উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস / কবি আসছে/ ফারুক আহমেদ/ প্রথম পর্ব

স্যারের দরজায় নক করে দাঁড়িয়ে থাকে পিয়াল।

স্যার আওয়াজ পেয়ে ভেতর থেকে বলে, ইয়েস কামিং।

পিয়াল কাঁচুমাচু হয়ে রুমে ঢুকে স্যারকে সালাম দেয়। বলে, স্যার আপনার শরীর কেমন?

স্যার পিয়ালের দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। মৃদু বাতাস আমগাছের পাতা সুড়সুড়ি দেয়ার মতো করে নাড়াচ্ছে। স্যারের চোখ সেদিকে থাকে।

  • তুমি আজ কেন এসেছ আবার? বলিনি খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে।
  • জি স্যার, বলে কাগজের একটা ফাইল বাড়িয়ে দেয় পিয়াল।
  • এটা কী, প্রশ্ন করলে পিয়াল সেদিকে যায় না, যায় অন্যদিকে। বলে, স্যার গতকাল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে আর্টিক্যালটা ছাপা হয়েছে দৈনিক প্রভাত ফেরির সাময়িকীতে, সেখানে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া

গেল। ভাবতে অবাক লাগে আপনি কীভাবে গুনে গুনে বলে দিলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কোকিল

কুড়িবার এসেছে, তার মধ্যে কোকিল গান গেয়েছে ১০ বার, আর নিশ্চুপ থেকেছে ১০ বার। এমন

নিখুঁতভাবে গুনে গুনে বের করা একমাত্র আপনার পক্ষেই সম্ভব, স্যার।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে পিয়াল মাথা তোলে।

মাথা তুলে স্যারের দিকে তাকালে স্যার বসার জন্য ইশারা করেন।

অনুমতি পেয়ে পিয়াল স্যারের টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়ে।

  • স্যার, এটা মূলত আপনার ‘বাঙালির সাহিত্যরস ও বাঙালি চরিত্র’ বইটি নিয়ে ছোট একটি লেখা।

এমন বইয়ের মূল্যায়ন স্যার আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অসম্ভব এসময়ের অন্য কারো পক্ষেও। তবে

আমার মুগ্ধতা না লিখে পারলাম না।

স্যার কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে পিয়ালের দেয়া পৃষ্ঠাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, মন্দ তো লিখনি।

পিয়াল এই সুযোগটা লুফে নেয়। বলে, স্যার ১৯৭২-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘একটি জাতির কীভাবে এক্কা দোক্কা খেলতে হয়’ শিরোনামে আপনার যে প্রবন্ধের বইটা বেরিয়েছি, সেটা পড়ে শেষ করলাম।

  • তা-ই নাকি! কী বলো সেই বই তো বাজারে নাই, তুমি পেলে কোত্থেকে?
  • স্যার, পল্টনের ফুটপাত থেকে, আপনার বই পেলে তা আমি কোনোমতেই হাতছাড়া করি না।
  • হুম। স্যারের ঠোঁটের কোনায় একটা হাসির ঝিলিক দেখা যায়।

পিয়াল বলতে থাকে, স্যার, ওই বইটা পড়ে মনে হলো, আপনার রসবোধের তুলনা হয় না। আপাত গম্ভীর সিরিয়াস বিষয়ের ভেতর আপনি এমনভাবে রস ভরে দিয়েছেন, যা মৌচাকের মতোই ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা মধুর প্রবাহ যেন। পিয়াল থামে, বলে, সরি স্যার, বেশি বলে ফেললাম।

  • না, ঠিক আছে, তোমার তো অনুসন্ধানের চোখ ভালো বলেই মনে হয়।
  • না স্যার, তো প্রবন্ধটটা…
  • কী, বলো।
  • স্যার, মানে মানে আপনি চাইলে আমি প্রভাত ফেরির সাময়িকীতে আর্টিকেলটা দিতে পারি।
  • তা দাও, এজন্য আমার চাইতে হবে কেন?
  • না মানে স্যার, আপনি যদি একটু বলে দেন সাহিত্য সম্পাদককে।
  • ঠিক আছে, অসুবিধা নাই, তুমি দাও, সাহিত্য কেন আমি সম্পাদককেই বলে দিব। আমার এই কার্ডটা নিয়ে গিয়ে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করবে। আমি ফোনে বলে দিচ্ছি।
  • জি স্যার, থ্যাঙ্কু স্যার।

পিয়াল চেয়ার থেকে উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালে পেছন থেকে স্যার পিয়ালকে একটা নরম সুর দেয়, চা খেয়ে যেও, আমি সোহাগকে বলে দিচ্ছি।

  • জি স্যার। পিয়াল মাথা ঘুরিয়ে সালাম দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

পিয়াল চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর আসে জহির। জহির এসে নিচে আটকে যায়। বিশাল বপুর দারোয়ান পথ আটকে জহিরকে বলে, স্যারের সঙ্গে এখন দেখা করা যাবে না।

  • কেন? জহির জানতে চাইলে আবারও বলে, এখন দেখা করা যাবে না, স্যারের গেস্ট আছে, অন্য কারো যাওয়া নিষেধ এখন।

বেশ তো, এখন যাবে না, যাবে পরে। কিন্তু কতক্ষণ লাগতে পারে, গেস্ট চলে গেলে কি স্যার ফ্রি হবেন, এসবের কোনোটার উত্তর দারোয়ানের কাছে না পেয়ে জহির আশাহত হয়। তবে আশা পুরো ভেঙে পড়ে না। সে দেয়ালঘেরা সবুজ ঘাসের লনটায় হাঁটে ছোট ছোট পা ফেলে।

সিঁড়ি থেকে ঘাসে ঢাকা সামনের ছোট উঠোনটায় সে পায়চারি করে সময় পার করছিল। হাঁটায়, পা ফেলার যে ফাঁক, সে ফাঁক দিয়ে কুমকুম এসে হাজির হয়। কুমকুমের কেন এখনই আসতে হবে জহির তা ভেবে পায় না। তবে এসে পড়ায় ওর ভালোই লাগে। কয়েকদিন আগে একটা কবিতা পাঠের আসরে কুমকুম ওর ঠিক সামনের সিটে বসেছিল। সেখানে আবার কুমকুমের ওপর একটা ফ্যান ঘুরছিল। এতে কুমকুমের চুল এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করে। তার এত চুলের ছোটাছুটির ভেতর থেকে একটা-দুটা চুল ছোট বাচ্চাদের হাত বাড়ানোর মতো জহিরের নাকে এসে লাগছিল। এ ব্যাপক এক আনন্দের ব্যাপার। চুলটা নাকে এসে হাত বুলায়, আবার চলে যায়। হাত বুলায় এবং আবারও চলে যায়। মনে হচ্ছিল, এতে কুমকুমের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় রয়েছে। আর না হয় চুল ম্যাডাম এত সাহস কোত্থেকে পাচ্ছে। চুল এসে যে ঘ্রাণ জহিরকে দিয়ে যাচ্ছিল, তা তাকে একটা উত্তেজনায় ফেলে দেয়। এতে তার মনে হয়েছিল অনুষ্ঠান শেষে কুমকুম এগিয়ে এসে বলবে, জহির ভাই, গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক পালাবদল-এ ছাপা হওয়া আপনার কবিতাটা ভালো লেগেছে আমার। কী দারুণ শিরোনাম তুমি একটি বিকাল। তবে দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, অনুষ্ঠান চলাকালীন এবং অনুষ্ঠান শেষে কুমকুম একবারের জন্যও জহিরের দিকে ফিরে তাকায়নি।

এই ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতে সেই কুমকুমই তার কাছে এসে হাজির হলো প্রথমে মাথার ভেতর আর এখন বাস্তবে। ব্যাপারটা এরকম মোড় নিবে জহির একদম ভাবেনি, একদমই না। দেখল কুমকুম তার পাশে। তবে এমন নয় যে, তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে অক্ষিবাণে জহিরকে কাৎ করে বলছে, তুমি একটা কবি। কুমকুম উপরে ছিল, সেখান থেকে নেমে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে সে গেইটের দিকে চলে যাচ্ছে বরং এই দৃশ্যটাই পথচারির মতো জহির দেখল। তবে এই যাওয়ার ভেতর এক ফাঁকে জহিরের সঙ্গে কুমকুমের একবার চোখাচোখি হলো, এটুকুই আনন্দ।

জহির গেস্ট চলে গেছে দেখে রিসিপশনে হাজির হলো।

  • আমি এখন যাব?
  • যান।

জহির দারোয়ানের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে হন হন করে উপরে উঠে গেল। ওপরে এসে দেখল পুরো অফিস ফাঁকা। সন্ধ্যা তো হয়েই গেছে, ফাঁকা এ-ই স্বাভাবিক। স্যার কাজের লোক বলেই, বিদগ্ধ বলেই তাঁর সময়জ্ঞান নাই। তিনি অফিসে থাকেন, আর অফিস তাঁর সঙ্গে থাকে। অফিস জুড়ে ছড়িয়ে থাকা চেয়ার-টেবিল মনে হলো জহিরকেই দেখছে। দেখুক, কবিকে দেখবে না তো কাকে দেখবে! সে স্যারের রুমের দিকে চোখ ফেলে। স্যারের উপস্থিতি পিয়ন সোহাগকে দিয়েই জানা যায়। ছেলেটা জহিরকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। ও এরকম হাসে, যাকে তাকে দেখে একরমভাবে হাসে। মাঝে মাঝে জহিরের মনে হয় কষে চড় লাগালে ভালো লাগত। মাঝে মাঝে মনে হয় আহা ও বে-আক্কেল ফকিন্নির পুত, শিল্প-কাব্য-তামাশা দেখে তোর আরও বেশি করে হাসা উচিত।

আজ কিন্তু ইচ্ছা হচ্ছে কষে চড় লাগানোর। সে ইচ্ছাটা রুমালের মতো পকেটে রেখে জহির জিজ্ঞেস করে, স্যার আছেন?

উত্তরে সোহাগ মাথা নাড়ায়।

জহির স্যারের রুমে ঢুকতে গেলে সোহাগ পথ আগলে বলে, এইখানেই দাঁড়ান। স্যার বাথরুমে গেছেন।

এতক্ষণে জহিরের মাথাটা একটু ঘোরে। কিন্তু সে বেশি ঘুরতে দেয় না। স্যারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। স্যার ফিরে আসে মিনিট ৫ পর। দেখেই জহির কাৎ হয়ে যায়, স্যার সামালাইকুম।

স্যার এর উত্তর দেয় না। ফলে জহির আরেকবার সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এবারও কিন্তু উত্তর দেয় না স্যার। কাছাকাছি হলে স্যার একটু ধমকের স্বরে বলে, তোমাকে এ সময় কে আসতে বলেছে?

  • না স্যার, মানে। জহির মিনমিন করে।

স্যার অবশ্য ততক্ষণে রুমে ঢুকে যায়।

কুমকুম কি সিএনজিতে উঠে গেছে, নাকি বাসের জন্য অপেক্ষা করছে? জহির স্যারের অফিস থেকে বেরিয়ে পড়তে সে বিষয়টাই ভাবতে থাকে।

Series Navigationধারাবাহিক উপন্যাস// কবি আসছে //ফারুক আহমেদ// দ্বিতীয় পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *