে তা পেয়েছিল। তার থেকেই তো তার বংশের উত্তরপুরুষরা আজ এই দেশের নীতি-নির্ধারক মহলের সদস্য।