ঈদসংখ্যার গল্প।। সুগার ড্যাডি।। রণজিৎ সরকার

বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখে বের হয়ে সারা আর কাফি খাবার অর্ডার দিয়ে আটতলায় মুখোমুখি বসে আছে। হল রুমে মোবাইল ফোন তেমন বের করেনি দুজনের কেউ। তাই এখন বসে মোবাইল ফোনে নেট সংযোগ দিয়ে অনলাইনে আপডেট জানার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ফেসবুকে দেখছে। এমন সময় কাফি বলল, ‘ফেসবুকে তোমার স্ট্যাস্টাসটা পড়ে সেদিন খুব হেসেছি।’
সারা মোবাইল ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘কোনো স্ট্যাস্টাসটা। বলো তো কাফি।’
কাফি বাঁ হাতটা বাম গালে রেখে বলল, ‘আমার সাথে ঝগড়া হয়েছিল। কয়েকদিন কথা হয়নি তোমার আমার। এই ফাঁকে তুমি একদিন তোমার বান্ধবীদের সাথে নিয়ে বসুন্ধরা সিটিতে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে। আইসক্রিম খেতে খেতে এক মধ্যবয়স্ক লোক আর এক তরুণীর সাথে প্রেমালাপ করছিল। দুজন খুব অন্তরঙ্গ হচ্ছিল। প্রথমে তুমি ভেবেছিলে কাজিন বা অন্য আত্মীয় কিন্তু পরে বুঝেছ লোকটা বিবাহিত এবং তথাকথিত সুগার ড্যাডি। তার বউ কল করেছিল। তরুণটি বলেছিল, ‘এই তোমার বউ কল করেছে? কী বলবে এখন? লোকটা তখন বলেছিল, আরে চিন্তা করো না, এখন কল ধরব না, পরে বলব মিটিংয়ে ছিলাম।’ তুমি তো মাঝে মাঝে কল ধরো না। এবং তোমার আশপাশে লোকজন থাকলে কল কেটে দাও। তোমার পাশে থাকা মানুষটির কাছে ভালো সাজো। তাকে গুরুত্ব দাও অথচ আমার বেলায় সেটা হয় না। আমার পাশে তুমি থাকলে নানা জনের কল ধরো, কথা বলো। এমনকি চ্যাটিং করো। আমাকে অবমূল্যায়ন করো। যাক আমার কথা বাদ দিলাম। তুমি স্ট্যাস্টাসে আরও লিখেছ, বাংলাদেশের সং¯ৃ‹তি এখন পরকীয়ায় আচ্ছন্ন। তরুণীরা টাকা উপার্জনের জন্য পোশাকের মতো বয়ফ্রেন্ড পাল্টায় আর বুড়া ব্যাটাগুলো আছে সস্তা ফিলিংস নেয়ার ধান্ধায়। মাঝখান থেকে সংসারে অশান্তি। এক পর্যায়ে ডিভোর্স…। এ রকম কিছু কথাবার্তা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলে। মনে পড়ে। কয়েকদিন আগের পোস্ট। ফেসবুকে গেলেই দেখতে পারবে।’
‘ও আচ্ছা। তোমার হাসার কারণ কী হলো? যা দেখেছি তাই লিখেছি। তোমার ফোন কেটে দেওয়া, কল ধরা মানেই কি তোমার প্রতি আমার অবমূল্যায়ন করা। তুমি আসলে হীনম্মন্যতায় ভোগো কাফি।’
‘তুমি অন্যের দোষ ধরার আগে একবারও তোমার কথা ভাবলে না। আমরা আসলে ভেতরে এক, বাইরে অন্য। ফেসবুকের স্ট্যাস্টাস পড়ে মানুষের চরিত্র নির্ধারণ করা যায় না।’
‘সেজন্যই তোমার সাথে ঝগড়া বাদে। আর আমি কী ভাবব?’
‘তোমার-আমার সম্পর্কের নাম কী? ওদের জায়গায় তো আজ আমরা বসে আছি। আমার আগে আরও দুজনের সাথে যে তোমার পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। এখনো যে শুধু আমার সাথে সম্পর্কে আছো, এটা আমার বিশ^াস হওয়ার কথা! একাধিক সম্পর্ক আছে তা টের পাই। মাঝে মাঝে একটু অধিকার নিয়ে যখন সন্দেহের দৃষ্টিতে কথা বলি, তখন তো তুমি বলো, অনলাইনের ডিজিটাল যুগে একসাথে দুই-তিনটি প্রেম তো চলমান থাকে প্রেমকাতরমনের মানুষদের। যেমন ফেসবুকে হোয়াটসঅ্যাপে ও বাস্তবে একাধিক প্রেম থাকতেই পারে। তুমি নিজেই পরকীয়ায় আচ্ছন্ন। অথচ তুমি নীতির কথা বলে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছো। তাই তোমার চরিত্রের কথা ভেবে আর স্ট্যাস্টাস পড়ে না হেসে পারিনি। কথায় আছে না, যার শরীর দিয়ে গন্ধ বের হয় তার নাম রেখেছে আতর আলী।’
সারা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে তাই সাথে সাথে বলল, ‘কাফি, তুমি তো আমার জীবনের সব কাহিনি জানো। এমনকি আমার স্বামী মামুনও জানে, আমি পরকীয়া প্রেম করি। কিন্তু কিছু বলার আর সাহস পায় না। কারণ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মামুনের নেই। তাই সে অধিকার নিয়ে আমাকে কোনো কথা বলতে পারে না। আমি এখন স্বাধীন। আমার যখন যা ইচ্ছা, তা পূরণ করার চেষ্টা করি। তাকে কোনো ধরনের কৈফিয়ত দিতে হয় না। তবে তোমাকেও কোনো কৈফিয়ত দিতে চাই না। ভালো লাগলে আমার সাথে মিশবে না হলে আর কথা বলবে না, মিশবে না। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তবে শোনো স্ট্যাস্টাসটা কেন দিয়েছি জানো, আমার পোস্ট পড়ে একজনও যদি সতর্ক ও সাবধানে থাকে, তাহলে আমি সার্থক, কারণ এ জগতে পা রেখেছি, অন্য কেউ যেন সুখের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে ক্ষণিকের সুখের জন্য পরকীয়া প্রেমের নেশায় আসক্ত না হয়। তাদের সতর্ক করার জন্যই আমার স্ট্যাস্টাস।’
‘তাই! আমি আসলে বুঝতে পারিনি সারা। তোমার স্ট্যাস্টাসের উদ্দেশ্য। তবে তোমার সাথে মেশার একটা উদ্দেশ্য আমার আছে। তবে শোনো, যে কোনো নেশায় আসক্ত হওয়া ক্ষতিকর। আমার দেখা মতো যে নারীরা যত বেশি স্বাধীন তারা তত বেশি অশ্লীল। জীবনের চলার পথে বাস্তব উদারণ হয়ে রয়েছে অনেকেই।’
‘এটা কি বলছো কাফি।’
‘সত্যি বললাম, তোমার কথা বলি, তুমি যে মাঝে মাঝে আমার সাথে সারাদিন থাকো। তোমার স্বামী তো দেখি একবারও খোঁজ নেয় না। কোথায় যাচ্ছ। কী করছ। একটু তো হলেও তো খোঁজ নেওয়া দরকার পড়ে তার তাই না। তোমাকে পুরো স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। তুমিও তোমার ইচ্ছামতো কাজের দোহাই দিয়ে মাঝে মাঝে অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়ছ। তুমি তো আজ সারাদিনে একবারও তোমার স্বামীকে কল দিয়ে খোঁজ নিলে না। সিনে কমপ্লেক্সে সিনেমা দেখলাম। আর এই জায়গায় বসে সেদিন ওই লোকটা মানে সুগার ড্যাডি বসে যে কাজটা করছিল। আজ তো আমি আর তুমি একই কাজ করছি। তাই না।’
‘তুমি আর বেশি কথা বলো না কাফি। আমি আসলেই বিবেকের কাছে বড় অপরাধী। আমার জন্য দুটি সংসার ভেঙে গেছে। স্ত্রীরা তাদের ডিভোর্স দিয়েছে। আরও একটি ভাঙার পথে। দুইজন এখনো বিয়ে করেনি। আমাকে তারা স্ত্রী হিসাবে চায়। আমার জন্য অপেক্ষায় আছে। এক সময় মনে করেছিলাম, প্রথম সংসার করব না, মামুনকে ডিভোর্স দেব। আপন যে কজন আমার জীবনে আছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন বিয়ে করে দ্বিতীয় সংসার করব। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। তার কারণ যখন জানতে পারলাম আমি কখনো মা হতে পারব না। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম অন্যের সংসারে ফলবিহীন গাছ হয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। অন্যের স্ত্রী হিসাবে অন্যের ঘরে না গিয়ে মামুনের ঘরে থেকেই অন্যের সাথে পরকীয়া করে নিজের প্রয়োজনে আনন্দফুর্তি করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কারণ মামুন যত স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে, অন্য কেউ এত স্বাধীনতা দেব না। তাই বিয়ে করিনি। অনেকের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছি। অনেকে ব্লক করে দিয়েছি। নিত্য নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছি। অনেকেই সাবেক প্রেমিক। আর তুমিসহ বেশ কয়েকজন আছে বর্তমানে।’
কথাগুলো শুনে অবাক হলো কাফি। গভীরভাবে ভাবল, সারা খুবই বিপজ্জনক নারী। দাম্পত্যজীবনে সুখ না হলে একজন নারী কতটা খারাপ হতে পারে তা সারাকে জানলেই বোঝা যায়। আজ আরও গভীরভাবে টের পেলাম। সারাকে ভালো পথে ফেরাতে হবে।
সারা বলল, ‘কি কাফি, তুমি কি কফি খাওয়া বাদ দিয়ে গভীরভাবে কী ভাবো। আমার কথাগুলো নিয়ে গভীর ভাবনায় পড়ে গেলে মনে হয়।’
কাফি ডান হাতটা মাথার চুলের ভেতরে রেখে বলল, ‘তোমাকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাই আমি। তোমার ভালোর জন্যই মানসিক ডাক্তার দেখানো উচিত। তুমি স্বাভাবিক হলে আগামীর দিনগুলো তোমার জন্যই ভালো হবে। আর এভাবে চললে তোমাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে যেতে সময় লাগবে না।’
‘কাফি আমি কি এতটাই খারাপ হয়ে গেছি।’
‘মানুষ আসলে নিজের ভুলটা ধরতে পারে না। আমরা সিনেমা নাটক সিরিয়াল দেখি তখন কিন্তু ভিলেনকে চিনে ফেলি তার কর্মকাণ্ডের জন্য। তুমি কি কখনো নিজের চরিত্র সিনেমার মতো করে নিজের বিবেকের কাছে সিনেমার মতো করে উপস্থাপন করেছ। মনে হয় করনি। আজ রাতে শুয়ে থেকে তোমার জীবনের ভালো ও খারাপ দিকগুলো নিয়ে একজন পরিচালকের মতো করে ভাববে এবং সেটা সিনেমার মতো করে বিবেকের কাঠগড়ায় হাজির করবে। তখন তুমি তোমার চরিত্রটা সম্পর্কে জানতে পারবে তুমি কতটা খারাপ, কতটা ভালো। এবং নিজেকে তখন সিনেমার ভিলেন চরিত্রটাই মনে হবে তোমার। আমরা সিনেমায় ভিলেন চরিত্রের পক্ষে কেউ থাকি না। পক্ষ নিই নায়ক বা নায়িকার। ভিলেনকে ঘৃণা করি। শেষে এসে চাই তার শাস্তি। অপরাধের শাস্তি হয় খুশিতে আমরা হাততালি দিই, শান্তি পাই।’
‘এভাবে তো কখনো ভাবিনি কাফি। তবে তোমার কথাগুলো ভালো লাগল। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন তোমার কাছে। তুমি এতকিছু জানার পরও আমার সাথে সম্পর্ক রাখছ কেন?’
‘তোমার শরীরের ভেতরে দুঃখকষ্টের বেদনার সমুদ্র প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। সবাই হয়তো তোমার সুখে সঙ্গী হতে চায় আর আমি চাই তোমার দুঃখের দুর্দিনের সঙ্গী। কারণ তোমাকে আমি প্রকৃত ভালোবাসি। এত কিছু জানার পরও তোমাকে আমি দেবী মতোই দেখি। অস্থির অনিশ্চিত সম্পর্কের জগৎ থেকে সংসার জগতে ফিরে মনোযোগ দাও। ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী হও। এমফিল পরীক্ষার জন্য পড়ালেখায় মনোযোগ দাও। সময় নষ্ট করো না। নিজের জন্য ও দেশের জন্য ভালো কিছু করো। তোমার মেধা আছে, মেধা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলেই তুমি জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাবে, এখনো সময় আছে। জীবন শেষ হয়ে যাইনি। সব ধরনের সহযোগিতার জন্য আমি তো তোমার পাশে আছি সব সময়। তোমার যখন যেটা প্রয়োজন সেটাই শতভাগ মেটানোর চেষ্টা করব। প্লিজ তুমি আর অন্যের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে সংসার ভেঙে দিও না। আকাশে তারার মতো সব পুরুষকে আপন না ভেবে চাঁদের মতো একজনকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকা ভালো। তাতে প্রকৃত সুখ-শান্তি পাওয়া যায়।’
‘তুমি তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বললে কাফি। আগে তো কখনো এভাবে আমাকে কেউ বুঝিয়ে বলেনি। আমি আসলে মামুনের এক ভুলের জিদে আর ইগোতে ভুল পথে চলে এসেছি। সেও চলে গেছে ভুল পথে। এটা আমার ঠিক হয়নি। তুমি আমার পাশে থাকবে তো আজীবন। তাহলেই আমি ভালো হতে পারব কাফি। মামুনকে ভালো পথে ফেরাতে পারব।’
‘একজন নারী অনেকে কিছুই করতে পারে। কথায় আছে নাÑ সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। তোমার জীবনে যে কয়জন এসেছিল তারা তোমার ক্ষণিকের সুখ দিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে। এখন সর্বনাশের পথটা বিসর্জন দিয়ে স্বর্গে বাস করবে সে চিন্তা করো।’
‘কাফি তুমি তো ভালো ছেলে, সৎ ছেলে। তোমার সঙ্গে সঙ্গ দিয়েই স্বর্গে বাস করার পথ খুঁজব। তুমি পাশে থাকো। আজ সত্যি কথা দিলাম। তোমার কথা মেনে চলার চেষ্টা করব।’
‘আমি কতটুকু ভালো কতটুকু খারাপ সেটা তুমি ভালো করেই জানো। আর আমি তোমার সব সময় ভালো চাই, তোমাকে ভালোর পথে ফিরে নিজেকে সমাজের কাছে আলোকিত করতে হবে। ভালো পথে চলার পথিক হিসাবে আমাকে সব সময় পাবে।’
সারা আবেগে কাফির হাতে হাত রাখল। নিজের দোষগুলো ভাবতে ভাবতে অনেক সময় চুপচাপ থাকল সারা। একটু পর ধীরে বলল, ‘কাফি, এখন উঠি। মনটা অস্থির লাগছে। শরীরটা খারাপ লাগছে। চলো বাসায় যাই।’
‘ঠিক আছে চলো। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তোমার বাসায় যাব না।’
‘না না পাগল। এখন তো মামুনের বাসায় আসার সময়। আমার বাসার কাছাকাছি পর্যন্ত চলো। তারপর তুমি নেমে যাবে। আমি বাসায় চলে যাব।’
‘ঠিক আছে। চলো।’
সারা আর কাফি বসুন্ধরা সিটি থেকে বের হলো। কাফি উবার ডাকল। গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলছে। দুজন হাতে হাত রেখে গল্প করছে। কিছু সময় পর গাড়ি সারার বাসার কাছাকাছি এলো। কাফি গাড়ি থেকে নামল। একটু পর গাড়ি সারার বাসার গেটে পৌঁছে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *