ছোটগল্প।। অক্সিজেন।। সৈয়দ ইফতেখার

‘তুমিহীন এই পবিত্র নগরীতে আমিই সবচেয়ে অপবিত্র। তুমিবিনা আমি যেন…’। আজকাল অনিলের কী জানি হয়েছে। কেবল কবিতা পড়ে। তার আধো আধো মনে থাকা পঙক্তিগুলো পরে বিড় বিড় করে। ওর বন্ধুরা বলে ‘প্রেমের দোষ’। কিন্তু বাউণ্ডুলে অনিলের কি প্রেম সাজে!

এ কথা সত্য, বর্তমানে তাকে দেখতে পাওয়া যায় পাড়ার শেষ গলির বাড়ির নিচে। বারান্দায় হা করে তাকিয়ে থাকে। সবই বয়সের বেয়াড়াপনা, কুড়ি বছরের ছেলেটার মনে প্রেম এসেছে; মুরুব্বিরাও মনে করেন। তারা বিষয়টাকে ভালোভাবে নেন না, অথচ বাসাতেও জানাননি। কেবল মসজিদে যাওয়া-আসার সময় দেখলে মনে মনে একটু ছি করেন আরকি। বাঙালি সমাজবদ্ধ জীবনের চিরায়িত রূপ এটাই।

রাত ৯টার বেশি হবে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মগ্ন অনিল। আড্ডার বিষয়, ফেসবুক স্ট্যাটাস। অনিল মধ্যরাতে না ঘুমিয়ে লেখেছিল, ‘কতকাল হয় না দেখা, আর কত থাকবো একা’! এটার মানে কী, তার ব্যাখ্যা শুনছিল বন্ধুরা। এমন সময় একটা ফোন এলো। বন্ধুরা ভাবলো ওই বারান্দার সামনে দাঁড়ানোর কেরামত বুঝি! আসলে না। ফোনটা পরিবারের। মায়ের ফোন। অনিলের একটা সুন্দর পরিবার আছে- মা বাবা ও খুব ছোট বোন। খুব ছোট বলতে মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ওপাশ থেকে মা বললেন, খোকা দ্রুত চলে আয় আজ, তোর বাবা খেয়ে নিয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে। কদিনের জ্বরে শরীরটা ভেঙে গেছে তার। অনিল উদাসের মতো বললো, আসছি। ফোনটা রেখে আরও বহু সময় আড্ডায় মাতলো। কে শোনে কার কথা! কোনো পাত্তাই পেলো না রাত ৯টা ২০ মিনিটে মায়ের ফোন। বাসায় যখন অনিল, তখন ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বেজে ৬ মিনিট। মা- বাবার মাথায় হাত রাখতে রাখতে কবেই শুয়ে পড়েছেন কে জানে। ছোট বোন অত্রি এসে দরজাটা খুললো। উহু, দাদা তুমি আবার স্মোকিং করেছো, এটা কি মানুষ করে, ছোট্ট মেয়েটা খুব বিরক্তি নিয়ে বললো। শাসন শাসন ভাব আছে ওর মধ্যে। অনিল কিছু না বলেই দে-ছুট।

পরেরদিন বিকেলেও অনিলের কাছে ফোন এলো বাসা থেকে। চারিদিকে বড় বড় দালান হয়ে যাচ্ছে। সূর্যের দেখা পাওয়া ভার। তবে এখনও কিছু জায়গা খালি আছে। সেখানে একটা ছোট পুকুরও আছে, সেই পুকুরের সামনের দেয়ালে বসে বসে সিগারেট ফুঁকছিল পাড়ার উত্তম কুমার। সিগারেট নিয়ে উদাস অবস্থা, টের পেতে পেতে বন্ধ রিংটোন। কল ব্যাক করায়, পাশ থেকে বাবা বলেলন, হাসান ভাইয়ের ফার্মেসি থেকে কিছু ওষুধ নিয়ে আয় তো। আমি এসএমএস করেছি। দেখ বানান ভুল হতে পারে ওনার কাছ থেকে নেয়ার সময় শিওর হয়ে নিস। প্রশ্ন করবি, জ্বর, সর্দি, ঠাণ্ডার ওষুধ কিনা এগুলো। আমি স্বাস্থ্য সেবার হটলাইন থেকে নিয়েছি নামগুলো। ফার্মেসিতে হাসান সাহেবকে টাকা দিতে হলো না, ওষুধগুলো অনিল নিয়ে পৌঁছে দিলো বাসায়। বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবে, শরীর কেমন এখন তার আর সুযোগ হয়নি। কাশি দিতে দিতে প্রচণ্ড বুকে ব্যথা হওয়ায় ক্লান্ত বাবা শুয়ে পড়েছে সন্ধ্যায় অসময়ে। বিষয়গুলো একটু একটু ভাবালো অনিলকে। অথচ পরিবার নিয়ে চিন্তা তার কখনই ছিল না। কিন্তু সে কী করবে এখন, কী-ই বা করণীয় কিছুই যে জানা নেই।

অনিল ইদানীং খুব ফেসবুকে কবিতার লাইন লেখে স্ট্যাটাস দেয় এটা তার বন্ধু তালিকায় সবাই দেখে। যার অধিকাংশই প্রেম প্রেম। আজও তার স্ট্যাটাস প্রেম ও বিরহ মিলিয়ে। মন ভালো না থাকলে যা হয় আরকি। এভাবে আরও একদিন চলে গেলো। মা জানালেন, বাবার শ্বাস কষ্টের কথা। চারিদিকে এমন হচ্ছে। তাই মায়ের কণ্ঠে কান্নার সুর। সেই করুণ কথা শুনে অনিলকে এবার বলতে হলো না, দৌড়ে চলে গেলো হাসান আঙ্কেলের ফার্মেসিতে। পরামর্শ, একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় নিতে পারলে খুব ভালো হয়। হাসপাতালে নেয়া গেলে আরও ভালো, কিন্তু সেখানে বেড পাওয়া যাবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই!

অনিলের ছোটাছুটি শুরু। কোথায় যে অক্সিজেন পাওয়া যায় আগামাথা জানা নেই। এর মধ্যে একবার মায়ের ফোন এলো, মাকে অনিল জানালো, তোমরা চিন্তা করো না, আমি অক্সিজেন নিয়ে আসছি, হাসান আঙ্কেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, অক্সিজেন দিলেই নাকি বাবা ঠিক হয়ে যাবেন, কমে আসবে বুকে ব্যথা, শ্বাস নেয়া স্বাভাবিক হবে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় খুব একটা বেশি টাকা সঙ্গে আনেনি অনিল। তাই পকেটে যা আছে তাই দিয়ে কাজ চালাতে হবে। সবখানে বেশি বেশি টাকা চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পরক্ষণে অনিল ভাবে, পকেটে পয়সা কম থাকলে বুঝি সব কিছুরই ব্যয় উচ্চ মনে হয়!

বহু কষ্টে একটা সিলিন্ডার পাওয়া গেলো। হাফ ছেড়ে বাঁচার মতো পরিবেশ। সিএনজিতে করে রওয়ানা হতেই রাস্তায় ঢের যানজটে নাকাল অবস্থা। ক্লান্ত অনিল, দুপুরে খাওয়াও হয়নি। কী যে দৌড়ঝাঁপ। এমন কষ্ট আর আগে কখনো হয়নি, বাসায় গিয়ে তা মাকে বলবে বলে অনিল ঠিক করে। এবার সুস্থ হলে বাবাকে একটা আইফোন কিনে দিতেই হবে। আবদারের জায়গাটা আরও পোক্ত হলো বটে। এটা ভাবতে ভাবতেই অনিলের অ্যান্ড্রয়েডে কল। অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময়ের সেই কলে, অত্রির কণ্ঠ, বাবা আর নেই…।

One thought on “ছোটগল্প।। অক্সিজেন।। সৈয়দ ইফতেখার

  • জুন ৪, ২০২১ at ১০:৩৮ অপরাহ্ণ
    Permalink

    So sad story.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *